নিষিদ্ধ পল্লীর বিরাট আলিশান আঁধারীয়া রুমটার মাঝে নতুন কাস্টমারের অপেক্ষায় অপেক্ষারত সেখানের মালকিন, রূপমাধুরী। চুলের ভাঁজে থাকা তাজা বকুল ফুলের মালাটা থেকে মোহনীয় সুঘ্রাণ পরিবেশটাকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মায়াবি করেছে। স্লিভলেস ব্লাউজের উপর জড়ানো পাতলা টিস্যুর ন্যায় সাদা শাড়ি এবং ঠোঁটে লাগানো লাল টকটকে রঞ্জকে তাকে আবেদনময়ী কোনো অপ্সরা মনে হচ্ছে। রুমের চারপাশে নিভু নিভু আলোয় জ্বলতে থাকা মোমবাতির কারণে তার শরীরকে কোমল মাখনের সাথে নির্দ্বিধায় তুলনা করা যাবে। একটু পর পর সে তার শরীরে মিষ্টি সুগন্ধীটা মেখে নিচ্ছে। নিজেকে আকর্ষণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা সে করেছে। আজকের খদ্দের টা বেশ পয়সাওয়ালা কিনা। একবার তার চোখে পরে গেলে টাকার বিছানায় দিবানিশি নিদ্রা যাপন করা যাবে। তাই তো সে অন্যান্য মেয়েদের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই আদর-যত্নের ব্যবস্থা করেছে।
রূপমাধুরীর ভরা টসটসে আবেগের সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন খদ্দের টা রুমের ভেতর প্রবেশ করলো। চোখ-মুখে কামুক এক হাসি দিয়ে রমণী যখন তার খদ্দেরের দিকে তাকালো, অনাকাঙ্খিত মানুষটাকে দেখে সে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। মোমের আবছা আলোয় বহু পরিচিত প্রেমিকের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অনেকগুলো বছর পর, প্রিয় প্রেমিকের বিছানার সঙ্গী হওয়ার জন্যই বুঝি এত আড়ম্বর পূর্ণ আয়োজন ছিলো! রূপমাধুরী দু’পা পেছনে চলে গেলো। অবাক ভাব তার শরীরের শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ এর বেগে ছুটে গেলো।
শুধু রূপমাধুরী নয়, তার সামনের মানুষটাও কম অবাক হয় নি। চোখ দু’টো যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। কণ্ঠে শব্দ দের আন্দো° লন। তবুও লোকটা কোনো মতে উচ্চারণ করলো,
“বীরাঙ্গনা!”
রূপমাধুরী টান টান কণ্ঠে বললো,
“বীরাঙ্গনা না, আমি বারাঙ্গনা।”
_
১৪১৯ বঙ্গাব্দের দোসরা জ্যৈষ্ঠ, বৃহস্পতিবার। সিলেটের বিশাল চা বাগানের ভেতর মিহি সুরে ডাকছে কোকিল। ভোর হতে না হতেই দেখা দিয়েছে ঠা ঠা শুষ্ক রোদের। সেই রোদ মাথায় নিয়ে এপাড়া-ওপাড়া ছুটে বেড়াচ্ছে পত্র। আজ তার প্রচুর কাজ, বড়বোনের বিয়ে কিনা! কত কিছু তাকে জোগাড় করতে হচ্ছে ছুটোছুটি করে!
