চিত্তবৃত্তি পর্ব ১৬

0
716

#চিত্তবৃত্তি
#পর্ব_১৬

‘ এখানটায় একটি চুমু দিতে পারবে মুসকান? ‘

ইমনের আকুল আবদনে মুসকানের হৃদয় হলো ব্যাকুল। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করে ওঠল তার। নীরস গলাটা ঘনঘন ঢোক গিলে ভিজিয়ে নিল। চোখের পলকও ফেলল ঘনঘন। ইমন অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সমস্ত ক্রোধ যেন হঠাৎই বিলীনতায় রূপ নিয়েছে। দু’চোখে ভর করেছে এক আকুল নেশা। ঐ মাদক চাহনিতে মুসকানের সমস্ত সত্তা কেঁপে ওঠল৷ জড়ীভূত হয়ে বসে রইল সে। ইমন নিজের আবেদনীয় প্রশ্নের উত্তর পেল না। আর না পেল কোনো প্রতিক্রিয়া। সহসা বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুখে ফুটে ওঠল তাচ্ছিল্য মাখা হাসি। যে হাসি চোখ এড়াল না মুসকানের। বিনিময়ে বুকের খুব গভীরে টনটনে অনুভূতি হলো তার। কী করবে? ইমনের আবদার মেটাবে? কিন্তু মন থেকে একদমই সায় আসছে না। জাগ্রত হচ্ছে না কোনো অনুভূতি। আবার লজ্জাও লাগছে। এমন পরিস্থিতিতে এমন আবদার তীব্র অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে তাকে। মুসকানের সে অস্বস্তি টের পেয়েই ইমন তাচ্ছিল্যতার সঙ্গে হাসল৷ সহসা ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ বাড়ি ফিরতে হবে। ‘

চমকে ওঠল মুসকান৷ বাড়ি! ইমন কী ভুল করে এটা বলল? তার তো আশ্রমে ফেরার কথা। ইমন আবার জেদ করে তাকে চৌধুরী বাড়ি নিয়ে যাবে না তো? আঁতকে ওঠল মুসকান। ভীতগ্রস্থ হয়ে সেও ওঠে দাঁড়াল। কাঁপা কণ্ঠে শুধাল,

‘ বাড়ি মানে? ‘

আচমকা শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ইমন। যেই দৃষ্টি দেখে বুক কেঁপে ওঠল মুসকানের। ইমন দৃষ্টি স্থির রেখেই জবাব দিল,

‘ বাড়ি মানে বাসস্থান। যেখানে আমি সহ আমার পরিবার বাস করে। আর বাড়ি মানে আমি বুঝিয়েছি তুমি যে বাড়িতে বেড়ে ওঠেছ। ‘

মস্তক নত করে অপরাধী মুখে মুসকান বলল,

‘ আমি ওখানে যাব না। ‘

‘ যেতে তোমাকে হবেই। ‘

নিঃশ্বাস আটকে গেল মুসকানের। ক্রুদ্ধ ইমন চৌধুরীর ক্রুদ্ধতার সীমানা আঁচ করে তিরতিরিয়ে ঘামতে লাগল সে৷ দেহ কেঁপে ওঠল মৃদুভাবে। সেই কম্পন তার পাতলা মসৃণ ঠোঁটজোড়াতে দৃশ্যমান হলো। ইমন খেয়াল করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। রাশভারি গলায় বলল,

‘ আমাকে মুক্ত করে চলে যাবার অপশন দিয়েছিলাম। ওটা যখন বেছে নাওনি। এবার দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নাও। ‘

ইমনের কঠিন দৃষ্টিজোড়ায় এক পলক তাকাল মুসকান পরোক্ষণেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ইমন আর সময় অপচয় না করে আচমকা তার হাত ধরল। কাঠ কাঠ স্বরে বলল,

