শেষ বয়সের প্রাপ্তি পর্ব ৩

0
860

#শেষ_বয়সের_প্রাপ্তি
পর্বঃ ৩
লেখনীতেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)

মায়ের কান্না শুনেে এক প্রকার তাড়াহুড়া করেই মায়ের রুমের দিকে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি মা কান্নাকাটি করছে। মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম আসলে মাকে যে কি বলব আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তারপরও বললাম,

– মা, আপনি তো মা হতে চলেছেন এটাতো আমাদের সবার জন্য অনেক বড় একটা খুশির খবর তাহলে কান্নাকাটি কেনো করছেন? আপনি আমাকে বলেছেন রবিনের জন্মের পরে আল্লাহ পাকের দরবারে কত কান্নাকাটি করেছেন, আর একটা সন্তানের জন্য এতো বছর পর আজ আল্লাহপাক আপনার সেই আশা পূরণ করেছেন। প্লিজ মা এভাবে কান্নাকাটি করবে না। আল্লাহ নারাজ হবেন।

– বৌমা, তাই বলে এই বয়সে এসে আল্লাহপাক এমন একট পরীক্ষার মধ্যে আমাকে ফেললেন!! আমি এই সমাজে মুখ দেখাবো কি করে?

– মা এভাবে বলবেননা। আর এতে আপনি নিজেকে কেন দোষী ভাবছেন? আপনার তো কোনো দোষ নেই!! হয়ত সয়ং আল্লাহপাক নিজেই চাইছেন এমন কিছু হোক। তা না হলে ভেবে দেখুন তো, কতো মানুষের একটা সন্তানের জন্য কতো হাহাকার। একসময় আপনিও কতো চেয়েছিলেন তখন না হয়ে এখন হচ্ছে যেটা এই বয়সে এসে কখনোই সম্ভব না। যদি না আল্লাহ পাক নিজে হাতে না দেন।

– না সোহেলী এ হয়না, এটা কোনো ভাবেই সম্ভব না। আমি এই বাচ্চা রাখতে পারবোনা। এই বয়সে এসে আমি সমাজের কারো সামনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না। তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলো। আমি এই বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবো।

– ছিঃ মা, এমন পাপ কথা মুখেও আনবেন না। আপনি আপনার বিয়ের ১১ বছর পরও যখন মা হতে পারেননি, মা ডাক শোনার জন্য রাতের পর রাত বালিশ ভিজিয়েছেন সেদিন সমাজ আপনার পাশে এসে দাঁড়ায়নি, সমাজ আপনাকে সেদিন মা ডাক শুনাতে পারেনি, বরং উল্টো আপনাকে কটু কথা শুনিয়েছিলো। আপনি এক বেলা না খেয়ে থাকলে সমাজ আপনাকে এক বেলা খেতে দিবে না, তাহলে কিসের সমাজ!! কিসের লজ্জা!! হ্যাঁ আমাদের সামজ নিয়ে বাস করতে হয় তাই সবার সাথে মিলে মিশে চলতে হয়, আর চলবো আর এই বিষয়টা সমাজ কিভাবে নিবে সেটা সমাজের লোক গুলো বুঝবে। তাতে আমাদের কোনোকিছু থেমে থাকবেনা মা। আপনি এই নিয়ে আর কোন চিন্তা করবেন না। যখন যা হয় তখন সেটা দেখা যাবে।

– কিন্তু!!

– কিন্তু কি মা?

– রবিন!! আমার রবিনের সামনে দাঁড়াবো কি করে?

– মা, আপনি এসব নিয়ে একদম ভাববেন না। রবিন ছোটো বাচ্চা না যে সে কিছু বুঝবেনা। রবিন ঠিক সবটা বুঝতে পারবে। আর সব থেকে বড়ো কথা এতে আপনার কোনো হাত নেই যা কিছু এসেছে আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে।

মা কোনো কথা বলতে পারছেনা কেঁদেই চলেছে। আমি উনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি কিন্তু আমারই কি বা করার আছে। তারপরও যতটুকু পারলাম চেষ্টা করলাম বুঝানোর।

– মা, চলুন গোসল করে খেয়ে নিবেন।

– আমার কিছুই ভালো লাগছেনা মা। তুমি যাও আমি পরে গোসল করে নিবো।

– আপনার শরীর ঠিক নেই ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারছেন না। আপনাকে একা ছাড়বোনা আমি গোসল করিয়ে দিয়ে তারপর যাবো।

জোর করেই মাকে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করিয়ে, মাথার চুল গুলো যখন আঁচড়ে দিচ্ছিলাম ঠিক এমন সয়ম কলিংবেলটা বেঁজে উঠলো। আমি গিয়ে দরজা খুলে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন বাবা বাসায় ঢুকার সময় আমাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

– এই যে আমার মা চলে এসেছে। দরজা খুলে আমার মায়ের মুখটা না দেখলে আমার শান্তি লাগেনা। দিনটাই যেনো অপূর্ণ থেকে যায়।

কিন্তু আজ বাবা কোনো কথা না বলেই মাথা নিচু করে ভিতরে চলে গেলো। বুঝতে পারলাম বাবা সবটা জেনে গেছে তাই লজ্জায় আমার থেকে মুখ লুকাতে চাইছে। সব বুঝতে পেরে আমিও আর বাবাকে কিছু বললাম না।

মায়ের রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম মা খুব কান্নাকাটি করছে। মনে মনে বললাম কাঁদুক নিজের প্রিয় মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে কিছুক্ষণ কাঁদলে হয়তো একটু হালকা হতে পারবে।

রুমে গিয়ে আম্মুর কাছে কল দিলাম। মায়ের কান্না দেখে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তাই আম্মুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললে হয়তো আমারও একটু ভালো লাগবে।

– আম্মু কেমন আছো?

