চাঁদের কলংক পর্ব ৩

0
1822

#চাঁদের_কলংক ( ৩)
#রেহানা_পুতুল
দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই কথাগুলো শুনে গেলেন কামরুল মির্জা। সপাটে দরজা খুলে ফেললেন। কটমট দৃষ্টিতে চাইলেন শয়নের দিকে। কড়া শাসনের সুরে বললেন,
” পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়। তুমি দ্রুত আমার রুমে আসো বলছি। ”

এই বলে তিনি ব্যস্ত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। শয়ন তন্দ্রার মুখোমুখি দাঁড়িয়েই,
” তুই আমার জীবনে আস্ত একটা অভিশাপ।তোর জন্য ক্রমশ আমার বাবার চক্ষুশূল হয়ে যাচ্ছি আমি। ”

” কিন্তু একসময় বলতেন আশীর্বাদ।” বলল তন্দ্রা।

” বলতাম। কিন্তু সেটা পাস্ট। পাস্ট ইজ পাস্ট। প্রেজেন্ট নয়। বুঝলি।”

” তাহলে আমার পাস্ট নিয়ে পড়ে আছেন কেন? তার জন্য কি আমি দায়ী? বর্তমানের আমাকে দেখুন। ”

“সেটা আর এটা এক হলো? যেই ছেলের সাথে আমার সাপে নেউলে সম্পর্ক। তুই তার সাথেই ছিহঃ! ”

” খুব অল্পসময়ের ভিতরেই পেপার পেয়ে যাবি তুই। ”

এই বলে শয়ন পা বাড়াতে লাগল। এমন সময় তার এক চাচাতো ভাবি রুমে এসেই,
” কি ব্যাপার শয়ন। ডুমুরের ফুল হয়ে গেলে দেখি। পাওয়াই যায়না। নাকি তন্দ্রার আঁচল তলে শয়নের কেবল শয়নেই থাকতে ইচ্ছে করে। তোমাদের নাকি লাভ ম্যারেজ শুনলাম? ”

” এসব ফালতু গসিপ কই পাও তোমরা। সরো বলেই,
শয়ন রুম থেকে বের হয়ে গেল বাবা মায়ের রুমে। ”

“কি ব্যপার? ও রেগে আছে মনে হলো।”

” হুম আমার ও মনে হলো। মনে হয় উনাদের কোন পারিবারিক বিষয় হবে।”

” হয়তো। কাকার মতই জেদ শয়নের।”
শয়নের ভাবি চলে গেল তার বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনেই।

তন্দ্রা দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে,
শব্দ করেই বলতে লাগল,
পৃথিবীতে সবাই স্বার্থপর। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে আপন ও হয়ে যায় পর। প্রিয়জনও হয়ে যায় অপ্রিয়জন। হায়রে শয়ন। আমিই ছিলাম আপনার নয়ন। সেই ক্লাস নাইনে যখন পড়ি। তখন থেকেই আপনি আমার পিছনে টইটই করে ঘুরতেন। নব্বই দশকের প্রেমিকের মতো চিঠি, কার্ড,চিরকুট, ফুল,চকোলেট কি দেননাই আমাকে।
তন্দ্রা স্মৃতির গহীন বনে হারিয়ে গেল। স্রোতস্বিনী নদী তরঙ্গের মতই তার মানসপটে একের পর এক আছড়ে পড়তে লাগল সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলোর কথা।

স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায়ই শয়ন দাঁড়িয়ে থাকতো নানা বাহানায়। যেহেতু শয়ন পাশের গ্রামের ছেলে। তাই স্কুলের সময়সূচি তার জানা ছিল। অপরদিকে চেয়ারম্যানের ছেলে বলে স্কুলের নানান কর্মসূচিতেও যুক্ত ছিল। তাই পথে ঘাটে শয়নের পদচারণা ছিল কিছুটা দম্ভনীয়।

একদিন ক্লাসের টিফিন পিরিয়ডের সময় তন্দ্রা মাঠের দিকে যাচ্ছিল একা একা। অমনি ডাক পড়ল পাশ থেকে। ফিরে দেখে স্কুলের ঝাড়ুদার আয়া সুধা।
” কি দিদি?”