‘ কী ভেবেছিলে? চোরের মতো পালিয়ে যাবে ইমন চৌধুরী এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? এটা ভেবে থাকলে কতটা ভুল ভেবেছ নিশ্চয়ই টের পেয়েছ? চোরের মতো নয় বাঘিনীর মতো পালানোর সুযোগ তোমাকে দেয়া হয়েছে। যদি পারো আমার দৃষ্টিকে সাক্ষী করে চলে যেও। আমার হৃদয়কে নিহত করে বিদায় নিও। আর এসব যদি না পারো সারাজীবনের জন্য আমার হয়েই থেকে যাও। ‘

ভারিক্কি বাক্যগুলো আওড়ে সামনের পথে অগ্রসর হলো ইমন। থমকানো মুসকানের হাতে টান পড়তেই তাকেও যেতে হলো তার সঙ্গে। ইমন এক হাতেই ফ্ল্যাটের মেইন ডোর বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দিল। এরপর সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল নিচে। উদ্দেশ্য নিজ বাড়িতে ফেরা। এরপর বোঝাপড়া হবে বাবার সঙ্গে!

প্রচণ্ড গম্ভীর ভঙ্গিতে বাইক স্টার্ট দিল ইমন। মুসকানের মনে পড়ে না জীবৎকালে কখনো ইমনকে ঠিক এতটা গম্ভীর মুখে দেখেছে কিনা। এর মানে স্পষ্ট হয় যে এ প্রথম ইমন চৌধুরী সাংঘাতিক রেগে গেছে৷ যে রাগ তার পুরো ভাবমূর্তিকেই বদলে দিয়েছে। মুসকানের বুকটা দুরুদুরু করছে। সেই দুরুদুরু বাড়িয়ে দিল ইমনের কঠিন এক বাক্য,

‘ কাঁধে হাত রাখতেও সমস্যা? ‘

চমকাল মুসকান। ঢোক গিলে আলতো করে স্পর্শ করল ইমনের ডান কাঁধ। ইমনের মেজাজ বিগড়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত ধমক দিল,

‘ ভালোভাবে ধরো মুসকান। আর কোনো বিপদ ঘটানোর চিন্তা মাথাতেও এনো না৷ ‘

দু-চোখ গলে দুফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়ল মেয়েটার। কাঁপতে থাকা অধর কামড়ে ধরে বল প্রয়োগ করেই কাঁধ ধরল সে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাইক টান দিল ইমন। সামনের আয়নায় মুসকানের চোখে জল স্পষ্ট দেখল সে। ফলশ্রুতিতে চোয়ালদ্বয় সর্বোচ্চ শক্ত করে, দম আঁটকে সর্বোচ্চ স্পিডে বাইক টানতে লাগল। চলতি পথে একসময় হঠাৎ ব্রেক কষলে মুসকান ভারসাম্য হারিয়ে ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে জাপটে ধরল তাকে৷ মুখ থুবড়ে রাখল পিঠে। ইমন অনুভব করল সবই। কিন্তু তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না৷ বাইক স্বাভাবিক ভাবে চললে মুসকান স্বাভাবিকই থাকে৷ হঠাৎ হঠাৎ ব্রেক কষলে ইমনকে একই ভাবে জাপ্টে ধরে। একবার, দুবার এভাবে অসংখ্যবার। সহসা ইমনের মস্তিষ্কে প্রশ্ন জাগে, মুসকান কি আচমকা ভয়ে এমনটা করছে? নাকি সুযোগ পেয়ে স্বেচ্ছায়ই৷ যদি স্বেচ্ছায় হয়ে থাকে তবে চরম বিরক্ত হবে সে। কারণ তীব্র কষ্টে, দগ্ধীভূত হৃদয়কে শান্তি দিতে সে যে আবদারটি করেছিল। তা পূর্ণ না করে প্রকোট অপমান করেছে মুসকান। যা সে ভুলেনি, ভুলতে পারবেও না। তাই নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছে। এ জীবনে মুসকান স্বেচ্ছায় তাকে ধরা না দিলে সে ধরার আগ্রহ প্রকাশ করবে না। এতে বিয়ে করেও যদি তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক দৈ হি ক সম্পর্কটা না হয় না হবে। তবুও সে বুঝিয়ে দেবে আজকের চাওয়াটায় কোনো কামুকতা ছিল না। ছিল শুধুই প্রগাঢ় ভালোবাসার অনুভূতি।
.
.
মুসকানকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল ইমন। দাদুভাই অশ্রুসিক্ত নয়নে বসার ঘরে সোফার মাঝ বরাবর বসে। বাড়ির প্রত্যেকের মুখটাই থমথমে। ইতিমধ্যে মোজাম্মেল চৌধুরী খবর পেয়েছে। অম্লানের নানু বাড়ি থেকে মুসকানের পালিয়ে যাবার খবর। ইমন মুসকানকে খুঁজে পাওয়ার অপ্রত্যাশিত ঘটনা সম্পর্কেও অবগত হয়েছে। এরপর ঠিক কী ঘটতে চলেছে বা এরপর ঠিক কী কী ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে। ভাবতেই তার প্রেশার বেড়ে গেছে। আপাতত সে ঠিক কোথায় কোন অবস্থানে আছে কেউ জানে না।

