তুমি অতঃপর তুমিই
৩৬
অন্তিম পর্ব (১ম অংশ)
Taniya Sheikh
বাহিরে ঝড় ভেতরও যে কম, তা নয়। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। এলোমেলো বাতাসে চারপাশটা ধুলোময়। গাছের শাখে শাখে লেগেছে ঝড়ো হাওয়ার তাল। রাস্তায় মানুষ আছে তবে গতি নেই তাদের চলার। সম্মুখে অতর্কিতে ধেয়ে আসা প্রবল বাতাসকে উপেক্ষা করার মতো বোকা তারা নয়। নিরাপদ স্থানে তাই ঠাঁই নিয়েছে। সেই সচেতন মানুষগুলোর দৃষ্টি পাগলপ্রায় ছুটোছুটি করা একটা মানুষের দিকে। রাস্তার হাঁটুসমান পানির নিচে গাড়ি আঁটকে যাওয়ায় বেচারা আহত শরীর নিয়ে গাড়ি ঠেলছে। এক হাতে কিছুতেই গাড়ি নড়াতে পারল না দেখে বৃষ্টির জলে ভিজে এদিক ওদিক সাহায্যে জন্য তাকায়। উৎসুক জনতা সেটা বুঝেও চুপ করে রইল। তবে কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে বলল,
” শীঘ্রই ছাউনির নিচে আসুন,ভাই।”
” আপনি গাড়িটা ধাক্কা দিতে পারবেন? প্লিজ আসুন।” এতটুকু বলতেই শানের কণ্ঠস্বর কয়েকবার থমকে থমকে গেল। ওর চোখের জল এই বারিধারায় ঢেকে যায়। সামনের লোকগুলো জানে এই লোক বিপদে পড়েছে কিন্তু তাদেরই বা কী তাতে! তারাও তো এই ঝড়ের কবলে পড়ে অসহায়। শান আরও কয়েকবার অনুরোধ করল। বলল,
” দেখুন আমার ইমার্জেন্সি। একটু যদি গাড়িটা ধাক্কা দিতেন!”
” আরে মিয়া, দেখতাছো না কী ঝড় উঠছে? আর তুমি আছ গাড়ি ঠেলন লইয়া।” লোকটার কথা শেষ হতে না হতেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল অদূরে। বাজটা পড়ল বিদ্যুতের খুঁটির উপর। তার ছিড়ে ঝুলে পড়তেই সেখান থেকে হুশিয়ারী দিল লোকেরা,
” ঐ মিয়ারা,পানিতে নাইমো না। তার ছিঁড়ে ঝুলে পড়ছে। বাতাসের তোড়ে পানিতে পড়ল বইলা। আরে রাস্তার পানি থেইক্যা ওঠেন,ওঠেন।” যে দুই গাড়ির ড্রাইভার তখনো বসেছিল গাড়িতে- তড়িৎ গতিতে নেমে উপরে এলো তারাও। শান উঠল না দেখে মুরুব্বি গোছের একজন আরেকটি যুবক ছেলেকে নিয়ে টেনে উপরে উঠায়। শানকে বোঝায়
পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয়। যত ইমার্জেন্সিই থাক ঝড় না থামা পর্যন্ত কিছুই করার নেই৷ শান তাদের বুঝাতে চেষ্টা করল। সবাই বুঝল কিন্তু সান্ত্বনা ছাড়া তাদের কাছে আর কিছুই ছিল সেই মুহূর্তে। একটুপর খবর এলো সামনে খুঁটি ভেঙে রাস্তার মাঝে পড়েছে। গাড়ি যাবে না আপাতত। শান এভাবে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে পারবে না। কে জানে ইমা কী অবস্থায় আছে! তাছাড়া পুলিশের নজরেও তো পড়া যাবে না এই সময়। গতকাল হুশ ফেরার পর শান অস্থির হয়ে ওঠে। ইমরোজ, আহসান সাহেব ওকে মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে বললে, শানের মনে সন্দেহ জন্মে সামিরাকে নিয়ে। ইমার নিখোঁজে দিশেহারা হয়ে সব ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ সে মোবারককে কল করে ডেকে আনে। মোবারক শানের ডান হাত প্লাস্টার করা, মাথায় ব্যাণ্ডেজ করা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে। ও কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই শান বলে,
” তুই আমাকে বলেছিলি গতকাল রাতের পর সামিরা বাসা থেকে বেরোয়নি, রাইট?”
