#হীরকচূর্ণ_ভালোবাসা
#পর্ব১২
#রাউফুন
‘আমি জানি তো। কিন্তু আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেন? ওঁরা তো জোর করে পরিয়েছে কিন্তু আপনার এখানে কাঁপাকাঁপির কি আছে?’
মাইজিন আরেক কদম এগিয়ে এলো। বলল, ‘ভয় পাচ্ছেন?’
তুলিকার ভীতিকর অবস্থা দেখে মাইজিন আরেকটু এগিয়ে আসে! তুলিকা জুবুথুবু হয়ে এবার পিছিয়ে যায়। দিক ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক দৃষ্টি বিচরণ করে। ভাবছে এখান থেকে যদি পালাতে পারতো তবে হইতো এই অস্বস্তি থেকে বাঁচতো।
‘ভয় পাবেন না! আমি কিছু করবো না।’
‘আপনাকে ভয় পাওয়ার কি আছে? আপনি কি ডা’কা’ত সরদার নাকি!’ মাইজিনের কথার পিঠে সাহস সঞ্চার করে বলে তুলিকা।
‘হ্যাঁ তাই তো? ভয় কেন পাবেন? শুধু একটু কাঁপছিলেন এই আর কি! এটা আর এমন কি। বিদ্রুপ করে হেসে বললো মাইজিন।
তুলিকা মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে রইলো। মাইজিন আবার বললো, ‘ওহ হ্যাঁ আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!’
‘কিহ?’
‘হ্যাঁ। মাইজিন সৌন্দর্যের কদর করতে জানে। কারোর প্রশংসা করতে কার্পণ্য বোধ করে না।’
মাইজিনের প্রশংসায় লজ্জায় মিইয়ে গেলো তুলিকা। মাইজিন খাটের মধ্যখানে তীরন্দাজ করে লাফিয়ে উঠে বসলো৷ ধপাস করে একটা শব্দ হলো। তুলিকা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে বললো, ‘কি করছেন টা কি? খাটে শব্দ করছেন কেন? ওপাশের রুম থেকে ওঁরা কি ভাববে?’
‘কি ভাববে? আমি তো কিছু করিইনি।’
অস্বাভাবিক ভাবে অস্বস্তি ঘিরে ধরে তুলিকাকে। সে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে, ‘ ওঁরা খুব পা’জি আপনি তো জানেন!’
‘আপনিও কিন্তু কম যান না। আপনাকে যতটা সাদাসিধা ভেবেছিলাম আপনি ততটা নয়। মনে কি সব ভেবে বসে থাকেন আল্লাহ্। বেশ চঞ্চলও বোটে আপনি! আপনার প্রে’মে পরার সব গুলো কারণ আপনার মধ্যে আছে।’
‘এহ!’
‘এহ নয় হ্যাঁ। মেইবি আই ফল ইন লাভ উইদ ইউ।’ স্পষ্ট ভাবে বললো মাইজিন। তুলিকা চোখ কোণা করে বলে,
‘মেইবি?’
‘হু। আমার এই টুকু ভালোবাসাও খুব ধারালো! মাইজিন সুলতানের ভালোবাসা যে-সে পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু আপনি সেই যোগ্যতা রাখেন এবং সেটা আছে আপনার মধ্যে। আপনি হইতো আমার জন্যই জন্মেছেন তা না হলে আমি যেমন মেয়ে পছন্দ করি ঠিক তার সব গুলো গুণই কেন আপনার মধ্যে থাকতে হবে?’
‘আল্লাহ্ তায়ালা প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তার জুটি গড়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আপনার সঙ্গে আমার জুটি বেঁধেছেন তাইতো এখন আমি আপনার স্ত্রী!’
‘একটা কথা বলবো?’
‘হুম!’
‘আজকে কিন্তু আপনার আমার কাছেই থাকতে হতো৷ যেমন ধরুন প্রথম বার আপনার বান্ধবী আপনার বাসায় বেড়াতে এসেছে তাকে কি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই যেতে দেওয়া যায়? আমি তো জোর করেই রেখে দিতাম। একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না অতিথি আপ্যায়নের? ওঁরা যেহেতু থাকতই সেই অনুযায়ী আপনার আমার কাছেই থাকতে হতো আজ।’
‘আ-আপপনার কাছে মানে?’ ঘাবড়ানো গলায় বলে তুলিকা।
‘না মানে আমার বিছানায় থাকতে হতো তাই না? কি লু’চু মন আপনার!’
‘মোটেও না। থাকতে হতো তো কি?’
‘তো তখনও কি আপনার এই সেইম অনুভুতি হতো তুলিকা?’
‘আমার এখন ঠিক কেমন অনুভুতি হচ্ছে আপনি বুঝলেন কি করে?’
