#চাঁদের_কলংক ( ১৩)
#রেহানা_পুতুল
তন্দ্রা গাড়ির কাছাকাছি আসতেই শয়ন দুচোখ বন্ধ করে ফেলল। তন্দ্রা এসে শুনতে পেল তার প্রিয় গানটা বাজছে। দাঁড়িয়ে একটু শুনল। এরপর শয়নের কোলের উপরে এক টুকরো কাগজ পেলে চলে গেল গেটের বাইরে।
শয়ন টের পেতেই নেত্রপল্লব মেলে ধরলো।
” অনেক ক্ষুধা লাগছে। নাস্তা খেয়ে আসতেছি। ”
পড়েই শয়ন বলল। আর কত তন্দ্রা। আমার থেকে শেখা চিরকুট দেয়ার সিস্টেম আমার উপরেই এপ্লাই করছ। মুখে বললে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত। এই প্রেমিক হৃদয়টা পোড়াতে এত চন্দন কাঠ কই পাও বালিকা। শয়ন একবার ভাবল উঠে যাবে বিল মিটিয়ে দিতে। পরে চিন্তা করল তন্দ্রা সিনক্রিয়েট করতে পারে। এই ভেবে গেলনা আর। চোখ বন্ধ করে গান শুনতে লাগল। চিরকুটটা আগের অবস্থায় রেখে দিল। বোঝাবে সে ঘুমিয়েছিল। দেখেনি।
তন্দ্রা কিছুসময় পর ফিরে এলো। শয়নের মুখের উপর অপলক চেয়ে রইলো। বাইরে থেকে আরো হ্যান্ডশাম আরো সুন্দর হয়ে গিয়েছে শয়ন। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে বেশ লাগছে। শ্যামলা রংটা উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে। তার ভিতরটা যদি এমন সুন্দর হতো তাহলে বিয়ের রাতটাকে এভাবে বিনষ্ট করে দিতে পারতোনা। অনুযোগ, অভিমান নিয়ে তন্দ্রা গাড়ির ভিতরে ঢুকে বসল।
শয়ন টের পেরে চোখ মেলে তাকাল। গাড়ি ড্রাইভ শুরু করল। কোথাও না থেমে একটানে গাড়ি নিয়ে বাড়িতে চলে গেল। নিজের রুমে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।
দুপুরে ভাত খেয়ে সবাই বিশ্রাম নিতে লাগল। শায়না ও তন্দ্রা পাশাপাশি শুয়ে আছে৷ তন্দ্রার দৃষ্টি তাক হয়ে আছে দেয়ালের চিত্রকর্মটার দিকে। শায়নার দৃষ্টি স্থির মোবাইলের দিকে। সে গেমস খেলছে। দৃষ্টির পরিবর্তন না করে দুজন বাক্য বিনিময় করছে৷
” ভাবি ট্রিট কবে দিবে?”
” কবে চাই রাই?”
” কালই। বাকির নামে ফাঁকি। সো লেট করতে রাজী নই আমি। ”
” ওক্কে ডান। কি খাবে বা কি চাই তোমার? ”
” কাল দুপুরে লাঞ্চ করব বাইরে। যেকোনো একটা ভালো রেস্টুরেন্টে। যার যা খেতে চায় খাবে। তনুকে ফোন করে চলে আসতে বল। ”
” ওকে একা আসতে দিবেনা মা। আমরা যেতে পথে থেকে ওকে তুলে নিব। ”
” রাইট। গাড়ি নিয়ে গেলেতো তোমার জামাইকে লাগবে। ”
” হুম তাতো লাগবেই।”
দাঁড়াও ভাইয়াকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করি।
” এই ভাইয়া তুমি ভাবির থেকে ট্রিট নিবা। কুইক জানাও।”
” হুম নিব। তবে কন্ডিশন মাত্র একটা।”
” আজব। ট্রিট হয় যে দেয় তার ইচ্ছেমতো। ”
” এমন ট্রিট আমার চাইনা। ফোন রাখ।”
” আচ্ছা শুনিতো। বল কি চাও।”
” একটা নিউ মুভি এসেছে হলিউডের। আমাকে সেটা দেখাতে হবে ট্রিটের মালিক নিজে পাশে থেকে।”
” ওকে বলে দেখি। কবুল হয় কিনা।”
শায়না ফোন রেখে দিল। তন্দ্রার দিকে চেয়ে নাক কুঁচকে বলল,
” কি করিবে সখী এবার। পালাবে কোথায়?”