” হ্যাঁ।” মোবারক ঘাড় নাড়িয়ে বলে। ইমা সেই রাতে বাসায় আসার পরপরই মোবারককে সামিরার উপর নজর রাখার জন্য পাঠায় শান।
” তুই ভালো করে ভেবে বল। হয়তো তুই কোথাও গিয়েছিলি, খেতে,বাথরুমে অথবা অন্য প্রয়োজনে। তখন হয়তো বের হতে পারে।” শান বলল।
” প্রশ্নই ওঠে না। আমি আমার প্রয়োজনীয় কাজের সময় লোক সেখানে দাঁড় করিয়ে তবেই গিয়েছিলাম। কিন্তু এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন? আর আপনার এই অবস্থা কী করে হলো?”
” মোবারক, আমি ইমাকে পাচ্ছিনা রে।” শান অসহায় চোখে চেয়ে বলে। চোখ দু’টো জলে ভরে গেছে। মোবারক শঙ্কিত হয়ে বলে,
” কি বলছেন? কখন? কিভাবে হলো?”
” তোর সাথে দেখা করে আসার পরই ওকে আমি বাসায় পাইনি। এসে দেখি সব কিছু সাজানো -গোছানো কেবল ইমাই নেই।” শান সব খুলে বলতেই মোবারক কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর আর্ত কণ্ঠে বলে,
” স্যার, আমি আপনাকে তখন একটা কথা বলিনি।”
” কী?”
” সামিরাকে বাসা থেকে বেরোতে না দেখলেও বজলু বাইরে গিয়েছিল। আপনি চলে যাওয়ার ঘণ্টা খানেক বাদেই সে ফিরে আসে।”
” তুই আমাকে আগে কেন বলিসনি?”
” আমি জানতাম না তখন। যেই ছেলেটা আমার সাথে ছিল ও পরে বলে। সরি স্যার।” মোবারক নত মাথায় প্রায় কেঁদেই ফেলল। শান আর সময় নষ্ট না করে অসুস্থ শরীরে বেরিয়ে পড়ে ডাক্তার, ইমরোজসহ বাকিদের বাধা অগ্রাহ্য করে। সেখান থেকে বেরোনোর পরই বাইরে ঝড় ওঠে। রাস্তায় জ্যামে আঁটকে গাড়িতে থাকা অবস্থায় মোবারক কল করে জানায়, ইমরোজ অ্যারেস্ট হয়েছে। জোর করে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ানোয় সামিরা ওদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। শানকে পুলিশ খুঁজছে। শান মহাবিপদে পড়ল। ক্রমেই ওর সামনে স্পষ্ট হলো সামিরার প্লান। সামিরা ইচ্ছে করে কেঁদে কেঁদে গতকাল সব বলেছিল। নেশায় মাতাল হওয়াটা ছিল ওর নাটক। শানের এখন দৃঢ় বিশ্বাস ইমার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে সামিরা দায়ী। কিন্তু এতোক্ষণে কেন বুঝল ও! কেন আগেই এসব বুঝল না? নিজের উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ শান। সকল ভয়, ডর উপেক্ষা করে সামিরার বাসা উদ্দেশ্য রওনা হলো। পথিমধ্যে ভারী বর্ষণ আর ঝড়ের কবলে পড়ে তাকে আরো একবার হতে হলো বাধার সম্মুখীন। মোবারক সাবধান করে দেয় শানকে। পুলিশের হাতে পড়লে ইমাকে খুঁজে পাবে না সে। সুতরাং যা করতে হবে ভেবেচিন্তে, ঠাণ্ডা মাথায়। অস্থির হওয়া যাবে না। তাহলে আবার ভুল করে বসবে। হেঁটে হেঁটে ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে এগোতে লাগল। রাস্তা অনেকটা নির্জন। দোকানপাটে সাটার লাগানো। