#চিত্তবৃত্তি
#পর্ব_১৪+১৫
#জান্নাতুল_নাঈমা
দু’দিন ধরে নিখোঁজ মেয়েটি। থানায় জিডি করেছে দাদুভাই। চিন্তায় চিন্তায় দেহ ভেঙে পড়েছে তার। অতিরিক্ত শরীর খারাপ করায় তার মেজো ছেলে এসে বাড়ি নিয়ে গেছে। ইমন আজ রাতে ফিরবে৷ এদিকের কোনো খবরই সে জানে না৷ যখন জানতে পারবে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে? তাই নিয়ে সকলে প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় রয়েছে। চিন্তা নেই শুধু ইভানের। সে দিব্যি ডিনার সেরে ইংলিশ মুভি দেখতে বসল৷ মধ্যরাতে বাড়ি ফিরল ইমন। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ইয়াশফার ঘরে দরজায় নক করল। দরজা খুলে ইমনকে দেখতেই ইয়াশফার পিল চমকে গেল। ইমন ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কীরে মনে হয় বাঘ দেখলি? ‘
‘ কইই না তো। কিছু বলবে ভাইয়া? ‘
ইমন কোনো প্রকার ভণিতা না করেই বলল,
‘ মুসকানের সাথে তোর কথা হয়েছে? দুদিন ধরে ফোন বন্ধ। ‘
ঢোক গিলল ইয়াশফা। বলল,
‘ না তো কথা হয়নি। ‘
চিন্তিত দৃষ্টিতে কয়েক পল তাকিয়ে রইল ইমন। লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে উদ্যত হলো সে। তখনি ইয়াশফা বলল,
‘ দাদুভাইয়ের শরীর খারাপ। তাই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। ‘
চমকাল ইমন। দাদুভাই এখানে? অসুস্থ সে। ওদিকে মুসকান ফোন ধরছে না৷ উত্তেজিত হয়ে পড়ল সে। এক মুহুর্ত দেরি না করে চলে গেল দাদুভাইয়ের ঘরে। ঘুমন্ত দাদুভাইকে দেখে ডাকল না ইমন। মৃদু পায় নিজের ঘরে চলে গেল। ভেবেচিন্তে কল করল আশ্রমের খালাকে। সেও ফোন ধরল না। গোটা রাত হাসফাস করে কাটিয়ে দিল ইমন। সকাল হতেই দাদুভাইয়ের মুখোমুখি হলো সে। দাদুভাইয়ের মুখেই প্রথম শুনল অনাকাঙ্ক্ষিত সেই ঘটনা। এক নিমিষে ইমনের চেনা সত্তা বিলীন হয়ে গেল। ফর্সা মুখের রঙ ধারণ করল রক্তিম বর্ণ৷ দাদুভাই তাকে সামলাতে সমস্ত কথা শেয়ার করলেন। সেদিন সকালে মুসকান ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর বাড়ি ফেরেনি। থানায় জিডি করেছে এ কথাও জানাল। এ পর্যন্ত শুনে দাদুভাইয়ের প্রতি কোনো অভিযোগ তুলতে পারল না ইমন৷ বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। চেনা জানা সকল জায়গায় গেল সে। খোঁজ করল মুসকানের। হঠাৎ করে এভাবে মেয়েটা হারিয়ে গেল? এর পেছনে নিশ্চয়ই বড়ো কোনো চক্রান্ত আছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল সে। চিন্তা করল তীক্ষ্ণ ভাবে। ভাবল গভীর ভাবে। কোনো ভাবেই দিশা পেল না৷ কোন সুরাহাই মিলল না। এরপর গেল থানায়। থানা থেকে বন্ধুদের নিয়ে মুসকানের মেয়ে সহপাঠী প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসল। দিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলে দেহে ক্লান্তি এলো তার। সেই ক্লান্তি নিয়ে রাস্তার ধারে বসে দিহানকে বলল,
‘ দিহান, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমার মাথা কাজ করছে না। আমার হৃৎস্পন্দন সায় দিচ্ছে না। ও কোথায় গেল? কেন গেল? এভাবে কেন, কেন দিহান? ‘
পাশে বসে ভরসার সহিত কাঁধে হাত রাখল দিহান। বলল,
‘ মাথা ঠাণ্ডা করে ভাব ইমন। নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে। ‘
কথোপকথনে এ পর্যায়ে মোজাম্মেল চৌধুরীর কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তিনি বললেন,
‘ ইমন, তুমি কি আমার কাছে আসতে পারবে? শরীরটা ভীষণ খারাপ বাবা একবার এসে ঘুরে যাও। ‘
সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল ইমন। বাবার শরীর খারাপ! এক্ষুনি যেতে হবে তাকে। বাইক স্টার্ট দিল সে। দিহানকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম করে আচমকা থেমে গেল। সহসা চ্যাঁচিয়ে ওঠল,
‘ দিহান, সবাই তো জানে মুসকান নিখোঁজ। বাবাও জানে। তাহলে ফোন করে একবারো ওর কথা জিজ্ঞেস করল না কেন? ‘
দিহান হতভম্ব হয়ে গেল। অতি তুচ্ছ একটা বিষয়কেও ইমন এভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে? মুসকানের ব্যাপারে এই ছেলেটা কাউকে এক চুল পরিমাণ ছাড় দেবে না। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
‘ যাওয়ার পর বলবে হয়তো। ‘
শহরে বাবার বাসায় এলো ইমন। দীর্ঘসময় বাবার সঙ্গে চুপচাপ বসেও রইল। মোজাম্মেল চৌধুরী নানা ধরনের কথা বললেন। কথার ফাঁকে মুসকানের প্রসঙ্গও তুললেন৷ সে নিজ দায়িত্বে মুসকানের খোঁজ নিচ্ছে এ ভরসাও দিলেন। কিন্তু ইমনের মনে স্বস্তি কিছুতেই এলো না। রাতে ঠিকভাবে খেতেও পারল না সে৷ বারবার ফোন চেক করল। এরই মধ্যে থানায় দু’বার কল করা হয়ে গেছে। ছেলের অস্থিরতা, অসহায় বোধ সচক্ষে দেখলেন মোজাম্মেল চৌধুরী। মনে মনে ভাবলেন, প্রথম প্রথম এমন করবে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইমনের সৎ মা সাজিয়া বেগম। স্বামীর সব কর্মকাণ্ড বিষয়েই সেই অবগত থাকেন। তাই মুসকানের বিষয়েও অবগত৷ ইমন তার সৎ ছেলে। মুখে যতই ইমনের প্রতি সে ভালোবাসা দেখাক না কেন। মনে মনে একবিন্দু ভালোবাসাও নেই। এই যে মোজাম্মেল চৌধুরী ছেলেকে ভালোবেসে ছেলের ভালোর জন্য এতকিছু করছেন৷ এতে বিন্দু আগ্রহ তার নেই৷ সতীনের ছেলে যাকে খুশি তাকে বিয়ে করুক৷ তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে তো খুশিই হয়েছিল। যখন শুনেছিল ইমন কাজের মেয়ে মুসকানকে বিয়ে করবে। কারণ এতে চৌধুরি বাড়ির সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে। যার জন্য দায়ী হবে কেবল ইমন। ফলশ্রুতিতে মোজাম্মেল চৌধুরীর মনেও ইমনকে নিয়ে বিরূপ অনুভূতি হবে৷ এই বিরূপ অনুভূতি হোক এটাই তার একমাত্র চাওয়া। বাবা, ছেলের সম্পর্কে অবনতি ঘটলে তারই লাভ৷ ইমনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হলে মোজাম্মেল চৌধুরীর একমাত্র আদরের জায়গা হবে মেয়ে ইমা। সাজিয়ার একমাত্র গর্ভজাত সন্তান। নিজের সন্তানের চেয়ে সতীনের সন্তান বেশি ভালোবাসা পাবে এটা সহ্য করা তার জন্য খুবই কঠিন। যা দীর্ঘ বছর ধরে সহ্য করছেন তিনি৷ কিন্তু এবার বোধহয় ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছে। বিরাট বড়ো সুযোগ এসেছে। বাবা ছেলেকে সাপে নেওলে পরিণত করার।
ঘুম চোখে ধরা দেবেনা৷ বেডরুমে পায়চারি করছে ইমন৷ পাশাপাশি ঘাঁটছে মোবাইল ফোন। হঠাৎ সাজিয়া বেগমের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো,
‘ ছাদে এসো। মুসকানকে নিয়ে জরুরি কথা আছে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। ‘
ম্যাসেজটা পাওয়া মাত্র থমকে গেল ইমন। তবে কী তার সন্দেহটাই ঠিক? মুহুর্তেই চোখ, মুখ শক্ত হয়ে ওঠল তার। পেশিবহুল শরীরটা শক্ত পাথরের ন্যায় স্থবির হয়ে রইল কয়েক পল। সৎ মায়ের আহ্বানে চলে গেল ছাদে। তার বলা প্রতিটি কথা মস্তিষ্কে গেঁথে নিল সযত্নে। পাশাপাশি তার প্রতি এত সদয়বান হওয়ার পেছনের রহস্যটাও আঁচ করে ফেলল। তবুও মুখে ক্রূর হাসি ফুটিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।
.
