মিঠা রোদ পর্ব ৩৫

1
2298

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:৩৫
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

পৃথিবীর সবথেকে বিদ্রুপ জড়িত হাসিটা যেন এইমাত্র হেসে নিলো দিশা।কবীরের কথাগুলোকে তোয়াক্কাও করলো না।বরং চেয়ার থেকে নিজের ব্যাগটা হাতে তুলে বলল,

“তোশা তুমি কবীরের বাবাকে কী বলে ডাকো?নিশ্চয় দাদা কিংবা নানা নয়।সেখানে তোমার মা আঙকেল বলে ডাকে।হয়তো তুমিও তাই ডাকবে।এই একটা জিনিসে বোঝা যায় তোমাদের সম্পর্কের রঙ মাখা ভালোবাসা প্ল্যান করা কতোটা নো ং রা।তোমরা যেটাই বলো না কেন?শেষে বিয়েটা আমি হতে দিবো না।আমি মটেও চাইবো না শেষ জীবনে গিয়ে আমার একমাত্র সন্তানের বাবা কষ্ট পাক।আজ উঠি।”

কবীর বা তোশা দুটো মানুষ যেন মুখে কুলুপ এঁটে রইলো।সুমিষ্ট চেহারায় দিশা নামের মানুষটা কতোটা না সত্য কথা বলল তাদের।তবে এই সত্যটি হজম হলো না প্রেমিক যুগলের।অভিমানে তোশা কবীরকে ছেড়ে বের হয়ে গেলো।দিশা পুনরায় মনকাড়া হাসলো।

“ছোট মরিচের ঝাল যেমন বেশী।ঠিক তেমনটা ওর মতো মেয়েদের আবেগ বেশী।তাই নিজের ভাতিজির কথা চিন্তা করে হলেও সরে যাও সবকিছু থেকে।”

“আমরা রিলেশনে আছি এটা বৃষ্টি তোমাকে বলেছে?”

“হ্যাঁ।ওর রিকোয়েস্টে এখানে আসা।স্বার্থপর হবেনা।সারাজীবন ভাই ও তার পরিবারের জন্য কতোকিছু করলে।এটা শেষ বেলায় এসে ধুঁয়ে দিবেনা আশা করি।”

কবীর নিশ্চুপ।যেন কথা বললে অজানা মহামারী ছড়িয়ে পড়বে।সুগঠিত পেশিবহুল হাত গুলো দ্বারা দিশাকে বাহিরের রাস্তাটি অবশ্য দেখাতে ভুললো না।

“আমার পরিবার দিশা।কী করবো সেই বিষয়ে প্রাক্তনের থেকে নিশ্চয় উপদেশ নিবো না।”

“কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাক্তন আশীর্বাদ স্বরুপ হয়ে থাকে।ভালো উপদেশ গুলো গ্রহণ করো।আসছি।”

“আর ফিরে এসো না।”

অপমানটা গ্রহণ করলো না দিশা তবুও মুখের রঙ পরিবর্তন করে বের হয়ে গেলো।কবীরের মনে হলো দুজন স্বার্থবাদী নারী একা করে চলে গেলো তাকে।

(***)

“মন্দ বলুক সমাজ
তুমি আমারই, হায়, বলবো শতবার
ও আমার বন্ধু গো
চির সাথী পথ চলার,
তোমারই জন্য গড়েছি আমি
মঞ্জিল ভালোবাসার।”

গানগুলোর প্রত্যেকটি লাইন তোশার মনে বিষাদ জুড়ে দিলো।পরনে তার কুঁচি করা সুন্দর একটি জামদানী।আশির দশকের মেয়েদের মতোন করে খোঁপা করা চুলে।এইতো আজ শ্যুটিং এর দ্বিতীয় দিন তার।বেশ ভালো অভিনয় করছে তোশা।কিন্তু ডিরেক্টর সোহান হয়তো তৃপ্ত হতে পারছেনা।তাকে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসিয়ে রেখেছে।ব্যক্তিটা অবশ্য অমায়িক।গানের গলা সুন্দর।তোশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁকিয়ে দেখছে।সোহান মিষ্টি হেসে বলল,

“গানটা ভালো গেয়েছি তোশা?কী বলো?”

