চিত্তবৃত্তি পর্ব ১০ +১১

0
816

#চিত্তবৃত্তি
#পর্ব_১০+ ১১
#জান্নাতুল_নাঈমা৷

চৌধুরী বাড়ির বড়ো ছেলের বিয়ে। হুট করেই বিয়েটা ঠিক হলো। ইমনেরও ব্যস্ততা বেড়ে গেল। ভেবেছিল, মুসকানের ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথা বলবে৷ সামনাসামনি। হঠাৎ আনিস ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো। পিছিয়ে গেল তার ভাবনাটাও। বাড়ির বড়ো ছেলেরাই বিয়ে করেনি৷ সবে প্রথম জন করবে। তার সিরিয়াল তো একদম শেষে। কিন্তু এই সিরিয়াল ভেঙেই মুসকানকে সে বউ করতে চায়। শুধু বড়ো ভাইয়ের বিয়েটা হয়ে যাক। যেহেতু ঠিক হয়ে গেছে। সম্পন্ন হয়ে যাওয়াই ভালো।

চৌধুরী বাড়ির বিয়ে মানেই এলাহি আয়োজন। আশ্রম থেকে দাদুভাইও বাড়ি চলে এলেন। সব আত্মীয় স্বজনকে বিয়ের কার্ড পাঠানো শেষ। মোজাম্মেল চৌধুরী স্ত্রী, কন্যা নিয়ে উপস্থিত। সব আত্মীয় স্বজনকে বিয়ের কার্ড পৌঁছানো হয়েছে কিনা নিশ্চিত হলেন সাজিয়া বেগম৷ ইমনের সৎ মা৷ সে সময়ই সে বললেন,

– মুসকানকে তো বিয়ের কার্ড দেয়া হয়নি৷

তার এহেন কথায় সকলে হকচকিয়ে গেল৷ কঠিন হয়ে গেল ইভানের মুখাবয়ব। যা দূর থেকে ঠিক খেয়াল করল ইমন৷ সাজিয়া বেগম বললেন,

– মেয়েটা ছেলেবেলা থেকে এ বাড়িতে ছিল। এ বাড়ির একজন সদস্য হিসেবেই তো ছিল৷ ওকে ইনভাইট করা উচিৎ। আমাদের বাড়ির বিয়েতে শত-শত লোক দাওয়াত খেতে আসবে। ও না আসলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু হবে৷

তার কথায় অনেকেই সম্মত হলো। শুধু মোতালেব চৌধুরী। অর্থাৎ, দাদুভাই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করলেন৷ ইমনও টুঁশব্দ করল না৷ বরাবরই মনে মনে সৎ মায়ের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে সে। এবারও তাই করল। সাজিয়া ইমনকেই মুসকানের জন্য কার্ড দিলেন। বললেন,

– বাবা তুমি দিয়ে এসো মুসকানকে।

ইমন চুপচাপ কার্ড নিল। দাদুভাই তার নীরবতা দেখে ভ্রু কুঁচকালেন। সকলের অগোচরে শুধালেন,

– তোমার কী মত দাদুভাই।

ইমন স্পষ্ট করে জানাল,

– আমি চাই না মুসকান এই অনুষ্ঠানে আসুক। এ বাড়ি থেকে ইনভাইটেশন কার্ড ওকে দেয়া হবে৷ পাশাপাশি জানানো হবে আমি চাই না ও আসুক। এরপর ও আসবে কি আসবে না, এটা সম্পূর্ণ ওর ওপর ডিপেন্ড করবে।

ইমন সেদিনই আশ্রমে যায়। মুসকানকে কার্ড দেয়। পাশাপাশি জানায় সে চায় না ও বাড়ি যাক। মুসকান মৃদু হেসে কার্ড গ্রহণ করে। বলে,

– আমি যেতে চাই না।

এ কথা শুনে ইমন বলল,

– আমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছেকে দাও।

স্মিত হেসে মুসকান বলল,

– দুজনের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছি বলেই যাব না।

আচমকা ইমনের ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসি ফুটে। যা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে মুসকান। সে জানে, এই মানুষটা আগাগোড়া শুধু তারই ভালো চায়। যত নিষেধাজ্ঞা সবটাতে মিশে থাকে শুধু তার ভালো-মন্দ। সেই আস্থাতেই তো মুসকান চোখবুঁজে বিশ্বাস করে নিয়েছে ইমনকে।
.
.
গুটিগুটি পায়ে দিন পেরিয়ে গেল পাঁচদিন। আগামীকাল আনিস চৌধুরীর বিয়ে৷ এই পাঁচদিন হাতেগোনা তিন কি চারবার ইমনের সঙ্গে কথা হয়েছে মুসকানের। দেখা হয়েছে একদিন। ইমন জানিয়েছে, স্কুল থেকে ছুটি মাত্র দু’দিন। তাই রোজ স্কুল করে এসে বাড়িতে সময় দিতে হয়৷ রাতে অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকায় ফোন অফ করে ঘুমায়। সবটা বুঝে মনকে স্বান্তনা দেয় মুসকান। বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায়। পড়াশোনা করে৷ ভার্সিটিতে যায়। দিনশেষে তবুও বুক চিনচিন করে তার। অদ্ভুত এক অশান্তি ঠেকে হৃদয় গভীরে। সে বুঝতে পারে ছোটোসাহেব তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে তার প্রতি অনুভূতিরা হয়েছে তীব্র। সহজ ভাষায় ঐ মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে। যে ভালোবাসার অন্ত নেই। সময় গুনতে গুনতে বিয়ের দিন পেরিয়ে গেল। পরেরদিন মুসকানের বক্ষঃস্থলেও উত্তেজনা বেড়ে গেল। এখন থেকে আগের মতো সময় দেবে ছোটোসাহেব। আগের মতোই তার কাছে আসবে৷ এই খুশিতে কল করল ইমনের ফোনে। ফোন রিসিভ হলো না। একঘন্টা পর ম্যাসেজ পেল,

