#চাঁদের_কলংক ( ৯)
#রেহানা_পুতুল
চৈত্র মাসের গা জ্বলা গরম নব বৈশাখ মাসেও। বসন্তের বিদায়ী সুর এখনো ছড়িয়ে আছে প্রকৃতিতে। ডালে ডালে শত পুষ্পের সুরভি ও কোকিলের কুহু কুহু কলরব থেকে বিদায় নিল ঋতুরাজ বসন্ত।
তার পূর্বে গোটা বসন্ত নিরব সাক্ষী হয়ে নিল বহু আনন্দ বেদনার। প্রকৃতিকে উজাড় করে দিলো মাখো মাখো সুখ আর কোমল সজীবতা। ফুরফুরে আমেজে ভরে ওঠল চারদিক। উতলা হলো কতশত জনের বিরহে পোড়া মন। কিন্তু তন্দ্রা ও শয়ন নামের দুটো সুখপাখির অন্তরকে উতলা না করে করেছে বড্ড একেলা। হায় নিয়তি! হায় প্রকৃতি! কি নির্মম!
নিয়তি ও প্রকৃতি কিছুই দিতে পারেনি তন্দ্রা নামের মানবীকে। বরং রিক্ত নিঃস্ব করে দিতে সে আলসমি ও কার্পণ্য করেনি। উপহার দিয়েছে রাশিরাশি বেদনা ও অপার একাকীত্ব। চারপাশে সবকিছু থেকেও নেই। শুধু একজন মানুষের অভাবে।
ভাবনার অথই সমুদ্রে ডুবে গেল তন্দ্রা। কামরুল মির্জার কথাগুলো তার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোষে ডিগবাজি খেতে লাগল। এমনি কি উনি এসব বলেছেন নাকি। কিন্তু উনি কি কোনভাবে…
তন্দ্রা আর ভাবতে পারছেনা। অবসাদগ্রস্ত বিষিয়ে আসা মনটা নিয়ে উঠানে পা রাখল। তার আগে এলোমেলো হয়ে থাকা খোলা চুলগুলোকে বিক্ষিপ্তভাবে পেঁচিয়ে হাতখোঁপা করে নিল। বুকের একপাশে পড়ে থাকা ওড়নাটা মেলে মাথার উপরে দিয়ে নিল। বাড়িতে তেমন কাউকেই পেলনা। সবাই আদিলদের বাড়িতে চলে গিয়েছে। অগত্যা সে একাই গেল।
যেতে যেতে দুঃশ্চিন্তা করলো তন্দ্রা,
আমার দেওয়া মেসেজ কি আদিলের মোবাইলের আছে? এটা কেউ দেখে গেলে সর্বনাশ। নির্ঘাত ফাঁসি। তবে তার ফোনের পাসওয়ার্ড দেওয়া। হুট করে কেউ চাইলেও ঢুকতে পারবেনা। মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও ক্লিপটাও রিমুভ করতে হবে। যদি তার ল্যাপটপে সংরক্ষিত থাকে। সেখান থেকেও রিমুভ করতে হবে। তন্দ্রার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল এক ঝলক বিজলী চমকানোর ন্যায়
আদিলের মৃ’ তদেহ তাদের উঠানের মাঝখানে রাখা খাটিয়ার মাঝে। তার মা বোনদের গগনবিদারী ক্রন্দনরোল ও আহাজারিতে আকাশ বাতাশ থমকে গেল। উপস্থিত সবার চোখে পানি। নানা গুঞ্জনে শোক বাড়ি মুখরিত।
জগতে প্রতিটি মানুষই কারো কারো কাছে অনেক প্রিয়। ভালোবাসার সজ্জন। আদিল প্রিয় হয়ে থাকা মানুষগুলো অঝোরে কাঁদছে বুক চাপড়ে। বহুজনের ভীড়ে থাকা তন্দ্রারও দুচোখ ভরে গেল অশ্রুবাণে। কিন্তু সে একবার ও আদিলের মুখ দর্শন করলনা।
যে জীবিত মুখটি দেখলে ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসতো তন্দ্রার। সে একই মানুষের ভাষাহীন নিথর মুখখানা দেখে করুণা প্রকাশ করতেও অনাগ্রহী তন্দ্রা। কয়েকজন মুখের উপরে বলেই ফেলল,
আহারে। মাইয়াটা ক্যামনে বোবা কান্না করতাছে আদিলের জন্য। রাইতে বিরাতে হেগো আপনজন হইয়া আছি আদিল পোলাটায়।
রাহেলা ও তনু তন্দ্রাকে দেখেই তব্দা খেয়ে গেল। তবুও তাকে তারা সেখানে মুখে কিছুই বললনা।
লা’শ নিয়ে আর কোন তোড়জোড় হলনা। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুপুর শেষ না হতেই দাফন সম্পূর্ণ হয়ে গেলো।
