#মিঠা_রোদ
#পর্ব:১৬
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া
“আমি খুব ঘেমে গিয়েছি তোশামণি।লজ্জা লাগছে।”
“কল্লোল ভাইয়া লজ্জা পাও কেন?সকলে তোমার পোশাক দেখে বুঝবে যে খেলার মাঠ থেকে দৌড়ে এসেছো।তোমার ছোট মাথা এটা বুঝলো না?”
কল্লোল চোখ দুটো ছোট ছোট করে তোশার পানে তাঁকালো।চশমার আড়ালে অবশ্য সেটা বোঝা গেলো না।তার থেকে বয়সে ছোট হয়ে কীনা মেয়েটি বলছে ছোট মাথা?
“এখন কেমন আছো তোশা?ধরো এটা তোমার জন্য।”
“চকলেট কেন?”
“হসপিটালে রোগী দেখতে এলে কিছু একটা নিয়ে আসতে হয়।তুমি তো বাড়ীতেই চলে যাবে একটু পরে।সেজন্য কী নিয়ে আসবো ভাবছিলাম।”
উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো তোশা।মনোমুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য গ্রহণ করলো কল্লোল।এই হাসির অনুরূপ ছন্দ আজকেই খুঁজে বের করবে সে।
“রোগীকে দেখতে কেউ চকলেট নিয়ে আসেনা।যাই হোক আম্মু কোথায় গেলো?”
“ডক্টরের কাছে হয়তো।আমার হাসপাতালে এলে কেমন যেন লাগে?নিজেও তো একদিন ডক্টর হবো তাইনা?”
“হবে তো।আমি বিজনেস করবো।কবীর শাহ এর সাথে প্রতিযোগীতা করে।”
“কবীর আঙকেল?আচ্ছা তাকে তো দেখলাম।”
মুখের রঙ আরো কয়েক ধাপ ঘোলা করে তোশামণি জবাব দিলো,
“সে তো সব জায়গায় আছে।”
(***)
মায়ান একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে।তাহিয়ার সামনে রিসিভ করতে কেমন বিব্রোতবোধ হচ্ছে কবীরের।তার ভুল সে যদি তোশার ব্যাপারটি না জানাতো তবে এমন কল করতো না।এদিকে তাহিয়ার ফোনে কল করার সাহস মায়ানের নেই।তাহিয় আড়চোখে স্ক্রিনে ভেসে উঠা বিদেশি নাম্বারটি দেখে শুধালো,
“মায়ান এতো কল করছে কেন কবীর?তোশার ব্যাপার বলেছো?”
“হ্যাঁ।এখানে আসার আগে বলেছি।”
“ওহ।দেখবে বলবে যে তাহিয়া একজন কে য়া র লে স মাদার।আমি সত্যি বুঝিনি তোশার শরীরটা এমন হয়ে যাবে।”
“বলবেনা।ও জানে তুমি কীভাবে আগলে রেখেছো মেয়েকে।তেমন কিছু হয়নি।শুধু একটু হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করো মেয়েকে।”
তাহিয়া কিছু একটা নিয়ে প্রচন্ড উশখুশ করছে।যেন না বলতে পারলে শান্তি মিলছেনা।কপালে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো টিস্যু দিয়ে মুছে নিলো।এখনও বেশ সুন্দর দেখা যায় তাকে।কবীর অবশ্য বিষয়টি বুঝতে পেরে শুধালো,
“কিছু বলবে তাহিয়া?”
“হ্যাঁ।ভুলভাবে নিওনা।এতো দামী গিফট তোশাকে কেন দিয়েছিলে?বিষয়টি আমাকে খুব বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল।”
কবীরের ভেতর থেকে উষ্ণ শ্বাস বের হয়ে এলো,
“লকেটটিতে ওকে খুব সুন্দর মানাতো এজন্য দেওয়া।তুমি রাখতে দিও তোশাকে।”
“কিন্তু তাও।আচ্ছা ওটা তো মায়ান দেয়নি?”