– মুসকান, আজ আনিস ভাইয়ের বউভাত। সারাদিন ভীষণ ব্যস্ত থাকব৷ আমি তোমায় রাতে কল করব।

ম্যাসেজটা দেখেই বিমর্ষ হয়ে গেল সে। তবুও পরিস্থিতি বিবেচনায় মানিয়ে নিল। সে তো বাচ্চা নয়। তাই অবুঝ হলে চলবে না৷ সারাদিন বিষণ্নতায় কাটল মুসকানের। রাতে অপেক্ষা করল ইমনের কল আসার। কিন্তু মানুষটার কোনো কল এলো না। সে নিজে কল করলেও ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। ফলে সহসাই ভেঙে পড়ল সে। বালিশে মুখ গুঁজে উন্মাদের মতো কাঁদতে শুরু করল। পরোক্ষণেই নিজেকল সামলে নিয়ে ভাবল,

– ছিঃ ছিঃ। এসব কী করছি আমি? এসব কী আমাকে মানায়। আমি তো ম্যাচিওর মেয়ে।

ভাবতে ভাবতেই চোখ গলে পানি বেরোয়। ভালোবাসার অনুভূতির কাছে, প্রিয় মানুষটাকে অনেক বেশি মিস করে ফেললে কী আর এসব নীতি কথা মানায়? উহুম একটুও মানায় না। সারারাত কান্নাকাটি করেই পার হলো তার। সকালবেলায় বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাল। এক সময় আর ভালো লাগল না। রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিল। ফেসবুকে ঢুকে নিউজফিড স্ক্রোল করল দীর্ঘক্ষণ। হঠাৎই গতকাল রাতে ইমনের আইডিতে আপলোড দেয়া কয়েকটি পোস্ট নজরে পড়ল। ছয়টা ছবির মধ্যে পাঁচটাতে তারা ভাইবোন সকলে। সাথে দুএকজন অপরিচিত মুখও রয়েছে। লাস্ট পিক অর্থাৎ ছয় নম্বর পিকচারটা দেখে মুসকানের শ্বাস আটকে গেল। ইমনের সঙ্গে কোনো এক সুন্দরী রমণীর পিকচার। দুজনেই বেশ ক্লোজ হয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটা হলদু রাঙা পাতলা ফিনফিনে একটি শাড়ি পরা। মুসকানের হাত কাঁপতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর খেয়াল করল তার পুরো শরীরটাই কাঁপছে। থম মেরে বসে রইল সে৷ মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী করবে? কী ভাববে বুঝে ওঠতে পারছিল না। অসহ্য অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে কল করল ইমনকে। লাগাতার কল করেই গেল। তেরোবারের সময় ফোন রিসিভ হলো। মুসকান কাঁপা স্বরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে টানা স্বরে এক মেয়ে বলল,

– হ্যালো, হু আর ইউ?

মুসকান চমকে ওঠল৷ দম বন্ধ করে বলল,

– আপনি কে?

– আ’ম রিতিশা ইউ?

মুসকান শক্ত গলায় বলল,

– আমার যতদূর মনে পড়ে এই নামে কাউকে আমি কল করিনি।

ওপাশ থেকে বলল,

– আপনি এ্যাইমনকে কল করেছেন রাইট।

– সরি উনার নাম এ্যাইমন না।

– হোয়াট এভার, ও আমার কাছে এ্যাইমনই। হি ইজ মাই ডার্লিং…। এ্যাইমন ডার্লিং শাওয়ার নিচ্ছে আপনি পরে কল করবেন। অকে বায়।

কল কেটে গেল৷ মুসকানের কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল৷ ক্রোধে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম তার। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করল শুধু।
.
.
ইমন আশ্রমে এলো সেদিন সন্ধ্যায়। বাচ্চাদের চকোলেট দিয়ে মুসকানের খোঁজ করতেই রিপ্তি বলল,

– আন্নি দলজা খুলেই না৷ খুলেই না কত ডাকচি।

ইমন ভ্রু কুঁচকে বলল,

– কখন থেকে?

