#প্রেমপ্রেয়সী
#পর্ব_১৭
#লেখিকা_N_K_Orni
— আমি তোমাকে বলেছিলাম যে অন্য ছেলেদের থেকে নিজেকে দূরে রাখতে। কিন্তু তুমি বারবার এটাই করো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তাই এটাই ভালো হবে তুমি অন্য ছেলেদের কাছে না যাও।
ম্যাসেজটা পড়ে রাহিয়া খুবই বিরক্ত হলো। সে সাথে সাথে ওই নম্বরে ম্যাসেজ দিল,
— আর যদি যাই তাহলে কি করবেন?
ম্যাসেজটা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ম্যাসেজ এলো,
— যদি যাও তাহলে তাদের এমন অবস্থা করব যেটা তুমি ভাবতেও পারবে না। তাদের পরিণতি খুবই খারাপ হবে। তখনই বুঝতে পারবে কি হলো? তাই বলছি কেন নিজের জন্য অন্য মানুষকে কষ্ট দিবে? ওদের থেকে দূরে থেকে ওদের ভালো থাকতে দেও সাথে নিজেও ভালো থাকো।
ম্যাসেজটা পড়ার পর রাহিয়ার হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ল। সে সাথে সাথে ওই নম্বরে কল দিল। কিন্তু আজকেও বেশ দেরি হয়ে গেছিল। ততক্ষণে ফোন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে রাহিয়ার আবারও নিজের উপর রাগ হলো। তখনই আবারও নম্বর থেকে ম্যাসেজ এলো। সে সাথে সাথে ম্যাসেজটা দেখল।
— তুমি যতই চেষ্টা করো তাতে কিছুই হবে না। আমি না চাওয়া পর্যন্ত তুমি কখনোই আমাকে কল দিতে পারবে না। আমি যদি চাই তাহলেই তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারবে। তাই ধৈর্য্য ধরে আমার জন্য অপেক্ষা কর।
রাহিয়া এবার তাকে ম্যাসেজ দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ম্যাসেজ গেল না। সে আবারও কল দিতে গেল। কিন্তু সেটাও হলো, এবারও বন্ধ বলল। এতে রাহিয়া মন খারাপ করে রুমে চলে এলো। সে রুমে এসে ওই লোকটার দেওয়া ম্যাসেজটা নিয়ে ভাবতে লাগল। এসব ভেবে তার মনে কিছুটা ভয় ঢুকে গেল। সে ফোনের ওই লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল,
— আমার জন্য যদি ওই লোকটা কারো ক্ষতি করে দেয়? সে তো ঠিকই বলেছে। আমার জন্য অন্য মানুষ কেন কষ্ট পাবে? তাহলে এখন আমি কি করব? আমি কি বিয়েটাতে না করে দিব? আমার জন্য যদি সে অন্যদের ক্ষতি করে তখন কি হবে? উফফ! আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না?
এরকম বিভিন্ন কথা তার মনে এসে ভিড় করতে লাগল। অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করার পর সে সিদ্ধান্ত নিল সে বিয়েটা ভেঙে দিবে। কিন্তু কীভাবে বিয়েটা ভাঙবে এটা সে বুঝতে পারবে। তারপর সে ঠিক করল সে তূর্যকে কল দিয়ে বলবে সে যেন বিয়েটা ভেঙে দেয়। কারণ সে তার বাবাকে এই কথা বলতে পারবে না। একটু পর সে তার কথামতো তূর্যকে কল দিল। সে ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেল যাতে কেউ কোনোভাবেই শুনতে না পারে। তূর্য ফোন ধরতেই সে বলে উঠল,
— তূর্য আপনার সাথে আমার কি কথা ছিল? আপনি কি আমার কথাটা রাখতে পারবেন?
— হুম বলো।
— আপনি কি বিয়েটা ভেঙে দিতে পারবেন? প্লিজ আমার জন্য বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি এই বিয়েটা করতে পারব না।
— কিন্তু কেন? তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?