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাওয়ায় দিনরাতের পার্থক্য করা যাচ্ছে না। আহত শরীরখানা নিয়ে অনেকদূর হাঁটায় ব্যথায় টনটন করছে হাড়। তবুও থামে না শান। মাথার ব্যাণ্ডেজ একটু একটু করে রক্তে লাল হয়ে বৃষ্টিতে ভিজে কপাল চুয়ে পড়ে সেই পানি। প্রয়োজনে ব্যথাতুর হাতটাও কাজ করতে বাধ্য হয়। ইমার চিন্তায় সব ব্যথা ভোলে শান। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে খান প্যালেসের অদূরে। বাইরে পুলিশ পাহারা। আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু লক্ষ্য করছে শান। এদিকে সব আবাসিক এলাকা। গা ঢাকা দেবার জায়গা খুব কম। তার উপর সবাই শানকে চেনে। পরিবেশ বৈরি বলে কাওকে দেখা যাচ্ছে না বাইরে। কিন্তু এভাবে এদিকে থাকাটা নিরাপদ নয়। শান কোনোমতে লুকিয়ে খান প্যালেসের দক্ষিণ দিকের নির্মাণাধীন একটি বিল্ডিং-এর নিচে গিয়ে লুকায়। মোবারক বলেছে সামিরা পরশু’র পর থেকে বাসাতেই আছে। বজলুকেও আর বাইরে বেরোতে দেখা যায়নি। শানের কেন যেন এখন মনে হচ্ছে ইমা খান প্যালেসের কোথাও আছে। ঝড় থেমে গেছে। বৃষ্টিও ঝিরিঝিরি পড়ছে। দূর্বল শরীর একটু জিরোতে চায়। শান সেসব গ্রাহ্য করে না। দু-কদম এগিয়ে যেতেই মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যায় ভাঙা ইটের খোয়ার স্তুপের উপর। পিঠে গেঁথে গেঁথে যায় খোয়ার টুকরো। ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে শান। ঝাপসা হয়ে আসে চোখের সামনে। ধীরে ধীরে সমস্ত শরীর অবশ হয়ে পড়ে।
আস্তে আস্তে চোখ মেলে ইমা। দৃষ্টির সামনে এখনো ঝাপসা। বোঝার চেষ্টা করে নিজের অবস্থা। ঘুম থেকে ওঠার পর শানের চিরকুট পায় ইমা। নির্ঘুম, দুশ্চিন্তা কয়েকরাত পার করে এই দুই রাত ভালো ঘুম হয়েছে ওর। শরীরটাও চাঙা লাগছে। বিছানা গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে আসতেই কলিং বেল বেজে ওঠে। শান এসেছে ভেবে চেক না করেই দরজা খুলে দেয়। শান ছিল না, কে ছিল সেটা বোঝার পূর্বেই জ্ঞান হারায় তখন ইমা। সব মনে পড়তেই ভয়ার্ত চোখে তাকায় চারিদিকে। দুর্গন্ধময় একটা জায়গায় ফেলে ওকে বেঁধে রাখা হয়েছে। চারপাশে মলমূত্র সহ মড়া পঁচা জীবের,খাবারের উৎকট গন্ধ। গা গুলিয়ে আসে ইমার। পেট মুচড়ে বমি চলে আসে৷ গড়গড় করে বমি করে দেয়। নিজের গায়ের উপরই পড়ল সেটা। এমনভাবে বেঁধে শুয়ে রাখা হয়েছে যে, উঠে বসতে পারছে না। নড়তে গেলেই পেটে চাপ লাগছে। ব্যথায় চোখ-মুখ খিঁচে শক্ত হয়ে যায় ইমার।