‘আপনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। আপনার অনুভূতি এখন, অস্বস্তি, লজ্জা, ভয়, মানে একাধিক মিশ্রিত অনুভূতি যাকে বলে। ঠিক বললাম তো?’
তুলিকা চুপ রইলো। মাইজিন বললো, ‘আরেক খান কথা বলবো?’
‘আবার কি কথা? আচ্ছা বলুন!’
‘না না কথা না, কথা না। রিকোয়েস্ট আছে। একটা রিকোয়েস্ট করবো?’
‘হুম করুন!’
‘আজকে আমি আপনাকে অনুভবে আদর করতে পারি?’
‘ক-ক-কি বলছেন আপনি?’
‘তেমন কিছু না। এটুকুতেই এতো ভয়? এই নাকি আপনি ভয় পাচ্ছেন না? আমি শুধু আজকে সারারাত আপনাকে দেখতে চাই। আমি আমার এই টুকু ভালোবাসাটা আপনাকে দেখে দেখে উপলব্ধি করতে চাই। কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে বা’জে ভাবে দেখবো না। এসব ভাববেনও না কিন্তু! মাইজিন সুলতান কিন্তু তার কথা রাখে। আপনার মুখ ছাড়া আর অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি ঘুরাবো না।’
তুলিকা জমে গেলো মাইজিনের ঠান্ডা, শান্ত ভঙ্গিতে বলা কথায়। সে কোনো বাক্য বিনিময় না করে আস্তে আস্তে খাটের এক পাশে শুয়ে পরলো। মাইজিন বাধ সাধলো এতে। বললো,
‘উঁহু উঁহু চলবে না। আমি আপনাকে দেখবো আর আপনিও আমাকে দেখবেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন ঘুমানোর আগ মুহুর্ত অব্দি।’
তুলিকা এবারও নিশ্চুপ। সে শুধু মাইজিনের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে তাকিয়ে রইলো। মাইজিন অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো। তুলিকার মুখের ফিচার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো। তুলিকার ভ্রুর একটু উপরে একটা তিল আছে। তার লাল খয়েরী রঙের ঠোঁট যেনো পেন্সিল দিয়ে আঁকানো। কি নিখুঁতভাবে আল্লাহ্ তায়ালা তাকে বানিয়েছেন। মেজেন্টা কালারের শাড়ীতে যেনো তার সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেছে। মাইজিনের চোখে যখন তুলিকার গভীর ভাবে চোখ পরলো তখন আরও জমে গেলো। সে চোখ সরিয়ে নিতেই শুনতে পেলো,
‘মা-শা-আল্লাহ্!’ মাইজি বলেছে। কিছুক্ষন আবার শুনলো,
❝দূর নিলিমায় রয়েছি তোমার পাশে
খুঁজে দেখো আমায় পাবে হৃদয়ের কাছে,
বলবো না কোন গল্প, গাইবো শুধু গান
যে গানে খুঁজে পাবো ভালোবাসার টান ।
নৌকাতে আজ তুমি মাঝি আমি তোমার সাথী
আকাশ ছোঁয়া পালে জলুক চাঁদ সূর্যের বাতি,
দুটি কুরির চোখেতে আজ ভোরের আলো লাগে
নাহয় ফুটুক একটি ফুলই গভীর অনুরাগে!❞
খিলখিল করে হেসে উঠলো তুলিকা।বললো, ‘মশাই, এটা তো বিছানা নৌকা না। না আছে চাঁদ, সুর্য না আছে নদী।’
‘ভারী আন-রোমান্টিক মেয়ে তো তুমি?’
‘আচ্ছা খাটকে নৌকা ভাববো কোন দুঃখে? ভাবলেও নদী কোথায়?’
‘ভাবতে হবে না। ঘুমাও!’
‘আচ্ছা!’
‘এই এই আমি কি আপনাকে তুমি বললাম?’
‘হ্যাঁ!’ মুচকি হেসে বললো তুলিকা।
‘স্যরি হ্যাঁ!’
‘স্যরি হওয়ার কিছু নেই তো। তুমিই বলবেন আজ থেকে!’
‘অনুমতি দিচ্ছেন?’
‘ হ্যাঁ।’
‘না থাক। আমি সেদিনই তুমি বলবো যেদিন পুরোপুরি ভাবে আপনাকে আপন করে পাবো!’
‘আচ্ছা!’