সুমা নামের মেয়েটি বলল,

– দুপুর থেকে দরজা খুলছে না। যতবার ডাকি ততবার বলে মাথা ব্যথা ঘুমাচ্ছে।

ইমন বিচলিত পায়ে মুসকানের ঘরের সামনে এলো। দরজায় টোকা দিয়ে ডাকল,

– মুসকান দরজা খুলো।

বারকয়েক ডাকার পর দরজা খুলল মুসকান। চোখ, মুখ ফুলিয়ে সাংঘাতিক অবস্থা তার। ইমন সে রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। মুসকান তাকে ভড়কে দিয়ে বলল,

– কেন এসেছেন? আমার কাছে আপনার না আসলেও চলবে। প্লিজ চলে যান।

ইমন থমকানো স্বরে বলল,

– মুসকান শান্ত হও। কী অবস্থা করেছ নিজের।

কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হলো সে। মুসকান এতে ক্ষেপে গিয়ে বলল,

– প্লিজ, নো এক্টিং।

ইমন চাপাস্বরে ধমক দিল,

– কী বলছ এসব মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

সহসা দু-হাত জোর করে মুসকান বলল,

– প্লিজ আমাকে একা থাকতে দিন। আমি একটু শান্তি চাই প্লিজ।

দরজা থেকে সরে গেল মুসকান৷ রুমের এক কোণায় বসে নীরবে অশ্রু ঝরাতে লাগল। ইমন ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না দ্বিধায় ভুগছিল। যখন মুসকান নীরবে কান্না করতে করতে হেচকি তুলতে শুরু করল। তখন সে দ্বিধা কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। মুসকানও চমকে দাঁড়িয়ে গেল৷ বৃথা চেষ্টা করল কান্না লুকোনোর। ইমনের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল। নিজেকে কষ্ট দিতে এই মেয়ে খুব এক্সপার্ট। আর যেদিন থেকে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হতে শুরু করেছে। সেদিন থেকেই ভুলভাল বুঝে নিজে নিজেই কষ্ট পাচ্ছে। ভীষণ আফসোস হলো তার। সেই আফসোসের কণ্ঠেই হঠাৎ মুসকানের অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে ইমন বলল,

– মানুষ এমন একটা হতভাগা জাতি, যে কখনো কখনো চিৎকার করে মন খুলে কাঁদতে ইচ্ছে হলেও তারা কাঁদতে পারে না। শুধু মাত্র লোক চক্ষুর ভয়ে।
আমরা নিজেদের স্বাধীন স্বাধীন বলে সারাজীবন গলা ফাটাই। রাস্তা, ঘাটে যে কোন জায়গায় বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বলি আমরা স্বাধীন, আমরা স্বাধীন। অথচ দিন শেষে রাতের আঁধারে লোকচক্ষুর ভয়ে লুকিয়ে কাঁদি। স্বাধীন ভাবে কাঁদতে পারিনা, স্বাধীন ভাবে কখনো কখনো হাসতে পারিনা। এই আমাদের স্বাধীন জীবন? আচ্ছা এমনটা হতে পারেনা, কারো মন খারাপ। বাবা-মা,বন্ধু -বান্ধব, আশেপাশের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ, হাজব্যান্ড, ওয়াইফ আঘাত দিয়েছে? তুমি মন খুলে কাঁদতে চাও? দু’হাত উঠিয়ে উন্মুক্ত বুক পেতে কাছে কেউ ডাকতে পারেনা? বলতে পারে না, আসো আমাকে আঁকড়ে ধরে যতো পারো কাঁদো, চিৎকার করে কাঁদো। মনের সব আবেগ খুলে প্রকাশ করো, সব ব্যথা অশ্রুকনার মাঝে ঝড়ে যেতে দাও। কাঁদো তুমি অনেক কাঁদো। মানুষের জীবন কেন এমন থাকবে?
হাসতে গেলে বাঁধা, কাঁদতে গেলে বাঁধা। বাঁধা, বাঁধা, বাঁধা কেন এই বাঁধা? বলতে পারো?

সহসা থামল ইমন। মুসকানের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। অশ্রুসিক্ত মুখশ্রীতে নিক্ষেপ করল প্রগাঢ় চাহনি। ক্ষীণ স্বরে বলল,

– মুসকান, কষ্ট হচ্ছে? কাঁদতে চাও? আমায় আঁকড়ে ধরো। কাঁদো তুমি মন খুলে। সব ব্যথা প্রকাশ করে দাও আমার এই বুকে।

বলেই কয়েক কদম পিছিয়ে দু’হাত তুলে মুসকানের দিকে তার উন্মুক্ত বুক পেতে দিল। মুসকান আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। এভাবে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে বলেনি। ছোট্টবেলা থেকেই দুঃখ হলে, কষ্ট পেলে শান্তিতে মন খুলে কাঁদার জায়গাটুকু পায়নি সে। অথচ আজ ইমন তাকে সেই জায়গা করে দিয়েছে। সে কি না গিয়ে থাকতে পারে? কক্ষনো না। এই পৃথিবীতে যার তৃপ্তি সহকারে কাঁদার জায়গা নেই। তার মতো হতভাগিনী আর একজনও হতে পারে না। মুসকান আর এক মুহুর্ত দেরি করল না৷ আর না হাতছাড়া করল অনাকাঙ্ক্ষিত এই সুযোগটুকু৷ ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো ইমনের বুকে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। ইমন চুপিচুপি কানে কানে বলল,

– এত অবুঝ হলে চলে জান? রিতিশা আমার মায়ের বোনের মেয়ে। খালাত বোন সে আমার৷ সে জানে তুমি আমার মনের রানি৷ তাই মজা করেছে তোমার সাথে।

ভাঙা আওয়াজে অভিমান মিশিয়ে মুসকান বলল,

– আর ঐ ছবিটা?