ভয় হচ্ছে আশেপাশে তাকিয়ে। স্বল্প আলোয় ভূতুড়ে ঠেকছে এই স্থান। হঠাৎ কানের কাছে কিছু খচখচ করতেই চেঁচিয়ে ওঠে ইমা। ব্যথায় চিৎকার করে সরে যায়। একটা বড়ো তেলাপোকা। ইমা হুশ,হুশ করেও সেটাকে দূরে সরাতে পারেনা। একটুপর এমনিতেই পালিয়ে যায় তেলাপোকা৷ ইমা চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়ে। সব গন্ধের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে বমির গন্ধ। দাঁত কামড়ে ভেজা ফ্লোরে নাক ঠেসে রইল। কী বিশ্রি গন্ধ এখনো পাচ্ছে৷ কিন্তু কতক্ষণ এভাবে থাকবে আর! এই শরীরে বেশিক্ষণ একস্থানে একইভাবে থাকা কষ্টের। ইমা সোজা হয়ে শুতেই ফের ব্যথা পায়। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এরচেয়ে মৃত্যুও বুঝি উত্তম। মুখ খুললেই বমি আসে। অভুক্ত ইমার বমিও ঠিকমতো বের হয়না৷ ঐ ওয়াক টানেই পেটের নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে আসছে চায়। ইমা নিজেকে নিয়ে ভয় পায়না৷ ওর যতো ভয় পেটের সন্তানটাকে নিয়ে। নিজের অজান্তেই একটাকে হারিয়েছে। এটাকে হারাতে চায়না আবার। একজন অসহায় মা সন্তানের জীবনাশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়ে। চিৎকার করে বলে,
” আমাকে যা খুশি করো কিন্তু আমার পেটের সন্তানকে মেরো না।সামিরা, আমি জানি তুমি শুনছ আমাকে। তুমি তো শানকে চাও, তাই না? আমি তাই দিয়ে দেবো, একেবারে চলে যাবো। প্লিজ আমার বাচ্চাটাকে বাঁচতে দাও।”
ইমার কান্নার শব্দ বাড়তেই একটা হাসি এই বেসমেন্টের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়। ইমার কান্না ঢাকা পড়ে সেই হাসির জোরে। কারো নেমে আসার শব্দ শুনতে পায় ইমা। খট,খট। একটু পর একজন মানুষের ছায়া পড়ে সামনের দেয়ালে৷ হাড় কাঁপানো হাসি দেওয়া মানুষটার চেহারা ইমা দেখতে পায়। আগের মতো মানবীয় চেহারা নয়, এই অস্পষ্ট আলোয় ভয়ানক সেই চেহারা। চোখ দু’টোতে হিংস্রতা, দাঁত বের করা হাসিটা যেন কোন রক্তপিপাসু মানবীর। ইমার অবস্থা দেখে জিহ্বা উপরের তালুতে লাগিয়ে টাহ্ শব্দ করে আবার বেসমেন্ট কাঁপিয়ে হাসে। চারপাশের ক্ষুদ্র জীবও সে হাসিতে চমকে ওঠে। ওদের ছোটাছুটির শব্দে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। কয়েকটা মূষিক ইমার গায়ের উপর দিয়ে ছুটে পালাতেই ভয়ে চিৎকার করে ওঠে ইমা। তাই দেখে আরও হাসে সামিরা। ইমার চিৎকার থামতেই হাসি নিভে যায়। চারিদিকে নেমে আসে ছমছমে নীরবতা। ইমা আকুতি জানায় অনাগত বাচ্চার সুরক্ষার জন্য। না, কোনো প্রত্যুত্তর মেলে। ছায়া ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকে৷ ইমা কাঁদতে,কাঁদতে ফের আকুতি করতেই চিকন সুরে হাসতে হাসতে গুনগুন করে সামিরা৷ তারপর আবার সেই জুতার শব্দ খট,খট৷ ইমা কাঁদে আর আকুতি জানায়,
” আমাকে ছেড়ে দাও সামিরা। আমার সন্তানকে বাঁচতে দাও,প্লিজ,প্লিজ।”
” বাঁচতে দেবো! হ্যাঁ, দেবো তো। তোমার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গেলে যে অনেক ধৈর্য্য ধরতে হবে তোমাকে ইমা। ধরবে না ধৈর্য্য তুমি?” মায়াভরা কণ্ঠে বলতে বলতে ফের নেমে এলো নিচে সামিরা। এসে দাঁড়াল ইমার পেছনে।
