বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা শেষ পর্ব

0
335

#বী°রা°ঙ্গ°না_হইতে_বা°রা°ঙ্গ°না
#মম_সাহা

অন্তিম পর্ব-৬

আজও নিয়ম করে সূর্য উঠলো। পেঁজা তুলোর দল ছুটে বেড়ালো আকাশ ঘেঁষে। প্রকৃতি তার নিয়ম অনুযায়ীই কার্য শুরু করলো কেবল বদলালো মানুষের জীবন ধারা। আজ পত্রলেখাদের নড়বড়ে বাড়িটা তে ঘটলো অন্যকিছু। রোজকার মতন আজ কাক ডাকা ভোরে বাড়ির সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় মেয়েটা প্রয়োজনীয় কাজ গুলো করলো না রুটিন অনুযায়ী। বাসি থালাবাসন অযত্নে পড়ে রইলো রান্নাঘরের কোণঘেঁষে। শুকনো পাতার স্তূপও জমে রইলো তার নিজের জায়গায়। গোবর জল দেওয়া হলো না বাড়ির দরজাটাতে। শুনশান নিরবতায় আচ্ছাদিত রইলো বাড়ির প্রাঙ্গণ যা ঘুমিয়ে থাকা বাড়িটার মাঝেও শিহরণ বইয়ে দিলো।

বাহিরে তুমুল মোরগ ডাকার শব্দ হচ্ছে কিন্তু উঠোনে হচ্ছে না কোনো ঝাঁট দেওয়ার শব্দ যা অবাক করলো ছায়াকে। নিমিষেই হালকা হয়ে গেলো তার ঘুম। এক ঝটকায় সে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। রোজকার অভ্যাসে ভাঁটা পড়তেই অবাক হলে সে। ব্যস্ত পায়ে ছুটে এলো উঠোনে। যেমনের উঠোন পড়ে আছে তেমন ভাবেই। ভারী অযত্নের শুকনো ঝড়া পাতা গুলো ক্ষীণ বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছে কেবল। ছায়া কণ্ঠ একটু উঁচুতে তুললো, ব্যস্ত কণ্ঠে পত্রকে ডাকলো,
“কালিন্দী, এই কালিন্দী!”

পত্রের ঘরের দরজা আগের মতনই খিল দেওয়া। অথচ পদ্ম এবং পুষ্প কাঁচা ঘুম নিয়েই বেরিয়ে এলো নিজেদের ঘর থেকে। বেরিয়ে এলেন সমিরবাবুও। পত্র এবং তার পিসি এক রুমে থাকতো। পিসির মৃ° ত্যুর পরও হাজার জোর করা স্বত্তেও সে রুম ছাড়ে নি। কাল সারা টা রাত সে কীভাবে থাকলো একা একা সেই রুমে! কিঞ্চিৎ কী ভয়ও করলো না! যতই হোক,কাছের বা পরিচিত মানুষটার মৃ ত্যু র পর কিছুদিন তাদেরকে আমরা কাছ থেকে বেশ অনুভব করি। সেটা আমাদের মতি ভ্রম হোক কিংবা স্মৃতির তাড়নায় হোক, আমরা তাদের অস্তিত্ব টের পাই। যাকে আমার অলৌকিক কিছুর নাম দিয়ে ভীত হই। অথচ চরম ভীতু মেয়েটা কিনা কাল সারারাত এই আশ্চর্য জনক কাজটা করে ফেললো! বাড়ির প্রতিটা মানুষের ভাবতেই লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো।

সমিরবাবু কপাল কুঁচকে বিরক্তের স্বরে বললো,
“কী সমস্যা, ছায়া? তুমি ওরে ডাকো ক্যান?”

“আজ ও দোর খুলে নি দেখো। কোনো কাজও করে নি! ও তো এমন কখনোই করে নি। কী হলো ওর!”

ছায়ার কণ্ঠে তুমুল উৎকণ্ঠা যাতে ঘুম ছুটে গেলো উপস্থিত বাকীদেরও। সবাই ই ছায়ার কথা অনুযায়ী চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে চারপাশটা পরোখ করে দেখলো। সত্যিই তো! আজ যেমনের উঠোন তেমনই রয়েছে! সকলের মাঝেই তুমুল বিস্ময়ের ছোঁয়া। তার মাঝেই ছায়া আবার বেশ জোরে ডাকলো,
“কিরে কালিন্দী, উঠেছিস?

