#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব২২
#রাউফুন
দ্বিপ্রহরিক আলস্য কাটিয়ে উঠে বসে তুলিকা। সেদিনের ঘটনার পর থেকে সে আরও কথা বলতে পারেনি মাইজিনের সাথে। বলতে গেলে কোনো রকম বাক্য বিনিময় করেনি নিজে থেকে। শুধু মাইজিন কিছু জিজ্ঞেস করলে তার প্রতুত্তরে কথার উত্তর দিয়েছে। মাইজিন তবুও অটল থেকে তুলিকাকে আপন করার চেষ্টার প্রয়াস চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ভাবে সে তুলিকাকে সম্পুর্ন খুশি করার চেষ্টা করছে নিজের কর্মকাণ্ড করে। রোজ আলাদা আলাদা ভাষায় কিছু একটা বলে যাচ্ছে অফিসে যাওয়ার আগে। না বুঝতে পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলো শুধু। প্রথম দিন যেদিন বলেছে সেদিন কি যেনো ছিলো? তুলিকা মাথায় হাত ভাবার মতো করে আওড়ালো, ‘ওহ হ্যাঁ তি আমো! পরদিন বলেছে, ইয়া তেবয়া লিউব্লিউ!’
এরপর, নান্নু নিনান্নু প্রীতিসুথিন!’
তারপর, ইস লিবে দিস!’
উম তারপর, ফ্ইয়ে তাইমে!’
মুই তোমাকে ভাল্ পাও!’
লাষ্টের টা তুলিকা বুঝতে পেরেছিলো। বুঝতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলো বটে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সে কিছুতেই মাইজিনকে সহজ ভাবে নিতেই পারছে না।
চলতি সময়ের মধ্যেই যেন সূর্যকরোজ্জ্বল গগনের মন ক্ষুণ্ণ হলো। শেফালি ফুলের নরম গায়ে অনিল আঁচড় কাটতেই দোলায়মান হলো তারা। ঝপঝপ শব্দ করে শালিকের দল উড়ে গেল দিগন্তে। আকাশ জুড়ে তখন কৃষ্ণমেঘের রাজত্ব। দিবালোক হয়েও যেনো নিশুতি রাতের প্রহর চলছে। কিঞ্চিৎ সময় যেতে না যেতেই গা ঝাঁকুনি দিয়ে এক পলশা বৃষ্টি নামলো তপ্ত ধরার মধ্যখানে৷ আলতোভাবে ছুঁয়ে সিক্ত করে তুললো শুভ্রতায় মোড়ানো কোমল ফুলের গা। অকৃত্রিম ঘ্রাণে মাতোয়ারা হলো আশপাশ। তুলিকা মন প্রাণ ভরে ঝমঝমিয়ে পরা বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলো। এই তো সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মাইজিনকে ফলো করেছিলো সে। কি এমন সত্যি ছিলো যার জন্য মাইজিন তার সাথে এরুপ আচরণ করেছিলো। ঠিক কতটা কষ্ট তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলো তার করা ব্যবহারে সে খোঁজ তো মাইজিন রাখেনি! ঐ তিক্ততায় ভরা দুটো দিন কোনো ভাবেই ভুলে উঠতে পারে না সে৷ মন থেকে মাইজিনের সঙ্গে সহজ হতেই পারছে না। চেষ্টা তো করছে সে মাইজিনের সঙ্গে স্বাভাবিক হওয়ার। কিন্তু আসলেই কি ততটাই সহজ এভাবে একটা সম্পর্ক স্বাভাবিক করা? সে যে মানতে পারে না কোনো ভাবেই৷ তুলিকার কোনো কিছু থেকে একবার মন উঠে গেলে সেখানে মন বসাতে পারে না চাইলেও। এমন কি কোনো খারাপ আচরণ ও সে সহজে ভুলে যেতে পারে না। এই যে মাইজিনের খারাপ আচরণের পর আজ পাঁচ টা মাস কেটে গেছে তবুও সে ভুলতে পারেনি। মাইজিনকে মানতে পারেনি এতো যত্ন, এতো ভালোবাসার পরেও। মাইজিনের তার উপেক্ষার ফলে যে কতটা কষ্ট হয় সেটা খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করতে পারে কিন্তু তাও নিজের ইগোটাকেই সে বড় করে দেখছে। তম্বন্ধে তার কলিংবেলের শব্দে ঘোর কাটলো তুলিকার৷ সে দরজা খুলে দিলো। মাইজিন ভিজে জুবুথুবু ভাবে ফিরেছে। এই বৃষ্টিতে আবার না জ্বর বাঁধিয়ে ফেলে। মনে মনে চিন্তা হলেও তুলিকা মুখে কিছু বললো না।
মাইজিন স্বাভাবিক ভাবে ঘরে ঢুকে চেঞ্জ করে নিলো। আজকে বেশি ভিজেনি সে কিন্তু বৃষ্টির পানিতে তার অসুখ বাঁধানোর ধাত আছে।
‘আজ তারাতাড়ি ফিরলেন যে?’