.
পরেরদিন সকালবেলায় ইমন চলে গেল৷ বলে গেল, সে বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু সে বাড়ি গেল না। ঠিক দুপুর বারোটায় যখন মোজাম্মেল চৌধুরী গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। সেও বাইক নিয়ে পিছু নিল বাবার গাড়ির৷
.
.
অম্লানের নানা বাড়িতে মুসকানকে নিয়ে আসা হয়েছে। অম্লানকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল মুসকান৷ রাজি বলেই বড়ো বাবার আদেশ অনুযায়ী অম্লানের মায়ের সঙ্গে এখানে এসেছে। কিন্তু গতরাতে অম্লানকে ইভানের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছে সে। ওপাশের কথা সে না শুনলেও তার সঙ্গে মঙ্গলজনক কিছু ঘটবে না টের পেয়ে গেছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেছে গতরাত থেকেই। সেই থেকেই পালানোর পথ খুঁজছে সে। ছোট্ট একটি জায়গা জুড়ে এলতলার একটি বাড়ি। বাড়িটা গ্রামের দিকেই। জায়গাটা চেনে না মুসকান। তবুও ছলেবলে কৌশলে আশপাশটা পরোখ করে নিয়েছে। পালাতে হবে তাকে শিঘ্রই পালাতে হবে৷ নিজের হাতে নিজের এতবড়ো সর্বনাশ কিছুতেই করবে না। ইমনের জীবন থেকে সরে যেতে হবে বলে নিজেকে সে ধ্বংস করবে না৷ এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরল তার৷ কয়েকজন সুবিধাবাদী, নিষ্ঠুর হৃদয়ের মানুষদের কবল থেকে আত্মরক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠল। অম্লানের নানা বেঁচে নেই। নানি আর মামি একসাথে থাকেন। মামা থাকেন বিদেশে। মামার দুই ছেলে পড়াশোনার সুবাদে রয়েছে ঢাকায়। বাড়িতে নানি মামি ছাড়া কেউ নেই। আর রয়েছে অম্লান আর অম্লানের মা৷ সন্ধ্যায় বিয়ে৷ কেনাকাটা করতে বেরোলো অম্লান। অম্লানের মা আর মামি অল্প আয়েজনের রান্না বসিয়েছে। নানি মুসকানের সাথেই ছিল। তার প্রাকৃতিক ডাক এসেছে। তাই কাজ সারতে ঢুকেছেন বাথরুমে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাল মুসকান। নিজের সঙ্গে আনা ব্যাগটা নিয়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই সদর দরজা দিয়ে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে দৌড় লাগাল। পাকা রাস্তায় আসতে না আসতেই পেয়ে গেল সিএনজি। ওটা ধরেই চলে গেল টাঙ্গাইল পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে। ওখানে নেমে অটোর জন্য দাঁড়িয়েছে সে। বাবার গাড়ি ফলো করতে করতে পুরাতন বাস স্ট্যান্ড পর্যন্তই এসেছে ইমন৷ চলতি বাইকেই আচমকা চোখ চলে যায় বা পাশে৷ মুসকানকে দেখেই বুক ধ্বক করে ওঠে তার। দু-চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে মুহুর্তেই। দিকবিদিকশুন্য হয়ে চিৎকার করে ডাকে,
‘ মুসকান! ‘