আদিলের একান্ত নিকটজনেরা ভেজা কন্ঠে বলাবলি করছে,
” আহারে খোদা। কেমন বাইক এক্সিডেন্ট করলো বাবায়। একটা অঙ্গই কাটা পড়ল।”
” হোন্ডার চাকার মধ্যে কি জানি চাকুর মত কি একটা আছে৷ আমি ঠিক জানিনা৷ ওইটায় নাকি কাটা পড়ছে। ”
” আচ্ছা মোটা জিন্সের প্যান্টের ভিতরে এটা ক্যামনে কাটা গেল। অবাক লাগে ভাবতে।”
” আরেহ না। ঘটনা এটা না। মোটরসাইকেল নিয়ে যখন পড়ে গেল গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে। তখন একটা সিক ঢুকে গেল ওখান দিয়ে। পরে সেটা কেটে ফেলতে হয়েছে। ওই সিকটা মাটির মধ্যেই গেঁড়ে ছিল। ”
এমন নানাজনের মুখ দিয়ে নানা মুখরোচক কথার ফুলঝুরি ঝরতে লাগল। তন্দ্রার মায়ের গলা জড়িয়ে আদিলের মা ঢুকরে কাঁদল ছেলের বহু স্মৃতিচারণ করে৷ রাহেলা চলে এলো আদিলের মাকে শান্তনার বাণী দিয়ে। বলল পরে আবার যাবে৷ তারা মা মেয়ে তিনজন বাড়িতে চলে এলো।
রাহেলার ফোন এলো। তাহের উদ্দীন আদিলের কথা জিজ্ঞেস করলো। রাহেলা নিজের চোখে দেখা সব জানাল স্বামীকে।
” আম্মু ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাচ্ছে।”
কামিজের উপর দিয়ে নিজের পেট খামচে ধরে বলল তনু।
” ক্ষুধা সবার লাগছে। তোর একার নয়। পারলে নিয়ে খা। নয়তো আমি আসতেছি। সকালেই রান্না করে ফেলছি ওই খবর শোনার পর। ”
তন্দ্রা ভাত বেড়ে দিল তনুকে। নিজের জন্য ও মায়ের জন্যও নিলো। সবার প্লেটেই একত্রে সব দিয়ে দিল। বাটি বাটি করে টেবিলে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি নেই তার মাঝে। সবাই খাওয়া শুরু করল। তনু ভাত খাওয়ার মাঝামাঝি পর্যায়ে থেমে গেল৷
” আচ্ছা তুই এমন কাঁদলি কেন বুবু? এটা কি তোর অভিনয় ছিল। না সত্যি সত্যিই আদিল ভাইয়ের জন্য পরান পড়ল। ”
” তোর কি মনে হয় বলতো দেখি?”
” আমার দুটোই মনে হয়রে। ”
” কারণ। ”
” ভেরি সিম্পল। আদিল ভাই সব সময় আমাদের ভালোমন্দে পাশে ছিল। এখন সে মারা গিয়েছে। মৃত ব্যক্তির উপরে এমনিতেই জীবিত মানুষদের রাগ পানি হয়ে যায়। এটা আমার শোনা কথা। ঠিক ওই ঘটনাটা স্কিপ করলে সে অত খারাপ ছিলনারে। ”
” তুই কলেজে উঠেই দেখি খুব ভারি ভারি কথা শিখে গেলি। এটা ভালো তনু। ”
” থ্যাংকিউ মাই ডিয়ার বিগ সিস্টার। ”
” তনু খা। এত প্যাঁচাল করিস কেন মেয়ে?”
গমগম স্বরে আদেশ দিয়ে বলল রাহেলা।
কামরুল মির্জা স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে নিজের রুমে বসেছেন। রুমের দরজা বন্ধ। শেফালি তার দায়িত্বে থাকা কাজ নিয়ে হরদম ব্যস্ত।
” জীবনের পথ পরিক্রমায় কখন কি হয়। কি ঘটে। তা আগে থেকে কেউই বলতে পারেনা। যেহেতু পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। বৌমাকে নিয়ে তোমার এখন কি সিদ্ধান্ত? ”
গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইলেন শয়নের কাছে। বাকিরাও চুপ হয়ে আছে। শয়নের মতামত শোনার অপেক্ষায় তারাও।
” তন্দ্রাকে নিয়ে আসব বাবা। ”
এক বাক্যে জানাল শয়ন।
তিনি আলহামদুলিল্লাহ বলে সন্তুষ্টির চোখে চাইলেন শয়নের দিকে।
” কবে যাবি আনতে বাবা?”