” আমি পাশে থাকবনা। বাজেট দিয়ে দিব। সে দেখে নিলেই তো হবে।”
” আরেহ ইয়ার রাজী হও। নয়তো তোমার রিকসা ভাড়া লাগবে। সে গেলেতো গাড়ি করেই যেতে পারব। ভাড়াগুলো বেঁচে যাবে। ”
” লাগলে লাগুক। আমি সহজে মচকাইওনা। ভাঙিওনা। গলিওনা। এসবের বয়স নাই।”
” তুমিওতো দেখি ঠ্যাটা আছ ভাবি। বয়স নাই। বয়স কোথায় গেল। স্বামীর সাথে এখনো বাসর হয়নি। আবার বয়স গেল।”
ঘাড় কাত করে তন্দ্রার দিকে চেয়ে আবদারের ঢংয়ে বলল শায়না।
কিছুক্ষন গড়াগড়ি করে তন্দ্রা উঠে গেল।
” মসলা চা খাবা রাই? আমার ভীষণ প্রিয়।”
” দিলে খাই। তোমার জামাইর ও পছন্দ। তার জন্য এক কাপ দিও দয়া হলে। ”
সন্ধ্যায় সবাই বসেছিল ড্রয়িংরুমে। শেফালী সবাইকে চা নাস্তা এনে দিল নিত্যদিনের মতো। শয়ন ঘুম থেকে উঠে মাত্রই লাঞ্চ সেরে বাবা মায়ের পাশে এসে বসল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই শয়ন বলল,
” শেফালি লেবু চা দারুণ হয়েছে। এভাবে মাঝে মাঝে লেবু দিয়ে মসলা চা বানাবি।”
” ভাইজান চা আমি বানাইনি। ভাবিজান বানাইছে। লেবু ছিলনা। গাছের লেবু পাতা দিয়ে বানাইছে।”
শায়না ফিক করে হেসে ফেলল।
শয়ন বোনের দিকে গরম চোখে চাইল। বলল,
“এখানে হাসির কি হলো। চা খা।”
শাহিদা বেগম বললেন বেশ মজা হয়েছেতো। আমিতো এটা জানতামনা। বউ কোথায়।
তন্দ্রা পা বাড়িয়ে সবার সামনে এলো পর্দার ওপাশ থেকে।
” জ্বী মা শুনছি।”
” তোমার কাপ কই। নিয়ে আসো।”
” মা আমিতো চা কাপে খাইনা। মগে খাই। ডাবল কাপ ।”
” তো নিয়ে আস। আমাদের সঙ্গেই বসে খাও। আমার দাদি বলতো,কোন কিছু একজন খাইলে বিষ। আর দশজন খাইলে চিজ।”
” চিজ কি আম্মু। পিৎজাতে দেয় যে সেটা?” বলল শায়না।
” নাহ এই চিজ বলতে কোন খাবারের বস্তুকে বোঝায়। ”
“বউমা লেবু পাতা কখন দিলে? আল্লাহ। কেউই ধরতে পারবেনা এই লেবু ছাড়া লেবু চায়ের নিঞ্জা টেকনিক। দারুণ হয়েছে।”
” মা চা যখন প্রায়ই হয়ে আসবে। তখন পাতার ঘ্রাণ বুঝে ও চায়ের পরিমাণ বুঝে দিতে হয়। আমি গাছ থেকে এনে পাঁচটা লেবু পাতা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে দিয়েছি। শুরু থেকে দিলে চা তেতো হয়ে যাবে। দুই মিনিট রেখেই পাতাগুলো তুলে ফেলতে হয়। এটা মনে রাখতে হবে। ”
” বউমা চা আর থাকলে আমাকে আরেক কাপ দাও। ” বলল কামরুল মির্জা।
” দিচ্ছি বাবা।” বলে তন্দ্রা শশুরকে আরেক কাপ চা এনে দিল।
শয়ন শায়নাকে বলল, “ওই আমাকে আরেক কাপ এনে দে থাকলে।”
” ইসসরে। পারবোনা। তোমার বউকে বলতে পারনা। তুমি কি তার ভাসুর নাকি?”
” না দিলে নাই। এভাবে বলিস কেন। বজ্জাতের হাড্ডি। ”
” কাল দুপুরে বাইরে লাঞ্চ করব। গাড়ি করে যাব। মাথায় রেখ।”
শয়নকে বলল শায়না। বাকি কথা এড়িয়ে গেল শায়না। নয়তো গাড়ি করে যাওয়া হবেনা। শয়ন গোপনে শিহরিত হলো শুনে। যাক অন্তত কাল সিনেমা হলের আঁধারে বালিকার একটু সান্নিধ্য লাভ করা যাবে।
পরেরদিন দুপুরে তারা তনুকে তুলে নিল পথের থেকে। সবাই মিলে গ্রাম থেকে জেলা সদরে চলে গেল। এখানে গ্রামীণ ছাপ রেখে মানসম্মত কয়েকটি রেস্টুরেন্ট হয়েছে। লাঞ্চ সেরে যার যেটা খেতে ইচ্ছে হলো খেয়ে নিল। লাচ্ছি,ফালুদা,আইস্ক্রিম,কোকাকোলা,
মিল্কশেক,পুডিং, ফিরনি।
শয়ন সবার উদ্দেশ্যে বলল লেট হলে টিকেট পাওয়া যাবেনা। তাড়াতাড়ি আস সবাই। শায়না শুকনো ঢোক গিলে বলল,
” ইয়ে মানে ভাইয়া,ভাবি সিনেমা দেখবেনা। বাড়ি যাবে। পেট ব্যথা হচ্ছে মনে হয়। ”
” ফাজলামো করিস আমার সাথে। কাল কি বললি আমাকে?”