— না, এটা তো আমি সেদিনই বলেছিলাম।
— তাহলে কি কারণে বিয়েটা ভাঙতে চাও? আমাকে কি তোমার পছন্দ না?
— আসলে এসব কিছুই না।
— তাহলে কি? আমাকে আগে বলো তুমি কেন বিয়েটা ভাঙতে চাও? নাহলে আমি বিয়েটা ভাঙব না। তবে তুমি যদি কারণটা বলো তাও আমি বিয়েটা ভাঙার কথা ভাবব না।
— ওহ।
বলেই রাহিয়া ফোনটা কেটে দিল। এরপর সে চিন্তায় পড়ে গেল এখন কি করবে। সে রুমে ফিরে এসে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে লাগল। রাতে তার বাবা বাসায় এলে সে ওনার রুমে গেল। রায়ান সাহেব মেয়েকে দেখে বলে উঠলেন,
— কিছু বলবে?
— আসলে বাবা আমার তোমার কাছে একটা প্রশ্ন ছিল।
তিনি এবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,
— হ্যাঁ বলো। এতে এতো বার জিজ্ঞাসা করার কি আছে?
— আচ্ছা আমি যদি এই বিয়েটা করতে না চাই তাহলে তখন কি করবে?
— তখন তোমার জন্য অন্য ছেলে দেখব। কিন্তু তবুও আমি তোমার বিয়ে দিব। কারণ আমি তোমাকে দ্রুত বিয়ে দিতে চাই।
— ওহ আচ্ছা।
বলেই রাহিয়া চুপ হয়ে গেল। কারণ সে তার বাবার কথাটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল।
— কেন? হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে যে? তুমি কি এই বিয়েতে রাজি না?
— না না বাবা আমি রাজি। আমি তো এমনিই এই প্রশ্ন করলাম।
— সত্যি তো? দেখো রাহিয়া তুমি যদি বিয়েতে রাজি না থাকো তাহলে না বলতে পারো। কারণ এখনো সময় আছে। কারণ আমি তোমাকে জো*র করে কোথাও বিয়ে দিতে চাই না। তাই বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়া পর্যন্ত মন দিয়ে ভাবো কি করবে? তোমার হাতে কাল বিকাল পর্যন্ত সময় আছে।
— আচ্ছা।
বলেই রাহিয়া ওখান থেকে বেরিয়ে এলো। সে রুমে এসে একটু আগে তার বাবার বলা কথাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগল। এসব ভেবে সে খুবই চিন্তায় পড়ে গেল যে সে কি করবে? সে মনে মনে নিজেই নিজেকে বলতে লাগল,
— এই বিয়েটাতে না করে দিলে বাবা অন্য ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তবুও বিয়ে ঠিকই হবে। তাহলে এখানেই রাজি হয়ে যাওয়া উচিত। নাহলে এই সমস্যা থেকেই যাবে। তার থেকে বিয়েতে রাজি হয়েই দেখি। এরপর যা হবে দেখা যাবে। হতেও পারে ওই লোকটা বিয়েতে কোনো সমস্যাই করতে পারল না।
রাহিয়া সারারাত চিন্তাভাবনা করে সে ঠিক করল সে বিয়েটা করবে। পরদিন সকালে রাহিয়ার কাছে আরও একটা পার্সেল এলো। মিসেস নাদিয়া এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল তার কিছু জিনিস দরকার ছিল। সে রুমে এসে বক্সটা রেখে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর ভাবতে লাগল যে বক্সটা খুলবে কিনা। কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনার পর সে ঠিক করল যে বক্সটা খুলবে। বক্সটা খুলতেই আবারও একটা কাগজ নজরে পড়ল। সে সেটা হাতে তুলে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,
— এই লোকটা কি এসব ছাড়া অন্য কিছু পারে না? প্রতিবার দেখি কিছু না কিছু লিখে পাঠায়। আচ্ছা আমি কি এটা খুলে দেখব? উমম! খুলে দেখি আবার কি লিখে পাঠিয়েছে?
