নীলিমায় কালো মেঘ পর্ব-৯

0
566

নীলিমায় কালো মেঘ
পর্ব-৯

“তোর বউ কি আর এমনি এমনি এত বড় পদে প্রমোশন পেয়েছে ? খোঁজখবর করে দেখ নিশ্চিত ওই ডিরেক্টর ব্যাটার তোর বউকে নিয়ে বদ মতলব আছে। ভাবি কোনো ট্রাপে পড়ার আগে ওখান থেকে সরিয়ে আন।”— বারবার মিজানের বলা কথাগুলি মাথায় ঘুরছে আবিরের। সত্যিই কি এমন কিছু ঘটছে ?
মিজান আবিরের পুরানো বন্ধু । মিজানের ইলেকট্রনিকস মালপত্রের দোকান আছে। আবির সুযোগ পেলেই মিজানের কাছে যেয়ে বসে। দু বন্ধু নানান ধরণের সুখ দুঃখের গল্পগুজব করে। নিজেকে হালকা করতে মিজানের কাছে ভাবনার প্রমোশনের কথা বলতেই মিজান এ কথা বলে উঠলো। মিজানকে তখন মুখের উপর ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেও তার মনের মধ্যে সেই থেকে খচখচ করছে। আসলেই তো রায়হান সাহেবের সাথে ভাবনার কোনো , নাহ! কিছুই ভাবতে পারছেনা আবির। ভাবনাকে সে পাগলের মত ভালোবাসে। আর ভাবনাও তাকে। ভাবনার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। ভাবনা এমনটা যে কোনোদিনও করবেনা এটা সে জানে কিন্তু এই রায়হান সাহেবের কি ভরসা? খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে আবিরের। কিন্তু এসব কথা ভাবনার কাছে সে বলবে কী করে ? ভাবনা ব্যাপারটা যদি অন্যভাবে নেয়! সত্যিই ভাবনা যদি এমন কিছু করে তবে সে মরে যাবে। ভাবনাকে ছাড়া নিজেকে চিন্তাও করতে পারেনা আবির।

প্রায় দু’মাস কেটে গেছে। ভাবনার জন্য চিন্তা কিছুতেই কাটছেনা আবিরের। ভাবনার অফিসের সবাইকে নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে ।পুরো পরিবারের দাওয়াত। আবির ইচ্ছে করেই অফিসের দোহাই দিয়ে ভাবনার সাথে গেলোনা। ভাবনা খুব মন খারাপ করে শুধু তার মেয়েকে নিয়েই গেলো। আবির এতটা হীনমন্যতায় ভুগছে যে ভাবনার সাথে তার অফিসে যেতেও খুব বিবেকে বাধা দিচ্ছে। ভাবনার পাশে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগে । ভাবনার অফিসের সবাই যাতে তাকে নিয়ে হাসাহাসি না করে তাই ইচ্ছে করেই ভাবনার সাথে গেলোনা আবির।

অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ভাবনা রায়হান সাহেবের কেবিনে প্রবেশ করল। ঢুকতেই দেখলো রায়হান সাহেবের মুড অফ।
– স্যার ,আমি কি ভুল সময়ে চলে এলাম ?
– নো , ইটস ওকে। বসুন । এনি এমার্জেন্সী?
– স্যার , একজন ক্লায়েন্টের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।
– হ্যা বলুন।
ভাবনা কথা শুরু করতে যাবে ঠিক তখন রায়হান সাহেবের ফোনটা বেজে উঠল।
– এক্সকিউজ মি!
– শিওর স্যার!
– হ্যা, আশা বল! আরে ভাই আমি সিরিয়াল না পেলে কি করবো বল! বললাম অন্য ডাক্তার দেখাও। দেশে কি নিওরোসার্জনের অভাব নাকি! উনাকে দেখাতে হলে এক সপ্তাহ আগে থেকে সিরিয়াল দিতে হয় সে তো তুমি জানোই । এমন করে হুট করে বললেই কি সিরিয়াল পাওয়া যায়? আমি কয়েক জায়গায় কন্ট্যাক্ট করেছি কিন্তু হচ্ছেনা। এখন কি করি বল! সকাল থেকে এ নিয়ে মুড খুব খারাপ ।আর তার উপর তুমি এভাবে প্রেসার ক্রিয়েট করলে কি করে হবে ? আব্বাকে বল কিছুদিন এখানে থাকতে। এর মধ্যে আমি ব্যবস্থা করতে পারব। এই সুযোগে নাতীদের সাথে ক’টা দিন বেড়ানো হবে। আচ্ছা রাখছি। দেখি কি করা যায়! কোনো ব্যবস্থা হলে আমি তোমাকে ফোন দিবো ।
কথা শেষ করে রায়হান সাহেব বললেন, এক্সট্রিমলি সরি! আপনাকে বসিয়ে রেখেছি। এবার বলুন