সে ডাক শুনে আঁতকে ওঠে মুসকান। দূর থেকে ইমনকে দেখে বুক কেঁপে ওঠে তার৷ নিজেকে সামলে নেয় মুহুর্তেই। উল্টোপথে হাঁটা ধরে। ইমন বাইক নিয়ে ত্বরিত তার কাছে আসছে টের পেয়ে সামনের অটোতে ওঠে পড়ে। অটোওয়ালা স্বাভাবিক চিত্তে অটো স্টার্ট দিলে আচমকা ইমনের বাইক সামনে এসে দাঁড়ায়। মুসকান হৃৎপিণ্ডটা চেপে ধরে শক্ত দেহে বসে রয়৷ পৃথিবী উল্টে যাক সে সাড়া দেবে না। কোনোমতেই যাবে না ইমনের সঙ্গে। এদিকে ইমন যেন পুরো পৃথিবীর বিনিময়ে হলেও মুসকানকে নিজের সঙ্গে নেবে। নিজের কাছে রাখবে। প্রচণ্ড রকমের হট্টগোল বেঁধে গেল! মুসকানের ভাবগতিক দেখে তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ল ইমন৷ বাঘের মতো গর্জন ছাড়ল অটো থেকে নেমে দাঁড়াতে। বেশ একটা জটলাও বেঁধে গেল মুহুর্তেই। ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল ইমনের। মুসকানের হাত শক্ত হাতে চেপে ধরে এক ঝটকায় অটো থেকে বের করে আনল। সর্বসম্মুখে চিৎকার করে বলল,
‘ তুমি আমার সঙ্গে যেতে বাঁধ্য মুসকান। প্রয়োজনে পুলিশের গাড়িতে তুলে তোমাকে নিয়ে যাব৷ থানায় জিডি করা হয়েছে। তুমি আমাকে বাধ্য করো না হিংস্র ভাবে তোমায় নিতে৷ ‘
মানুষের মাঝে হৈচৈ পড়ে গেল। যেন কোনো সিনেমার শুটিং হচ্ছে। শুরুতে অনেকেই ইমনকে মারতে এসেছিল৷ কিন্তু তার দাপটের কাছে কুলোতে পারেনি কেউই৷ এছাড়া উপস্থিত অনেকেই ইমনকে আগে থেকেই চেনে। শেষে জয় ইমনেরই হলো৷ মুসকানকে নিয়ে সে নিজের ফ্ল্যাটে চলে এলো। দাদুভাইকে ফোন করে জানিয়ে দিল, মুসকানকে খুঁজে পেয়েছে। আর মুসকানকে শক্ত হাতে হির হির করে টানতে টানতে রুমের ভিতর ছুঁড়ে ফেলল। ক্রোধের তাড়নায় ইমনের মুখাকৃতি বদলে গেছে। যেই বদলানো রূপে ভয়ে গা শিউরে ওঠল মুসকানের। ইমন যখন হিসহিসিয়ে বলল,
‘ তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া না হওয়া পর্যন্ত এখানেই বন্দি থাকবে। ‘
কথাটা বলেই বাইরে থেকে দরজা লক করে দিল সে। মুসকান ছুটে এসে দরজায় হাত চালাতে লাগল। বলল,
‘ ছোটোসাহেব দরজা খুলুন। প্লিজ, দরজা খুলুন। আমার ওপর এভাবে জুলুম করতে পারেন না আপনি। ‘
শক্ত মূর্তির ন্যায় এপাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনল ইমন। অবাক হবে? বিস্মিত হবে? নাকি দুঃখে মরে যাবে? বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। তীব্র যন্ত্রণায় ঠায় দাঁড়ানো মানুষটা ধপ করে বসে পড়ল। দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে শ্বাস নিল ঘনঘন। রাগটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সে? ঐ মেয়েটাকে খু’ন করে দিতে ইচ্ছে করছে৷ যে মানুষটাকে দেখলে মুগ্ধতায় নিজেই খু’ন হয়ে যায়৷ সেই মানুষটাকে কি খু’ন করা সম্ভব? বিষাক্ত অনুভূতিতে ছটফটাতে শুরু করল ইমন৷ ঐ মানুষটা তার হৃদয়ের কতখানি জুড়ে কীভাবে বোঝাবে? এখনো মেয়েটা কেন বুঝল না। কেন করল এভাবে আঘাত? সহসা চিৎকার করে ওঠল ইমন। যেই চিৎকার শুনে মুসকানের দরজায় করাঘাত থেমে গেল৷