শাহিদা বেগম আগ্রহ ভরা চিত্তে জিজ্ঞেস করলো।
” যে একা গেল। সে একাই আসতে পারবে। তার মতো সাহসীদের কাউকে লাগেনা।”
ছেলের কটাক্ষ কথার রেশ ধরে তার মা মুখ গোঁজ করে বলল,
“আজবতো। বর্তমানের ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে। এই গ্রাম থেকে সেই গ্রামে একা চলে গেল। এতে সাহসের কি দেখলি।
শয়ন নিরব। মায়ের কথার কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলনা। কামরুল মির্জা এক পলক ছেলের দিকে চাইলেন।
” আমি গিয়ে নিয়ে আসব ভাইয়া?”
উৎফুল্ল স্বরে বলল শয়নের একমাত্র ছোটবোন শায়না।
” আমি জানিনা সেটা। তোর ইচ্ছে। তবে কবে যাবি আমি জানাব।”
বিমর্ষ নয়নে বলল শয়ন।
” থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। ভাবিদের বাড়িটা আমার কাছে জোস লাগে। কি নিরিবিলি। কি নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিময় পরিবেশ। বেশ আরামদায়ক ও। ”
” জানাবি আবার কি। সামনের সপ্তাহে নির্বাচন। তার আগেই বৌমা চলে আসুক।”
” তোমরা যা ভালো মনে করো। তাই করো।”
শয়নের মা বলল,
” তুই না যাস। অন্তত একটা ফোন দিস বউকে। তাহলে সেও সহজ হবে তোর প্রতি। যেহেতু একটা ঝড় বয়ে গেল জীবনে। ”
মায়ের আহ্লাদীপানা কথায় শয়ন হই হই করে উঠল। কাঠ কাঠ গলায় মায়ের দিকে চেয়ে বলল,
” ফোন দেওয়ার দায়িত্ব শুধু আমার একার? তার নয়? সেওতো কখনো একটা ফোন বা মেসেজ দেয়নি আমাকে। আর যে নিজেই জটিল। সে কারো প্রতি সহজ হয়না সহজে।সম্পর্কের শুরু থেকেই তাকে সহজ করতে, ইমপ্রেস করতে কি পরিমান পরিশ্রম করতে হয়েছে তা শুধু আমি জানি। ”
” জানবিতো তুইই। আমরা কিভাবে জানব? তুইতো বললি এই মেয়েকে বিয়ে না করতে পারলে এই দেশে দ্বিতীয় কোন মেয়েকেই আর বিয়ে করবিনা। ”
জেদি গলায় বলল শাহিদা বেগম।
” হুম বলছি। আর এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি। যত মধু তত বিষ। আমার এখন পালিয়ে বাঁচার উপক্রম। ”
” কিসের পালিয়ে বাঁচার উপক্রম। কি বলছিস আবোলতাবোল? ”
” কিছুনা মা। ” শয়ন রুম থেকে চলে গেল।
তবুও শাহিদা বেগম স্বস্তির দম ছাড়লেন । বললেন,
বউকে যে আনার জন্য ওর দিলে রহমত হয়েছে। এতেই লাখ লাখ শুকরিয়া আল্লাহর কাছে।
” আব্বু পরশু যাই আমি আর শেফালী? ”
” আচ্ছা যাইস।” চিন্তিত মুখে বলল কামরুল মির্জা।
সেদিন বিকেলেই শয়ন নিজের রুমে পায়চারি করতে লাগল। সবকিছু কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। পরিস্থিতি জটিলাকার ধারণ করলো। তন্দ্রার সাথে তার মধুর সম্পর্কটা নোনাজলের মত বিষাক্ত হয়ে গেল। সুন্দর থেকে অসুন্দর হয়ে গেল। সহজ থেকে কঠিন রূপ নিল। হাহ! করে তপ্তশ্বাস ছাডল শয়ন। ভোরের উদীয়মান সূর্যের ন্যায় তার ভিতরে প্রবল গ্লানিবোধ উদিত হলো।
একটা ভুল কয়েকটা ভুলের জন্ম দেয়। একটা অপরাধ কয়েকটা অপরাধের জন্ম দেয়। একজনের পাপ দশজনকে ঘিরে ধরে। শয়ন ঠিক করল তিনমাস অবধি থাকবেনা দেশে৷ তার আগেই দেশ ছাড়বে। নয়তো বলা যায়না। কখন কিভাবে ধরা পড়ে যায়। দেশের বাইরে থাকলে এ সম্ভাবনাটুকুও থাকবেনা আর।
চলবেঃ ৯ ( শেয়ার ও মন্তব্যর আশাবাদী)