গ্রামের সরু পথটি দিয়ে পনেরো বছরের কিশোরী পত্র ছুটে যাচ্ছে পাড়ার জেঠিমাকে ডাকতে। কী যেন একটা নিয়ম আছে বিয়ের যেটা জানার জন্য একজন বড় মানুষ দরকার, তাই তো পত্রের মা তাকে পাঠিয়েছে জেঠিমার কাছে। কোনো মতে নাকেমুখে শ্বাস আটকে সে ঠাকুর বাড়ির জেঠিমার কাছে এসে পৌঁছালো। জেঠিমা তখন কেবল রান্না বসিয়েছে। পত্র হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে জেঠিমাদের পিঁড়ের উপর বসেছে। বুকের উপর ভাজ করা সুতির ওড়না টা দিয়ে ছোটো কালো মুখটার ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
“জেঠিমা, ও জেঠিমা, একটু আমাদের বাড়িতে চলো, মা বলেছে তোমারে নাকি দরকার এক্ষুনি। কী যেন একটা কাজ আছে।”
ঠাকুর বাড়ির জেঠিমা বিশেষ হেলদোল দেখালো না পত্রের কথায়। বরং মাটির চুলায় সরু একটা বাঁশের টুকরোর সাহায্যে ফু দিতে দিতে বললো,
“ও পত্র, মা শোন না, আমি এখন তোর জেঠা মশাইয়ের জন্য রান্না বসিয়েছি। সে মিনসে তো দুপুরের শুরুতেই গরম গরম ভাত না পেলে তা°ন্ডব চালিয়ে দেয়। তুই নাহয় গোঁসাই দের বড় বউকে নিয়ে যা। ও মহিলা আবার ভালো নিয়মকানুন জানে।”
পত্র গোঁ ধরলো। চোখ-মুখ কুঁচকে বললো,
“না না, মা তোমাকেই যেতে বলেছে। আর তোমার যেই পিতলের বড় কড়াইটা আছে না, সেটাও নিতে বলেছে।”
ঠাকুর জেঠিমা বিরক্ত হলেন। বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
“আমার বাড়ির সব বাসনপত্র দেখি তোদের বাড়িতে চলে যাচ্ছে। কী বিয়ে ধরলি বাপু! অন্যের কাছ থেকে খুঁজেমেগে বিয়ে ধরার কী দরকার ছিলো বলতো দেখি!”
জেঠি মায়ের কথা তেমন গায়ে মাখলো না পত্র৷ বরং সে জেঠিমার পাশে এসে গায়ে গা ঘেঁষে বসে পড়লো। জেঠিমার হাতের খুন্তিটা জোর করে নিজের হাতে নিয়ে তরকারি নাড়তে নাড়তে বললো,
“আমরা তোমরা কী আলাদা হলাম নাকি গো? আমরা চা বাগানের সবাই ই তো সবার আত্মীয়। যাও না গো জেঠিমা। তুমি না আমার লক্ষী জেঠিমা, যাও না। দিদির বিয়েটা ভালোই ভালোই মিটে গেলে সবারই তো খুশি তাই না বলো? তুমি আমাদের বাড়ির কাজটা শেষ করতে করতে আমি তোমার রান্নাবান্না এগিয়ে দিবো। এবার যাও লক্ষী জেঠিমা।”
এমন মিষ্টি, আহ্লাদী আবদার ফেলতে পারার সাধ্য কারো নেই। তাই তো না চাইতেও ঠাকুর জেঠিমা উঠে দাঁড়ালো। বেশ শক্ত কণ্ঠে বললো,
“একমাত্র তোর এই মায়ার জন্য আমি কিচ্ছুটি করতে পারি না। মায়া দিয়ে যেন সব বেঁধে রাখবি এমন পণ করেছিস। তা আমি যাচ্ছি কিন্তু, সাবধানে করবি সবকাজ। আর শোন, তোর অভ্র দাদা কিন্তু একটু পর চা খাবে। তাকে একটু ঘন করে চা বানিয়ে দিস কেমন? দুধের সর দিবি। আর ওর পড়ায় বিরক্ত করিস না কেমন?”
