শেষ বয়সের প্রাপ্তি পর্ব ৫

0
659

#শেষ_বয়সের_প্রাপ্তি
পর্বঃ ৫
লেখনীতেঃ আয়েশা সিদ্দিকা (লাকী)

রবিন রিপোর্ট গুলো এপিঠ ওপিঠ উল্টে পাল্টে পড়ে হাত থেকে রিপোর্ট গুলো দুরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এক প্রকার চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,

– এগুলো কি এনে দিছো আমার সামনে? ফাজলামি করো আমার সাথে?

– ফাজলামির কি দেখলে যা রিপোর্ট সেটাই তো তোমাকে দিলাম, এতে এতো সিরিয়াস হওয়ার কি আছে সেটাই তো বুঝলামনা!! আর ওই রুমে বাবা মা আছে এমন চিৎকার কেনো করছো? আস্তে কথা বলো উনারা শুনতে পাবে।

– চিৎকার করছি কেনো সেটা তুমি জিজ্ঞেস করছো?

– হ্যাঁ আমি জিজ্ঞেস করছি।

– এতো কিছুর পরও আমাকে জিজ্ঞেস করছো আমি কেনো চিৎকার করছি?

– রবিন তুমি একজন শিক্ষিত আর যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে। মায়ের এমন রিপোর্ট দেখে অন্তত তোমার এমন রিয়েক্ট করা মানায় না।

– সোহেলী!! তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি নিয়ে নাচছো? আমি অফিস, বস, কলিগ, আর সমাজে কিভাবে এটার মুখোমুখি হবো? কিভাবে আর পাঁচটা মানুষকে কি বলবো?

– রবিন আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, মা তোমার, মা আমার, আর তুমি মায়ের কথা না ভেবে তুমি ভাবছো তোমার অফিসের বস, কলিগ আর সমাজের কথা? তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি আমি। এই দুনিয়ায় কেও না বুঝলে অন্তত তোমার মা কে বুঝা উচিৎ ছিলো। এই সময় আমাদের উনার পাশে দাঁড়ানো উচিৎ। আর তুমি তা না করে উনার উপর আঙুল তুলছো।

– সোহেলী আমি কারো দিকে আঙুল তুলছিনা। আমি আমার সমস্যার দিক গুলো বলতে চাইছি মাত্র। আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষ আমার দিকে আঙুল তুলে যা বলার বলবে যা তোমাকে আমি বুঝাতে পারবোনা।

– বাহহহ রবিন, রাস্তা দিয়ে বুঝি তুমি একাই হাঁটবে? আমি বা আমরা কেও হাঁটবোনা? যে কথা গুলো আজ আমার বলার কথা ছিলো, তুমি যেমন রিয়েক্ট দেখাচ্ছো সেই রিয়েক্ট আজ আমার দেখানোর কথা ছিলো সেটা তুমি ছেলে হয়ে কি করে পারছো?

– সোহেলী তোমার এই ফালতু জ্ঞান মুলক কথা আমার কাছে অসহ্য লাগছে তুমি যাও এখান থেকে।

– আজ আমার একটা কথা মনে হচ্ছে মা যে ১১ বছর একটা সন্তানের জন্য হাহাকার করেছে তার চেয়ে মায়ের হয়তো নিঃসন্তান থাকাই ভালো ছিলো যে সন্তান মা বাবার দিক না ভেবে ভাবে সমাজের লোকের দিকটা। এমন সন্তান কেনো হয় মানুষের!!

আমি আর কোনো কথা না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম, নিজের রাগকে আর কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। আমি ভাবতেও পারিনি রবিনের মত ছেলে এমন ভাবে রিয়েক্ট করবে। আমি ভেবেছিলাম মা তো সবসময় চেয়েছিলো আরেকটা সন্তান। আর এই সন্তান আসাতে রবিন খুশিই হবে। কিন্তু আমার ভাবনটা এভাবে ভুল প্রমানিত করে দিলো!!