” তুমি যা বলবে তাই করব,তাই করব আমি।” ইমা ঘুরে সোজা হয়ে উপরে তাকাতেই বরফ মেশানো এক বালতি পানি ওর মুখে উপর ঢেলে দেয় সামিরা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ইমার। শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। কিছুসময়ের জন্য নিস্তেজ হয়ে পড়ে ইমা। সামিরা পা দিয়ে ওর শরীরটা ঠেলা দেয় আর হাসে। ইমার নাকে,কানে পানি ঢুকে যাওয়ায় কষ্ট হয়। হাঁপানি রোগীর মতো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সামিরা হাতে তুড়ি বাজিয়ে বজলুকে ডাকতেই একটা চেয়ার নিয়ে দৌড়ে আসে বজলু। দু-পা দুদিকে ছড়িয়ে বসে সামিরা। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,
” তুই জানিস, তোর বোন ইরাটা বড়ো বেশি বোকা। ইজ্জত বাঁচাতে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। আহারে বেচারী!” সামিরা খিক করে হেসে চাপাস্বরে বলে,
” মরে ভালোই করেছে নয়তো ওর মৃত্যু তোরই মতো হতো, তিলে তিলে। কি যে মজা লাগে রে! পিস! পিস।” বলেই ইমার পিঠ বরাবর সজোরে লাথি দিতেই উপুড় হয়ে পড়ে ইমা। ব্যথায় শক্ত হয়ে যায় শরীর। ঐ অবস্থায় চুলের মুঠি ধরে টেনে বসায় ওকে সামিরা। ঝুঁকে ইমাকে নকল করে বলে,
” আমার বাচ্চাকে বাঁচতে দাও সামিরা!” সামিরার চোখ জ্বলে ওঠে,” তোর বাচ্চাকে বাঁচাব? প্রথমটাকে যেমন করে বাঁচিয়েছিলাম তেমন করে?” ইমা চমকে তাকায়। সামিরা বিস্মিত হওয়ার ভান ধরে বলে,
” হা! সব বলে দিলাম।” ফের খিকখিক করে হেসে ওঠে,
” আমার বালডাও ছিঁড়তে পারবি না তোরা। তোর শান নিজেকে কী ভাবে? জেমস বন্ড না শার্লক হোমস হুম? সামিরাকে জেলে পাঠাবে। হা,হা,হা৷ হোয়াট অ্যা জোকস।” ইমার চোয়াল চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
” শানকে আমি পেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও! ও আমাকে বার বার উপেক্ষা,তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। আমার জায়গায় তোকে বেছে নিয়েছে। তোকে! তোর মতো ছোটোলোকের মেয়েকে। কী আছে তোর মধ্যে যা আমার নেই,বল? আমি তোর চেয়ে বেশি শিক্ষিত,বেশি সুন্দরী। তবুও শান তোকে ভালোবাসে,পাগলের মতো ভালোবাসে। চার বছর ওর থেকে তোকে দূর করেও আমি শানকে পাইনি। সারাক্ষণ ইমা,ইমা। তুই শানকে দিবি? আমি কী ফকির রে? সামিরা ভিক্ষা নেয় না, দেয়ও না। দেয় শুধু মৃত্যু। বেচারী তোর মা,তোর ভাই,তোর বাপটাও আমারই কারনে মরল। মরল! না,না। আমিই তো মেরেছি। তোর মা’কে দিনের পর দিন মেন্টালি টর্চার করে,মাহিবকে উস্কে তোর ভাই,বাবাকে। তোর ঐ বাচ্চাটা, ওকেও তোর মা আমারই হুমকিতে নষ্ট করেছে। বেচারীর কী অনুনয়! নাতি,মেয়ে ব্লা,ব্লা। যেই আমি বললাম আমি তোকে আর শানকে মেরে ফেলব সেই এবর্শন পিল খাইয়ে তোর বাচ্চাটা মেরে দিল। হি! হি!” ইমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সামিরা। পাশে দানবীয় শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বজলু৷ ও হাসছে না। চোখ দু’টো পাথরের মূর্তির মতো স্থির। ইমার চোখ দিয়ে আর জল পড়ে না। হতবিহ্বল, শান্ত হয়ে উবু পড়ে আছে। সামিরা আবার বলে,