পত্র ভালো মেয়ের মতন মাথা নাড়ালো। জেঠিমা ছুটলো পত্রদের বাড়ি। জেঠিমা বের হওয়ার পর মিনিট দুই পেরুতেই জেঠিমাদের বাড়ির ভেতরের রুম থেকে ডাক ভেসে এলো। পত্র ডাক শুনেই চা বসিয়ে দিলো দ্রুত। অভ্র দাদার শৃঙ্খলার বাহিরে যাওয়া পছন্দ না। সঠিক সময়ে চা না পেলে হয়তো বাড়ি মাথায় তুলবে। খুব দ্রুত হাতেই চা বানিয়ে ফেললো পত্র। রান্না-বান্নায় একদম পাকাপোক্ত সে। যেকোনো রান্না সে খুব দ্রুতই সেরে ফেলতে পারে কোনো রকমের সাহায্য ছাড়ায়। বাড়ির বেশিরভাগ কাজ তো সে-ই করে। দিদি আবার তেমন কাজ-টাজে হাত দিতো না। সারাক্ষণ হাত-পায়ে গাঢ় আলতা দিয়ে নকশা এঁকে, চুলের মাঝে সুন্দর সিঁথি করে, কাজল দিয়ে অপ্সরা সেজে, এপাড়া ওপাড়া হেঁটে বেরানোই ছিলো দিদির কাজ। পত্রও কম পাড়া ঘুরে না কিন্তু মেয়েলি সাজগোজের প্রতি তার আবার আকর্ষণ কম। আকর্ষণ কম থাকার কারণও আছে। ছোটোবেলা থেকেই গায়ের মেটে কালো রঙের জন্য তেমন রূপসীর খাতায় তাকে কেউ বসায় নি। মনের মাঝে কেবল একটা ধরণা পুষেই সে বড় হয়েছে, কালোদের রঙিন হওয়া বারণ। এতে অবশ্য তার আফসোস নেই, দিদির ফকফকা সাদা শরীরটার দিকে তাকালেই তার চোখ জুড়িয়ে যায়। তাই তো সে সবসময় টাকা জমিয়ে জমিয়ে বাজার থেকে চকচকে রঙের রেশমি চুরি এনে দিদির দুই হাত ভরে পড়িয়ে দেয়। তখন দিদির হাত গুলো দেখলে মনে হয় যেন নিজেই পড়ে আছে। ভালো চকচকে রঙের কোনো জামা আনলে তা সে দিদিকেই দিয়ে দেয়। দিদি পড়লে যে চোখ জুড়ানোর মতন শান্তি, তাতেই পত্রের রাজ্যের তৃপ্তি। অথচ সেই দিদি এখন অন্যের ঘরে চলে যাবে ভাবতেই তার কষ্ট হচ্ছে।
পত্রের ভাবনার মাঝে ভেতর ঘর থেকে আবার চায়ের জন্য ডাক ভেসে এলো। পত্র তাড়াতাড়ি শরীরে ওড়না টা ভালো করে জড়িয়ে চায়ের কাপ নিয়ে ছুটে লাগালো অভ্র দাদার ঘরে। ঠাকুর জেঠা মশাই বেশ শৌখিন, তাই তো কী সুন্দর করে বাড়ির ভেতরটা সাজিয়েছে! পত্রের কাছে এ বাড়ির সবচেয়ে পছন্দের জিনিস হলো লাইব্রেরী। জেঠা মশাই একটা বিরাট লাইব্রেরী তৈরী করেছেন, অবশ্য কেবল জেঠা মশাই না অভ্রদাও বই পড়তে বেশ ভালোবাসেন। শহর থেকে আসার সময় কত রকমের বই নিয়ে আসেন।
পত্র চায়ের কাপটা নিয়ে ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ওড়নাটা আরও একবার ঠিক করে নিলো অতঃপর ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“অভ্রদা, আসবো?”
কথার পরে আরও নিরব হলো পরিবেশ তার কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই ঘর থেকে গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“পত্র নাকি? আয়।”
পত্র দরজা টা আরেকটু হা করে খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। রুমটা কেমন ঠান্ডা! শিরশির করে উঠলো পত্রের শরীর। রুমটা থেকে কেমন মিষ্টি সুবাস ভেসে এলো! কেমন মোহনীয় সেই ঘ্রাণ! এই রুমটার আবহাওয়া সবসময় এমন শীতল থাকে। মানুষটা এত ঠান্ডার মাঝে কীভাবে থাকে কে জানে? গরম কালে এমন ঠান্ডা টা ভালো লাগে নাহয় কিন্তু শীতকালে কীভাবে সম্ভব! যতসব অদ্ভূতুরে কান্ডকারখানা। পত্র চায়ের কাপটা নিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। সেই টেবিলেই জ্বলছে রাজকীয় একটা টেবিল ল্যাম্প অথচ অভ্রদা টেবিলে নেই। ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার দরজাটা খোলা। অভ্রদার ঘরটা চা বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ঘর বলা যায়। এত নজরকাড়া সৌন্দর্য ঘরটাতে। কত রকমের আঁকিবুঁকি দেয়ালের মাঝে। যেখানে পুরো চা বাগান জুড়ে মাটি এবং টিনের ঘরের ছড়াছড়ি সেখানে অভ্রদাদা দের বাড়িটা সেগুন কাঠের তাও আবার দোতালা বিশিষ্ট। পত্র চা রেখে যেই না বেরুতে যাবে, সে মুহূর্তে বারান্দা থেকে অভ্রদা’র গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে ডাক এলো,
“পত্রলেখা, শোন তো।”
পত্র দাঁড়ালো। একমাত্র অভ্রদা তার পুরো নামটা বলে ডাকে। এর জন্য পত্রের ভীষণ ভালো লাগে তাকে। নিজের নাম টা অল্পভাষী মানুষের মুখে শুনলে সবারই বোধহয় ভালো লাগে। পত্র ক্ষীণ কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ অভ্রদা, বলো না।”
“পড়াশোনা কেমন চলছে তোর? স্কুলে যাচ্ছিস তো?”