– ওটা রিতিশাই আমার ফোন থেকে আপলোড করেছে। ছবিটাও জোর করে তোলা। ইমন চৌধুরী এক নারীতই আসক্ত মাই জান। আর সেই নারীটা তুমি৷

সমস্ত অভিমান এক নিমিষে দূর হয়ে গেল মুসকানের৷ বদ্ধ উন্মাদের মতো কাঁদতে লাগল সে আর বলতে লাগল,

– আপনি এতো ভালো কেন ছোটোসাহেব? আপনি আমায় এতো বোঝেন কেন? জানেন আমার খুব কষ্ট হয়েছে এ কয়েকদিন। বুকের ভেতর অদ্ভুত যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠেছে শুধু৷ আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে ছোটোসাহেব। আপনার সান্নিধ্য আমি খুব উপভোগ করি। আপনি যতক্ষন আমার আশপাশে থাকেন ততক্ষণ অদ্ভুত প্রশান্তি লাগে বুকের ভেতর। দূরে গেলে হাসফাস লাগে। কথা না বললে অশান্তিতে পাগল পাগল হয়ে যাই৷ আমি পারছি না, আপনাকে ছাড়া এক মুহুর্তও টিকতে পারছি না কী করব আমি কী করব?

হুহু করে কাঁদছে আর কথাগুলো বলছে মুসকান৷ দু’হাতে খামচে ধরেছে ইমনের পিঠ৷ বুকের বাঁপাশটা নোনাপানিতে সিক্ত করে তুলছে৷ ইমন কিছু বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল। মুসকানের শক্ত করে জড়িয়ে ধরা চোখ বুজে অনুভব করল সে৷ ক্রন্দনরত কণ্ঠ, কথা কানের ভিতর রেকর্ড করে নিল সে। হৃদয় গভীরে গেঁথে রইল প্রেয়সীর প্রতিটি কথা৷ ভালোবাসা সুন্দর তার চেয়েও বেশি সুন্দর ভালোবেসে দেয়া স্বীকারোক্তি।

– আমি আমার সারাটাজীবন আপনার নামে লিখে দিতে চাই ছোটোসাহেব। বিনিময়ে আপনি পুরোটাতেই চাই নিজের আধিপত্য।

বিস্মিত হলো ইমন। ঘাড় নিচু করে একটিবার দেখার চেষ্টা করল মুসকান নামক মায়াময়ী, তার মুগ্ধময়ীর মুখশ্রী। যে কথাগুলো শুনছে সে। যা শুনে তার কান দু’টো ধন্য হচ্ছে। সে কথাগুলো যে মুখ দিয়ে বলছে সেই মুখটি একটাবার দেখার তৃষ্ণা হলো তার। নিজের চোখজোড়া ধন্য করতে মরিয়া হয়ে ওঠল খুব৷ কিন্তু মেয়েটা এতটাই আবেগি হয়ে পড়েছে যে মুখ গুঁজে উন্মাদের মতো কাঁদছে। ফোঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইমন৷ দু’হাতে আগলে মুসকানের মুখ উঁচু করল। পুরুষালি উষ্ণ হাতের তলায় ঢাকা পড়ল মেয়েটির ভেজা নরম কপোলদ্বয়। আচমকা ইমনের হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। যখন দেখল মুসকানের ওষ্ঠদ্বয় কাঁপছে। খেয়াল করল শুধু ওষ্ঠ জোড়া নয় লম্বাটে দেহখানিও কাঁপতে কাঁপতে মিইয়ে পড়ছে। শরীরে কাঁ’টা দিয়ে ওঠল ইমনের৷ ভালোবাসার মানুষটির এহেন অবস্থায় বক্ষঃস্থলে তীব্র আন্দোলন শুরু হলো। যেই আন্দোলনে ভাটা দিতে, প্রিয়তমার অশ্রুসিক্ত মুখে, কম্পিত ওষ্ঠে সহসা ভালোবাসার শীতল স্পর্শ এঁটে দিল। কয়েক সেকেণ্ড অতিবাহিত হতেই যেন সংবিৎ ফিরে পেল মুসকান৷ যখন বুঝতে পারল তার সঙ্গে ঠিক কী ঘটছে শরীর জুড়ে যেন বিদ্যুতিক শখড লাগল। নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে টালমাটাল অবস্থা। সহসা চোখ মুখ খিঁচে দু’হাতে ইমনের বুকের পাটায় ধাক্কা দিল। কিন্তু কোনোভাবেই সরাতে সক্ষম হলো না। সে ক্ষণে ক্ষণে চেষ্টা করে গেল। কখনো দুর্বল চিত্তে মিইয়ে রইল৷ ইমন অদ্ভুত এক নেশায় যেন মত্ত রইল৷ দীর্ঘক্ষণ। এক সময় ক্ষ্যান্ত দিল সে। নরম অধর ছেড়ে চোখ মেলে তাকাল। দু’হাতে আঁকড়ে ধরা মুসকানের পিঠ আলগা করতে গিয়েও চট করে পুনরায় আগলে ধরল৷ সংবিৎ ফিরে পেল ইমন নিজেও। দু-চোখ খিঁচে আছে মুসকান। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায় নোনাপানি। ইমন ঢোক চিপল। অবাক হলো নিজের প্রতি৷ এসব কী হয়ে গেল! সে কীভাবে এতটা নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারল! মুসকান তাকে কী ভাবছে? মেয়েটা তাকে ভুল বুঝল না তো? বাড়াবাড়ি বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। মৃদুস্বরে বলল,

– ওহ শীট!