ছায়ার ডাকের পর মিনিট দুই পেরুতেই সশব্দে পত্রের ঘরের দরজাটা খুলে গেলো। হেলতে দুলতে বেরিয়ে এলো পত্র যাকে দেখে ভূ° ত দেখার মতন চমকে উঠে সবাই। অতি উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠে পুষ্প। ছায়ার ভাষারা দিশেহারা হয়, দিশেহারা হয় তার অনবরত ধুকপুক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডটাও। সমিরবাবুও অবাক হলেন। পত্রের নির্ঘুম থাকা টানা টানা চোখ যুগলে তখনও কোনো আবেগ নেই। কেমন কর্কশ, ভাষাহীন।

সেকেন্ড পেরিয়ে সময়টা যখন মিনিটের ঘরে যায় তখন হুঁশ ফিরে সবার। ছায়া মুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠে এই কাক ডাকা ভোরে। আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং কণ্ঠ উঁচিয়ে বলে,
“চুলের এই কী করেছিস তুই? এত ঘন, লম্বা চুল গুলো ঘাড় অব্দি হলো কীভাবে? কেটেছিস কেন! কখনই বা কাটলি?”

“কাল রাতে।”

মায়ের এমন উচ্চ কণ্ঠের বিপরীতে পত্রের কণ্ঠ শীতল। ছোটো কণ্ঠে দিয়ে দিলো মায়ের উত্তর। ছায়া হতভম্ব চোখে তাকায় স্বামীর পানে। বলতে চায় অনেককিছু কিন্তু অনাকাঙ্খিত ঘটনায় তার শব্দ গুচ্ছ হোঁচট খাচ্ছে বার বার।

সমিরবাবু মেয়ের দিকে এগিয়ে যায়। সেও কম অবাক হয় নি। তবুও মেয়ের অবস্থা হয়তো বুঝতে পারে সে তাই তো মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে বলে,
“চুল গুলো কেটেছিস কেন, মা? কত সুন্দর চুল।”

“চুল গুলো আঁচড়ে দেওয়ার মানুষ তো বিদায় নিয়েছে তো শুধু শুধু অযত্নে ফেলে রাখবো কেন? তাই কেটেছি।”

সমির বাবু তপ্ত শ্বাস ফেলেন। মেয়ে যে তার পিসিকে ভীষণ ভালোবাসে, এটা কারোই অজানা না। গোপনে বাড়লো হতাশা। মেয়েকে আর কিছু বলার ভাষা তিনি খুঁজে পেলেন না। কেবল ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“সব মানুষ চির কাল থাকবে না তোর সাথে, এটা মেনেই আগাতে হবে।”

“মানুষ না থাকুক, স্মৃতি গুলো তো আছে। তা যে ঘুমাতে দেয় না।”

সমিরবাবু কিয়ৎক্ষন মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়ের দিকে তাকালেই নিজের বোনের কথা মনে পড়ে। এমন না যে পত্রের সাথে সরলার চেহারার কোনো মিল আছে, তবুও কোথাও যেন অনেক মিল। দুঃখের দিক দিয়ে কী? সমিরবাবু কোনোরূপ কথা না বলেই নিরবে প্রস্থান নেন। ছায়া কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। পত্রও আবার আগের মতন নিঃশব্দে চলে যায় নিজের ঘরে। ছায়ার সাহস হয় না মেয়েকে কিছু বলার। কেমন ধ্বংসাত্মক রূপ মেয়ের! মানুষ হারানোর শোকে মেয়েটা কী পা° গল হলো?