” বেচারা শান! পুলিশ খুঁজছে তোর শানকে। এসেছিল আমাকে জেলে পাঠাবে বলে! হা! হা! তোকে খুঁজতে, খুঁজতে বাড়ির পেছনের বিল্ডিংএ এসে পৌঁছেছে। ভালোয় হয়েছে তাই না বল? যে আমার হবে না তার অন্য কারো হওয়ার হক নেই, কারো না। আমি না পাওয়ার দুঃখে শোক করব আর তোরা হেসেখেলে সংসার করবি? কোনোদিন না।” সামিরা পা তুলে ইমার কোমর বরাবর লাথি দিতে গিয়েও দেয়না৷ ভয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলে ইমা। হঠাৎ কী এক বিকৃত বুদ্ধি আঁটে সামিরা। বজলুকে ইশারায় ডেকে ইমাকে টেনে দাঁড় করায়। প্রথম প্রথম ইমা দাঁড়াতে পারছিল না। শেষে বজলুর প্রসস্থ বুকে গা লাগিয়ে দাঁড় করায় ইমাকে৷ সামিরা ওদের দুজনের দিকে ঘুরতে ঘুরতে মুচকি হাসে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বলে,
” বজলু, রেপ।”
চমকে তাকায় ইমা। বজলুর ভাবগতিক বোঝার উপায় নেই। ইমার শরীরের রগে রগে টান ধরে। ঝটকা দিয়ে বজলুর শরীর থেকে দূরে সরে। সামিরার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
” ছি! তুই মানুষ! নারীর আদলে গড়া এক ডায়নি,পিশাচী। ভুল হয়েছে আমি আমার সন্তানের প্রানভিক্ষা চেয়েছি তোর কাছে। তুই কী আমায় প্রাণ ভিক্ষা দিবি? তোর মতো নিকৃষ্টের মুখে থু দেই।” একদলা থু সামিরার মুখে নিক্ষেপ করে ইমা। রাগে গজগজ করে ওঠে সামিরা। বজলুকে আদেশ করে এখন,এই মুহূর্তে ইমাকে শেষ করতে তবে তার আগে বিবস্ত্র করতে বলে। পৈশাচিক হাসি ওর ঠোঁটের কোনে। সেটা অচিরেই ম্লান হয়ে যায় বজলুর নির্লিপ্ততায়।
” বজলু, আমি আদেশ করেছি তোমাকে। বিবস্ত্র কর ওকে।”
মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে বজলু। সামিরা রাগে ক্ষিপ্র হয়ে চড়াও হয় ওর উপর। পড়ে থাকা পুরাতন রড দিয়ে মাথায় বাড়ি দিতেই মাথা ধরে ফ্লোরে বসে পড়ে বজলু। আঘাত বেশ লাগলেও এই দানবের কাছে সেটা সেটা সামান্য। বজলু খুন করতে পারে কিন্তু একজন গর্ভবতীর শ্লীলতাহানি করার মতো নিকৃষ্ট সে নয়। তারও ঘরে পোয়াতি বউ। ইমার কষ্ট দেখে বার বার বউটার চেহারা ভেসে ওঠে। নিষ্ঠুর,পাষাণও গলে যায় ইমার করুন দশা দেখে। গলে না কেবল সামিরার মন। বজলুকে আহত করে সে ইমার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই প্রচণ্ড জোরে মাথায় আঘাত পায়। ছিটকে পড়ে দূরে। হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
” ইমা!”
