হীরকচূর্ণ ভালোবাসা পর্ব ২৩

0
1064

#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব২৩
#রাউফুন

‘আপনি আপনার বাবার সঙ্গে কথা বলেন না কেন? নাহ মানে এখানে আসার পর দেখিনি আপনাকে উনার সঙ্গে কথা বলতে। তাছাড়া কতদিন থেকে এখানেই থাকছেন। আপনার বাড়ি থেকে তো কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছে না কেউ?’

মাইজিন কিয়ৎক্ষন মৌনতা বজায় রাখে তুলিকার এই প্রশ্নে। সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

‘আমি ওঁদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। সম্পত্তির অর্ধেকটা বাবাকে দিয়েছি। রাজশাহীর ফ্যাক্টরির নিচের ডিপার্টমেন্টের সম্পুর্নটা শুধুই এখন আমার। আর বাকি ডিপার্টমেন্টটা বাবার! আমি সবটাই দিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু বাকি সম্পত্তি তো মায়ের। আমি আমার মায়ের সম্পত্তির অংশ কাউকে দিবো না। আর বাবার সঙ্গে দেখা হয় কিন্তু কথা বলতে পারি না। হইতো সংকোচে কিংবা অস্বস্তিতে।’

‘আংকেল আপনাকে কোনো রকম প্রশ্ন করেন নি? কেন আপনি এমন করলেন?

মাইজিন প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘ছাড়ুন না ওসব!’

‘এখন আমার মনে হচ্ছে আপনি শুধু মাত্র আমার জন্য এতোটা সেক্রিফাইজ করলেন। আমি না থাকলে হইতো এতোটা দু-টানা থাকতো না আপনার জীবনে।’

‘উঁহু আপনার জন্য না তো। আমার জন্য করেছি সবটা। আমার আপনার সঙ্গে ভালো থাকাটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট আমার কাছে! আমার আপনার প্রতি ভালোবাসা! মোহ, সবকিছুই আরোপিত আপনার কাছে, শুধুই আপনার কাছে সমর্পণ করেছি সবটা। মানুষ বলে মোহের কাছে পরাজিত হওয়া ঠিক নয়। কিন্তু খুব কম মানুষই মোহ যুদ্ধে অপরাজিত থাকে। আপনার সঙ্গে যতদিন ছিলাম খুব সুন্দর ছিলো সবটা৷ আমি আমার লাইফের বেস্ট সময় কাটাচ্ছিলাম সে-সময়। খুব বেশি সুন্দর কোন কিছু দীর্ঘস্থায়ী হয় না! তাই তো আমার জীবনেও স্থায়ী হয়নি সে-সময়। ভীষণ ভয় হয় আমার। এই ছোট ছোট মুহুর্ত, আপনার সঙ্গে কাটানো সুখের মুহুর্ত হারানোর ভয়, আপনাকে হারানোর ভয় হয়।’

‘ভয় পাবেন না আমি আছিতো।আমিও সেই সুন্দর দিন গুলো মন সাপটে গেঁথে রাখবো আজীবন। সবচেয়ে সুন্দর কিছু মুহুর্ত উপভোগ করেছি আমি তখনই। তাই ওই সব স্মৃতি রোমন্থন করে রাখা আমার দায়িত্ব!’

‘আপনার জীবনে কি সত্যিই খুব সুন্দর কিছু উপভোগ করতে দিয়েছি আমি? আপনাকে ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আপনাকে ভালো রাখতে পারিনি। উলটো একটা সমস্যার জন্য আপনাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম খুব নোং’রা ভাবে। আমাকে ক্ষমা করবেন তুলিকা। আমি সত্যিই ক্ষমা চাওয়ার মুখ রাখিনি আপনার কাছে কিন্তু তবুও আপনার তরে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। পারলে এই অধম টাকে ক্ষমা করে দিন!’

‘আমি ছোট্ট একটা উপদেশ দেয় মাইজিন সুলতানকে? ক্ষমা চাওয়ার ফার্স্ট কন্ডিশন হলো,যে কারণে ক্ষমাটা চাচ্ছেন সেটা যেনো দ্বিতীয়বার আর না হয় এবং নিজে থেকে শ্বপথ নেয়া এরকমটা যেনো আর না হয়। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার নামই মনুষ্যত্ব। আপনি যখন সবার সাথে চলবেন,সবাইকে সম্মান করবেন, দেখবেন সম্মান যতটুকু আপনার প্রাপ্য সেটুকু ঠিকই আপনার ঝুঁলিতে আসবে।’

মাইজিন কিছু না বলে অপলক তাকিয়ে থাকে তুলিকার দিকে। স্পষ্ট ব্যথিত নয়ন তার। সে মোলায়েম কণ্ঠে বলে, ‘আপনার মনে আমাকে নিয়ে আর কোনো স্বংশয় নেই তো? আপনি ক্ষমা না করলে যে আমি শান্তি পাবো না।’

‘আমার কাছে আপনার কোনো ভুল নেই বলবো না। ভুল তো আপনার ছিলো তবে সেই ভুলের পরিপ্রেক্ষিতে যে আমি আপনার করা সব ভালো কিছুকে ভুলে যাবো তা তো নয়। ওই যে বললাম, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। যেহেতু আপনি মন থেকে ক্ষমা চাইছেন তবে ক্ষমা করলাম। ক্ষমা করা মহৎ গুণ। আর যেনো এমন না হয়!’

