#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১১|
কুসুমের বয়স এখন ১৮ বছর। দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা চলছে তার। গায়ে গতরে পরিপূর্ন রমণীকে দেখলে যে কারো চোখ ঝলমলিয়ে উঠবে। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সামনাসামনি কথা না হোক! ফোনকলে কথা বলেই দুজনের সম্পর্ক আগের চেয়ে বেশ সহজ হয়ে এসেছে। উচ্ছ্বাসের এ মাসের শেষের দিকে দেশে আসার কথা ছিল।
উচ্ছ্বাসের দেশে আসা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে দারুন আমেজ দেখা যাচ্ছে। কুসুমের পরীক্ষা শেষ হলেই ধুমধাম করে বিয়ের কথা পাকা করা হবে। কুদুমের বাসায় সর্বদা উচ্ছ্বাসের জয়গান চলে। ছেলেটা বিদেশে গিয়ে কত কষ্ট করে ভবিষ্যৎ গড়ছে, পরিশ্রমী ছেলে, তার কোনো তুলনা হয় না শুনতে শুনতে কুসুমের জীবন প্রায় অতিষ্ট! কুসুম বসার ঘরের সোফার টেবিলে বসে অঙ্ক কষছিল। টেবিলের উপর এক গ্লাস কোক রাখা। কোকের গ্লাসে পরপর চুমুক দিচ্ছে এবং অঙ্ক করছে। একটু পর ইব্রাহিম এসে বসে কুসুমের পাশের সোফায়। রিমোট হাতে নিয়ে টিভিটা চালু করে খেলা দেখতে বসে। খেলার শব্দে কুসুম বিরক্ত হয়। বই বন্ধ করে ভাইকে বলে,
‘ টিভির আওয়াজ কমাও, ভাই। পড়ছি আমি। ‘
ইব্রাহিম আড়চোখে কুসুমের দিকে তাকায়। পরপরই মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,
‘ পড়াশোনা করে কি দুনিয়া উদ্ধার করে দিয়েছিস? যা, নিজের ঘরে গিয়ে পড়। ‘
কুসুম ভাইয়ের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকায়। রেগে কপাল ফাটছে তার। কুসুমের মা সাহেদা পাশে বসে জামা সেলাই করছেন। কুসুম মায়ের দিকে চেয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘ মা, তুমি কিছু বলবে ভাইকে? খামোকা আমার সঙ্গে ঝগড়া করছে। টিভির সাউন্ড একটু কমালে কি হয়? টিভির সামনেই তো বসে আছে। ‘
সাহেদা ছেলেকে চোখ রাঙায়। মৃদু শাসন করার উদ্দেশ্যে বলেন,
‘ কুসুম পড়ছে না? সাউন্ড কমাও। ‘
ইব্রাহিম সাউন্ড একটু কমিয়ে মাথা চুলকে খেলা দেখায় মনোযোগ দেয়। হঠাৎ সাহেদা প্রশ্ন করেন,
‘ উচ্ছ্বাস কবে আসছে কিছু জানিস, ইব্রাহিম? ‘
ইব্রাহিম খেলা দেখায় মনযোগ দিয়ে উত্তর দেয়,
‘ এ মাসের শেষে। ২৬ অথবা ২৭ তারিখের দিকে। ওর থিসিস শেষ করতে যতদিন লাগে আরকি। ‘
সাহেদা আশ্বস্ত হোন। কুসুমের দিকে চেয়ে বলেন,
‘ কুসুম তোর পরীক্ষা যেন কবে শেষ? ‘
কুসুম উত্তর দেয়, ‘ ১৮ তারিখ। ‘