বদ্ধ দ্বারের ভেতরে মুসকান। বাইরে ইমন৷ দু’জনের হৃদয়েই চলছে তীব্র আন্দোলন। মনে তীব্র জেদ চেপেছে ইমনের। এই জেদ শুধু বাবার প্রতি নয়। মুসকানের প্রতিও৷ সেই জেদকে কেন্দ্র করেই সহসা ওঠে দাঁড়াল সে৷ দরজা খুলে ঢুকল ভেতরে। এরপর সশব্দে লাগিয়ে দিল দরজা৷ মুসকান চমকে ওঠল। চকিতে ফিরতেই ইমনের বিক্ষিপ্ত চেহারাটা ভেসে ওঠল৷ আচম্বিতে বক্ষঃস্থল কেঁপে ওঠল তার। গৌরবর্ণ দেহে কালো শার্টটা অযত্নে পড়ে আছে। বুকের দিকের দুটো বোতাম খোলা। ঘর্মাক্ত বুকটায় লোমগুলো লেপ্টে আছে। বিক্ষিপ্তভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চলায় বুকের পাটা করছে ঘনঘন ওঠানামা। শার্টের হাতা গোটানো থাকায় কালো লোমে ভরা ফর্সা ত্বকেও নীল রঙা রগ ফুলেফেঁপে ওঠেছে। অতিরিক্ত ক্রোধ শুধু চোখ, মুখেই নয় সর্ব অঙ্গ কাঠিন্যে পরিণত করেছে মানুষটার। দমফাটা চাউনি ফিরিয়ে নিল মুসকান৷ নিঃশ্বাস ছাড়ল নিভৃতে। দুচোখে ঝড়াল নীরব অশ্রু। ইমন টলানো দেহে এগিয়ে এলো। ধপ করে বসল পাশে৷ ভারী শরীরটা ধপ করে পাশে বসায় আবারো কেঁপে ওঠল মুসকান। শ্বাসরোধ করে বসে রইল সে৷ নিস্তব্ধ, গুমোট পরিবেশ। চারদেয়ালে আবদ্ধ ঘরটায় থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। ক্ষণে ক্ষণে একজোড়া শরীরের গভীর নিঃশ্বাস ভাপা অনুভূতির সৃষ্টি করছে। সেই অনুভূতি অবশ্য বেশিক্ষণ স্থির থাকল না৷ আচমকা ইমন ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে বলল,
‘ আমাকে শান্ত করো মুসকান। আমাকে শান্তি দাও। ভয়ানক কিছু করে ফেলব। ভয়াবহ আঘাত করে বসব তোমায়। প্লিজ আমাকে শান্ত করো। ‘
হুমকি না আকুতি? বোধগম্য হলো না। শঙ্কিত হয়ে ঢোক চিপল মুসকান৷ আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, ইমনের অস্বাভাবিক মুখাবয়ব৷ মুহুর্তেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল মাত্রাতিরিক্ত। অপরাধবোধ না ভয় ঠিক কোনটা থেকে সংকুচিত হয়ে এলো মুসকানের মুখ জানা নেই। ইমন জানতেও চায় না৷ সে কেবল তার আহত হৃদয়, অশান্ত মনে শান্তি চায় স্বস্তি চায়৷ যে তীব্র ভয়, যন্ত্রণা এই মেয়ে দিয়েছে তার বিনিময়ে ভালোবাসা চায়। মুসকানের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ইমন তার গা ঘেঁষে বসল৷ ভরাট কণ্ঠে পুনরায় বলল,
‘ আমায় শান্ত করো। ‘
গা শিউরে ওঠল মুসকানের। কিঞ্চিৎ দূরে সরে গেল সে। এতে যেন দ্বিগুণ উদ্ধত হয়ে ওঠল ইমন। প্রায় ঠেসে বসল ওর দিকে৷ মুসকান ঘনঘন ঢোক গিলে আড়চোখে তাকাল। ইমন খেয়াল করে একই সুরে বলল,
‘ তোমার এই মুখ, এই চোখ আমাকে আঁটকে দিল মুসকান। আমি তোমাকে খু’ন করতে পারলাম না। ‘
এ কথা বলেই আচমকা দু হাতে ওর কপোলদ্বয় চেপে ধরল। বেসামাল কণ্ঠে বলল,