‘ঠিক আছে।’ খুশিতে গদগদ হয়ে মাইজিন তুলিকাকে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হলেও হাত ফিরিয়ে নিয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে চুলকে নিলো। মাইজিনকে অবাক করে দিয়ে তুলিকা মাইজিনের দু হাত নিয়ে নিজের কোমড়ে ধরিয়ে দিলো। অতঃপর নিজে থেকেই মাইজিনের গলা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। যারপরনাই অবাক হয়ে মাইজিন তুলিকাকে প্রথম বারের মতো সজ্ঞানে স্পর্শ করলো। যা ছিলো অপ্রত্যাশিত! মাইজিন তুলিকার এলোকেশীতে চুমু দিয়ে বললো,

‘এই পৃথিবীতে চেয়েছি তোমাকে,
এক সমুদ্র ভালোবাসা রয়েছে এই বুকে,
যদি কাছে আসতে দাও, যদি ভালোবাসতে দাও,
এক জনম নয়, হাজার জনম ভালোবাসবো তোমাকে।’

লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মুখ লুকালো তুলিকা।

‘লজ্জা পাওয়ার জন্য বেস্ট স্থানটা চুজ করেছেন মিসেস সুলতান!’


সুন্দর এক সকালের সঙ্গে মাইজিনের ঘুম ভাঙে।
প্রাণ প্রিয় প্রেয়সীর এক গাছি চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো মুখশ্রী জুড়ে। মেয়েটাকে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে পুরো। ঘুম ভাঙ্গায় না আর সে। স্মিত মুখে তাকিয়ে থাকে। আকস্মিক তার ইচ্ছে করে চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে৷ কিন্তু এটা যে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়৷ একটা সুন্দর দিনের পর তাদের জীবনের নতুন সূচনা করবে। মাইজিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মোহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার স্ত্রীর দিকে। ক্ষণেই নিজেকে ছন্নছাড়া লাগলো তার। মস্তিষ্ক হলো শূণ্য। আনমনে আওড়ায় সে, ‘ আপনার সম্মোহনের কাছে মদ্যপনেশাও অতি নগন্য তুলিকা।’

অনেক দিন পর মাইজিন ব্রেকফাস্ট তৈরি করলো সেই পুরনো দিনের মতো। তুলিকার আজকে ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। কোনো এক ভালো লাগায় আবিষ্ট হচ্ছে মন। মনে হচ্ছে মন থেকে ভারী কিছু সরে গেছে। কালকে মাইজিনের তার কাছে সবটা শেয়ার করাই হইতো। মাইজিনকে নিয়ে ভাবতে আরও বেশিই ভালো লাগছে। তুলিকা বিছানা ছেড়ে উঠে রান্না ঘরের দিকে যায়। সে জানে মাইজিনকে এই মুহুর্তে রান্না ঘরেই পাবে। আজকে আর মাইজিনকে কিছু বললো না। সেও কাজে হাত লাগাই। মাইজিন সাহস করে তুলিকাকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে৷ আকস্মিক স্পর্শে কেঁপে উঠে তুলিকা। কাল হঠাৎই কি হয়েছিলো তার? লাজ লজ্জা ভুলে মাইজিনকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে। পোড়া গন্ধে মিষ্টি আসে এখানে। এমন দৃশ্য দেখতেই খুক খুক করে কাশে। ঝটপট সরে দাঁড়িয়ে পরলো মাইজিন। মিষ্টি অপ্রস্তুত হয়ে মিনমিন করে বলে,

‘আপু ভাজি পুড়ে যাচ্ছে। আর একটু তারাতাড়ি করলে ভালো হয়। আমার স্কুলের দেরি হচ্ছে!’

‘তুই যা। হয়ে এসেছে সব রান্না।’

মিষ্টি নিজের বুবুজানকে আর অস্বস্তিতে ফেলতে চাইলো না। ঠোঁট চেপে হেসে রুমে চলে গেলো। ফোন হাতে নিয়ে কাউকে একটা ফোন করলো সে।

তুলিকা ফোস করে শ্বাস ফেলে বলে, ‘ইশ কি ভাববে এখন মিষ্টি। ওর সামনে যাবো কি করে এখন আমি?’