পত্র জিহ্বায় কামড় দিলো। সে তো কিছুদিন ভীষণ পড়াশোনা ফাঁকি দিয়েছে দিদির বিয়ের উপলক্ষে, তা বোধহয় অভ্রদা জেনে গিয়েছে। নাহয় সে তো এমন ভাবে জিজ্ঞেস করতো না।
পত্রকে চুপ থাকতে দেখে অভ্র বারান্দা থেকেই গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এসব বিয়ে, আনন্দ কিছু সময়ের। তোর সাথে থাকবে তোর যোগ্যতা, সাময়িক আনন্দ না। তাই সেই যোগ্যতায় ধ্যান দিবি। শরীরের রঙের খোঁটা নাহয় তোর পিছু ছাড়বে না। বীরঙ্গনা হতে হবে বুঝেছিস?”
চিত্রা ডানেবামে মাথা নাড়ালো তবে ততক্ষণে তার চোখে কিঞ্চিৎ জলের স্রোত এসে হাজির হয়েছে। অভ্রদা যেমন ভাবে গায়ের রঙের কথা মনে করিয়ে দেয়, হাজার যোগ্যতাও সেই রঙের অপমান ঢাকতে পারবে না। পত্র আরেক পা এগুতেই অভ্র আবার বলে উঠলো,
“টেবিলের উপর দেখিস তোর জন্য একটা প্যাকেট রাখা আছে। সেটা নিয়ে বাড়ি যাবি।”
অভ্রর কথা মতো পত্র টেবিলের উপর থেকে প্যাকেট টা নিলো। যেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শুভদা’ উপন্যাস টা ছিলো। পত্র কান্না কান্না মনেও হেসে উঠলো। বই তার ভীষণ পছন্দের। আর এ পছন্দটা সৃষ্টি করেছেও অভ্রদা। এত বই উপহার দিয়েছে। শহরে গেলেই বই দেয়। পত্র বই নিয়ে বেরুতেই দেখে জেঠিমা চলে এসেছে। পত্র আর না দাঁড়িয়ে নাচতে নাচতে ছুট লাগায় নিজের বাড়ির দিকে। সেই ছুটন্ত পত্রের দিকে তাকিয়ে কাঠের কারুকাজ সংবলিত বারান্দা থেকে রুক্ষ মানবের দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো। আক্ষেপের স্বরে বললো,
“তুই কবে বড়ো হবি, পত্র!”