– এইতো রে মা ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি আম্মু। আব্বু কেমন আছে?

– তোর আব্বুও ভালো আছে।

– কি করছো আম্মু?

– বসে আছিরে মা, তোর বাবা আসবে তাই অপেক্ষা করছি। রবিন সকালে কল করেছিলো তোর শাশুড়ী নাকি অসুস্থ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। তুই নাকি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিস? ডাক্তারের কাছে ব্যাস্ত থাকবি তাই কল দেইনি।

– হ্যাঁ আম্মু, মা একটু অসুস্থ।

– ডাক্তার কি বললো?

আম্মুকে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। আর না বলারই বা কি আছে এটা আহামরি কোনো অপরাধ তো না বরং খুশিরই খবর। যে যেভাবে নিবে তার কাছে এটা তেমন খবরই হবে।

– আম্মু!!

– হ্যাঁ মা বল। তোর শাশুড়ীর কি অবস্থা? কি বললো ডাক্তার?

আমি মুখে কিছুটা হাসি নিয়ে বললাম,

– আম্মু জানো আমি ভাবি হতে যাচ্ছি।

– কি বলিস এগুলো!! তোর মাথা ঠিক আছে?

– মাথা কেনো ঠিক থাকবেনা। মা কনসিভ করেছে, কিছু দিন পর আমাদের বাসাতে ছোট্ট একটা বাবু আসবে। তাকে নিয়ে সারা বাড়ি খুশিতে মেতে থাকবে।

আম্মু কেমন যেনো চুপ হয়ে গেলো। আমি এপাশ থেকে ডেকেই যাচ্ছি কিন্তু আম্মু কোনো সাড়া শব্দ দিচ্ছে না। অনেক্ষণ পর,

– আম্মু আছো?

– হ্যাঁ আছি।

– কি হলো কথা বলছোনা যে!

– কি বলবো ভেবে পাচ্ছিনা। কিন্তু তুই খুশি?

– হ্যা আম্মু খুব খুশি এমন একটা সু সংবাদে পেয়ে খুশি না হয়ে পারা যায় বলো!! রবিনের পরে মা তো চেয়েছিলো মায়ের কোল জুড়ে আরো একটা সন্তান আসুক। এখন মায়ের সে আশা পূরন হয়েছে। কিন্তু শুধু সময়টা ঠিক নেই। তাতে কি হয়েছে আমরা তো আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে।

– তোর শাশুড়ী খুশি?

– না আম্মু। মা অনেক কান্নাকাটি করছে শুনার পর থেকে।

– সবই তো বুঝলাম কিন্তু এই বয়সে এই ধকল কি নিতে পারবে তোর শাশুড়ী!

– কি আর করার বলো, কোনো কিছুই তো আমাদের হাতে নেই। আল্লাহতো আছে সব ঠিক করে দিবে।

– সেটাই, আল্লাহকে ডাক। আর দেখি আমি একসময় সময় করে গিয়ে দেখে আসবো।

– আচ্ছা আম্মু, তাহলে আমি এখন রাখছি। মাকে আবার খেতে দিতে হবে।

– আচ্ছা মা যা।

মনে মনে সোহেলীর মা আসমা বেগম বেশ খুশি হলো। যতটা খুশি রবিনের মায়ের মা হওয়াটা তার চেয়ে দ্বিগুণ খুশি তার মেয়ে সোহেলী হাসি মুখে এতো সহজে এতো কঠিন একটা পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে সব কিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

সোহেলী তার মায়ের সাথে কথা শেষ করে মোবাইলটা রেখে তার শাশুড়ীর রুমের সামনে গিয়ে বললো,

– বাবা, আপনি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে মাকে নিয়ে খেতে আসুন আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেলো।

আমি এসে টেবিলে খাবার গুছাতে শুরু করলাম। সব কিছু গুছিয়ে অনেক্ষণ হলো বাবা মায়ের অপেক্ষা করছি কিন্তু কারো কোনো খোঁজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমি আবার গিয়ে ডাকলাম,

– মা আসবো?

কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমি আবার ডাক দিলাম,

– মা আমি আসবো ভেতরে?

– মা বললো, হ্যাঁ মা এসো।

ভেতরে গিয়ে দেখি বাবা অফিসের ড্রেস পরে মাথা নিচু করে এখনো বসে আছে। মা নিজের চোখটা মুছে কান্নাটা আড়াল করতে চাইলো আমার কাছ থেকে। বুঝতে পারলাম তাদের মনের উপর দিয়ে কি যাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললাম,

– কি ব্যাপার বাবা আপনি এখনো সেই ড্রেস পরেই বসে আছেন? সেই কখন বলে গেছি ফ্রেশ হয়ে নিতে।
আর মা শুনেন, বাবার বিরুদ্ধে কিন্তু আমার একটা অভিযোগ আছে এর বিচার কিন্তু আপনি করবেন তা না হলে আমি ভিষণ রাগ করবো।

– কি অভিযোগ মা?

– নতুন অতিথি এখনো আসেনি মাত্র আসার খবর পেয়েছে বাবা। তাতেই আমাকে পর করে দিয়েছে। জানিনা পরে কি করবে। বাসায় ঢুকে আজ বাবা আমাকে মা ডাকেনি, বাবার সেই মিষ্টি হাসিটা আমি পাইনি আজ বাবার কাছ থেকে। এটা কিন্তু আমি মানবোনা।

মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উনার চোখ দুটোতে কালো মেঘ জমেছে অনেক আগেই, পানিতে টলমল করছে চোখ দুটো বৃষ্টি নামবে এখনি।

চলবে…..

কেমন হচ্ছে জানাবেন অবশ্যই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here