সাহেদা শান্তির নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘ যাক, উচ্ছ্বাস আসার আগেই তোর পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। ছেলেটা এতদিন পর আসছে। তোর পরীক্ষা থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যায়। ‘
মায়ের কথা শুনে কুসুমের ভীষন অদ্ভুত লাগছে। সবাই শুধু উচ্ছ্বাস ভাইয়ের কথা ওর সামনে বলে কেন? কুসুমের কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয় এসব শুনলে। কুসুম আর থাকে না বসার ঘরে। বই খাতা নিয়ে উঠে পরে টেবিল থেকে। হনহন করে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে পেছন থেকে সাহেদা ডেকে উঠেন,
‘ কই যাস? ‘
কুসুম যেতে যেতে উত্তর দেয়, ‘ নিজের ঘরে পড়তে যাচ্ছি। ভাইয়ের টিভির শব্দে আমার কান জ্বলছে। ‘
__________________________
কুসুমের পরীক্ষার আজ শেষ দিন ছিল। পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বেরুতেই পেছন থেকে সেঁজুতি ডেকে উঠে। কুসুম ব্যাগ কাধে নিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। সেঁজুতি দৌঁড়ে আসে কুসুমের দিকে। কুসুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। কুসুম মৃদু হেসে বলে,
‘ এক্সাম কেমন হলো তোর? ‘
সেঁজুতি বলল, ‘ ছয় মার্ক ছেড়ে এসেছি। ‘
কুসুম চেঁচায়, ‘ ছয় মার্ক? ‘
সেঁজুতি হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভান করে বলে,
‘ এমন অবাক হচ্ছিস কেন? মাত্র ছয় মার্ক ছেড়ে এসেছি। পুরো খাতা নয়! ‘
কুসুম শান্ত হয়। পরীক্ষায় প্রশ্ন ছেড়ে আসা সেঁজুতির নিত্যদিনের ব্যাপার। এ নতুন নয়! কুসুম হাটা শুরু করে। সেঁজুতি পাশে হাঁটছে। সেঁজুতি একসময় প্রশ্ন করে,
‘ তোর জামাই কবে আসছে রে? ‘
কুসুম থতমত খেয়ে যায় এমন প্রশ্নে। নিজের লজ্জার দামামা সামলে উত্তর দেয়, ‘ ২৬ তারিখ। ‘
‘ এ মাসের? ‘
‘ হু! ‘
সেঁজুতি কুসুমের পিঠে মৃদু হাতে থাপ্পড় দিয়ে বলে,
‘ তাহলে তো ইদ লেগে গেল তোমার কুমকুম। ‘
কুসুম চোখ রাঙিয়ে তাকায়, ‘ কোনো ইদ ফিদ না বুঝলি। সোজা হাট। ‘
সেঁজুতি হাসে। কুসুম সেঁজুতির হাসি দেখে লজ্জায় কেমন ঝিম ধীরে যায়। ইশ! বিয়ে না করেই এরা যা লজ্জা দিচ্ছে কুসুমকে। বিয়ে করলে কুসুমকে এরা বোধহয় লজ্জা দিয়ে মেরেই ফেলবে।
__________________________
কুসুম বাড়ি এসে দেখে সবার মন খারাপ। ইব্রাহিম ভাইয়া কুসুমের মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যাচ্ছেন। মা কি কথা বলবেন বলবেন করেই দ্বিধা নিয়ে বলতে পারছেন না। কুসুম ভাবল একবার জিজ্ঞেস করবে তাদের। উষা আপা কুসুমের ঘরে আসলে কুসুম পেটের কথা পেটে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করেই বসে,