“মেয়েকে কিছু দিতে মায়ানের কখনো আমার বাহানা লাগবেনা তাহিয়া।”
হাঁটতে হাঁটতে তারা কেবিনের কাছে এসে পড়েছে।এমন সময় তোশার হাসিমাখা মুখটা দরজার কাছ থেকে কবীরের দর্শন হলো।শত শত জলকণা সমেত সমীরণ যেন কবীরকে স্পর্শ করে গেলো।একটি হাসিতে এতোটা মুগ্ধতা লুকিয়ে থাকতে পারে?উহু,লুকিয়ে কোথায়?ওইযে প্রকাশে আছে।যে কেউ মনোযোগ দিলে মুগ্ধ হতে বাধ্য।কবীরের মনে যখন শান্তির বাতাস বয়ে যায় তখন সামনে বসে থাকা কিশোরীর মনে দুঃখ
অগ্ন্যুৎপাতকালে আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত গলিত প্রস্তরাদির মতোন গড়িয়ে পড়তে থাকে।
“তোশামণি চলো।এখন আমাদের বাড়ী যাওয়ার সময়।কল্লোল ওকে উঠতে সাহায্য করো তো।”
কল্লোলের পূর্বে কবীর তোশার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো।কিন্তু মেয়েটি পুরোদস্তুর তামাটে পুরুষটিকে উপেক্ষা করে কল্লোলের হাত ধরলো।তাহিয়া জিনিস পত্র নিয়ে তোশার আরেক পাশে ধরে তাকে বেড থেকে নামিয়ে দিলো।কবীর এখনও বিষয়টি হজম করতে ব্যস্ত।
“কবীর তুমি একটু তোশাকে ধরবে?আমি গাড়ীটা পার্কিং এড়িয়া থেকে বের করে আনতাম।”
জবাব না দিয়ে তোশাকে এক হাত দিয়ে শক্ত করে আলিঙ্গন করলো কবীর।ফলস্বরুপ কল্লোলকে হাত ছাড়তে হলো।
“তুমি যাও তাহিয়া।আমি নিয়ে আসছি ওকে।কল্লোল তোমারও স্পোর্টস ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে।এগিয়ে যাও।”
কল্লোল মাথা দুলিয়ে এগিয়ে গেলো।এরকম নির্জনতার অপেক্ষায় ছিল কবীর।তোশাকে গম্ভীর সুরে বলল,
“হাত ধরতে কী সমস্যা ছিল?কল্লোলের সামনে বিষয়টি কেমন হলো না?”
“আপনি বিবাহিত?”
“এটা আমার প্রশ্নের জবাব হলো না।আমি বিবাহিত এটা আজ জানলে নাকী?”
প্রশ্নটি করে নিজেই থমকে গেলো কবীর।খানিকটা হতবিহ্বল কণ্ঠে শুধালো,
“আমার ডিভোর্স হয়েছে।ছেলে আছে বিষয়টা তুমি এতোদিন জানতেনা তোশা?”
“যদি বলি না।”
“আজ জানলে?”
“হ্যাঁ।”
কবীর পূর্বের সবকিছু মনে করলো।এতোদিন যে ভালোবাসা নিয়ে কথা হতো সেখানে ছেলে সমন্ধে একটি প্রশ্নও তোশা করেনি।এমন নয় বিষয়টি প্রথম মাথায় এলো
পূর্বেও এসেছে।কিন্তু সত্যি যে তোশা এতো বড় কিছু জানবেনা তা বুঝতে পারেনি।মলিন হাসলো কবীর।
“আমাকে এখন ঘৃ ণা করছো তাইনা তোশামণি?বিশ্বাস করো বুঝিনি যে এতো বড় বিষয়টি জানবেনা।এ কারণে তখন হাত ধরলেনা?”