” ধরো এই গোলাপ ফুল। তোমার জন্য।”

তন্দ্রা বুঝেও চমক খেল।
” কে দিয়েছে দিদি? ”

চেয়ারম্যানের পোলা আমারে দিয়া কইলো তোমারে দিতে।

তন্দ্রা ফুলগুলো নিয়ে চুপিচুপি কমনরুমের ভিতরে চলে গেল। বিবশ হয়ে গেল ফুলের সৌন্দর্য দেখে। একদম টাটকা। স্নিগ্ধতা আর সতেজতায় মাখামাখি। গাছ থেকে সদ্য ছিঁড়ে নেওয়া। প্রতিটি পাপড়িতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ লিখা রয়েছে।

কোন পাপড়িতে লিখা শয়ন + তন্দ্রা। কোনটায় ‘ ভালোবাসি’। কোনটায় ‘ স্বপ্ন’। কোনটায় ‘ ডাহুকী’। কোনটায় ‘ তোর নামেই’।

তন্দ্রা একদিকে শিহরিত। আরেকদিকে ভীত। দোটানায় পড়ে বেহাল তরুণী হৃদয়ের অনুভূতিগুলোর।

তন্দ্রার থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে শয়ন। এভাবে কেটে গেল আরো কয়েক মাস। তন্দ্রা দশম শ্রেণীতে উঠে গেল। একদিন এক জনের মাধ্যমে শয়ন চিরকুট পাঠালো তন্দ্রাকে।

“তোমার নামে করেছি বিরহকে সঞ্চয়।
নাম দিয়েছি তার প্রণয়।”

সেদিন সারারাত বিনিদ্র রজনী পার করেছে তন্দ্রা। ঘুমেরা যেন তার তার সাথে আড়ি নিয়েছে। উথাল-পাতাল অনুভূতির দাপটে তন্দ্রার ও পাগল পাগল লাগে। তবুও কোন সাড়া দেয়নি তন্দ্রা। এভাবে এসএসসি পরিক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। শয়ন এক বিকেলে তন্দ্রার পথরোধ করে দাঁড়াল।

“বালিকা দোহাই তোমার। শোন বলছি। ”

তন্দ্রার পা জড়িয়ে গেল। জড়ানো পায়ে দাঁড়িয়ে যায়। চোখের কোমল পাতা উল্টিয়ে শয়নকে পলক মেরে চায়। পরক্ষণেই দৃষ্টি নামিয়ে মিহি কন্ঠে বলল,
” কেন বারবার আসেন আপনি? আমি ডাকি আপনাকে? ”

” কেউ ডাকেনি তবু এলাম। বলতে এলাম ভালোবাসি। ”
” এটা এখন আমার কথা হলেও মূলত
কবি ‘ হেলাল হাফিজের ‘ লিখা একটি কবিতার চরণ এটা।

” বুঝলাম। পথ ছাড়ুন। আমি যাব। ”

বালিকা শোন,
” তোমাকে একটা খেলাঘর উপহার দিলে নিবে?”

” খেলাঘরতো একটু হাওয়াতেই ভেঙ্গে পড়ে যাবে। ”

” তুমি এটা কিভাবে জান?”

” বারে। আমি পলিসহ গ্রীষ্মের ছুটিতে কত বানিয়েছি কলাপাতা ও নারকেলপাতা দিয়ে খেলাঘর। তারপর বাতাস বইতে শুরু করল। অমনি হুড়মুড় করে আমাদের খেলাঘরটা ভেঙ্গে গেল। ”

নিমিষেই শয়ন হই হই করে উঠল মাঝ রাস্তায়। চোখ পাকিয়ে বাহ বাহ,

” বালিকা ঘর বোঝ তুমি, কিন্তু মন বোঝনা। ”

” কার মন বুঝব আমি? ” জিজ্ঞেস করল তন্দ্রা।

” কার আবার। এই পথ হারা পথিকের।”

” আপনি এমন বিরক্ত করেন কেন আমায়? লোকে দেখলে আমার বদনাম হয়ে যাবে। ”

বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে বলল তন্দ্রা।

” যত বদনাম হোক। যত কলংক হোক। আমি তোমাকে চাই। চাই মানে চাইই।”

” কিন্তু আমিতো চাইনা। এক পাক্ষিক কোন কিছুতে পূর্ণতা আসে?”