রুম থেকে বেরিয়ে দেখি মা ডাইনিং এর পাশে পানির বোতল হাতে দাঁড়িয়ে। কয়েক ফোঁটা লোনা পানি দু গাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়েছে ডাইনিং টেবিলের উপর। হয়তো পানি নিতে এসেছিলো এসে রবিনের সব কথা শুনে ফেলেছে।

আমি মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের কাঁধে হাত রাখতেই মা বললো,

– তুমি পারবেনা মা। রবিন কে আর কিছু বলোনা। আমি একটা ব্যাবস্থা ঠিক করে ফেলবো।

আমি কোনো কথা বলার আগেই হাত দিয়ে চোঁখের পানি মুছে রুমে চলে গেলো। কিছু বলার সুযোগটা আর পেলামনা। কিন্তু না, মাকে কোনোভাবেই এটা করতে দেয়া যাবেনা মায়ের বয়স হয়েছে আর বাচ্চাও কনসিভ করা চার মাস হয়ে গেছে এখন কিছু করতে গেলে মায়ের জিবনের রিস্ক আছে। আমি বেঁচে থাকতে মায়ের কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবোনা আর বাচ্চাটার কি দোষ!! অন্য কারো জন্য সে কেনো পৃথিবীতে আসতে পারবেনা!! আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।

আমি কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। রবিনকে কি করে বুঝাবো!! আল্লাহ তুমি সহায় হও রবিনকে সু-বুদ্ধি দাও। যেভাবেই হোক রবিনকে বুঝাতে হবে।

আমি রুমে যেতেই রবিন বেরিয়ে চলে গেলো। পিছন থেকে কয়েকবার ডাকলাম কিন্তু কোনো কথাই শুনলোনা, চলে গেলো। কিন্তু আমি এখন কি করবো? আমি জেনে শুনে এভাবে মাকে আর উনার অনাগত সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে পারিনা। দেখি রাতে আরেকবার বুঝানোর চেষ্টা করবো।

মাগরিবের আজান দিচ্ছে চারদিকে আমি ওজু করে নামাজে বসলাম আল্লাহ পাকে দরবারে চেয়ে দেখি হয়তো উনিই সব ঠিক করে দিতে পারেন। নামাজ শেষ করে রান্না করতে চলে গেলাম। যাই হয়ে যাকনা কেনো খেতে তো হবে। রান্না শেষ হতে হতে রাত নয়টা বেজে গেলো।

আমিও হাত মুখ ধুয়ে ওজু করে এশার নামাজ পড়ে নিলাম। শরীর মন দুটোই খুব ক্লান্ত লাগছে কি যে করবো কোনোদিন ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিনা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি রাত প্রায় ১১ টা বেজে আসছে রবিন এখনো আসছেনা। এদিকে বাবা মায়ের খাওয়ারও সময় হয়ে গেছে।

আচ্ছা রবিন যখন আসে আসুক বাবা মাকে খেতে দিয়ে দেই। মায়ের রুমের সামনে গিয়ে বেশ কয়েকবার ডাক দিলাম কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ নাই। এবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে শুরু করলাম,

– মা ও মা দরজা খুলেন অনেক রাত হয়ে গেছে আসেন খেয়ে নিন। বাবা ও বাবা দরজাটা খুলেনতো।

কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। এভাবে বেশ কয়েকবার ডাকার পর বাবা এসে দরজা খুললো।

– কি ব্যাপার বাবা সেই কখন থেকে ডাকছি কথা বলছেন না যে!!

– এমনি মা।

– মা কই? আসুন মাকে সাথে করে নিয়ে এসে খেয়ে নিন। মায়ের অনেকগুলো ওষুধ আছে রাতে খেয়ে সেগুলো খেতে হবে।

– রবিন এসেছে?

– না বাবা এখনো আসেনি। হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছে আপনার খেয়ে নিন রবিন আসলে আমি আর রবিন একসাথে খেয়ে নিবো।

– রবিন আসুক একসাথে খাই!!