‘ আপা, কিছু কি হয়েছে? বাড়ির সবার এত মন খারাপ কেন? ‘
উষা কুসুমের পাশে এসে বসে। কুসুম সবে গোসল করে বেরিয়েছে। চুলে টাওয়াল পেঁচানো। উষা কুসুমের চুলের টাওয়াল খুলে তার চুল মুছে দিতে থাকে। বলে,
‘ আমি কারণ বললে তুই আবার রাগ করবি না তো? ‘
কুসুম চিন্তিত হয়। আস্তে করে বলে, ‘ না করব না। এবার বলো তো কি হয়েছে। এত ঘুরাচ্ছ কেন কথা? ‘
‘ উচ্ছ্বাস এ মাসে আসছে না। ডিসেম্বরে আসবে। মানে আরো ৭ মাস পর। ‘
কুসুম তাজ্জব বনে যায়। উচ্ছ্বাস ভাইয়ের সঙ্গে কালকেও কথা হয়েছে। কুসুমকে সে বলেছে, ২৬ তারিখ আসবে। এরইমধ্যে এই কথা পাল্টে গেল কিভাবে? কুসুম অবিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘ তুমি মিথ্যা বলছ, তাইনা আপা? ‘
উষা কুসুমের চুল আঁচড়ে দিয়ে বলে,
‘ আমি মিথ্যা বলছি না। একটু আগে উচ্ছ্বাস ইব্রাহিম ভাইকে ফোন করে বলেছে এটা। ওর থিসিস কমপ্লিট হয়নি। রিজেক্ট করে দিয়েছে। সেটা কমপ্লিট করতে আসতে আসতে আরও ছয় মাস লেগে যাবে। সে বারবার ইব্রাহিম ভাইয়ের কাছে সরিও বলেছে। বলেছে তোকে বুঝিয়ে বলতে। তুই রাগ করবি সে জানে। রাতে কল করে সে তোকে বুঝিয়ে বলবে বলেছে। ‘
কুসুমের চোখের কোণে জল জমে যায়। এতটা বছর অপেক্ষা করার পর আজ সে কি না বলছে, আরো সাত মাস পর আসবে? পাষাণ লোক! এমন পাষাণ লোকের সঙ্গে কুসুমের কোনো কথা থাকতে পারে না। রাতে কল করুক না! কুসুম মোটেও তার কল ধরবে না। পা/ষাণ, পা/ষাণ, পা/ষাণ!
এইজন্যেই বোধহয় গতকাল উচ্ছ্বাস ভাই বারবার কুসুমকে বলেছিল,
তার আসতে দেরি হলেও হতে পারে। কুসুম যেন মন খারাপ না করে। সে বিদেশের মাটিতে নিজের ইচ্ছেই পরে নেই। বাধ্য হয়ে এখানে আছে। যত দ্রুত দেশে আসা যায়, সে সেই চেষ্টাই করবে। তাহলে এজন্যে কথাগুলো বলেছিল সে!
উষা কুসুমের কাঁধে হাত রাখে। কাঁধে চাপ দিয়ে বলে,
‘ মন খারাপ করিস না, হুঁ? চল কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে যাবি। এক্সাম দিয়ে টায়ার্ড নিশ্চয়ই! ‘
কুসুম উত্তর দেয়, ‘ তুমি ভাত রেডি করো আমি আসছি। ‘
উষা চলে যায়। কুসুম ফোন হাতে নেয়। রাগান্বিত হয়ে শেষবারের মত উচ্ছ্বাসের হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে মেসেজ করে,
‘ আপনার আর দেশে আসার দরকার নেই। বিদেশেই বিয়ে করে সেটেল হয়ে যান। দেশে কেউ আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে না। পাষাণ লোক! ‘
মেসেজ করেই ফোন বন্ধ করে রেখে দেয় কুসুম। এখন সে কল দিলে মরে গেলেও কুসুম আর ফোন ধরবে না। শাস্তি পাক সে!