বলেই সে কাগজটা খুলল। সেখানে লেখা ছিল,
“আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আমি তোমার প্রেমেতে গভীরভাবে আসক্ত প্রেয়সী। তাই তো তুমি আমার প্রেমপ্রেয়সী।”
লেখাটা পড়ে রাহিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর কাগজটা ভাঁজ করে বক্সের ভেতরে রেখে দিল। ওর নিচে কি ছিল তা একবারের জন্যও দেখল না। তারপর বক্সটা অন্য একটা জায়গায় রেখে দিয়ে বিছানায় এসে বসে পড়ল। এটা পাওয়ার পর সে খুবই চিন্তায় পড়ে গেল যে সে কি করবে? পুরোটা দিন সে আবারও এসব নিয়ে ভেবে কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার দিকে তূর্যের পরিবারের লোকজন এলো বিয়ের তারিখ ঠিক করতে। রায়ান সাহেব যেহেতু তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে চাচ্ছিলেন তাই এক সপ্তাহ পরই রাহিয়ার বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। এসব দেখে রাহিয়া আর কিছুই বলতে পারল না। সে তার বাবাকে বলল বিয়েটা যেন একটু সাধারণ ভাবে হয়। কারণ সে চায় না ওই লোকটা এসব জেনে কারো কোনো ক্ষতি করুক।
পরদিন বিকালে রাহিয়া তার রুমের বারান্দায় বসে একটু আগের এই কয়দিনের কথা ভাবতে লাগল। তার জীবন একেক সময় একেক দিকে যাচ্ছে। আর এসব তাকে খুবই বিভ্রান্ত করছে। তখন ওর রুমে মিসেস নাদিয়া এলেন। ওকে রুমে দেখতে না পেয়ে তিনি চলে যেতে নিলেন। পরে বারান্দার দিকে নজর যেতেই ওখানে গেলেন। ওকে ওখানে বসে থাকতে দেখে তিনি বলে উঠলেন,
— রাহিয়া তোর বিয়েতে সাবাকে আসার জন্য বলেছিস তো?
কথাটা শুনে সে তার মায়ের দিকে তাকালো। হঠাৎ সাবার কথা মনে পড়তেই সে বলে উঠল,
— ওর কথা তো ভুলেই গেছিলাম। আচ্ছা আমি এখনই ওকে বলছি।
— তুই নিজের ব্রেস্টফ্রেন্ডকেই বলিসনি তোর বিয়ের কথা? আচ্ছা যাইহোক, যেটা বলার জন্য এসেছিলাম। কালকে সকালে আমি আর তুই শপিংয়ে যাব। কোনো অজুহাত যাতে না দিতে পারিস তাই আগে থেকে বলে দিলাম।
— আচ্ছা।
মিসেস নাদিয়া ওখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাহিয়া উঠে গিয়ে তার ফোনটা নিয়ে এলো। তার সাবাকে কল দিয়ে ফোনটা কানে দিল। সাবা কল ধরতেই সে বলে উঠল,
— সাবা তুই কি করিস এখন যে আমার খোঁজখবরই নিস না?
— এর জন্য সরি। আর আমরা আজকে সকালে চট্টগ্রামে মামার বাসায় এসেছি। মামা অনেকদিন পর ফিরেছেন তো তাই?
— ওহ। তা তুই কবে ফিরবি?
— আপাতত ইচ্ছা নেই। যেহেতু এখন পড়ালেখার কোনো চাপ নেই আমি কমপক্ষে পনেরো দিন তো থাকবোই।
কথাটা শুনে রাহিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল না যে সাবাকে তার বিয়ের কথা বলবে কিনা। সে চায় না এখন সাবার আনন্দটা নষ্ট হোক। তাই সে ঠিক করল যে সে তাকে ওর বিয়ের বিষয়ে বলবে না।
— রাহিয়া চুপ করে আছিস কেন? কিছু হয়েছে?