– ইটস ওকে স্যার! নো প্রবলেম। কার সিরিয়াল পাচ্ছেন না?
– আর বলবেন না। আমার শশুরের জন্য। উনার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছিলো বেশ কয়েকবছর আগে। সেই থেকেই ক্ষ্যাপা মেজাজের মানুষ। আগে স্থানীয় একটা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। এমনিতেই কড়া মেজাজের মানুষ আর এখন তো পুরাই সোনায় সোহাগা। আমার বাসায় এলে উনার ভয়ে আমার বাসার কাজের মানুষ থেকে শুরু করে সবাইই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকি। কখন না কাকে কোন বেফাঁস কথা বলে ফেলে। এখানে আসলে সর্বোচ্চ দু’দিনের বেশি থাকেন না। উনি রেগুলার যে ডাক্তারের ফলো আপে থাকেন প্রতিবার দেখানো শেষ করে পরের বারের সিরিয়াল দিয়ে যান। কিন্তু এবার সমস্যা ফিল করায় আগেভাগেই চলে এসেছেন। এসেই ডাক্তারের সিরিয়ালের জন্য মেয়ের সাথে ভাঙচুর শুরু করার মত অবস্থা করেছে। তাছাড়া আমার মিসেসকেও এবার একটু উনাকে দেখাতে হবে । আমার সেকেন্ড বেবিটা হওয়ার পর থেকে ও নানান ধরণের সমস্যা ফিল করছে। মাইগ্রেনের সমস্যা মনে করে মেডিসিন খাচ্ছে কিন্তু তেমন ইম্প্রুভ হচ্ছেনা। তাই ভাবছে উনাকেই দেখাবে। একসাথে কাজ হয়ে যাবে। তাছাড়া উনি খুব ভালো ডাক্তার। আমার শশুরের তো এমন অবস্থা হয়েছিলো উনি বাঁচবে বলেই কেউ আশা করিনি। চিটাগং থেকে একদম মরার মতই নিয়ে এসেছিলাম । উনার ট্রিট্মেন্টে আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত আছে আমাদের মাঝে। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে উনার সিরিয়াল পাচ্ছিনা। বারবার ফোন দিয়েও লাইন বিজি পাচ্ছি। আর ডাক্তারের নাম্বার তো পাচ্ছিইনা। এদিকে আমার শশুর তো বোঝার পাত্র না। সে এই ডাক্তারই দেখাবে। তা কীভাবে কী হবে সে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বললাম অন্য ডাক্তার দেখাই আপাতত। সপ্তাহ খানেক পরেই উনাকে দেখাবেন না হয় আরেকবার। কিন্তু নাহ! সে নাছোরবান্দা!
– মুরুব্বীরা এমনই। বাচ্চাদের মত জিদ ধরে। এখানে উনাদের কোনো দোষ নেই। বয়সটাই এমন! তাছাড়া উনি হয়তো ওই ডাক্তারকে ভরসা পায় তাই অন্য কাউকে দেখাতে সাহস পাচ্ছেন না।
– সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু এখানে আমার কি করার আছে বলুন! আমি আমার মত করে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সিরিয়ালই দিতে পারছিনা । উনি আজ বা কালের মধ্যেই দেখাতে চাচ্ছেন।
– স্যার ,কিছু মনে না করলে কোন ডাক্তারকে দেখাচ্ছেন জানতে পারি কি?
– অবশ্যই! আপনি নাম শুনে থাকবেন উনার । নিওরোসায়েন্স হসপিটালের ডাক্তার উনি, ডঃ আতাউর রহমান। আমরা অবশ্য উনার এলিফ্যান্ট রোডের চেম্বারে দেখাই। হসপিটালে তো উনাকে সেভাবে পাওয়াই যায়না। এত বড় সার্জন। ব্যস্ত থাকেন খুব।
– ভাবনা মৃদু হেসে বলল, এখন চারটা বাজে তাইতো! উনি এখন মে বি বাসায় আছেন ।
– স্ট্রেঞ্জ! আপনি কী করে জানেন?
– দেখছি স্যার!