শয়ন নিশ্চুপ হয়ে যায় নিশ্চল পাহাড়ের মতো। আকূলভরা কন্ঠে গলায় জানতে চাইলো,
” কেন চাওনা বালিকা। আমার ভুল বা অপরাধ? বা আমি তোমার অযোগ্য?”

” আপনি চেয়ারম্যানের ছেলে। বড়লোক আমাদের চেয়ে। আপনাদের ক্ষমতা ও বেশী আমাদের চেয়ে।”

” এইই আমাকে এড়িয়ে চলার কারণ?”

” হুম। আর কিছু এখন মনে পড়ছেনা।”
বলেই তন্দ্রা ব্যস্ত পায়ে হাঁটা ধরলো। শয়ন কিছুই বললনা আর। কেবল হাসল এক ঝলক।

———-

শয়ন বাবার সামনে বসে আছে। এক পাশে বসে রইলো তার মা। বাসার অন্যরা আমোদ ফূর্তিতে ব্যস্ত। তাই রুমের ভিতরে এদের কথোপকথনে কোন বিঘ্ন ঘটছেনা। কামরুল মির্জা বিজ্ঞের মতো ঠান্ডা গলায় ছেলেকে বললেন,
” সামনে নির্বাচন। তুমি যেভাবে নির্মম আচরণ করছ বউয়ের সাথে। যে যদি তোমাকে ছেড়ে চলে যায় এই মুহুর্তে। কি হবে ভেবে দেখেছ একবার। আমি নির্ঘাত হেরে যাব। আর তুমিই নিজেই তোমার মাকে বলছ, এই মেয়েকে পছন্দ করো তুমি। ভালোবাস। বিয়ে করলে এই মেয়েকেই করবে।

কি বলনি এটা? ”

” হুম বলছি। কিন্তু বাবা…”

কামরুল মির্জা শয়নকে থামিয়ে দিলেন হাত উঠিয়ে।

” আমিও তোমার মাকে বলছি এই মেয়েকে আমার ও বেশ পছন্দ। বাপ ছেলের পছন্দ এক হয়ে গিয়েছে। তাহলেতো কোন সমস্যাই নেই। তুমি রইলে দেশের বাইরে। আমি মেয়েটার বাবাকে প্রস্তাব দিয়ে ফেললাম। এবং তারা সবাইকে জানিয়ে দিল বিয়ের বিষয়টা। ঠিক তারপরেই ঘটল সেই অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্ছিন্ন ঘটনাটা।
এবার আসি তোমাকে জানানোর বিষয়টায়। তোমার মায়ের মুখেই শুনলাম এই মেয়ের প্রতি তোমার গভীর ভালোবাসার কথা। সেই সূত্র ধরেই আমি তোমাকে বিষয়টা অবগত করিনি। তোমার মা বারবার বলছে তোমাকে জানাতে।এটা সত্যি।

আমি মনে করলাম , যাকে ভালোবাস তার এমন কিছু শুনলেও তুমি সহজভাবেই নিবে। তোমার উপরে এটা ছিল আমার ধারণা নয় একান্ত বিশ্বাস।

এখন হয়তো তুমি বলবে তাহলে কেন জানাইনি। কারণ আমি চিন্তা করলাম, তুমি আঘাত পাবে মনে। এবং সেটা পজেটিভলি। কি দরকার দূরে থাকা তোমাকে চিন্তার মাঝে ফেলে দেওয়ার। দেশে আসলে শুনবে বা জানাব। কিন্তু বিষয়টা হয়ে গেল হিতে বিপরীত। তুমি নেগেটিভলি দেখলে বিষয়টাকে। আমি স্তম্ভিত! নির্বাক! মেয়েটার প্রতি তোমার ভালোবাসা, বিশ্বাসের খুঁটি এতটা নড়বড়ে দেখে।”

” বাবা আমার প্রবলেমটা ব্যক্তিগত। আমি এক্সপ্লেইন করতে পারছিনা। আমার যন্ত্রণাটা যদি দেখাতে পারতাম। তাহলে রিয়েলাইজ করতে পারতে তোমরা। ”