— না তেমন কিছুই না। আচ্ছা আমি এখন রাখি। তুই ওখানে আনন্দ কর।
বলেই সে কলটা কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দেখতে দেখতে সময় চলে গেল। কালকে রাহিয়ার বিয়ে। রাহিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। কালকে তাকে এসব রেখে অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে। কয়েক বছরের মধ্যেই তার জীবন সম্পূর্ণ ঘুরে গেল। সে পছন্দ করত একজনকে। তারপর তার থেকে প্রত্যাখ্যান হয়ে, অপমানিত হয়ে তাকে ভুলে গেল। পরে আবার সেই তার পেছনে পড়ে গেল। আবার নতুন এক ব্যক্তি এলো যেও কিনা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু শেষে এই দুজনকে সরিয়ে সে এখন তূর্যকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। এখন সে দেখতে চায় কালকে বিয়েটা হয় কিনা। যদিও এখন শুধু এই রাতটুকু সময় আছে। রাতটা কেটে সকাল হলেই তার বিয়ে। তারপরও হঠাৎ করেই কিছু হতে পারে। কারণ এর আগেও কয়েক মূহুর্ত্তের মধ্যে তার জীবন ঘুরে গেছে। তাই এখন যে এমন হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসব ভাবতেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
হঠাৎ তার ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। রাহিয়া ভয় পেল যে সেই লোকটা ম্যাসেজ দেয়নি তো। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল করে সম্পূর্ণ অচেনা নম্বর থেকে একটা ম্যাসেজ এলো। এতে সে কিছুটা কৌতুহলী হয়ে ম্যাসেজটা খুলল। সেখানে লেখা ছিল,
— রাহিয়া আমার তোমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। এসব কথা তোমার জানা খুবই প্রয়োজন। আজকে যদি তুমি এই কথাটা না শোনো তাহলে তোমাকে সারাজীবন আফসোস করে যেতে হবে। তুমি যদি শুনতে চাও তাহলে *** জায়গায় চলে এসো।
ম্যাসেজটা পড়ে রাহিয়া বেশ অবাক হলো। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় আটটা বাজে। সে চিন্তায় পড়ে গেল যাবে কিনা। অনেক ভেবে সে ঠিক করল সে যাবে। আর জায়গাটা তার বাসার কাছেই তাই রাত হওয়া সত্ত্বেও সে যাওয়ার কথা ভাবল। তারপর তার মাকে একটা অজুহাত দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। সে যেতে যেতে মনে মনে বলতে লাগল,
— একবার গিয়েই দেখি কি হয়? সারাজীবন আফসোস করার থেকে একটু ঝুঁকি নেওয়া ভালো।
এসব ভাবতে ভাবতে সে সেই জায়গায় চলে গেল। কিন্তু ওখানে আসার পর ও যেমনটা ভেবেছিল তেমনটা কিছুই হলো। অন্যদিনের তুলনায় আজকে এখানে লোকজন একবারে নেই বললেই চলে। এতে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল কেউ আছে কিনা। হঠাৎই পেছন থেকে কেউ এসে তার মুখ চেপে ধরল। আকস্মিক এমন হওয়ায় সে বেশ ভয় পেয়ে গেল। তখন তার পেছনে থাকা লোকটা তাকে বলে উঠল,
— আমি কিছুতেই তোমাকে অন্য কারো সাথে বিয়ে করতে দেব না। তুমি শুধু আমারই হবে।
কথাটা শুনে রাহিয়া একদম চুপ হয়ে গেল। কারণ এই লোকটার কন্ঠ স্বর তার খুব চেনা। এই কন্ঠ স্বর সে আগেও শুনেছে। এটা মাথায় আসতেই একটা নাম তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। লোকটা তার মুখ ছেড়ে দুই হাত শক্ত করে ধরতেই মনে অজান্তে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
— রুদ্র!
চলবে,,,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। )