“এখন ভাবির পেট ব্যথা করছে যে। কত কি খেয়েছ মাগনা টাকা পেয়ে। দেখেছ? ”
শয়নের ঘাড়ের রগ ফুলে মোটা হয়ে গেল। সবাইকে নিয়ে গাডি স্পিডে চালিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেল বাড়ি। তনুকেও শায়না নিয়ে এলো তাদের সাথে দু’চারদিন বেড়ানোর জন্য। তন্দ্রা শশুর শাশুড়ির জন্য তার পছন্দের বিফ খিচুড়ি ও চিকেন রোল নিয়ে আসল। গাড়ি থেকে বের হয়েই শায়না খাবারগুলো ও তনুকে নিয়ে তার মা বাবার রুমে চলে গেল।
তন্দ্রা শায়নার রুমে ঢুকতে যাবে। অমনি পিছন থেকে শয়ন তন্দ্রার এক হাত মুঠোবন্দী করে নিলো। টেনে হিঁচড়ে নিজের রুমে নিয়ে নিল। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। তন্দ্রাকে খাটের উপরে ফেলে দিল।
এসি অন করে শার্টের দুটো বোতাম খুলে নিল। তন্দ্রা উঠে যেতে লাগলে শয়ন হ্যাঁচকা টানে পূনরায় বিছানায় শুইয়ে দিল।
কটমট দৃষ্টিতে বলল,
“তোমার পেটের কোথায় ব্যথা দেখাও? মিথ্যাবাদী কোথাকার। কারণে অকারণে শুধু মিথ্যা বলা শিখেছ। ”
” আমি মিথ্যা বলিনি। শায়নাকে গিয়ে ধরুন। আমি তাকে মানা করেছি। সে বলছে এটা এখন বলা যাবেনা।নয়তো আমাদের গাড়ি করে যাওয়া মিস হবে।”
” এটা মানলাম। কিন্তু পেট ব্যথা?”
” বেশি খাওয়াতে আমার সত্যিই পেট ব্যথা করছে। ”
” শুয়ে থাক। আমি হট ওয়াটার পট নিয়ে আসতেছি। ”
” একদম নাহ। আপনার কোন কেয়ার আমার প্রয়োজন নেই। আমার থেকে দূরে থাকলেই আপনার জন্য ভালো হবে।”
শয়ন তন্দ্রার দুবাহু ধরে খানিক ঝুঁকল। চোখ লাল করে জিজ্ঞেস করলো,
” আমি এতই খারাপ হয়ে গেলাম? আমার জন্য তোমার চোখভরা এত বিরক্তি? এত অপমান? ”
” আপনার সাথে কথা বলার আগ্রহটুকু আমার ফুরিয়ে গিয়েছে ওই এক রাতেই। একই ছাদের নিচে বাস করলেও আমাদের দুজনের পথ ভিন্ন। জীবন ভিন্ন। আমাকে যেতে দিন বলছি। নয়তো ভালো হবেনা।”
“আদিল বেঁচে থাকলে কি তুমি এতদিন বেঁচে থাকতে ?”
আকাশ থেকে খসে পড়া উল্কার মতো শয়নের আকস্মিক প্রশ্নে তন্দ্রা থমকে যায়। ঘাবড়ে উঠে। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। ভীত হয়ে আসা সত্তাকে এক ঝটকায় আড়াল করে ফেলে। বলিষ্ঠ কন্ঠে বলে,
“সে বেঁচে নেই কিন্তু।”
” এটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়।”
ভারি গলায় বলল শয়ন।
” অবশ্যই বেঁচে থাকতাম। এতই সহজ কাউকে মেরে ফেলা?”
” অবশ্যই সহজ। তুমি যদি একজন নারী হয়ে রাতের আঁধারে একজন পুরুষের শরীরের একটা অর্গান খন্ডিত করতে পারো। তাহলে সে কেন পুরুষ হয়ে দিনের আলোতে সামান্য একজন নারীকে মেরে ফেলতে পারবেনা?”
মুহুর্তেই তন্দ্রার সারা মুখ ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল। চকিতে চাইলো শয়নের চোখে।
কম্পিত ক্ষীণ স্বরে,
” আ আ আপনি কিভাবে…?
শয়ন এগিয়ে আসে তন্দ্রার সামনে। মুখোমুখি দাঁড়ায় নিদিষ্ট দূরত্ব রেখে। তন্দ্রার ঘনিষ্ঠ হওয়া, তন্দ্রার আলিঙ্গন পাওয়া যেন তার জন্য নিষিদ্ধ। গর্হিত।
” জেনে রাখ। আদিল মরে গেল বলেই তুমি বেঁচে আছ। আদিল নেই বলেই তুমি এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছ। আদিল চলে গেল বলেই তুমি এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে।”
কথাগুলো বলেই দরজা খুলে শয়ন রুম থেকে বের হয়ে যায়।
তন্দ্রা ঠায় দাঁড়িয়ে নির্বিকার চোখে চেয়ে রইলো শয়নের চলে যাওয়ার পানে।
চলবেঃ ১৩ (শেয়ার ও মন্তব্যর আশাবাদী)