‘এমনিতেই ভালো লাগছিলো না। ভাবলাম বউ বাড়িতে একা তাই বউকে কাম্পানি দিতে চলে এলাম! এক সাথে দু কাপ কড়া কফির সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা যাবে!’
মাইজিন ঠোঁট পাউট করে চোখ টিপে চুমু দেওয়ার ভঙ্গি করলো। বিষম খেলো তুলিকা। দিন দিন মাইজিনের দুষ্টামির মাত্রা বাড়ছে তো বাড়ছেই। মাঝে মাঝে এমন বেফাঁস কথা বলে যে না হেসে পারে না সে। তুলিকা কফি করতে চলে গেলো গম্ভীর মুখে। মাইজিন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো শুধু। কোনো ভাবেই মেডামের মন পাচ্ছে না যে। ভালো লাগছে না তার। আজকে তুলিকাকে সত্যিটা বলবে সে। তাতে তুলিকা কষ্ট পেলে পাক কিন্তু তুলিকার স্বাভাবিক হওয়া টা জরুরি! যখন কেউ কারো প্রতি মমতা বোধ করে তখনই সে লজিক থেকে সরে আসতে শুরু করে। মায়া-মমতা, ভালোবাসা এসব যুক্তির বাইরের ব্যাপার। বেশি নৈকট্য দূরত্বের সৃষ্টি করে। তাই মাঝে মধ্যে প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকাই ভালো। সম্পর্ক স্থির নয়, পরিবর্তনশীল। সে যখন তুলিকার থেকে দূরত্বে ছিলো প্রতিটি মুহুর্তে মুহুর্তে উপলব্ধি করেছে সে ঠিক কতটা ভালোবাসে তুলিকাকে। কিন্তু খারাপ ব্যবহার করার পর সাহস হয়ে উঠেনি তুলিকাকে মনের কথা বলতে৷ তুলিকা কফি করে আনলে মাইজিন অকস্মাৎ তুলিকাকে বললো,
‘এদিক আসেন। আমার আপনার সাথে কথা আছে।’
মাইজিনের কন্ঠ কৌতূহল শোনায়। তুলিকা কিঞ্চিৎ অবাক হলো বোধহয়। এক সাথে কিছু অনুভূতির সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো মনে। সে ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি খুব সিরিয়াস কিছু বলতে চাচ্ছেন!’