” শোন আমি বলতে চাই, যতকিছুই হোকনা কেন। তুমি কোন কঠিন সিদ্বান্ত নিবেনা। এটা আমার অনুরোধ নয় আদেশ। এবং কি নির্বাচনের পরেও না। প্রয়োজনে তুমি একাকী জীবন যাপন করো আপাতত। বউ আলাদা ঘুমাক অন্যরুমে। আর কয়দিন পরতো চলেই যাচ্ছ আবার। মনে রেখো,
পৃথিবীতে কোন সমস্যায় চিরস্থায়ী নয়। সেটা বাহ্যিক সমস্যা হোক আর মানসিক সমস্যা হোক। ”

নামাজ পড় নিয়মিত। মানসিক শান্তির জন্য মহানবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকাল সন্ধ্যায় নিয়মিত এ দোয়াটি পড়তেন। কখনো তা ছাড়তেন না। তুমিও পড়বে অন্তত রোজ একবার করে হলেও।

[আবু দাউদ-৫০৭৬ ইবনে মাজাহ-৩৮৭১]

” আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফওয়া ওয়াল আফিয়াতি ফিদ দুনিয়া ওয়াল আখিরাতি। আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফওয়া ওয়াল আফিয়াতি ফি দিনি ওয়া দুনিয়াই ওয়া আহলি ওয়া মালি। আল্লাহুম্মাজতুর আওরাতি ওয়া আমিন রাওয়াতি। আল্লাহুম্মাহ ফিজনি মিনবাইনি ইয়াদাই ওয়া মিন খলফি ওয়া আন ইয়ামিনি ওয়ান শিমালি ওয়া মিন ফাওকি। আউজু বিআজমাতিকা মিন বুখালি।

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই এবং দুনিয়া ও আখেরাতে প্রশান্তি চাই। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই এবং আমার দীন, আমার দুনিয়া, আমার পরিবার পরিজন এবং আমার ধন-সম্পদের ব্যাপারে প্রশান্তি চাই। হে আল্লাহ! আমার সব গোপন দোষগুলোকে তুমি ঢেকে রাখ, এবং আমার সব ভয়ের স্থানে তুমি আমাকে নিরাপত্তা দান কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে সামনে পেছনে ডানে বামে ও উপরে সর্বদিক দিয়ে রক্ষা কর। হে আল্লাহ! তোমার বড়ত্ব ও মহত্ত্বের উসিলায় আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই, আমি যেনো আমার নিচের দিক দিয়ে মাটিতে দেবে না যাই।”

” যেই মেয়েটাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতাম বাবা৷ পবিত্র মনে করতাম। সেই মেয়েটাকে আমার আগে অন্যকেউ ছুঁয়েছে। এটা মনে হলেই আমি ঠিক থাকতে পারিনা। তার চেয়েও বড় কথা হলো ওকে এমন একজন স্পর্শ করেছে। যে ছিল আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। আমি বিয়ের দিন বিকেলেই জানলাম সব। সেই ছেলে ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে আমার ফেসবুক মেসেঞ্জারে। এখানে আরো বিষয় আছে। আমি বলতে পারছিনা বাবা। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে কেবল।”

শয়ন হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল ছোট বাচ্চার মতন। দেয়ালে মাথা ঠোকাতে লাগল।

শাহিদা বেগম ও ছেলেকে ধরে কেঁদে ফেললেন। ছেলের মাথাকে বুকে চেপে ধরে বললেন,
” বাবা শুধু একবার এটা স্মরণ করে দেখতো। যদি তোমার ভালোবাসার তন্দ্রা কোন কারণে মারা যেত। তখন তোমার বুকে যেই যন্ত্রণা হতো।যে পোড়া দহন হতো। তার চেয়েও কি বেশি হয়ে গেল নাকি বেঁচে থাকা তন্দ্রার জন্যে পাওয়া এই যন্ত্রণা ও দুঃখ? ”

কামরুল মির্জা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে চাইলেন। ছেলেকে মোক্ষম যুক্তি দেখাতে পেরেছে বলে।

মা..মাগো বলে শয়ন মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
” আমি হেরে গিয়েছি মা। আমি পরাজিত হয়েছি এক জায়গায়। ”

চলবে ঃ ৩( প্লিজ মন্তব্য ও শেয়ার করে প্রেরণা দিবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here