ভাবনা ফোন বের করে তার বড় বোনকে ফোন দিল। কয়েকবার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে উত্তর এলো।

– হ্যা ভাবনা বল!
– আপি, দুলাভাই কই এখন?
– এই তো বাসাতেই আছে এখনো । একটু পরেই বের হবে ।কেনো রে?
– একটু দুলাভাইর কাছে দে তো! কথা আছে।
– আচ্ছা, দাঁড়া !দিচ্ছি।

প্রায় মিনিটখানেক বাদে ওপাশ থেকে ভাবনার দুলাভাই রেস্পন্স করলো।

– হ্যা ছোট গিন্নি, বল! এই অবেলায় দুলাভাইকে মনে পড়লো কেনো! আজকাল তো তুমি মহাব্যস্ত ! এতবড় কোম্পানীর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। আমাদের সাথে কথা বলার সময় কই!
– কি যে বলেন না , দুলাভাই! একটা হেল্প লাগবে এজন্য ফোন দিয়েছি। না করতে পারবেন না ,কিন্তু।
– কি হেল্প বল! তুমি হেল্প চাইলে না করতে পারি! সাধ্যের মধ্যে চেও কিন্তু। আবার লজ্জায় ফেলে দিওনা ।
– সাধ্যের বাইরে নয় অবশ্যই। আপনি চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন।
– ঠিক আছে ,বল তবে।
– আমাদের ডিরেক্টর স্যারের শশুর আপনার পেশেন্ট। উনি চিটাগং থেকে আসেন। বহুদিন ধরে আপনাকে দেখাচ্ছেন। উনার সিরিয়াল আরো পনেরো দিন পরে দেওয়া। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবার ঢাকাতে এসেছেন আপনাকে দেখাতে। কিন্তু সমস্যা আপনার সিরিয়াল পাচ্ছেনা। স্যারের ওয়াইফকেও নাকি দেখাবে। এখন কেমনে আজ দেখাবে সেই ব্যবস্থা করে দেন, প্লিজ।
– কিন্তু গিন্নী , রুলস ব্রেক করি কীভাবে? রোগী যে কজন দেখি তা তো ফিল আপ।
– সে আমি জানিনা। উনি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখবেনা। আজ না হয় দু জন বেশি দেখলেন। আপনি আপনার সেক্রেটারি টিপু ভাইকে ফোন দিয়ে বলেন আজ আর দুইজনের নাম লিস্টে আনতে । আপনি অনুমতি দিলে আমি টিপু ভাইকে উনাদের নাম লিস্ট করতে বলছি।
– উমমম! আচ্ছা, বলে দাও । আমি টিপুকে বলে দিচ্ছি। তুমি উনাদের নাম রেজিস্টার করে দাও। আজ নির্ঘাত তোমার আপির হাতে মার খেতে হবে। এমনিতেই প্রতিরাতে দেরী করে আসার জন্য তোমার আপা আর ভাগ্নে দুইজনের কাছে বকাঝকা খেতে খেতে জীবন তেজপাতা। আরো দেরী করে ফিরবো জানলে কি হবে বুঝতে পারছো!
– হাহাহা! আমি আপিকে বলে দিবো । আপনি টেনশনমুক্ত হয়ে রোগী দেখেন আজ। তবে অন্যদিন অবশ্যই করতে পারবোনা কিন্তু। তাই বাসায় একটু তাড়াতাড়িই ফিরবেন আশা করছি। এত টাকা পয়সা দিয়ে কী হবে বলেন। অনেক হয়েছে এবার একটু রাইয়ান ,রিদওয়ানের সাথে সময় কাটান । ওরা অনেক মিস করে আপনাকে।
– হুম! বুঝতে পেরেছি সব এক পাল্লার লোক।
– হাহাহা। রাখছি তবে দুলাভাই। অনেক ধন্যবাদ। দেখা হবে তাড়াতাড়ি। আল্লাহ হাফেজ।
ভাবনা ফোন রেখে বলল, স্যার ব্যবস্থা হয়ে গেছে । আপনি আংকেলের আর ম্যাডামের নাম আর ফোন নাম্বারটা লিখে দেন আমি এখনি সিরিয়াল দিয়ে দিচ্ছি ।