আচমকা হাত বাড়িয়ে মুসকানের আর্দ্র গালে এক হাত রাখল৷ থমথমে কণ্ঠে ডাকল,

– মুসকান?

মুসকান জবাব দিল না। সে একইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে। সর্বাঙ্গ কাঁপছে তার। তীব্র সে কাঁপুনি দেখে ইমনের বুকে ভয় জমল। অপরাধ বোধে দিশেহারা হয়ে গেল সে। ধাতস্থ হয়ে দু-হাত আগলে ধরল মেয়েটাকে। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসল। কাঁধ চেপে ধরল একহাতে। অন্যহাত গালে রেখে মৃদুস্বরে ডাকল,

– মুসকান, মুসকান। ঠিক আছ? মুসকান।

মুসকান চোখ খুলল না। ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়ল শুধু। দীর্ঘক্ষণ ওভাবেই বসে রইল ইমন৷ অপরাধী চোখে তাকিয়ে রইল মুসকানের মুখশ্রীতে। ভেজা চোখের জড়ো হয়ে থাকা পাপড়িগুলো দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কিছুক্ষণ পূর্বের করা ওষ্ঠ চুম্বনের কথা মনে পড়তেই নরম ভেজা ওষ্ঠে সুক্ষ্ম চোখে তাকাল। পাতলা মসৃণ ঐ ওষ্ঠ জোড়ায় এতক্ষণ চুমুর বর্ষণ নামিয়েছে সে! এতকাল যা থেকে নিজেকে কঠিন ভাবে সামলেছে আজ হুট করে এভাবে হামলেও পড়ল! অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!

চলবে…
®জান্নাতুল নাঈমা

#চিত্তবৃত্তি
#পর্ব_১১

প্রথম প্রেমের প্রথম স্পর্শে মাতোয়ারা মুসকান। ইমন পাশে বসে অনুভব করল সেই মত্ততা। হৃদয় জুড়ে হাতছানি দিল অবাধ্য ইচ্ছেরা। সেই উষ্ণ ইচ্ছে গুলোকে দমিয়ে নিল সে। প্রেয়সীর শরীর জড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে নিল আলগোছে। কিঞ্চিৎ দূরে সরে রুদ্ধশ্বাসে বলল,

– মুসকান, আজ রাতে এখানে খেয়ে যাব। তুমি কি রান্না করতে পারবে?

এ মুহুর্তে মুসকানকে স্বাভাবিক করা প্রয়োজন। যার ফলে এমন একটি আবদারই সে করল৷ এতেই কাজ হলো৷ অচেনা ঘোর থেকে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে এলো মুসকান। আলতো চোখে তাকাল ইমনের দিকে। তীব্র লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে তৎক্ষনাৎ আবারো চোখ বুজে ফেলল। এহেন দৃশ্যে বেসামাল হয়ে পড়ল ইমনের হৃৎস্পন্দন। এমনিতেই নিজেকে উন্মাদ লাগছে। আরো একটু উন্মাদনায় লিপ্ত হতে দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলছে তীব্র আন্দোলন। মুসকান যদি এই রূপেই পাশে থাকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে৷ ঢোক গিলল সে৷ নীরস গলাটা ভিজিয়ে নিল কিঞ্চিৎ। এরপর আচমকাই ওঠে দাঁড়াল। মুসকানকে
লজ্জা কাটিয়ে স্বাভাবিক গতিতে ফিরতে দিয়ে চলে গেল রুম থেকে। অনেকটা সময় একাকী কাটাল মুসকান৷ সকল আড়ষ্টতা কাটিয়ে এক সময় স্বাভাবিক হলো। রান্নাঘরে গিয়ে শুরু করল রান্নার তোড়জোড়। যে মহিলাটি রান্নার দায়িত্বে আছেন। তার নাম রাহিমা খাতুন। সে বসে সবজি কাটছিল। মুসকানকে রান্নাঘরে দেখে জিজ্ঞেস করল,

– কর্তাদাদা কবে আইব আফা?

মুসকান শান্তশিষ্ট ভাবে ফ্রিজ থেকে মুরগির মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখল। রাহিমা খালাকে বলল,

– আরো কয়েকদিন পর আসবে। খালা, আজ আমি রান্না করব।

– তুমি রাঁনবা?

