প্রেমপ্রেয়সী শেষ পর্ব

0
1537

#প্রেমপ্রেয়সী
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_N_K_Orni

বাসায় ফিরে রাহিয়া দরজা লাগিয়ে ওই কাগজগুলো নিয়ে বসল। ফিরে আসার সময় সে পুরোটা সময় মনে মনে এই বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে এসেছে। সে খুব করে চাচ্ছে যেন লেখায় কোনো মিল না থাকে। সে কাগজগুলো খুলে একসাথে রাখতেই দেখল সেই একই ধরনের লেখা। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে তিনার রুমে গেল। তারপর ওকে বলে ওই ডায়রির উপরের লেখার একটা ছবি তুলে নিয়ে এলো। রুমে এসে সে দেখল দুটোই একই ধরনের লেখা। সে ভালো করে সব অক্ষর মিলিয়ে দেখতে লাগল। সে দেখল একই হাতের লেখা। সে একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে মুখ সরিয়ে নিল। তারপর মনে মনে ভাবল,

— এখানে তো দেখছি দুটো লেখাই প্রায় একই। তার মানে কি তূর্যই সেই লোক? নাহ, এভাবে একটা হাতের লেখা দিয়ে কিছু প্রমাণ করা যায়। হতেও তো পারে দুজনের হাতের লেখাই একই রকম। শুধুমাত্র একটা হাতের লেখার জন্য আমার তূর্যকে অবিশ্বাস করা ঠিক হবে না। তবে আমার সন্দেহ ঠিকও হতে পারে। কারণ আমার আর তূর্যর বিয়ের পর ওই লোকটার আর কোনো ম্যাসেজ আসেনি। তারপর আবার দুজন ব্যক্তির হাতের লেখাও মিল আছে। বিষয়টা কাকতলীয় নাও হতে পারে। এজন্য তূর্যর উপর থেকে সম্পূর্ণ সন্দেহ উঠিয়ে দিলে হবে না। সন্দেহ যখন হয়েছে এর পেছনের বিষয়টাও জানতে হবে। সন্দেহ না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে এই বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। আর এজন্য আমাকে তূর্যর উপর ভালো করে নজর রাখতেও হবে। যদি তেমন কিছু না পাই তো ভালো। আশা করি আমার ধারণা যেন মিথ্যা হয়।

বলেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এরপর তার চোখ গেল বিছানার উপর ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে। সে সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— আমাকে এগুলো দ্রুত সরাতে হবে। আমাকে এগুলো কোনো সুরক্ষিত জায়গায় লুকিয়ে রাখতে হবে। এগুলো এমন জায়গায় লুকাতে হবে যেন এগুলো কিছুতেই তূর্যর চোখে না পড়ে। তূর্য এগুলো একবার দেখে ফেললে আমার আর কিছুই করার থাকবে না। এই কাগজ গুলোর সাথে ওই ড্রেস দুটোও লুকিয়ে রাখতে হবে। যাই তূর্য আসার আগেই এগুলো লুকানোর ব্যবস্থা করি। আমাকে এখনই সুরক্ষিত জায়গা খোঁজা শুরু করতে হবে। তূর্য যেকোনো সময় চলে আসতে পারে। ওর আসার সময়ের ঠিক নেই।

বলেই সে উঠে গিয়ে কাগজগুলো ভাঁজ করে একসাথে করল। তারপর অনেক খুঁজে একটা জায়গায় ওই ড্রেসগুলোর সাথে ওই কাগজগুলো রেখে দিল। সে এমনভাবে রাখল যাতে তূর্য যদি দেখতেও পায় তাহলেও যেন কিছু বুঝতে না পারে। রাহিয়া সবকিছু রেখে দিলেও এসব বিষয় তার মাথা থেকে যাচ্ছিল না। বারবার তার এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। রাতে তূর্য বাসায় ফিরলে সে খেয়াল করল রাহিয়াকে আজকে একটু অন্য রকম লাগছে। তার মনে হলো রাহিয়া হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে। তাই রাতে ঘুমানোর সময় সে রাহিয়াকে বলল,

— রাহিয়া কিছু কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?

কথাটা শুনে রাহিয়া তূর্যর মুখের দিকে তাকালো। সে ওসব বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। সে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে উঠল,

— কই কিছু না তো। তুমি একটু বেশিই ভাবছো।

— ওহহ।

পরদিন থেকে রাহিয়া তার কাজ শুরু করে দিল। সে তূর্যর সবকিছুর উপরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তার আচরণ থেকে শুরু করে ব্যবহৃত জিনিস সবকিছুকে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু সবদিকে ভালো করে খোঁজ রাখার পরও সে তেমন কিছুই পাচ্ছিল না। একদিন রাহিয়া বাইরে যাওয়ার জন্য ড্রেস বের করছিল। তখন তার চোখ গেল ওখানে থাকা একটা ফোনের দিকে। এটা তূর্যর পুরোনো ফোন। একদিন যখন সে এটার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল তখন তূর্য বলেছিল এটা তার পুরোনো, এটা এখন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সে এখানে রেখে দিয়েছে। রাহিয়া ফোনটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল,