–
ছুটে এসে হাঁপিয়ে ওঠেছে পত্রের শরীর। পত্রের বড় বোন পদ্মলতা তাড়াতাড়ি এসে নিজের ওড়না দিয়ে মুছিয়ে দিলো বোনের ঘর্মাক্ত মুখ খানা। বাবা-মায়ের আদরের তিন বোন ওরা। পিঠাপিঠি বলা যায়। বড়ো বোন পদ্মলতা, মেঝো হলো পত্রলেখা এবং ছোটো জনের নাম পুষ্পলোপা। পত্র এবং পুষ্প সাত মিনিটের বড়ো ছোটো। তাদের চেহারার গড়ণ হতে শরীরের গঠন একদম এক। কেবল ভিন্ন হলো গায়ের রঙ। পত্র কালো এবং পুষ্প বড় বোনের মতনই সুন্দরী। পত্রের বাবা সামান্য কেয়ারটেকার। চা বাগানের দেখাশোনা করেন তিনি। বেশ সাদামাটা মানুষ। ছোটোবেলা থেকেই তিনি সাহিত্য প্রেমী ছিলেন বলেই মেয়েদের এমন কাব্যিক নাম রেখেছিলেন। তবে তাদের শখ অনুযায়ী পরিবেশ ছিল বেশ অগোছালো কিন্তু তাতে কী, মানুষের সাথে মানুষের যে প্রীতি, তা ছিলো অনেক ৷ পদ্মলতা ঘাম মুছতে মুছতে বেশ আদুরে কণ্ঠে বললো,
“অনেক চাপ পরে যাচ্ছে তোর উপর তাই না রে?”
বড়ো বোনের কথায় মুচকি হাসলো পত্র। ডানে-বামে অনবরত মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
“কিসের কষ্ট গো, বড়দি? তোমার জন্য এই পত্রের জান হাজির।”
ছোটো বোনের এহেন কথায় পদ্ম পারে না বুকের সবটুকু স্নেহ ঢেলে দিতে। এই মেয়েটার দিকে তাকালেই কেন জানি তার অগাধ মায়া হয়। হয়তো মা মেয়েটাকে একটু কম আদর করে বলেই পদ্ম সেই ফাঁকা জায়গা টুকু পূর্ণ করতে চায়। বড়বোনের মাঝে এমনেতেও একটা মা মা আভাস থাকে। তন্মধ্যেই বাহির থেকে পদ্মের ডাক পড়লো। পদ্ম বোনকে বসিয়ে ছুটে গেলো বাহিরে। এতক্ষণ সবটাই মনযোগ দিয়ে শুনছিলো পুষ্প। পদ্ম বেড়িয়ে যেতেই সে দ্রুত এগিয়ে এলো পত্রের কাছে। হাতে দেওয়া আলতার মাঝে যত্নসহকারে নকশা করতে করতে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
“এই কালিন্দী, শুনলাম অভ্রদা নাকি বাড়ি এসেছে? সত্যি নাকি?”
“হ্যাঁ এসেছে তো।”
“এবার আমার জন্য কিছু আনে নি? তোর হাতে ওটা কী দেখি তো।”
কথাটা শেষ করেই পত্রের হাতে থাকা বইটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো পুষ্প। কতক্ষণ এপিঠ ওপিঠ উল্টিয়ে বললো,
“বই! ধূর। বই দিয়েছে তোকে? আমার জন্য কিছু দেয় নি তাই না রে?”
শেষ বাক্যটা বলতে বলতে মন খারাপের মেঘ হানা দেয় পুষ্পের সারা মুখ জুড়ে। তা দেখে পত্র তড়িঘড়ি করে ওড়নার কোনা থেকে একটা লাল নেলপলিশ এগিয়ে দেয় বোনের দিকে। মিষ্টি হেসে বলে,
“এই যে, এটা এনেছে। নে ধর।”
পত্রের হাতে নেলপলিশের শিশি দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে যায় পুষ্প। কোনোমতে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো নেলপলিশটা। লাফাতে লাফাতে বললো,
“আমি জানি অভ্রদা আমার জন্য কিছু না কিছু আনবেই। তোকে তো সাজগোছ করলে ভালো লাগবে না তাই বই দিয়েছে। তবুও ধন্যবাদ কালিন্দী।”
পত্র কেবল হাসলো। পুষ্প এবং পত্রের মা পত্রকে কালিন্দী বলে ডাকে কারণ সে কালো। গ্রামের খুব কম সংখ্যক লোকই পত্রের সঠিক নামটা উচ্চারণ করে। সবার কাছেই সে কালিন্দী নামে পরিচিত। হাহ্! গায়ের রঙ কালো হলে, নিজের নামটাও তখন অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যায় যা খুব সহজে আর কারো মুখে শোনা যায় না।