অবাক হলো খালা। মুসকান বলল,

– হ্যাঁ সবজি গুলো কেটে তুমি আরাম করো। আমি বাকিটা করে নেব।

সবজি কেটে, হাতের কাছে সব রেখে খালা বাচ্চাদের ঘর ঝাড়ু দিতে গেল। ইমন তখন বাচ্চাদের পড়তে বসিয়েছিল। খালা কথায় কথায় জানালো, মুসকান রান্না করছে। এটি শুনে বাচ্চাদের পড়তে বলে সে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। তাকিয়ে দেখতে লাগল মুসকানের গতিবিধি। লম্বাটে দেহখানি সাবলীল ভাবে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে। একমনে গরম কড়াইয়ে তেল ঢালছে। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, মুভিতে নায়িকারা যখন রান্না করে তাদের অবাধ্য চুল সামনে চলে আসে। পরনের ওড়না বাঁধা থাকে কোটিদেশে।
অথচ মুসকান আলাদা। তার অবাধ্য চুল তাকে বিরক্ত করছে না। ঘন, লম্বা সিলকি চুলগুলো কী সুন্দর পরিপাটি করে বাঁধা। পিঠ বেয়ে কোমড় পেরিয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই করছে। ওড়নায় মাথা, পিঠ ঢাকা। কোমর থেকে হাঁটু অবধি চুলগুলো ঠিকই দৃশ্যমান। ইমন দুচোখ ভরে দেখল। বেগুনি রঙের ওড়নায় আবৃত তার মনের মানুষটিকে দেখল। একমনে, মোহময় দুই চোখে অপলকে দেখেই চলল। তার সেই ঘোর দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটল হঠাৎ। মুসকান মশলা কষাতে শুরু করায় নাকে, মুখে ঝাঁজ লেগে কেশে ওঠল সে৷ আচমকা কাশির শব্দ পেয়ে চমকে ওঠল মুসকান। ঘাড় ফিরিয়ে মশলার ঝাঁজে ইমনের করুণ অবস্থা দেখে বুকের গহীনে চিড়িক দিল তার। মায়ায় টনটন করে ওঠল বক্ষঃস্থল। ত্বরিত অল্প পানি কড়াইয়ে ঢেলে ঢাকনা চাপিয়ে দিল৷ অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোলায়েম সুরে বলল,

– কিছু লাগলে বলুন। আপনি ওদিকে যান। আমি নিয়ে আসছি৷

দুবার হাঁচি দিল ইমন। মৃদু হেসে এগুতে এগুতে বলল,

– দাদুভাই নেই। মস্ত বড়ো সুযোগ।

ঢোক গিলল মুসকান। ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে বলল,

– সুযোগ! কীসের সুযোগ।

ইমন সহসা তার ওড়নার এককোনা টেনে চোখ মুছল। মশলার ঝাঁজে জল এসে গেছে। মুসকানের অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করল। কতটা অধিকার বোধ থেকে একজন মানুষ এভাবে ওড়না টেনে চোখ মুছতে পারে! শরীরটা শিরশির করতে লাগল তার। ইমন ওড়না ছেড়ে একপাশের দেয়ালে হেলান দিল৷ দু-হাত সন্তর্পণে পকেটে গুঁজে বলল,

– তোমাকে প্রাণভরে দেখার।

কথাটা বলেই দুষ্টু হাসল ইমন৷ লজ্জায় গাল দুটো রক্তিম হয়ে ওঠল মুসকানের। মুখ ফিরিয়ে রান্নায় মন দিল সে৷ ইমন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে লাগল তাকে৷ একদিকে তীব্র ভালোলাগায় হৃদয় ছেঁয়ে গেল তো অপরদিকে তীব্র লজ্জায় মরিমরি অবস্থা। ইমন টের পেল সমস্তটাই। তবুও মোহময় এই দৃশ্য থেকে লোভ সামলাতে পারল না। সে অনুভব করল, রান্না করার সময়ও নারীদের মুখশ্রীতে অন্যরকম এক সৌন্দর্য ভর করে। সত্যি তো এটাই নারীদের আশপাশে তাদের মনের পুরুষ থাকলে এমনিতেই সৌন্দর্য বেড়ে যায়।

রান্না শেষ করে রাহিমা খালার সাহায্যে বাচ্চাদের খাবার বেড়ে দিল মুসকান। ইমনকেও বসতে বলা হলো কিন্তু সে বসল না৷ সে রান্না ঘরে ঘুরঘুর করতে লাগল৷ হঠাৎ মনে পড়ল বাচ্চাদের জন্য সালাদ কাটা হয়নি৷ তাই সে নিজেই ছুরির সাহায্যে সালাদ কাটল। প্লেটে সালাদ রেখে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে হঠাৎ থেমে গেল সে। পিছিয়ে গিয়ে প্লেট রেখে বা হাতে ছুরি নিল। এরপর ছুরির আগাটা চেপে ধরল ডান হাতের বুড়ো আঙুলে। মুহুর্তেই ছ্যাঁৎ করে ওঠল বুক। বুড়ো আঙুলের মাথা দিয়ে ছলকে রক্ত বেরোতে শুরু করল৷ দাঁতে দাঁত পিষে সহ্য করে নিল যন্ত্রণা। চোখ বুজে গভীর শ্বাস ছাড়ল। এক মুহুর্তে নিজেকে কোনো এক ষোল বছরের কিশোর মনে হলো৷ যে কিনা তার বয়সী কোনো এক কিশোরীর প্রেমে মজে হাত কাটছে! পার্থক্য এটাই তারা কাটে ছ্যাঁকা খেয়ে। আর সে কাটল প্রিয়তমার গভীর আদর, যত্ন পাওয়ার লোভে।

– মুসকান!