— আচ্ছা এই ফোনের ভেতরে কিছু নেই তো? নাহ, আমাকে এই ফোনটাকে দেখতে হবে। কিন্তু এটা তো নষ্ট। দরকার হলে ঠিক করে নিব। কালকে তূর্য বাইরে যাওয়ার পর আমাকে এই ফোনটাকে নিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু না বলে ফোনটা দেখা কি ঠিক হবে? না আমাকে এই বিষয়ে ভালো করে জানতে হবে। এর জন্য ফোনটা দেখলে কিছুই হবে না।

বলেই সে ড্রেস নিয়ে ওখান থেকে সরে গেল। পরদিন রাহিয়া তার কথামতো তূর্য চলে যাওয়ার পর ফোনটা বের করে নিল। সে ফোনটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগল।

— আমি যে ফোনটাকে ভালো করে দেখতে চাচ্ছি কিন্তু এটা তো নষ্ট। এখন কি করব? আচ্ছা একবার খুলে দেখি হয় নাকি?

তারপর সে ফোন খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু ফোনটা খুলল না। এরপর তার কিছু একটা মনে হলো। তাই সে ফোনটার পাওয়ার অন করার চেষ্টা করল। সে ভেবেছিল এবারও কোনো কাজে দিবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ফোনটা খুলে গেল।

— তার মানে এটা নষ্ট না। তাহলে তূর্য আমাকে মিথ্যা বলেছে।

ফোন খোলার পর এবার আসে পাসওয়ার্ড। রাহিয়া নিজের নাম দিয়ে দেখল। কিন্তু ফোনটা খুলল। এবার সে তূর্যর নাম, তারপর তার জন্ম তারিখ দিল। তবে ফোনটা খুলল। সে নিজের জন্ম তারিখ দিল। কিন্তু এতেও খুলল না। এরপর সে তার নামের শেষে নিজের জন্ম তারিখ দিল। আর ফোনটা সাথে সাথেই খুলে গেল। এরপর ফোনের সবকিছু দেখতে শুরু করল। ম্যাসেজ খুলতেই তার সামনে সবটা ভেসে উঠল। সে বুঝতে পারল এটাই সেই ব্যক্তি যে তাকে ম্যাসেজ দিত। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

— তার মানে আমার সন্দেহই ঠিক। তূর্যই তাহলে ওই লোকটা। কিন্তু ও আমার এসব কেন করল? আমি আজকেই ওর সাথে এসব বিষয়ে কথা বলব।

রাতে তূর্য ফিরলে রাহিয়া ওই কাগজগুলো তার সামনে দিল। তূর্য একবার সেদিকে তাকাল। তারপর রাহিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— এটা কি? আর আমাকেই বা কেন দিচ্ছো?

— এটা আমি তোমাকে পড়ার জন্য দিচ্ছি। এগুলো আমাকে একজন দিয়েছিল।

তূর্য বুঝতে পারল না যে রাহিয়া তাকে এগুলো কেন দিচ্ছে। তখন তার চোখ গেল টেবিলের উপরে থাকা তার সেই ফোনের দিকে। তখন সে বুঝতে পারল রাহিয়া সবটা জেনে গেছে।

— তুমি হঠাৎ আমাকে এগুলো দিচ্ছো যে? তার মানে তুমি সব জেনে গেছ তাই না?

কথাটা শুনে রাহিয়া কাগজগুলো ওর সামনে থেকে সরিয়ে নিল। কিন্তু সে তূর্যর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। রাহিয়ার নীরবতা দেখে তূর্য সব বুঝে গেল। সে মুচকি হেসে বলে উঠল,

— “আমি তোমার প্রেমেতে গভীরভাবে আসক্ত প্রেয়সী। তাই তো তুমি আমার প্রেমপ্রেয়সী।”

বলতে বলতে সে রাহিয়ার একদম কাছে চলে এলো। রাহিয়া তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

— কেন করলেন এসব? আমাদের বিয়েটা তো এমনিতেও হয়েছে। তাহলে এসব করার কি দরকার ছিল?

— কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি যদি তোমাকে স্বাভাবিকভাবে গিয়ে এই কথাগুলো বলতাম তাহলে তুমি কখনো আমাকে মেনে নিতে না। তাই আমি এটা করেছি। আর এখন এসব বলে কি হবে? আমি তো কোনো সমস্যা করি। আর এখন তো আমাদের বিয়েও হয়ে গেছে। তাই এসব নিয়ে না ভাবলেই ভালো হবে।

— আচ্ছা এসব নিয়ে ভাবব না আর। কিন্তু তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেও। তুমিই রুদ্রকে মে*রেছ তাই না?

— রুদ্র! মানে তোমার সেই কাজিন যাকে তুমি পছন্দ করতে?