“আসলেও সুন্দর স্যার।”

“যখন সালমান শাহ্ ও মৌসুমির শ্যুটিং চলছিলো এই গানটায় তখন বাবার হাত ধরে এসেছিলাম দেখতে।সেই থেকে আমার প্রিয় গান।তোমাকে আমার কাছে সেই আর্লি এইজের মৌসুমীর মতোন লাগে।মিষ্টি মেয়ে।”

হুট করে কোথাও থেকে প্রতীক এসে তাদের পাশে বসলো।তোশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“নায়িকারা দেখতে মিষ্টি হয় সোহান ভাই।জানেন না কোনো স্পার্ক না থাকলে সে নায়িকা নয়।তোশা অভিনয়ে আরো ভালো করতে হবে।কিন্তু তোমার চেহারা বড় সুন্দর।”

“প্রতীক স্যার।অভিনয় জগতে সব কী সৌন্দর্য নাকী?দক্ষতা বলে কিছু নেই?”

মাথা দুলালো প্রতীক।একটা ছেলে দৌড়ে এসে তাকে কফি দিয়ে গেলো।সেখানে চুমুক বসিয়ে বলল,

“ফিফটি-ফিফটি।দুটোই লাগে।যাই হোক কেমন লাগছে?”

“ভালোই।খারাপ না।”

“আরো ভালো লাগতো যদি এতো কড়াকড়ি নিয়মে না থাকতে।মিস.শাহ তো সব ঠিক করে দিয়েছে।এমনকি তোমার পোশাক গুলোও।”

তোশা কথাগুলোর বিপরীতে অধর প্রসারিত করলো শুধু।কবীরের সঙ্গে কয়েকদিন ধরে নীরবে বোঝাপড়া চলছে তার।কারণটা অবশ্য দিশা।একটু অভিমানে তোশা ভেবেছিল ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবে মানুষটা।কিন্তু ওইযে পাষাণ হৃদয়ের মানুষ।

“কোথায় হারিয়ে গেলে তোশা?”

“এখানে আছি।”

প্রতীক হালকা ইতস্তত করলো।কিন্তু মেয়েটিকে তো পেতে হবে।এই কারণে নিজের ভালো প্রভাব বিস্তার করার নিমিত্তে বলল,

“আমার আগের কাজগুলো দেখেছো কখনো?কেমন লাগতো আমাকে?”

“হালকা পাতলা দেখেছি।কিন্তু আমার মামী আপনার খুব ফ্যান।”

“একদম ডাই হার্ড ফ্যান কোন নায়কের তুমি?”

তোশা মিনমিন করে বলল,

“সে অভিনেতা নয়।কিন্তু তার ফ্যান আমি।”

প্রতীক উপলব্ধি করতে পারলো মেয়েটা কার কথা বলছে।নিজেকে সর্বোচ্চ শান্ত রেখে বলল,

“মানুষটা কী কবীর স্যার?”

“হ্যাঁ।”

“ভয় করেনা এতো সিনিয়র কাওকে পছন্দ করতে?”

“বুঝলেন কীভাবে?”

“জানি একভাবে।”

তাদের কথার মধ্যিখানে সোহান সিন শ্যুট করার তাড়া দিলো।এবার বেশ ভালো করে অভিনয় করছে তোশা।দৃশ্যের এক পর্যায়ে মেয়েটার খোঁপায় ফুল গুঁজে ভালোবাসা ব্যক্ত করলো প্রতীক।বিনিময়ে তোশার নতমুখে লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো।ঠিক যেন লালচে করঞ্জ।

কবীর দূর থেকে দৃশ্যটি দেখলো।বুকে চিনচিনে ব্যাথা হলো তার?হয়তো।গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়ালো।তোশার আড়চোখের দৃষ্টি অবশ্য তার উপর পড়েছে।মেয়েটা দৃশ্যটি শেষ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো।এতে অবশ্য অভিনয়টি আরো নিখুঁত হলো বটে।

সোহান বৃদ্ধা আঙুল উঁচু করে বলল,

“খুব সুন্দর হলো তোশা।একটু ব্রেক নাও।বিকেলে আবার একটা দৃশ্য আছে।”

“জি ধন্যবাদ।”

তোশা পা চালিয়ে কবীরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।তবে মুখটা এখনও নিচের দিকে।এক হাতে আঁচলটি জড়িয়ে নিচ্ছে।মেয়েটির হাবভাব কেমন যেন অদ্ভূদ।কবীর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

“কী সমস্যা?”

ভেঙে ভেঙে বলল তোশা,

“লজ্জা পাচ্ছি।”

“কেন?”