‘ আমি তোমায় আর সময় দিব না৷ দিব না কোনো সময়। বিয়ে করবে আমায়? হাহ! প্রশ্ন নয় আদেশ করছি শিঘ্রই বিয়ে করতে হবে আমায়। ‘
মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল মুসকান। ইমনের দৃষ্টিজোড়া আজ কেন যেন বড্ড হিংস্র লাগছে। কিন্তু এই যে স্পর্শ এতে কেন হিংস্রতা নেই৷ তবে কী ইমনের মনে তার প্রতি হিংস্রতা জন্মেছে? শুধু দেখাতে পারছে না? কেন পারছে না ভালোবাসে বলে? চোখ বুজল মুসকান৷ নিঃশ্বাস ছাড়ল ফোঁস করে। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
‘ আমাকে ক্ষমা করে দিন ছোটোসাহেব। এই বিয়ে আমি করতে পারব না। ‘
ইমনের মাথায় যেন বজ্রপাত ঘটল! চমকে গিয়ে দু-হাত সরিয়ে নিল সে। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
‘ এটা তোমার মনের কথা নয়। ‘
মুখ ফিরিয়ে নিল মুসকান। কপট ক্রোধ প্রকাশ করে বলল,
‘ এটাই আমার মনের কথা। জীবনটা আমার সিদ্ধান্তও আমার। ‘
কঠোর ব্যক্তিত্বের ইমন চৌধুরীর জন্য এটুকুই যথেষ্ট ছিল নিভে যাওয়ার। দপ করে নিভে গেল সে। অস্বাভাবিক ভাবে চারপাশে তাকাতে লাগল। চোখ দু’টো তীব্র মাত্রায় লাল হয়ে রয়েছে তার। চোয়ালদ্বয় কঠিন থেকে কঠিনতর। কান দিয়ে গরম লাভার ন্যায় কিছু একটা নির্গত হচ্ছে বোধহয়। ভীষণ হাসফাস চিত্তে চোখ বুজল সে। মনে পড়ল সেদিনের সেই মুহুর্তটুকু। যে মুহুর্ত প্রণয়ের গভীর তৃষ্ণা নিয়ে মুসকানের অধরে ডুব দিয়েছিল সে। মনে পড়ল জোরাল অধিকার বোধ থেকে ঘন্টাখানেক আগে রাস্তায় অগণিত চোখকে স্বাক্ষি রেখে মুসকানকে তুলে আনার দৃশ্যটুকু। সবটা পরিষ্কার ভাবে মনে করেই দৃষ্টি খুলল সে। ত্বরিত তাকাল মুসকানের দিকে। বলল,
‘ বউ হবে না আমার? ‘
মুসকান নতমুখে ডান দিক বাম দিক মাথা নাড়াল। ইমন এবার সত্যি হিংস্র হয়ে ওঠল। আফসোস শুধু একটাই এই হিংস্রতা দিয়ে মুসকানকে সে কোনো ভাবেই আঘাত করতে পারবে না। তাই আঘাতটা হোক কেবল নিজের। মুসকানের একটি হাত টেনে নিজের গালে রাখল ইমন। দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ বিয়ে যখন করবেই না সেদিন ঐ চুম্বন মুহুর্তের জন্য আমার গালে সপাটে থাপ্পড় মারো। ‘
আঁতকে ওঠল মুসকান। বিস্মিত হয়ে তাকাল ইমনের কঠিন মুখটায়৷ ইমন স্থির হয়ে পুনরায় বলল,
‘ মারো মুসকান মারো। রাস্তা থেকে জোরপূর্বক এখানে নিয়ে আসার জন্য প্রতিশোধ নাও। এরপর চলে যাও এখান থেকে চিরমুক্তি দিয়ে দিব তোমায়। ‘
এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে পুনরায় বলল,
‘ হ্যাঁ মুক্তি তুমি পাবে। এখান থেকে চলেও যাবে। আমি আটকাব না। মেনে নিব সবটা। কিন্তু যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে যা যা হয়েছে তার জন্য আমাকে শাস্তি দিয়ে যেতে হবে। ‘
কথাগুলো বলতে বলতে মুসকানের হাত দিয়ে নিজের গালে নিজেই আঘাত শুরু করল ইমন। বার বার বলতে লাগল,