_

কঠোর নির্বাসন বেছে নেয় পত্র। দিন দুই কেবল দোর দিয়ে পড়ে থাকে নিজের ঘরে। বিচ্ছিন্ন হয় নিজের ছুটন্ত স্বত্তা থেকে। তখন শোকের নদীতে তার ভরাডুবি অবস্থা প্রায়। পিসির মৃ ত্যু র তৃতীয় দিন চলছে আজ। ভর সন্ধ্যাবেলা বিন্নী এসে হাজির পত্রদের বাড়ি। রোজকারের মতন আজও পত্রের ঘরের দরজা আটকানো। বিন্নী এসেই পত্রের দরজায় ঠকঠক শব্দ করে। বাড়িতে তখন ছায়া একা, তাও ঘুমে। বিদ্যুৎ নেই পুরো চা বাগানে। পদ্মলতা গিয়েছে পুকুরপাড়, দুপুরের এঁটো থালাবাসন মাজতে। পুষ্পও বাড়িতে নেই, হয়তো আছে কোথাও দস্যিপনা নিয়ে। বিন্নীর হাবভাবে কেমন যেন একটা গোপনীয়তা। গলার স্বরেও চোরা চোরা ভাব। পত্রের দরজায় দ্বিতীয়বারের মতন ক্ষীণ শব্দ করে প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“পত্র, খোল দরজাটা। আমার জরুরী কথা আছে।”

বিন্নীর এমন সতর্ক কণ্ঠে হয়তো পত্রের সন্দেহ হলো। সে মিনিট পেরুতেই সাবধানে খুলে দিলো দরজাটা যেন কোনো শব্দ না হয়। পত্র দরজা খুলতেই ঘরের ভেতরে সাবধানী পা ফেলে প্রবেশ করে বিন্নী। পত্রের ঘরে হারিকেন জ্বলছে মিটমিট আলোয়। বিন্নী সেই নিভু নিভু আলোতে যখন পত্রের দিকে তাকালো আচমকাই সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। অপ্রত্যাশিতভাবে কণ্ঠ থেকে অদ্ভুত এক মিহি স্বরের চিৎকার ভেসে এলো। পত্র বেশ বিরক্ত হলো সেই চিৎকারে। কপালে তিন-চার ভাঁজ ফেলে বিরক্ত কণ্ঠেই বললো,
“অমন চিৎকার করছিস কেন? পাড়া প্রতিবেশি ডাকার ধান্দা?”

বিন্নী ততক্ষণে অবাকের সপ্তম পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কথা বলতে চেয়েও পারছে না বলতে। সে কেবল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে পত্রকে! কেমন অচেনা পত্র! বিন্নী কিছুটা সংশয় মাখানো কণ্ঠে বলে,
“তোর এ কী সাজ? এমন অদ্ভুত ভাবে ঘরের ভেতর সেজে আছিস কেন?”

পত্র হু হা করে হেসে উঠে। হাতের গাঢ় লাল রেশমি চুড়ি গুলোকে শব্দ করে নাচাতে নাচাতে বলে,
“সুন্দর না? পিসি সবসময় বলতো, আমি যেন সেজে থাকি। তাই সাজলাম আরকি। কেমন লাগছে?”

বিন্নী আবারও পত্রকে পা থেকে মাথা অব্দি পরোখ করে। চোখ যুগল বোধহয় বেরিয়ে আসতে চায়। সাদা ফকফকা একটা থ্রি-পিস পড়ে আছে পত্র। ঘাড় অব্দি চুল গুলো মাঝে সিঁথি করে রেখেছে তাও তেল দিয়ে চুপচুপে। তার মোটা, সরু ওষ্ঠতে লেপেছে লাল রঞ্জক। কালো বর্ণের হাতে লাল বর্ণের আলতা টা বড্ড বেশিই বোধহয় বেমানান লাগছে! আবার অন্যদিকে আলতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেছে। কেমন একটা গা ছমছমে ভাব থাকা স্বত্তেও বিন্নী কৃত্রিম হাসি দিলো। অস্বস্তি নিয়ে বললো,
“সুন্দর লাগছে।”

“পিসির মতন লাগছে তো?”

বিন্নী চুপ করে থাকে। পত্রকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। ভয়ও জেঁকে ধরেছে। তবুও বিন্নী সেসব প্রসঙ্গ পাল্টে পত্রের হাতখানা শক্ত করে ধরলো, প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো,
“একটা জিনিস দেখাতে নিয়ে যাবো তোকে।”

“কী জিনিস?”