“আপনাকে দেখে।ইশ কতো সুন্দর আপনি।”

কবীর মুখে সংক্রিয়ভাবে হাসি চলে এলো।তবুও গম্ভীরতা বজায় রেখে বলল,

“তুমি আর লজ্জা?অভিনয় থেকে বের হও।”

“এভাবে বলবেন না।বুঝেন না কেন?নারী হওয়ার চেষ্টা করছি।আপনি এখন আমাকে হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন আমি জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলবো।আঁচলে মুখ লুকাবো।আপনি লজ্জা ভাঙিয়ে আরো কাছে আসবেন।এরপর…।থাক আপনি এসব কিছু করেন না।রোমান্স বর্জিত ব্যাটা।”

তোশার কথাটি শেষ হওয়ার সঙ্গে মেয়েটি বাহু ধরে নিজ কাছটায় টেনে নিয়ে এলো কবীর।বুকের সঙ্গে লেপ্টে গেলো যুবতী।আলতো হাতে তার কপালের চুলগুলো সরিয়ে বলল,

“বেলাডোনা,তুমি কিন্তু লজ্জা পাচ্ছো না।এভাবে আমার দিকে তাঁকিয়ে দেখছো কী?”

তোশা এখনও পলকবিহীন মানুষটিকে দেখছে।লজ্জা সেটা তো দূরের বিষয়।

“কবীর শাহ।আমাদের সম্পর্কটা কী নো ং রা?”

“দিশার কথাগুলো এখনও ভাবছো?”

তোশা সোজা হয়ে একটু দূরে সরে গেলো।আঁচলটা টেনে বলল,

“ভাবার বিষয় নয় কী?কিন্তু নো ং রা তো সেই সব সম্পর্ক যেখানে কাওকে ঠকানো হয়।আমরা কাওকে ঠকাচ্ছি না।হয়তো আপনি আমার বাবা-মায়ের বন্ধু।বয়সে বড়।কিন্তু কী বলেন?ভালো আপনাকে লাগে।শান্তি আপনাকেই লাগে।অথচ সকলে বলে বদলে যাবো।এইযে অনুভূতি।সব শেষ হয়ে যাওয়া এতো সহজ?”

কবীর তোশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“বড়দের মতোন কথা বলো না।তোমাকে ছোটখাটো পুতুল হিসেবে ভালো লাগে।চলো আজ রিক্সায় ঘুরবো আমরা।”

“শ্যুটিং আছে যে।”

“ওটা আজ হবেনা।আমি না করে দিবো।এই শাড়ীতেই চলো।”

“আপনি এতো ব্যস্ত।তাও কেন রোজ আমার জন্য সময় বের করেন?ভালোবাসেন এজন্যই তো।আমার জায়গায় অন্য কাওকে নিয়ে আসতে পারবেন?”

“সম্ভব না।এসব ভাবতে হবেনা।আমি ভবিষ্যতের সব ঝড় দেখবো।”

“তাহলে আমাদের সম্পর্ক নো ং রা না।হ্যাঁ ঠিক নো ং রা না।”

তোশা বারংবার কথাটি বলছে।কবীরের বড় মায়া হলো মেয়েটিকে দেখে।কাওকে পছন্দ করে নিজের করতে চাওয়ার মধ্যে হয়তো কোনো নোং’রামি নেই।দুটো মানুষ অসম ভালোবাসাতে জড়িয়ে গিয়েছে।একে অপরের সঙ্গে একটু ভালো থাকা তাদেরও প্রাপ্য।এইযে রিক্সায় হাত ধরে বসে আছে দুজন।কয়েকজন ইতিমধ্যে বাঁকা দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে তাদের।কিন্তু এই কবীর-তোশা প্রেমিক যুগলের সেগুলোর জবাব দেওয়ার সময় আছে নাকী।

নাকে মিষ্টি রজনীগন্ধার সুগন্ধে চিন্তা থেকে ফিরলো কবীর।যুবতী তার কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।হাত বাড়িয়ে ফুলটিকে দুমড়েমুচড়ে কংক্রিটে রাস্তায় ফেলে দিয়ে স্বস্ত্বি ফিরলো তামাটে পুরুষটির।নিজের বেলাডোনার গায়ে অন্য কারো দেওয়া ফুলের টোকাও দিতে নারাজ সে।কবীরের মন হঠাৎ বলে উঠলো,

“বেলাডোনার প্রতি এতো ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছে কীভাবে সে?এমন মায়াতে শেষ হওয়াও ভালো।”

চলবে।
এডিট ছাড়া পর্ব।সকলে সর্বোচ্চ রেসপন্স করবেন।কেমন লাগলো জানাবেন।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here