‘ কী হলো মুসকান, মারো আমায়। অন্যায় করেছি আমি। ভুল করেছি তোমার ওপর জুলুম করে। শাস্তি দাও। বিদায় হও। ‘
ইমনের এহেন আচরণ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মুসকান। শরীরের সমস্ত শক্তি অপচয় করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ইমনের শক্তির সঙ্গে কুলোতে পারল না। হৃদয়টা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার। ইমনকে সে আঘাত করতে পারবে না কিছুতেই না৷ দু-চোখ উপচে জল গড়াতে শুরু করল তার। মুখ ফুটে বলতে পারল না কিছুই৷ ইমন সহসা থেমে গেল। উন্মাদের মতো চাউনি ছুঁড়ে বলল,
‘ কী হলো মুসকান? কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমার দেহে আঘাত করতে এত ভয়, এত যন্ত্রণা? অথচ কী অবলীলায় হৃদয়ে আঘাত করে দিলে, করে যাচ্ছ। ‘
তাচ্ছিল্য ভরে হাসল ইমন। মুসকানের হৃৎপিণ্ড দুমড়ে মুচড়ে গেল যেন। অসহনীয় হয়ে ডুকরে ওঠল সে। ইমন ধরে রাখা হাতটা বাঁহাতে নিয়ে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বলল,
‘ চুপপ। একদম কাঁদবে না। চলে গিয়েছিলে না? জোর করে ধরে এনেছি তো? আবারো যাবে। তবে যাওয়ার আগে…
এ পর্যন্ত বলেই পুনরায় মুসকানের হাত তার গালে রাখল। বলল,
‘ মারো মুসকান। আমার ভুলের শাস্তি দাও। ‘
‘ আপনি কোনো ভুল করেননি। আমি পারব না আপনার গায়ে হাত তুলতে প্লিজ। ‘
প্রায় চিৎকার করে কথাটা বলল মুসকান। দু’চোখ গলে বেরোতে লাগল অবিশ্রান্ত নোনাপানি।
‘ আমি ভুল না করলে ভুলটা তো তুমি করেছ মুসকান। ‘
কান্না বিগলিত গলায় মুসকান বলল,
‘ হ্যাঁ আমি ভুল করেছি আমি। কী শাস্তি দেবেন বলুন তবুও মাফ করুন আমায়। এমন করবেন না এমন পাগলামি করবেন না। দোহাই লাগে৷ ‘
‘ শাস্তি? ‘
বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠল। কী শাস্তি দেবে? ভালোবাসার মানুষের ভুলের শাস্তি ভালোবাসা ব্যতীত আর কোনোভাবেই যে দেয়া যায় না। অন্য কেউ দিতে পারে কিনা জানে না। কিন্তু সে পারবে না। এই মেয়েটা যে তার ভীষণ ভালোবাসার, তীব্র স্নেহের, প্রগাঢ় মায়ার। শাস্তি বরং দূরে থাকুক। এবার মেয়েটাকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকটাকে শান্তি দিক। পরোক্ষণেই ভেতরটা অভিমানে বিদ্রোহ শুরু করল। বলে ওঠল,
‘ না ইমন চৌধুরী না। তুমি শাস্তি দিতে পারবে না বলে এতটা ছাড়ও দিও না। ‘
ভেতরের সত্তার এহেন পরামর্শে ইমন বলল,
‘ অনেক শাস্তি দিব। আঘাত নাই করলে ভালোবাসতে তো পারো? ‘
কথাটা বলেই মুসকানের হাত আলতো করে গালে ছোঁয়াল। চোখ বুজে ছাড়ল প্রলম্বিত নিঃশ্বাস। এরপর ধীরেধীরে সে হাতটা নিচে নামাতে লাগল। বুকের বা পাশটায় এসে থামাল হাতটা। শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘ এখানটায় একটা চুমু দিতে পারবে মুসকান? ‘
চলবে…