বাড়ির সবাই আজ শুধু নীরব দর্শক। দাদুভাইয়ের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মুসকান। দাদুভাই পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। অশ্রুসিক্ত চোখ দু’টো মুছলেন সন্তর্পণে। এরপর মলিন মুখে মুসকানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘ তোমার ঘরে যাও। আরাম করো। ‘

এ কথা বলেই একটু দূরে ভীত মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াশফার দিকে তাকালেন। বললেন,

‘ ইয়াশফা ওর ঘরে কিছু খাবার পাঠাই দেও। ‘

ইয়াশফা মাথা কাৎ করল। মুসকান ক্রন্দনরত মুখে তাকাল। অপরাধ সূচক চোখে। দাদুভাই ম্লান হাসল। মুসকান কিছু বলতে উদ্যত হলে সে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ভুল অবুঝ আর ছোটোদের দ্বারাই হয়। ওদের ভুল হয় বলেই ওরা অবুঝ, ছোটো৷ আর আমরা ওদের ভুলগুলো শুধরে দিই বলেই আমরা বড়ো, বুঝদার। ‘

দাদুভাইয়ের ভালোবাসা, উদারতায় শিউরে ওঠল মুসকান। এই মানুষটার ভালোবাসাকে কীভাবে তুচ্ছ করতে পারল সে? ভীষণ লজ্জিত হয়ে দৃষ্টি ফিরাতে নিয়ে আরো একবার কেঁপে ওঠল৷ পাশেই পাথরের ন্যায় শক্ত শরীরে দাঁড়ানো ইমনকে দেখে। যার চোখ দু’টো ভয়াবহ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোয়ালদ্বয় প্রচণ্ড শক্ত। কপালে ছড়ানো এলোমেলো চুল, পরনের শার্টের করুণ অবস্থা তার বুককে মারাত্মক কাঁপিয়ে তুলল। বুকের গহিন থেকে উপচে এলো কান্নার দমক। মুসকানের অপরাধী চোখ, বিধ্বস্ত মুখ দেখে সরে পড়ল ইমন। বাড়ির সকলেই সরে গেল তার সামনে থেকে৷ একমাত্র দাদুভাই ছাড়া। সে বললেন,

‘ গিন্নি, ঘরে যাও। ‘

রুদ্ধশ্বাস ত্যাগ করল মুসকান। মাথা নাড়িয়ে পা বাড়াল পরিচিত সে ঘরটায়। যে ঘরে দীর্ঘ বছর কাটিয়েছে সে৷
.
.
চলবে…‌
®জান্নাতুল নাঈমা…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here