” ইমা নয়, সন্তানহারা এক মা, মা হারা এক মেয়ে, পিতৃহারা এক কন্যা, ভাই হারা এক বোন তোর সামনে দাঁড়ান।” একটু আগেও যে ব্যথায় কাতর ছিল এই ক্ষণে সে অসীম শক্তি ধারণ করেছে। হাতের ইটটা ওর মুখে ছুঁয়ে নিচে পড়া লোহার রডটা হাতে নেয় ইমা। বজলুর দিকে ফিরে তাকায় একবার। নির্লিপ্ত বজলু মাথা ধরে নত মুখে এককোনে বসে আছে। ইমার সাহস বহুগুন বেড়ে যায়। ব্যথায় রক্তাভ মুখশ্রী। শরীরের জায়গায়,জায়গায় কেটে রক্ত ঝড়ছে। মুখের সামনে আলুথালু চুল। গায়ে ওড়না নেই৷ খুড়িয়ে এগোয়৷ পেটে অসহনীয় ব্যথা। ইমা চিৎকার করে সেই ব্যথা উপশম করতে চায়। সামিরার দুই হাঁটুতে সজোরে আঘাত করে।
” পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন টিকে থাকে না। তারপরও তোদের মতো মানুষ রূপি শয়তানেরা শয়তানি ছাড়ে না। জীবনটার অর্থ কী অসৎভাবে হাসিল করা, অপরকে ব্যথা দেওয়া,ঠকানো?না, জীবনের অর্থ সামনের জনের মুখে হাসি ফোটানো,আশেপাশের মানুষকে ভালো রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু তোরা এসবের কী বুঝবি, নরকের কীট?” সামিরা হাঁটু ধরে চিৎকার করে ওঠে। বজলুকে বার বার ডাকে। কিন্তু বজলু আর আসে না। সে আস্তে করে উপরে উঠে চলে যায়। ইমা এক চিলতে হেসে বলে,
” দেখলি তো! এই হচ্ছে জীবন। যা দিবি তাই পাবি। তুই বললি না তুই শুধু মৃত্যু দিস। তুই কে? জন্ম, মৃত্যু দেবার মালিক ঐ আল্লাহ তাআ’লা। তোর মতো নিকৃষ্টের কী সাধ্য মানুষকে মৃত্যু দেবার!” ইমা সামিরা থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে কষ্টে শিষ্টে। ম্লানমুখে হেসে বলে,
” কথায় আছে ইট মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। তোকে আমি পাটকেলও মারব না৷ কি করব জানিস?” সামিরার চোখে তখনো আগুন জ্বলে। ইমা হাতের রডটা একবার ঘুরিয়ে দেখে নেয়, বলে,
” মারলে তো কাহিনি শেষ। আমি তোর কাহিনি শেষ করব না। বরং এমন কাজ করব যেন তুই সারাজীবন মরার জন্য ছটফট করিস। কিন্তু মরণ তোর কাছেও আসবে না। তুই চিৎকার করবি,আর্তনাদ করবি তবুও মরতে পারবি না।” সামিরাকে ভাবার অবসর না দিয়ে আচমকটা ওর হাতে আঘাত করে ইমা। চট করে সামিরার পকেট থেকে মোবাইল টেনে বের করে পুলিশকে খবর দেয়৷ পুলিশের নাম্বার সামিরার কললিস্টে আগেই ছিল। অসহায়, পীড়িত কণ্ঠে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে ইমা। সামিরা পাশ থেকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পা দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে। কল কেটে সামিরার মাথার পেছনে টুং টুং করে রডটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে,
” সাইকো হওয়াটা কঠিন কিছু না,কঠিন হলো ভালো মানুষ হওয়া। তোর তো ভালো হওয়ার তারিখ উত্তীর্ণ হয়েছে। তোকে পাগলের চরিত্রেই বেষ্ট লাগবে। বেষ্ট অফ লাক।” সামিরার দৃষ্টি এবার নমনীয় হয়। কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা ভিক্ষা চায় ইমার কাছে। ইমা বলে,
” আচ্ছা যা! করলাম ক্ষমা তোকে৷ কিন্তু এক মা, মেয়ে,বোন তোকে এভাবেই ছাড়বে না। পাপ করলে যে শাস্তি পেতেই হবে, সা-মি-রা।” সামিরার মাথার পেছনে রড দিয়ে বাড়ি মারে ইমা। আর্তচিৎকার দিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে সামিরা। সাথে সাথে নিচে ঢলে পড়ে ইমা। কাপড়ে রডের হাতাটা মুছে সামিরার হাতে গুঁজে দেয়। দেখতে দেখতে চোখের সামনে আঁধার নেমে আসে।
চলবে,,,