তোশা কিছু বলল না।লিফটের ভেতর ঢুকে যেতে হলো তাদের।আশেপাশে আরো মানুষ থাকায় কবীর একটি কথাও বলেনি।কিন্তু পুনরায় নির্জনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেকি দাম্ভিক সুরে বলল,
“দেখলে আমি যে তোমার অনুভূতিকে মোহ,মায়া এবং আবেগের নাম দিতাম।কতোটা সত্য ছিল না।তুমি আমাকে ভালোবাসোনি।”
তোশা পূূর্বের মতোন নিশ্চুপ হয়ে থাকলেও এবার কবীরকে দেখলো।ব্যক্তিটা খুব লম্বা।তবুও তোশা মাথা এলিয়ে নাক টেনে কবীরের শরীরের ঘ্রাণ নিলো।গাড়ীর কাছে পৌঁছানো অবধি দুটো প্রাণ আর কোনো বাক্য বিনিময় করলো না।
(***)
ঘড়িতে এখন দুপুর তিনটে বেজে বিশ মিনিট।ভীষণ ক্লান্ত অনুভব হচ্ছে কবীরের।অথচ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং আছে।গতকাল থেকে মনটায় খড়া নেমেছে তার।কবীর নিজের সঙ্গে অভিনয় করেনা।সে জানে তোশার প্রতি পূর্বে ভালো লাগা থাকলেও এখন সেটা রুপ বদলে যাচ্ছে।একসময় নিজে অস্বীকার করলেও এখন মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে সে নিজ থেকে বিশ বছরের ছোট মেয়ের মায়াতে জড়িয়েছে।এই কারণেও বিয়েতে হ্যাঁ বলেছিল।সেদিন থেকে যা খারাপ লাগা ছিল মনের ভেতর তা গতকাল বৃদ্ধি পেয়েছে তোশার অবজ্ঞাতে।অবশ্য যা হওয়ার ঠিক হয়েছে।
“স্যার আপনি তো লাঞ্চ করলেন না।মিটিংটা শুরু করবো কখন?”
কবীরের এসিস্ট্যান্ট নাহিদ দরজার বাহির থেকে কথাটি শুধালো।উষ্ণ শ্বাস ফেলে কবীর জবাব দিলো,
“এখুনি শুরু করবো।”
“জি স্যার।”
নাহিদ ফিরে যাওয়ার আগে কিছু একটা মনে হতে থেমে গেলো।পুনরায় বলল,
“স্যার একটি মেয়ে এসেছিল আপনার সঙ্গে দেখা করতে।সম্ভবত কোথাও দেখেছি তাকে।”
কবীরের ভেতর এলেমেলোভাবে আন্দোলিত হয়ে উঠলো।সে সোজা হয়ে বসে বলল,
“নিজের নামটা কী বলেছে সে?”
“তোশা।”
“সে কোথায় এখন?”
“আপনি ব্যস্ত ছিলেন দেখে রিসিপশনে বসিয়ে রেখেছিলাম।কিন্তু সবেমাত্র বের হয়ে গেলো।”
কবীর একটুও অপেক্ষা করলো না।তৎক্ষনাৎ ফোনটা টেবিল থেকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।
“নাহিদ মিটিংটা দুই ঘন্টা পরে হবে।”
হন্তদন্ত হয়ে বাহিরে বের হয়ে এলো কবীর।এপাশ ওপাশে দেখলো কোথাও তোশা আছে কীনা।তার এই অফিস এড়িয়াটি খুব বড়।চারিধার পরিষ্কার বাতাবরণ।লাঞ্চ টাইম শেষ হওয়ায় বাহিরে দারোয়ানরা ব্যতীত কেউ নেই।দূরে এক জায়গায় ছিমছাম শরীরে মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলো কবীর।কিশোরী মেয়েটির বাহু শক্ত করে ধরতে সময় লাগলো না।
“তোশা তুমি এখানে কেন?”
“আপনি না ব্যস্ত ছিলেন শুনলাম।”
“তোমার আগে কোনো ব্যস্ততা নেই।আমাকে না বলে চলে যাচ্ছিলে কেন?”
কবীর হয়তো খেয়াল করেনি সে কী বলে ফেলেছে।কিন্তু তোশার ঠোঁট দুটোর মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হলো।এইযে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অফ হোয়াইট রঙের স্যুট পরনে পরিপাটি পুরুষটি কী এই মাত্র সবকিছুর উপরে তাকে রাখলো?পুরুষটির গা থেকে আসা মন মাতানো সুগন্ধে মনটা ভরে গেলো তার।এগিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো।
“একটু নিচু হবেন কবীর শাহ?আপনি অনেক লম্বা।”
“কেন বলো তো।”
“হোন না নিচু।”
কবীর কথামতোন নিচু হলো খানিকটা।তোশা নিবারণ হাতের ত্বকের সাহায্য তামাটে পুরুষটির কপালের ঘাম মুছে দিলো।নরম তুলতুলের হাতের ছোঁয়ায় কবীরের সবকিছু ভুলে যাওয়ার মতোন অবস্থা।তোশা সবথেকে সুন্দর হাসিটি দিয়ে বলল,
“আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এলাম।নতুন করে পরিচিত হবো দুজনে।”
চলবে।