আচমকা ইমনের চিৎকার সূচক ডাক শুনে চমকাল সে। ছুটে রান্নাঘরে এসে দেখল, ডানহাতটা রক্তাক্ত! দিকবিদিকশুন্য হয়ে সেও চিৎকার দিয়ে ওঠল,

– ছোটোসাহেব! কীভাবে হলো এটা?

কাঁদো কাঁদো মুখে কাছে এলো মেয়েটা। রক্তাক্ত হাতটা দু’হাতে আগলে নিল। নিমিষেই চোখ উপচে জল গড়াতে লাগল তার৷ সে জল দেখে ইমন হকচকিয়ে গেল। বিড়বিড়িয়ে বলল,

– কী মুশকিল! কাঁদছে কেন? কাঁদিয়ে ফেললাম!

মুসকান পুনরায় আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,

– কী করে হলো? আমারি ভুল, কেন আমি এলাম না। খালা, ও খালা তাড়াতাড়ি আসুন।

– মুসকান, মুসকান কুল। কাম্ ডাউন।

মুসকান সে কথা শুনল না৷ থামল না কিছুতেই৷ রাহিমা খালা ছুটে এলো৷ কান্না শুনে বাচ্চারা খাবার ছেড়ে চলে এসেছে৷ সুমা গিয়ে এন্টিসেপটিক ক্রিম এনে দিল। মুসকান নাক টানতে টানতে হাতে ক্রিম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। ইমন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুসকানের দিকে। তার একটু লোভের জন্য মেয়েটা কতটুকু কষ্ট পেল। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নরম স্বরে ডাকল,

– মুসকান?

মুসকান তাকাল। ইমন বাচ্চাদের চলে যেতে বলল। রাহিমা খালাও সালাদ নিয়ে আফসোস করতে করতে বেরিয়ে গেল৷ মুসকান তাকিয়ে আছে। ইমন কিছু বলবে তাকে সেই অপেক্ষায়৷ সবাই চলে যেতেই ইমন থমকানো স্বরে বলল,

– সরি।

উতলা হয়ে মুসকান বলল,

– আপনি সরি বলছেন কেন? সরি তো আমার বলা উচিৎ। আমার বোঝা উচিৎ ছিল আপনি এসব কখনো করেননি। আমি নিজেকে কক্ষণো ক্ষমা করতে পারব না৷

ইমনের এবার ভীষণ খারাপ লাগল। সে বলতে চাইল,

– তোমার কোনো দোষ নেই। বরং আমিই লোভী। তোমার হাতে খাবার জন্য এই বদমায়েশিটা করেছি আমি।

কিন্তু বলার পর প্রতিক্রিয়া কী হবে? সেই দুঃশ্চিন্তায় আর বলল না। তবে যেই লোভে এমন ঘটনা ঘটাল তা ঠিকই পূরণ হলো। খেতে বসার পর ইমন কীভাবে খাবে? এই চিন্তায় দিশেহারা হয়ে মুসকান ম্লান মুখে বলল,

– আমি আপনাকে খাইয়ে দিই?

ইমনের হৃদয় জুড়ে সুখের দুলুনি দিয়ে ওঠল৷ তবুও মুখে কপট গম্ভীরতা এনে বলল,

– খাইয়ে দেবে? হ্যাঁ দাও। তোমার অসুবিধা না থাকলে দাও। নয়তো আজ না খেয়েই কাটাতে হবে।

মুসকান আর দেরি করল না। খুব যত্ন নিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে শুরু করল। অপলকভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগল, ঠিক কতটা যত্ন নিয়ে, কতটা ভালোবাসা নিয়ে মেয়েটা তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এক মুহুর্তের মধ্যে সে ছোটোবেলায় চলে গেল। মায়ের যত্নটা ঠিক পাওয়া হয়নি। একদম শিশুকালে মা মারা গিয়েছে। দাদি বেঁচে থাকাকালীন যতটুকু যত্ন পেয়েছে। মারা যাওয়ার পর যত্ন ঠিক ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। সৎ মা তাকে যত্ন করতে চেয়েছে কিন্তু সে সেই যত্নের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিল। নিজেকে অতি অল্প বয়সেই অনেকটা বড়ো করে ফেলেছিল। নিজের কাজ নিজে করাটাই তার বেশি পছন্দনীয় ছিল। তাছাড়া সে ছোটোবেলা থেকেই ভীষণ বোঝদার ছেলে। মা হারা সন্তানরা একটু বেশিই বোঝদার হয়। সেও ছিল৷ তাই সৎ মায়ের থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে। সে বিশ্বাস করে এই দূরত্বটার জন্যই তাদের মধ্যকার সম্পর্কটি ঠিকঠাক রয়েছে। কোনো প্রকার তিক্ত অনুভূতির সৃষ্টি হয়নি। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল ইমন৷ অনমনেই মুসকানের হাতে কামড় দিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গেই হাত সরিয়ে নিল মুসকান। বুঝল ইচ্ছেকৃত নয়। ইমন মৃদু হেসে বলল,