– উনি আপনার কি হন? কিছুটা অবাক হয়ে বললেন রায়হান সাহেব।
– আমার বড় দুলাভাই।
– আপন দুলাভাই?
– জী স্যার! আমরা তিন বোন । আমি সবার ছোট ।
– মাই গড! সমাধান এত কাছে আর আমি হা হুতোশ করে মরছি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। কি বাঁচা যে বাঁচালেন ! আমার শশুর আমাকে পাগল করে ফেলছে একদম। আমি তো খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম এই নিয়ে। আজকে বাসায় যাবো কি করে সে চিন্তায় অস্থির ছিলাম। উনাকে আমি খুব ভয় পাই। যাই হোক বেঁচে গেলাম। আপনাকে ধন্যবাদ দিলেও আপনার উপকারের প্রতিদান দেওয়া শেষ হবেনা। আমি এখনি আমার ওয়াইফকে জানাচ্ছি । আপনি এই নাম রেজিস্ট্রি করে দেন।
– এ আর এমন কি স্যার! এভাবে লজ্জা দিবেন না , প্লিজ! আপনার উপকারে আসতে পেরেছি এটা সত্যিই আমার ভাগ্য।
– থ্যাংক ইউ সো মাচ।

আগামীকাল আবিরের জন্মদিন। ভাবনা মনে মনে ভেবে রেখেছে আজ অফিস ছুটি হলে আবিরসহ ঘরের সবাইকে নিয়ে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে ডিনার করবে। আগে কোনোকিছু জানালো না সে আবিরকে । পরেরদিন খুব তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে সে তার শাশুড়ি, কুহেলী আর জারাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো। আবিরকে ফোন দিয়ে জানালো সেখানে আসতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবির পৌঁছে গেলো। ভাবনা তাকে আগে কিছুই জানায়নি। আবির এতবড় রেস্টুরেন্টে সবাইকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায়। ভাবনা আগেই টেবিল বুকিং দিয়ে রেখেছিলো। ভাবনা খেয়াল করলো আবির এত আয়োজন দেখে সারপ্রাইজ হবার পরিবর্তে কেন যেন খুব বিরক্ত বোধ করছে। আবির পৌঁছাতেই তাদের টেবিলে বেশ সুন্দর একটা কেক এসে পৌঁছালো। আবিরের সব কিছুতেই কেমন বিরক্তি! মুখে প্রকাশ না করলেও ভাবনা ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারছে। কোনোরকম করে খাবার দাবার শেষ করে তারা বাসায় আসলো।
আবির তেমন বেশি কথাবার্তা বলছেনা ভাবনার সাথে। রাতে ঘুমানোর আগে আগে ভাবনা আলমারী থেকে একটা শপিংব্যাগ বের করে আবিরের হাতে দিলো।