_
গ্রীষ্মের তাপ দাহন প্রকৃতি জুড়ে। সারাদিনের ছুটোছুটির পর ক্লান্ত পত্র ঘর্মাক্ত শরীর খানা নিয়ে ঝাপ দিলো গ্রামের পুকুর খানায়। আহা কী শান্তি! ইচ্ছেমতন ডুবিয়ে পুকুর থেকে উঠে বসলো সে ঘাটে। ততক্ষণে আকাশ মুখ ভার করা শুরু করেছে। অবাধ্য বাতাসের বিচরণে মাত্র স্নান করা শরীরটাতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। সেই কম্পনরত শরীরটা নিয়ে পুকুরের পাশে বড় বকুল গাছটার নিচে চলে গেলো পত্র। তীব্র বাতাসের কারণে কত বকুল যে ঝরে পড়েছে! দেখে মনে হচ্ছে শীতলপাটির ন্যায় কেউ যত্ন সহকারে বিছিয়ে রেখেছে ফুল গুলোকে। পত্র কুড়িয়ে নিলো কিছু ফুল। মালা বানিয়ে বড়দির মাথায় লাগিয়ে দিবে। বেশ মানাবে মেয়েটাকে। কিন্তু কিছু ফুল কুড়িয়ে নিতেই সশব্দে তীব্র আলো ছড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হলো একটি জীপ গাড়ি। পত্রের ভিজে শরীরে আঁটসাঁট হয়ে তখন কালো রঙের জমাটা জড়িয়ে আছে। লজ্জায় কুঁকড়ে যায় পত্র। এই বিকেলে পুকুর পাড়ে সচারাচর কোনো ছেলে আসে না অথচ আজকেই কিনা এমন জীপ গাড়ি আসতে হলো? পত্র কোনো রকমের ফুল গুলো নিয়ে জীপ গাড়ির পাশ কেটে যেতে নিলেই ফুড় ফুড়ে কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এই মেয়ে, দাঁড়াও তো।”
ভীত মন নিয়ে পত্র দাঁড়ালো। জীপ গাড়ি থেকে হুড়মুড় করে নেমে এলো কত গুলো ছেলে। কী সুন্দর সাজ পোশাক তাদের! তন্মধ্যেই একজন বেশ ঠাট্টার স্বরে বলে উঠলো,
“এ দেখি জলজ্যান্ত অমাবস্যা হেঁটে বেড়াচ্ছে। তা খুকি, এমন ভাবে এই গাছতলায় কী করছো? মানুষজন হুট করে দেখলে ভয়ে অক্কা পাবে তো।”
ছেলেটার কথায় ছ্যাঁত করে উঠলো পত্র। সচারচর কেউ তার রূপ নিয়ে কিছু বললে সে এমন ভাবে ছ্যাঁত করে ওঠে না। সবসময়ই নিবিড় থাকে। অথচ আজ কী হলো কে জানে? রেগে গেলো সে, বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তাতে আপনার কী? আপনি তো অক্কা পান নি।”
ছেলেটা বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো বোধহয় পত্রের আচরণে। কারণ মেয়েটা এতক্ষণে যে ভাবসাব নিয়ে রেখেছিল কেউ ভাবতে পারে নি এমন বাঘিনী রূপ ধারণ করবে সে।
ছেলেটার আমতা-আমতা মুখ দেখে তার পাশেই দাঁড়ানো সাদা শার্ট পড়া ছেলেটা অমায়িক হেসে, বাহবা দিয়ে বলে উঠলো,
“বাহ্, দারুণ প্রতিবাদ করতে জানো তো। একদম বীরাঙ্গনা।”
পত্রের মুখ প্রশংসায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অনেক মানুষ তাকে অনেক ভাবে প্রশংসা করেছে কিন্তু এই প্রথম সে না চাইতেও রেগে গিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বীরাঙ্গনা শব্দের ওজন যে অনেক। পত্রলেখা বহন করতে পারবে তো সে ভার?
চলবে,,,,
#সূচনা_পর্ব
#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা
#মম_সাহা
[গল্পটা সাময়িক কারণে রেগুলার দেওয়া হবে না। আর অবশ্যই রেসপন্স করবেন।]