— নাটক বন্ধ করো। তুমি ওকে ভালো করেই চেনো। ওর সাথে কথা বললেই তুমি আমাকে হু*মকি দিতে।

— হ্যাঁ দিতাম। সেটা তো তোমাকে অন্য ছেলেদের কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য। আমি আসলে তেমন কিছুই করতাম না। ওগুলো শুধু তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য বলা। আর রুদ্রকে আমি কেন মা*রব?

— মিথ্যা বলা বন্ধ করো। তুমি রুদ্রকে মে*রেছো তাও দুইবার।

— উহু একবারও না।

— আমাদের বিয়ের আগের দিন তুমি আমাকে যাওনি? তুমি রুদ্রের পায়ে গু*লি করোনি?

— বিয়ের আগের দিন! ওইদিন তো আমাকে বাসাতেই ছিলাম। তোমাকে বাঁচাতে যাব মানে? কি হয়েছিল ওইদিন?

— তুমি সত্যি বলছো? তুমি সত্যিই ওইদিন বাসায় ছিলে?

— হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে যাও আম্মুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো?

— আচ্ছা।

বলেই রাহিয়া রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তূর্য তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল। কিছুক্ষণ পর রাহিয়া ফিরে এলো। সে মিসেস তানহার কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনিও বললেন যে তূর্য ওইদিন বাসায় ছিল।

— কি এবার বিশ্বাস হলো?

রাহিয়া মুখ তুলে বলে উঠল,

— তুমি যদি ওটা না হও তাহলে ওইদিন ওখানে কে ছিল?

— বাদ দেও ওই বিষয়ে। আমাদের এখন এটা ভেবে কি লাভ? হয়তো লোকটা রুদ্রের কোনো শ*ত্রু ছিল। সে তো আর বলেনি যে সে তোমার জন্য রুদ্রের পায়ে গু*লি করেছিল?

— না।

— তাহলে এসব বিষয়ে এতো কেন ভাবছ? এসব চিন্তাভাবনা বাদ দেও। চলো আমরা দুজন এসব কথা ভুলে যাই।

— একদমই না। তুমি আমাকে এসব কথা আগে কেন জানাওনি? কেন বলোনি যে তুমিই সেই গিফট দেওয়া লোকটা?

— ভয় পাচ্ছিলাম যদি তুমি আমাকে কিছু বলো। এখন তো সব জেনেই গেছো তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দেও।

— তুমি আমাকে বারবার মিথ্যা বলে গেছো। আমি তোমাকে কেন ক্ষমা করব?

— আমি শুধু তোমাকে হারানোর ভয়ে এসব বলেছি। এখন তো তোমাকে পেয়ে গেছি। এখন আর আমি এসব বিষয়ে মিথ্যা বলব না। প্লিজ রাহিয়া চলো ওসব ভুলে যাই। আমি আর কখনো তোমার কাছ থেকে কিছু লুকাবো না। আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দেও তোমাকে না বলার জন্য।

রাহিয়া কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তূর্য ওর মুখের কাছে গিয়ে বলল,

— তার মানে ক্ষমা করে দিয়েছো?

কথাটা শুনে রাহিয়া মুখে কিছু বলল না শুধু মাথা নাড়ালো। তূর্য তার সম্মতি পেয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

— চলো ওসব ভুলে যাই। আজকের পর থেকে আমাদের অতীত নিয়ে কোনো কথা হবে না।

— আচ্ছা।

বলেই রাহিয়াও ওকে জড়িয়ে ধরল। তূর্য তাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় মনে মনে বলল,

— আমি তোমাকে কখনোই বুঝতে দিব না ওটা আমি ছিলাম। বাসার কেউ জানে না যে ওইদিন আমি বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। এই ছোট্ট বিষয়টা অজানা থাকাই ভালো। মাঝে মাঝে কিছু জিনিস জানার থেকে অজানা থাকলে বেশি ভালো হয়। এতে জীবনে কোনো সমস্যা থাকে। মানুষ যত বেশি জানবে তত বেশি সমস্যা পড়বে। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তোমাকে আমি যেভাবেই হোক আমার কাছেই রাখব সারাজীবন। তোমাকে এভাবে লুকিয়েই আমি আগলে রাখব। তার জন্য যা করার আমি সে সবকিছু করব। তোমাকে নিজের কাছে রাখতে এইটুকু মিথ্যা আমি বলতেই পারি। কারণ তোমাকে ছাড়া আমি অসমাপ্ত। তোমাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। “আমি তোমার প্রেমেতে গভীরভাবে আসক্ত প্রেয়সী। তাই তো তুমি আমার প্রেমপ্রেয়সী।”

বলেই তূর্য একটা মুচকি হাসি দিল। তারপর রাহিয়াকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

সমাপ্ত

( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কারো ভালো না লাগলে ইগনোর করবেন। কিন্তু কোনো বাজে মন্তব্য করবেন না। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here