‘হুম। বসুন আমার সামনে।’
দুজনে কফি হাতে বসে। বাইরে বৃষ্টি তুমুল বেগে বাড়ছে। পুতুল হইতো বৃষ্টির দাপটে স্কুল থেকে বেরোতে পারেনি। প্রাইভেট শেষ করে আসতে আসতে ছয়টা বাজবে মেয়েটার। পুতুলের হাতে মুঠোফোন আছে। সে ফোন করেছিলো কফি করতে করতে। সে প্রাইভেট যাবে স্কুল থেকে বেরিয়ে। মাইজিন গলা পরিষ্কার করে দম নিলো। লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলো।
‘আমার জীবনের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা
জানাবো আপনাকে। আমার মা আসমা সিদ্দিকা আর শাপলা সিদ্দিকা উনারা দুইজন জমজ বোন৷ আমি আসমা সিদ্দিকার ছেলে। শাপলা সিদ্দিকা সম্পর্কে আমার খালামনি। মায়ের মৃ’ত্যুর পর শাপলা খালামনিকে মায়ের কথা রাখতে বাবাকে বিয়ে করতে হয়। আমি তখন বারো বছরের না বালক একটা ছেলে। মায়ের মৃত্যুতে শোকাভিভূত আমি মাকে সারাদিন খুঁজে যেতাম। তখন বাবা বাধ্য হয়ে শাপলা খালামনিকে বিয়ে করেন৷ আপনি সব সময় বলেন না? কেন আমি আপনাকে আপনার কাজে সাহায্য করি? আমি কোনো সময়ই চাই না আমার মায়ের মতোই আপনিও কষ্ট পান। আমি দেখেছি আমার মাকে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে। আমি দেখতাম আমার দাদি, আমার মাকে কিভাবে নির্যাতন করতেন। কতটা কষ্ট দিতেন। মা সারাদিন রাত খে’টে ম’র’তো দাদির মন পাওয়ার জন্য কিন্তু কোনো ভাবেই মন জিতেনি। এমন কি তিন বেলার খাবার পর্যন্ত মাকে ঠিক মতো দিতেন না। হাড়ির শেষ পোড়া ভাত টুকু দেখতাম মা শেষে ক্ষুধার জ্বালায় চেটে পুটে খেয়ে নিচ্ছেন। এমনই চলতে চলতে দিন কে দিন মায়ের শরীরের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। জানি না মায়ের কি অসুখ করেছিলো কিন্তু অসুখ তো ছিলো। সেটাও ভয়াবহ!’
মাইজিন থামলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আড়ালে তার চোখ মুছে নিলো। এখনো চোখ পানিতে টইটম্বুর হয়ে চিকচিক করছে। তুলিকারও চোখ ভিজে উঠে। অবাক হয়ে জানতে চাইলো তুলিকা।
‘আংকেল কি এসব দেখতেন না?’
‘বাবা বুঝতে পারতেন কিন্তু তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত! আমার দাদির মুখের উপর কোনো দিন ও কথা বলতেন না। উনাকে খুব সমীহ করতেন।’
‘যখন এতো কথা উঠলোই তবে এটাও বলুন আপনার শরীরে ক্ষত স্থানের কারণ কি? আমি সেদিন ভালো ভাবে দেখেছি অনেক পুরনো দা’গ ও আপনার শরীরে আছে। তার মানে আপনি এর আগেও এমন নিপীড়ন চালিয়েছে কেউ। কার নির্যা’তনের শিকার হয়েছিলেন আপনি?’
‘সেদিন আমাকে শাপলা খালামনি ফোন করে বলেছিলেন বাবা এসেছেন প্যারিস থেকে। আমি বাবার কথা শুনেই ওখানে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখি বাবা আসেন নি। উনি মিথ্যা বলে আমাকে নিয়ে যান। বাবা আসার আগেই আমাকে উনার ভাগনি শারমিনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমার সম্পত্তি হাতাতে চাইছিলেন। কিন্তু আমি শারমিনকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। আমি তো আপনাকে ভালোবাসি তবে শারমিন কে কিভাবে বিয়ে করতাম? আমি বিয়ে করতে রাজি হয়নি বলে আমার উপর ট’র্চা’র করেন তিনি। যখন আমি বিয়ে করতে চাইনি তখন আমার সম্পত্তির কাগজে সাইন করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সক্ষম হয়নি। এর মধ্যে আমি আপনাকে ফোন করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আমার ফোন তো কে’ড়ে নিয়েছিলেন ওই মহিলা। কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি আপনার সঙ্গে। দুই বার উইলের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনাকে দেখেছি। নাফিসের মাধ্যমে খোঁজ নিতাম আমি। নাফিস আপনার সকল প্রকার খবরাখবর আমাকে দিতো।