‘আমি কি করে জানবো এখন মিষ্টি আসবে।’

‘আচ্ছা যদি সত্যিই আমি প্রেগন্যান্ট হতাম তখন? আপনি আমাকে স্পর্শ করেন নি! তাহলে হুট করে আমি মা হতে যাচ্ছি যখন শুনলেন তখন আমাকে সন্দেহ হলো না একটুও? আমাকে নিয়ে মনে সন্দেহের বীজ বপন হতেই পারতো। আপনি তো এক মুহুর্তের জন্যও আমাকে সন্দেহ করেন নি? যদি সত্যিই রিপোর্ট টা আমারই হতো?’

হুট করেই মাইজিন তুলিকার দুই গালে হাত গলিয়ে নিজের দিকে মুখ ঘুরালো। মন্থর কন্ঠে বলল, ‘যে মেয়েটা নিজের স্বামীকে স্পর্শ করতে দেইনি এখনো অব্দি। সেই মেয়েটা যে অন্তত কোনো আজে-বা-জে কাজ করবে না সে আমি জানি। মেয়েটা বাজে সম্পর্কে লিপ্ত হবে এটা আমার ভাবনায় কেন, আমার মাথাতেও আসতো না। এমন নিকৃষ্ট চিন্তা যেনো আমার না আসে কোনো দিনও। আপনি আমার পবিত্র ফুল। শুধুই আমার ফুল।’

তুলিকা মাইজিনের দিকে ছলছল করে তাকিয়ে থাকে। মাইজিন তুলিকার গাল থেকে হাত সরিয়ে মুচকি হাসে। মশকরা করে বলল,

‘যদি বাচ্চা আসতোও না, সমস্যা ছিলো না আমার। ফ্রীতে একটা বাচ্চা তো পেতাম!’

‘আপনি আমাকে এতোটা বিশ্বাস করেন মাইজিন?’

‘যাকে ভালোবাসি তাকে অবিশ্বাস করবো কিভাবে? তাহলে তো ভালোবাসা শব্দটাই নড়বড়ে হয়ে যাবে। ভালোবাসা নামক পবিত্রতাকে বিকৃত করা হবে। এই পাগলি কাঁন্না করেন কেন? বলেছিলাম না আমার সামনে কাঁদবেন না? আমি ভুল করলে আমার সাথে ইচ্ছেমতো ঝগড়া করে নিবেন! কিন্তু কখনো রাগ, অভিমান করে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করনে না প্লিজ! এই-যে এখানে লাগে।’ মাইজিন হার্টে হাত দিয়ে দেখি বললো।

‘আপনি ছোট থেকেই কতটা নিদারুণ, নিষ্ঠুর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন আর আমি কি না আপনাকে ভুল বুঝলাম সত্যিটা না জেনে। আপনি ওই মহিলার এতো অত্যাচার সহ্য কেন করেছেন বলুন তো? আমার মনে পরলেই কষ্ট হচ্ছে ভীষণ!’

‘এখন আমি আমার মায়ের মতো দেখতে একজন মহিলাকে কিভাবে পুলিশের কাছে দিতাম বা তার গায়ে হাত তুলতাম? উনার জায়গায় যদি আমার নিজের মা হতো কখনোই হইতো আমাকে এতোটা আ’ঘা’ত করতেন না। কিন্তু ওই যে উনার ফেস টা, উনার ফেস টা যে আমার মায়ের ছিলো। আর মাইজিন সুলতান এতোটাও বেয়া-দব না যে একজন মায়ের বয়সি মহিলার সঙ্গে মিস-বিহেভ করবে। সে যতটাই খারাপ প্রকৃতির হোক না কেন!’

‘আচ্ছা আর এসব কথা কখনোই তুলবো না আমরা। চলুন মিষ্টির দেরি হচ্ছে!’

ব্রেকফাস্ট করার পর অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলো মাইজিন। দরজা থেকে ঘুরে এসে টুপ করে একটা চুমু দিলো তুলিকার গালে। সে জমে গেলো একদম।

‘কিমিও আইশিতের।’বললো মাইজিন!

‘এটা আবার কেমন ভাষা?’

‘আপনি বুঝে নিন।ভালোবাসার কথা বললে সেটা যে ভাষায় হোক না কেন ভালোবাসার মানুষ টা ঠিক বুঝে যায়।আমি জানি আপনি বুঝেন!’

ঠোঁট এলিয়ে হেসে তুলিকা মাইজিনের যাওয়ার তাকিয়ে থাকে অপলকভাবে!

#চলবে

আমি গল্প লিখার সময় কতবার যে পুতুল আর প্রশান্তর নাম লিখে ফেলি তার ইয়ত্তা নেই। আবার চোখে পরলে কে’টে ঠিক করে সঠিক নাম লিখি।আসলে পুতুল আর প্রশান্ত এই দুটো চরিত্র আমার ভারী প্রিয় চরিত্র।ওঁদেরকে লিখেছি তো পূর্বের গল্পে তাই হইতো ভুলে দুবার মিষ্টির নামের জায়গায় পুতুল লিখে ফেলেছিলাম গত পর্বে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here