_________________________
রাতে সাহেদা কুসুমকে নিজের ঘরে ডেকে নিলেন। কুসুম মায়ের ঘরে এসে দেখে মায়ের বিছানার উপর অনেক শাড়ি স্তূপ করে রাখা। সাহেদা মেয়ের গায়ে একটি শাড়ি পরখ করে দেখলেন। কুসুমের শ্যামলা গায়ে শাড়িটা দারুন মানাচ্ছে। কুসুমের শাড়ি দেখে বলল,
‘ এটা কার শাড়ি মা? ‘
‘ তোর। ‘
‘ আমার? আমি শাড়ি পড়তে পারি না। জানো না তুমি? ‘
‘ পড়তে হবে। আজ থেকে শাড়ি পড়া শিখতে হবে তোর। উচ্ছাস আসছে। তোকে কদিনের মাথায় তুলে নিয়ে যাবে তারা। বৌ হয়ে শাড়ি পড়বি না? ‘
কদিন পরই উঠিয়ে নিয়ে যাবে শুনে কুসুমের বুক ধ্বক করে উঠে। নতুন সংসার জীবনের কথা শুনে কুসুম কেমন ভয়ে মিইয়ে যায়। কুসুম নাছোড়বান্দার মত করে বলে,
‘ তুলে নিয়ে যাবে মানে? আমি যাব না। ‘
কুসুমের ভেজা কণ্ঠ শুনে বুকের ভেতর কেমন মুচড়ে উঠল সাহেদার। তিনি মেয়ের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বললেন,
‘ বিয়ে হয়েছে এখন তো তুলে নিবেই। ভয় পাচ্ছিস কেন? উচ্ছ্বাস খুব ভালো ছেলে। জানিস তো ওকে তুই। ‘
‘ কিছু জানিনা আমি। তার কথা আপাতত আমার সামনে বলবে না।’
কুসুমের কণ্ঠে রাগের আঁচ দেখে সাহেদা মৃদু হাসেন। ব্লাউজ, পেটিকোট মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন,
‘ আচ্ছা, বলছি না। এখন যা, দু কাপড় পড়ে আয়। শাড়িটা পরিয়ে দেই। দেখি কেমন মানায় তোকে। ‘
কুসুম ব্লাউজ, পেটিকোট নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। সাহেদা মেয়ের যাবার দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
#চলবে
#বৌপ্রিয়া
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
#পর্ব – |১২|
কুসুমের সে রাতে এক ফোঁটাও ঘুম হল না। সম্পূর্ন রাত বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বন্ধ ফোনের দিকে চেয়ে ছিল। ঘুম ধরা দিল একদম শেষ রাতে। সকালে সাহেদা মেয়েকে জেগে তোলার চেষ্টা করলেন। বাড়িঘর পরিষ্কার করছেন, ধোয়ামোছা করছেন, কত কাজ তার। অথচ কুসুম কি না বাড়ির মেয়ে হয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। সাহেদা শেষবারের মত কুসুমকে ডেকে গেলেন। জানালার পর্দা মেলে দিতে দিতে বললেন,
‘ উঠে পর কুসুম। ওরা এই আসলো বলে। এসে তোকে ঘুমাতে দেখল বিশ্রী লাগবে ব্যাপারটা। জলদি জলদি বিছানা ছাড়। ‘
সারারাত না ঘুমানোর কারণে কুসুমের চোখ লালচে হয়ে আছ। তীব্র মাথা ব্যথায় সে কাহিল। কুসুম গায়ের কাথা খামচে ধরে পাশ ফেরে। বিড়বিড় করে ঘুমন্ত কণ্ঠে আওড়ায়,
‘ এ-এ-এখন না। আ-আরেকটু ঘ-ঘুমাই না? ‘
সাহেদা শুনতে পান না কুসুমের কথা। দরজার পাশে থেকে উষা তাড়া দিচ্ছে, ওরা এসে গেছে। সাহেদা হাতে থাকা কুসুমের ওড়না ভাঁজ করে আলমারিতে তুলে দ্রুত মাথায় আঁচল তুলে বেরিয়ে যান বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যান। কুসুম এখনো গভীর ঘুমে মগ্ন।
দরজার ওপাশে উচ্ছ্বাস ও তার পুরো পরিবার দাড়িয়ে আছে। উচ্ছ্বাস সাহেদাকে দেখেই এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। মৃদু হেসে বলল,
‘ খালামনি, কেমন আছো? ‘