– পেট ভরে গেছে৷ এবার তুমি খেয়ে নাও।

মুসকান প্রতিবাদ করে বলল,

– উহুম শেষ হয়নি। আপনি এত অল্প খাননা আমি জানি।

ইমন মাথা দুলিয়ে হাসল৷ পেট ভরেই খাবার খেল সে৷ মুসকান হাত না ধুয়ে এক প্লেটেই নিজের খাবার বাড়ল। এই ব্যাপারটা একটু বেশিই হৃদয় কাড়ল ইমনের৷ তাই সে ওঠে যাওয়ার পূর্বে চট করে মুসকানের গালে চুমু এঁটে দিল। স্তব্ধ মুসকান মুখে খাবার পুরে বসে রইল। বিস্ময় চোখ স্থির রাখল সম্মুখে। গাল দুটো রঙিন হলো আচমকা। হৃদয়ে দুলুনি খেল একটিই প্রশ্ন আজ কী হচ্ছে এসব?
.
.
ইমনের হাত কাটা যতদিন থাকল। আর যতদিন দাদুভাই আশ্রমে না এলো ততদিন ইমন তিনবেলা আশ্রমে খেতে এলো। মুসকান নিজ হাতে যত্ন নিয়ে খাইয়ে দিল তাকে৷ ইমন খেয়াল করল এ কয়েকদিনে তাদের সম্পর্কে গভীরতা বেড়েছে।
.
.
দাদুভাই ফিরে এলেন। নিয়মানুযায়ী সবাই সবার কাজে ব্যস্ত রইল৷ ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সময়৷ ইমনের স্কুল থেকে শিক্ষাসফর যাওয়া হবে। মুসকান ক্লাস শেষ করে বেরিয়েই দেখল ইমন দাঁড়িয়ে। কাছাকাছি হতেই একসঙ্গে হাঁটতে লাগল দু’জন। আজ ইমন বাইক আনেনি৷ সে অফার করল,

– ফুচকা খাবে?

মুসকান আড়চোখে তাকাল। ফুচকা খাওয়া পছন্দ করে না ইমন৷ হঠাৎ করে ফুচকা অফার করছে? মতলব কী? তার ঐ আড় চাহনিতে বাঁকা হাসল ইমন। বলল,

– স্কুল থেকে শিক্ষাসফর যাব। দুদিন দেখা হবে না।

সহসা মুখ ভার হলো মুসকানের। ইমন তাকে এজন্যই ঘু’ষ দিচ্ছে। এই ঘু’ষ কি তার দু’দিনের ছটফটানি কমাতে পারবে? সেই যে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিল৷ আর তো কিছুই বলে না৷ বাবার সাথে কথা বলেছে কিনা সেটা নিয়েও কথা বলে না। সে এখন চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইমন তাকে বিয়ে করুক৷ যতটা চেনার প্রয়োজন ছিল চিনেছে সে। যতটা জানার প্রয়োজন ছিল জেনে নিয়েছে। এবার বউয়ের স্বীকৃতি চায় সে। মুখ ফুটে এটা বলতে পারছে না ঠিকই। কিন্তু মন তো আর মানছে না। এমনিতে ইমন সব বুঝে নেয়। কিন্তু ব্যাপারটা কেন বুঝছে না?

ফুচকার দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা৷ মুসকানকে আনমনে দেখে ইমন বলল,

– কী ভাবছ এত?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসকান। মৃদু হেসে বলল,

– দুদিন দেখা হবে না তাই।

ইমন ফুচকা অর্ডার করে কাছে এলো। বলল,

– ফোন করব।

সহসা মুসকান খেয়াল করল ইমনের চুলে হলুদ রঙের কিছু একটা লেগেছে৷ তাই হাত বাড়িয়ে ঝেড়ে দিতে লাগল সে। ঠিক সেই মুহুর্তেই রাস্তায় একটি প্রাইভেট কার থেমে গেল৷ ওরা খেয়াল না করলেও গাড়ির ভেতরে থাকা মোজাম্মেল চৌধুরী চোয়াল শক্ত করে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ আচমকা চোখ বুজে বিড়বিড়িয়ে বললেন,

– সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ! আমার একমাত্র ছেলের এই অধঃপতন! উফফ ইরা তুমি বেঁচে থাকলে এসব কিছুতেই হতো না। যে ছেলের মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিসিএস দেয়ার কথা। পিএইচডির জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার কথা। সেই ছেলে এখন সামান্য স্কুল টিচার হয়ে এক ফকিন্নির সঙ্গে রাস্তার ধারে ফুচকা খাচ্ছে!

আচমকা চোখ খুললেন তিনি। পুনরায় বললেন,

– না না এ হতে পারে না। আমার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যত এই মেয়ের জন্য নষ্ট হতে পারে না। এবার যা করার আমাকেই করতে হবে৷ তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করব ইরা৷ তুমি যা চাইতে ঠিক তাই হবে। আমি বেঁচে থাকতে ইমনকে ধ্বংস হতে দিব না। ওর সব ভুল শুধরে দিয়ে নিজ হাতে ওর ভবিষ্যত গড়ে দেব।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here