– কি আছে এর ভেতরে?
– খুলেই দেখোনা!
– তুমিই খুল।
– আশাহত মনে ভাবনা খুলে বলল, একটা শার্ট আর একটা টাই। পরে দেখনা সব ঠিক আছে কিনা! কালার পছন্দ হয়েছে তোমার?
– খুব ঘুম আসছে ভাবনা। সারাদিন তোমার মত এসি কেবিনে বসে কাটানোর সৌভাগ্য কই আমার। কাস্টমার হ্যান্ডেল করতেই সময় চলে যায় । তার উপর আজ এত দেরী হলো বাসায় ফিরতে। এখন এসব ভালো লাগছেনা। প্লিজ!
– এভাবে কেনো বলছো? তোমার জন্য একটা গিফট এনেছিলাম। দেখতো ঠিকঠাক আছে কিনা!
– রেস্টুরেন্টে এত টাকা খরচ করলে আবার গিফট কেনো? নাকি ক’দিন আগে তোমার বার্থডে তে আমি কিছুই করতে পারিনি সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছো?
– আবির! এসব কি বলছো? আমি সেই রেস্টুরেন্টে বসেই খেয়াল করেছি তুমি খুব বিরক্তিভাব দেখাচ্ছো। আমি কি এমন করেছি? আমি কি তোমার বার্থডে একটু স্পেশাল করে সেলিব্রেট করতে পারিনা।
– হ্যা পারো। তবে আমাদের স্ট্যাটাসের সাথে মিল রেখে। এতগুলি টাকা খরচ করে অমন রেস্টুরেন্টে যাবার দরকার কি ছিলো? তার উপর আবার এত দামী পোশাক আর টাই এনেছো।
– টাকাটা তো আমিই দিয়েছি তাইনা! তবে তোমার সমস্যা কোথায়?
– ইয়েস! এটাই আমার সমস্যা। তুমি যে এভাবে কথায় কথায় টাকার গরম দেখাও এগুলি আমার পছন্দ না। এই যে দামী শার্ট আর টাই নিয়ে এসেছো এটা পরে যাবার মত জায়গা আমার নেই। এগুলি না হলেও চলতো। এই দামে আমি তিনটা শার্ট কিনতে পারতাম অনায়সে।
– আবির! আমার মন চেয়েছে তাই কিনেছি। আমি কি আমার পছন্দের কিছু তোমাকে গিফট করতে পারিনা?
– হ্যা পারো! তবে আমাদের সামর্থ্যের বাইরে না অবশ্যই। আজকাল তোমার খরুচে হাত যেভাবে চলছে এজন্য সাবধান করলাম।
– আমি তো লোন করে কিছুই কিনিনি। তাহলে অন্যায় কোথায়?
– অন্যায় তোমার না। অন্যায় আমার। আমি এখন ঘুমাবো ,প্লিজ! আমি খুব টায়ার্ড । বলতে বলতেই শার্টের প্যাকেট টা ছুড়ে ফেলার মত করেই চেয়ারের উপর রেখে সে মশারীর মধ্যে ঢুকে গেলো।
আবিরের এমন আচরণ দেখে ভাবনার দু’চোখ বেয়ে ফোয়ারা নামলো । আবির এমন কেনো হয়ে যাচ্ছে দিনদিন? ভাবনার চোখের কোনা বেয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরে পড়ার আগেই খুব গোপনে ওড়নার আঁচলে মুছে নিলো। সুযোগ পেলেই আবির তাকে নানান ভাবে খোঁচা মারা কথা বলে। ভাবনা সব হজম করে নীরবে। ভাবনার শাশুড়িও একইভাবে ছেলের মত কথাবার্তা বলে।