সঙ্গেসঙ্গে উচ্ছ্বাসের মা পারুল ছেলের পিঠে থা/প্পড় বসান। চমকে উঠে উচ্ছ্বাস। সাহেদাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় মায়ের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে চায়। পারুল মুখ কুঁচকে বলেন,
‘ খালামনি কি? আম্মা বলবি। ‘
সাহেদা হেসে উঠেন। উচ্ছ্বাস অসহায় চোখে মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘ সদ্য বিয়ে হয়েছে, আম্মা। কিছু সময় তো দাও। খালামনিকে আম্মা বলতে লজ্জা লাগছে আমার। ‘
পারুল ভ্রু কুচকান। সাহেদা পারুলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
‘ ধুর। তোমার এসব ঢং বন্ধ করো তো আপা। খালামণিই ঠিক আছে। ‘
তারপর উচ্ছ্বাসের ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ কতদিন পর দেখলাম। বড় ছেলে হয়ে গেছিস। ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু হাসে। মাথা চুলকে সরে আসে সাহেদার থেকে। সাহেদা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘ ভেতরে আয়। এই ভেতরে আসো সবাই। ‘
একে একে সবাই ঘরে প্রবেশ করে। সাহেদা দরজা বন্ধ করে এগিয়ে যান সবার দিকে। সবাই সোফায় বসে। উচ্ছ্বাস সোফায় বসে এদিক ওদিক চায়। তারপর গলা কেশে আবারও সাহেদার দিকে তাকায়। একটু পর উষা আসে সবার জন্যে শরবত নিয়ে। সবাইকে শরবত দিয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে শরবত এগিয়ে দেয়। উচ্ছ্বাস শরবতের গ্লাস নিতে গেলে উষা ফিসফিস করে বলে,
‘ ঘরে ঢুকেই কাকে খুঁজছিলে? ‘
উচ্ছ্বাস হেসে বলে, ‘ কাউকে খুঁজছিলাম নাকি? ‘
‘ অভিনয় করছ? লাভ নেই। যাকে খুঁজছ সে ঘুম দিচ্ছে। নিজে গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে আসলে তবেই উঠবে বলে মনে হচ্ছে। ‘
উচ্ছ্বাস মৃদু হেসে গ্লাসে চুমুক দেয়। মুখ তুলে বলে, ‘ নাইস জুস। ‘
উষা প্রতিউত্তরে হেসে রান্নাঘরে চলে যায়। কুসুম ঘুমে শুনে উচ্ছ্বাসের মনে কোনো ভাবাবেগ হল বলে মনে হচ্ছে না উষার। উচ্ছ্বাস আগের মতোই সবার সঙ্গে কথা বলছে। উষা বিভ্রান্ত হল। কুসুম-উচ্ছ্বাসের সম্পর্ক কি এখনো স্বাভাবিক হয়নি? আশেপাশে পারুল কুসুমকে না দেখে সাহেদাকে প্রশ্ন করেন,
‘ হ্যা রে! কুসুম কই? ‘
সাহেদা অপ্রস্তুত হয়ে যান। বলেন, ‘ ঘুমাচ্ছে। দাঁড়াও, ডেকে আনছি।’
সাহেদা সোফা থেকে উঠে যেতে যান। তবে পেছন থেকে পারুল সাহেদার হাত টেনে ধরেন। বললেন,
‘ তুই যাচ্ছিস কেন? তুই আমার সঙ্গে গল্প কর। উচ্ছ্বাসের তো এখানে বসে কোনো কাজ নেই। ও গিয়ে ডেকে আনুক না? ‘
পারুল কথা বলে উচ্ছ্বাসের দিকে চান। উচ্ছ্বাসকে ইশারা করে বললেন,
‘ যা তো, কুসুমকে ডেকে নিয়ে আয়। ঘুমাচ্ছে ও। ‘
উচ্ছ্বাস অপ্রস্তুত হয়। গলা কেশে বলে, ‘ আমি যাব? ‘
পারুল চোখ রাঙান। বললেন,’ না, তোর বাপ যাবে। যা ডেকে নিয়ে আয় কুসুমকে। ‘
মায়ের রাগী কণ্ঠ শুনে উচ্ছ্বাস থতমত হয়ে যায়। গায়ে গতরে এবং বয়সে সে যতই বড় হয়ে যাক না কেন! মা’কে এখনো উচ্ছ্বাস অনেক ভয় পায়। মায়ের কথা সহজেই ফেলে দিতে পারে না। অতিরিক্ত সম্মান করে নিজের মাকে। তাই সে দ্রুত সোফা থেকে উঠে টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে বলে, ‘ খালামনি, আমি যাচ্ছি। তুমি গল্প করো। ‘