পত্রের প্রশ্নের উত্তর দেয় না বিন্নী বরং পত্রের হাত ধরে সাবধানে টেনে নিয়ে যায় ঘরের বাহিরে। যেতে যেতে তারা বাড়ির সামনের মাঠ পেরিয়ে ঘন জঙ্গলে ঘেরা পুকুর পাড়ে হাজির হয়। অন্ধকার রাস্তা, তুমুল নিরবতা। পত্রের মনে প্রশ্নের ছড়াছড়ি অথচ বিন্নী উত্তর না দেওয়ার ব্রত করেছে।

পুকুরের ডান দিকটাতে, যেখানে বটগাছের ঝোপঝাড়টা অবস্থিত, ঠিক সেখানে পত্রকে নিয়ে গেলো বিন্নী। পত্র কথা বলার জন্য ওষ্ঠ মৃদু কাঁপাতেই বিন্নী পত্রের মুখ শক্ত হাতে ধরে ফেলে। সাবধানী কণ্ঠে বলে,
“একটাও কথা বলিস না। কেবল ঝোপের দিকে উঁকি মে রে দেখ।”

পত্র মানলো বিন্নীর কথা, কথা বললো না। আলগোছে তাকালো ঝোঁপের ফাঁকে। অনাকাঙ্খিত, খুব ঘনিষ্ঠ কোনো দৃশ্য চোখে পড়তেই পত্র আৎকে উঠে। চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে তাকালো বিন্নীর পানে৷ কোনো রকম কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“ওরা! কী করছি এসব! ছিহ্।”

বিন্নী থামিয়ে দিলো পত্রকে। পত্রের হাতটা টেনে সতর্কতার সহিত বললো,
“চল এখান থেকে। তোর বোনের কীর্তি দেখার দরকার নেই।”

পত্রের চোখে তখনও অবিশ্বাস্যের ছোঁয়া। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“ওরা এখানে এসব করছে! এখানে আমার পিসিটা শেষ প্রাণ ত্যাগ করেছে, এই স্থানটাকে অপবিত্র করার কী দরকার ছিলো?”

“ভেঙে পড়িস না। আমার সাথে চল। এখান থেকে যেতে হবে।”

“এখান দিয়ে না, বাঁশঝাড় দিয়ে যাবো চল। এখান দিয়ে গেলে কারো না কারো চোখে পড়ে যাবো।”

পত্রের কথায় সাই জানালো বিন্নী। আঁধার হাতড়ে পথ ধরলো বাঁশের ঝাড়ের দিকে। বাঁশঝাড়ের প্রায় বেশ খানিকটা গভীরে যেতেই পত্র কিছু একটার সাথে পা বেঁধে পড়ে গেলো। শুকনো ডালা গুলো হাঁটুতে লেগে সাথে সাথে জ্বলে উঠলো হাঁটু। পত্র প্রায় ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠলো। বিন্নী এগিয়ে এলো দ্রুত, ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে পত্র? ব্যাথা পেলি কীভাবে? কিসের সাথে পা লেগেছে?”

পত্র ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
“জানিনা, কী যেন একটা আছে এখানে নরম নরম।”

বিন্নী হঠাৎ অনুভব করলো ভোঁটকা একটা গন্ধ আসছে। চারপাশ ভালো করে খুঁজে ডানদিকে তাকাতেই চিৎকার দিলো সে। বিন্নীর দৃষ্টি অনুভব করে পত্রও সেখানে তাকালো। নিমিষেই তার ব্যাথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কেবল শীতল কণ্ঠে তাকিয়ে বললো,
“লা° শ! পঁচে যাওয়া লা° শ! অভ্রদা!”

(সমাপ্ত)

লেখিকার কিছু কথা —–

[বিঃদ্রঃ প্রথম পরিচ্ছেদের অন্তিম পর্ব এটা। ধরুন এটা কেবল সহজ সরল পরিচ্ছেদ ছিলো। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে তুমুল রহস্য শুরু হবে এবং তৃতীয় পরিচ্ছেদে রহস্য সমাপ্ত বা গল্পের সমাপ্তি হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here