সেদিন খাবার টেবিলে জারা ইলিশ মাছ খাবার খুব আবদার করছে। ইলিশ ওর খুব পছন্দ। বিশেষ করে ইলিশের ডিম হলে জারার আর কিছুই লাগেনা। মাস পেরিয়ে গেছে ঘরে ইলিশ আনা হচ্ছেনা। এখন ইলিশের সিজন না তাই আশেপাশে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছেনা তাছাড়া দামও বেশ চড়া। বাজারের দায়িত্ব আবিরের উপর। ভাবনার কখনো এদিকটা দেখতে হয়না। মেয়ের আবদারের ব্যাপারটা মাথায় রেখে অফিস থেকে ফেরার পথে সুপারশপে ঢুকলো।
ইলিশের দাম সত্যিই খুব চড়া। একটু ডিম আছে এমন ধরণের মাছের হালি চার হাজারের উপর। এক হালিই আছে। ভাবনা পার্স চেক করে দেখলো হাজার পাঁচেক এর মত টাকা আছে। সে চারটা মাছই নিল। তাছাড়া ইলিশ মাছ জারার মত আবির আর তার শাশুড়িরও খুব পছন্দ। তাই ইচ্ছে করেই এক হালি মাছ কিনলো।
বাসায় ফিরে দেখলো আবির রান্নাঘরে ঘুটুরঘাটুর করছে। ভাবনা সরাসরি রান্নাঘরে চলে গেলো মাছ রাখার জন্য। সিংকের উপর ব্যাগটা রেখে আবিরকে বলল, কী ব্যাপার তুমি এখানে কি করছো? আমেনা খালা কোথায়?
– উনার ছেলে অসুস্থ। তাই রাতে আসবেনা। ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।
– আচ্ছা সরো তবে। আমিই দেখছি।
– তুমি চেঞ্জ করে আসো।
– হুম। আসছি তবে।
ভাবনা রান্নাঘরে ঢুকে দেখল আবির মাছগুলি নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে।
– কেমন কিনলাম? ঠকিনি তো!
– ভালোই। তবে এগুলি ছয়শো টাকা পিসের বেশি হবার কথা নাহ! এত দামে কেনো নিয়েছো?
– জারা আবদার করলো তাই নিয়ে এলাম।
– তাই বলে এতগুলি? এই টাকাতে তো বলা যায় সারা মাসের মাছ বাজার হয়ে যায় আমাদের। তাছাড়া জারা মাছ খেতে চেয়েছে আমিও শুনেছি। আমি কি পারতামনা আমার মেয়ের জন্য মাছ আনতে? আমি শুক্রবারে নিয়ে আসতাম। এখানে মহল্লার বাজারে এখন ইলিশ বেচেনা। ছুটির দিন ছাড়া তাই সম্ভব না মাছ কেনা।
– জারা কি আমার মেয়েনা? আমি কি মাছ এনে অন্যায় করেছি?
– অন্যায়ের কথা কেনো ? এত দাম দিয়ে সুপারশপ দিয়ে কেনার কী দরকার? ওরা দরকারের থেকে সবসময় বেশি দাম নেয় ।
– সমস্যা হয়নি তো! আমি ম্যানেজ করেছি। আমার পার্সে টাকা ছিল তাই নিয়ে এলাম।
– হুম, ম্যানেজ তুমি করেছো সেকথা তো জানি। তোমার পার্সে আজকাল চকচকে নোট থাকে যখন খুশি সবই করতে পারো । ঠিক আছে আমি গেলাম। তখনই তিনটে মাছ ফ্রিজে রেখে সে একটা মাছ কেটেকুটে রান্না করলো। জারা মাছের ডিম পেয়ে সে কি খুশি! আবিরের প্লেটে এক টুকরো মাছ তুলে দিতে যেতেই আবির প্লেট সরিয়ে নিলো। ভাবনার খুব খারাপ লাগছে আবিরের এমন আচরণে। সে নিজেও অভিমানে তার প্লেটের টুকরো বাটিতে তুলে রাখলো।

ভাবনা আবিরের কথার আর এমন আচরণের অর্থ ঠিকই বুঝেছে। আবির ঘরের বাজার সদাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছে আর ভাবনা বাসা ভাড়া দেয়। মাঝেমাঝে ভাবনা টুকটাক বাজার সদাই করলে আবিরের কেন যেন খুব লাগে। ভাবনা ব্যাপারটা বুঝতে পারে কিন্তু না বোঝার ভাণ করে এড়িয়ে যায়। আবির সবকিছু খুব মেপেমেপে কিনে। হাত খুলে খরচ করা সম্ভব নয়। তার উপর কাজের বুয়ার রান্নাবান্না। ভাবনা নিজে থেকে এটা সেটা নিয়ে আসে। এটা আবিরের মায়ের চোখে পড়লে ছেলের কানে পৌঁছে দেন সময়মতই। এটা নিয়ে আবির শুরু হয়ে যায় ভাবনার সাথে।
আবিরকে ছোট দেখাতে নাকি ভাবনা এসব করে। ভাবনা কোনোভাবেই আবিরের এমন আচরণকে শোধরাতে পারছেনা আবার মেনে নিতেও পারছেনা। মনে মনে শুধু ছটপট করছে সে।

আজ অফিসে ঢুকতেই পিয়ন এসে জানালো রায়হান সাহেব তাকে কেবিনে ডেকেছে। ভাবনার খুব ভয় হলো এত সকালে তো কোনোদিন ডাকেনা। আজ কেনো? কোনো ভুল করে বসেনি তো সে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here