পারুল লুকিয়ে হাসেন। উচ্ছ্বাস এগিয়ে যায় কুসুমের ঘরের দিকে। ঘরের দরজা হালকা ভিড়িয়ে রাখা। উচ্ছ্বাসের মনে পরে যায় তিন বছর আগের কথা। ঘরের দরজা এমন করে সেদিনও ভিড়িয়ে রাখা ছিল। তারপর সেদিন দরজা খুলে ভীষন অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পরে যায় উচ্ছ্বাস-কুসুম দুইজনেই। আজকে এই ভুল করবে না উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাস দরজার টোকা দেয়। একবার দুইবার, তিনবার। ভেতর থেকে সাড়া আসে না। কুসুম কি ঘুমাচ্ছে এখনো? অগ্যতা উচ্ছ্বাস দরজা খুলে দেয়। ভেতরে প্রবেশ করে। সহসা চোখ যায় বিছানার উপর লম্বা করে শুয়ে থাকা কুসুমের দিকে। যার চোখ বন্ধ, দুই চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম ভর করে আছে, শরীরে ওড়না নেই, কামিজের অবস্থা খারাপ। উচ্ছ্বাস আবারও অপ্রস্তুত হয়। তারা কাগজের দিক থেকে স্বামি স্ত্রী হলেও মনের দিক থেকে এখনো দুজন একে ওপরের কাজে অজানা, অচেনা। দুজনের মধ্যে বিস্তর ফারাক এখনো রয়ে গেছে। তিন বছর অগণিত বার মোবাইলে কথা বলার পরও এই দূরত্ব ঘুচে যায়নি। কুসুমকে এমন ছন্নছাড়া ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে উচ্ছ্বাসের বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। উচ্ছ্বাস অন্যদিকে মাথা নিয়ে ঢোক গিলে। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে এগিয়ে আসে কুসুমের দিকে। কুসুমের পাশে চেয়ার টেনে বসে। আশেপাশে চোখ রেখে খুঁজে কিছু একটা। বিছানার এক কোণে পরে থাকা ওড়না পেয়েও যায়। উচ্ছ্বাস সেটা হাতে নিয়ে কুসুমের গায়ে জড়িয়ে দেয়। হাত বাড়িয়ে কামিজ ঠিক করে দেয়। এসব করেছে তার পেছনে একটা কারণও আছে। উচ্ছ্বাস এখন কুসুমকে ডেকে তুলবে। উচ্ছ্বাসকে দেখে প্রথমে কুসুম চমকাবে ভীষনভাবে। তারপর সহসা নিজের শরীরের দিকে তাকাবে। তখন যদি শরীরের জামা কাপড় ঠিক না দেখে, নিজেও যেমন অপ্রস্তুত হবে। সেই পরিস্থিতি উচ্ছ্বাসকেও বিভ্রান্ত করবে। তাই উচ্ছ্বাস আগেভাগেই সতর্ক করে রাখল সবকিছু।
উচ্ছ্বাস এগিয়ে আসে। কুসুমের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে ডাকে, ‘ কুসুম, উঠো। এই কুসুম? কুসুম? ‘
পুরুষালি চেনা কণ্ঠ শুনে ঘুমের মধ্যেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে। কে এসেছে? কুসুম যাকে ভাবছে সেই কি? কুসুমের তর সয় না। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত পুরুষ ঝুঁকে আছে। যার পুরুষালি হাত কুসুমের চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি কুসুমের চোখেমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুসুম চমকে উঠে।
‘ও আল্লাহ! ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠে দ্রুত শোয়া থেকে বসে যায়। কুসুমের আচমকা চেঁচানোতে ঘাবড়ে যায় উচ্ছ্বাস। মুখ সরিয়ে এনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় কুসুমের দিকে।
#চলবে