আমি জানি রবিন আসলেও বাবা মায়ের সাথে খেতে বসবেনা তখন বাবা মা আরও বেশি কষ্ট পাবে। তাই কথা ঘুরিয়ে বললাম,

– বাবা রবিনের আসতে অনেক দেরি হবে। আমি কল করেছিলাম একটা কাজে আটকে গেছে। আর মা অসুস্থ এই সময় এতো রাত জাগা ঠিক হবেনা।

– আচ্ছা আসছি।

আমি গিয়ে টেবিলে খাবার গুছাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর বাবা মা এসে বসলো টেবিলে। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মায়ের চোখদুটো ফুলে গেছে হয়তো অনেক্ষণ ধরে কান্না কাটি করেছে। মা বললো,

– সোহেলি, মা তুমিও আমাদের সাথে খেয়ে নাও।

– মা রবিন আসলে আমি আর রবিন খেয়ে নিবো আপনারা খান।

– রবিন আজ এসে আর খাবেনা সেটা খুব ভালোভাবেই জানি। বরং ও আসলে তুমি খেতে ডাকলে উল্টো পাল্টা কথা শুনাবে তখন তোমার আর খাওয়া হবেনা। তখন আমার আরো বেশি কষ্ট হবে। তুমি খেতে বসো আমাদের সাথে।

আমি আর কোনো কথা না বলে খেতে বসলাম আসলে আমিও আর কথা বাড়াতে চাইছিলাম না। আমিও জানি মা যেটা বলেছে সেটাই হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সব কিছু গুছিয়ে আমি রুমে এসে শুয়ে রবিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষা করতে করতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। কিছু একটার শব্দ পেয়ে ঘুম ভাঙলো তাকিয়ে দেখি রবিন এসে ফ্রেস হচ্ছে। উঠে রবিনকে বললাম,

– ফ্রেস হয়ে এসো টেবিলে খাবার দিচ্ছি।

– আমি খেয়ে এসেছি খাবোনা।

আমি আর কথা বাড়ালামনা শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে নাস্তা বানাতে গেলাম নাস্তা বানিয়ে টেবিলে নাস্তা গুছাচ্ছি এমন সময় খেয়াল করলাম রবিন বেরিয়ে যাচ্ছে। বললাম,

– রবিন নাস্তা না করে চলে যাচ্ছো কেনো সব গুছানো হয়ে গেছে নাস্তা করে যাও।

– খিদে নেই পরে আমি বাইরে থেকে নাস্তা করে নিবো।

কথাগুলো বলেই রবিন বেরিয়ে চলে গেলো। আমি অসহায় এর মত তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনের অজান্তেই দু গাল বেঁয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কাওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হাত দিয়ে পানি মুছে মা বাবাকে নাস্তা করার জন্য ডাকতে গেলাম। মা বাবাকে ডেকে উনাদের খাবার রেডি করছি এমন সময় মা এসে জিজ্ঞেস করলো,

– রবিন কি অফিস চলে গেছে?

– হ্যাঁ মা মাত্রই বেরিয়ে গেলো।

– খেয়ে গেছে?

– হ্যাঁ মা খেয়ে গেছে।

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমিও বসে নাস্তা করতে শুরু করলাম। গলা দিয়ে নামছিল না খাবার। কেমন জানি সব আটকে আসছিলো তবুও জোর করে কিছুটা খেয়ে নিলাম।

মা বাবা নাস্তা করে রুমে চলে গেলো। খেয়াল করলাম বাবা কেমন চুপ হয়ে আছে কোনো কথা বলছেনা। আমিও আমার রুমে চলে এলাম। এভাবেই কেটে গেলো কিছুদিন। রবিন বাবা মা কারো সাথে কথা বলেন না। ভুল করে যদি মা বা বাবা কারো সামনে যদি পড়ে যায় তাহলে মাথা নিচু করে চলে যায়।

আমি বেশ কয়েক দিন কয়েক ভাবে রবিনকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি তাকে বুঝাতে ব্যার্থ হয়েছি আমি। বুঝাতে গেলেই ঝগড়া লেগে যায় উল্টা পাল্টা কথা শুনায় তাই আমিও আর কিছু বলিনা। বাবা মাও আগের থেকে চুপ হয়ে গেছে। পুরো বাসা জুড়ে কেমন একটা থমথমে পরিবেশ।

একদিন সকালে নাস্তা বানিয়ে বাবা মাকে খাইয়ে আমিও খেয়ে এসে শুয়ে আছি। শুয়ে থাকতে থাকতে চোখটা লেগে এসেছিলো। হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি আমার ক্লোজ এক বান্ধবী নিশি কল করেছে।

চলবে….

(কমেন্টে জানাবেন কেমন হচ্ছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here