আমার রুমে যে লুকানো ল্যাপটপ ছিলো এটা জানতো না কেউ-ই। কোনো ভাবেই যদি আপনার কথা শাপলা সিদ্দিকা জানতে পারতেন তবে যে আপনার ক্ষতি করতেন উনি। উনি কতটা সাংঘাতিক মহিলা ছোট বেলা থেকেই তা আমি জানি। তাই পারিপার্শ্বিক ভাবে আপনার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করে ফেলি। আমার বাড়িতে কোণায় কোণায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে সেই মুহুর্তে আপনাকে ক্যামেরায় দেখলেই চিনে ফেলতেন তিনি। আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে আপনার এটা ঠিক জেনে নিতেন আর আপনার ক্ষতি করে আমাকে ব্ল্যা’কমেইল করে সম্পত্তির কাগজে সাইন নিয়ে নিতো। আর বা’জে ব্যবহার না করলে আপনি আসতেন ও না। আমি নিরুপায় ছিলাম। এরপর বাবা এলেন আরও পনেরো দিন পর। বাবা আসার পর আমার ওরকম অবস্থা দেখার আগেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি আমি। আমি আগেও পালাতে পারতাম। তবে ওই মহিলা ঠিক আমার ঠিকানা খুঁজে বের করতো। আর আপনার সম্পর্কে জেনে যেতো। আপনার ক্ষতি হবে ভেবেই আমি কিছু করতে পারিনি। আমার পুঙ্খাঅনুপুঙ্খ খবরা খবর তিনি ঠিক লোক লাগিয়ে জেনে নিতেন। সেদিন চেয়েছিলাম রাস্তায় আপনাকে সব কথা বলতে কিন্তু আমার উপর সব সময় নজর রাখতো ওই মহিলার লোক। দ্বিতীয় দিন বলতে চাইলাম কিন্তু সেদিনও শাপলা সিদ্দিকার লোক আপনার পাশ কে’টে চলে গিয়ে আমাকে এলার্ট করেছে। বিশ্বাস করুন তুলিকা আপনাকে না চেনার ভান করা, আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার পর আমি নিজেও দগ্ধ হচ্ছিলাম প্রতিটি মুহুর্তে। কতটা মুমুর্ষ সময় পার করেছি কেবলই আমার আল্লাহ আর আমি জানি।’
ততক্ষণে তুলিকা হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলে,’ আপনি এসব সহ্য করেছেন কেন? আংকেলকে বলেননি কেন?’
‘বাবা যখন থাকতেন তখন শাপলা সিদ্দিকা আমার সঙ্গে ভালো আচরণ করতেন কিন্তু বাবা না থাকলেই কোনো একটা কারণে আমাকে এমন নির্মমভাবে নির্যা’তন করতেন। উনার চোখে মুখে আমি মায়ের চেহারাটা খুঁজে পেতাম তাই তার করা অত্যা’চার সহ্য করেছি ছোট বেলা থেকে। আমার শরীরের অগণিত দা’গ যেগুলো ওই মহিলার দেওয়া আঘা’তের চিহ্ন। আর বাবাকে বলতে পারিনি কারণ মা মা’রা যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘শাপলা খালামনিকে মা হিসেবে মেনে নিতে। উনার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিতে। উনি আমার সঙ্গে যা কিছুই করুন না কেন সেসব যেনো কাউকেই না বলি!’
‘আপনার কি মনে হয় না, আপনার মা সবটাই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আগে থেকেই। শাপলা আন্টির সঙ্গে হইতো কোনো ভাবে আংকেলের কোনো অবৈধ সম্পর্ক ছিলো যেটা আপনার মা জানতে পেরেছিলেন আর আপনাকে আগাম বার্তা দিয়েছিলেন এসবের। না হলে তিনি আগে থেকেই এসব কিভাবে কথা দেয়ালেন?’
‘জানি না আমি। আমারও এখানে খটকা লাগে কিন্তু উত্তর পাইনি আজও।’
‘শাপলা আন্টিকে দেখে তো মনে হয়নি উনি এতোটা নিচ মানুষ!’
বিদ্রুপাত্মক হাসিটা ঠোঁটের প্রান্ত অব্দি এসেও অদৃশ্য হয়ে গেল তার। কারণ ওই মহিলা কেমন ধারা মানুষ সেটা তো সে জানে। তবে মুখে কিছু বললো না মাইজিন।
#চলবে