•
মাইজিনের ঘুম যখন ভাঙলো তখন সে অনুভব করলো তাকে পেঁচিয়ে আছে একটা সরু হাত। সে তুলিকাকে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়েছে মনে পরছে না। তুলিকার তাকে প্রথম ছোঁয়া! এটা তো স্মৃতির পাতায় রোমন্থন করে রাখাই যায়। সে সুন্দর করে একটা ছবি তুলে নিলো। এরপর আস্তে আস্তে নিজের শরীরটাকে গড়িয়ে দিলো ফ্লোরে। যাতে তার স্পর্শ না লাগে তুলিকার হাতে। আর ঘুম ও না ভাঙে। ঘুম ভেঙে যদি দেখে তাকে ধরে আছে তুলিকা ভীষণ অস্বস্তিতে পরবে। এটা সে কিছুতেই চাই না। এমনিতেই কাল রাত থেকেই অস্বস্তিতে বিমুঢ় হয়ে আছে মেয়েটা। সে সন্তর্পণে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। আজ নামাজটাও সময় মতো হলো না। সে উঠে কাজা নামাজই আদায় করে নিলো। এরপর রান্না ঘরে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে শুরু করলো। বাসায় মেহমান এসেছে এভাবে তো বসে থাকা যায় না। সে তুলিকাকেও ডাকতে পারবে না। তুলিকার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে তো ডাকলে? তার যখন অর্ধেক রান্না শেষ তখন তুলিকার উপস্থিতি টের পেলো। সে আলতো ঘাড় ঘুরিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘গুড মর্নিং!’
‘আপনি আমার কথা শুনবেন না মাইজিন?’
‘আমি আবার আপনার কোন কথা শুনলাম না?’
‘আপনি আমাকে ডাকেন না কেন? ঠিক আছে আমার ঘুম টা খুব গভীর হয়। ঘুমালে কিছু বলতে পারি না৷ তাই বলে তো এমনটা নয় ডাকলে আমি উঠবো না।’
‘আপনি কি সুন্দর ঘুমাচ্ছিলেন। ডাকতে ইচ্ছে হয়নি।’
‘আপনি কোনো কাজ করবেন না। আজকের পর রান্না ঘরের আশেপাশেও যেনো না দেখি। মানে পাও মাড়াবেন না এদিকে। রান্না ঘর শুধুই আমার দখলে!’
‘আমি আপনার কাজে সাহায্য করলে কি হবে?’ অসহায় মুখ করে বললো মাইজিন।
‘আপনার রান্না খুবই বাজে তাই এরপর থেকে রান্না করবেন না।’
‘বা’জে রান্নায় খেতে হবে আপনাকে।’
‘আপনি এমন ত্যাদড়ামি কেন করেন রান্নার বিষয় টা নিয়ে? আমার কষ্ট হয় আপনাকে কাজ করতে দেখলে।’
‘কষ্ট পাবেন না তুলিকা। আপনি তো আমাকে জোর করে করাচ্ছেন না কাজ। আমি নিজের ইচ্ছেতেই করছি।’
সকালে ব্রেকফাস্ট এরপর মাইজিন সবার থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলো। আশফি আর নীতি রাতের ঘটনা আন্দাজ করেছে।তুলিকাকে আপাদমস্তক অবলোকন করেই বুঝতে পেরেছে তারা। বাকিটা তুলিকার পেট থেকেই বের করেছে তারা। তারাও বিদায় নিলো। যাওয়ার আগে আশফি বললো,
‘তুই বুঝতে পারছিস মাইজিন ভাইয়ার ভালোবাসার বিসালতা কিন্তু অনেক। একবার ভাব তার এইটুকু ভালোবাসার প্রখরতা যদি এতো হয় তবে মন প্রাণ উজাড় করে যখন অনেকটা ভালোবাসবে তা কতটা তীব্র, কতটা প্রখর হবে? সইতে পারবি তো তখন মাইজিন সুলতানের ভালোবাসার ধার? এবার থেকে তোদের সম্পর্ক টা নিয়ে ভাববি ভালো ভাবে বুঝলি? কালকের ঘটনাটা না করলেই পারতি!’
‘দেখ আশু, আমি এখনো মাইজিনকে ভালোবেসে উঠতে পারিনি। আমি সম্পুর্ন ভাবে আমাদের সম্পর্ক টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তাকে এতোটুকুও ঠকাতে চাই না আমি। যেদিন তাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবো সেদিনই আমি তার কাছে ধরা দেবো। নতুবা নয়৷ এভাবে যদি আমি তাকে ধরা দিই তবে যে তাকে ঠকানো হবে রে। আমি মাইজিনের মতো মানুষকে ঠকাতে চাই না!’
আশফি তুলিকাকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো, ‘আচ্ছা তবে তাই হোক। তুই মাইজিন ভাইয়াকে সময় মতো বলিস। আমি এখানে এরপর তখনই আসবো যখন শুনবো মাইজিন ভাইয়া আর তোর সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। তুই মাইজিন ভাইয়াকে ভালোবাসিস যেদিন শুনবো সেদিন আমি আর নীতি ভাবি চলে আসবো তোর আনন্দের সঙ্গী হতে।’
‘তার মানে কি তুই যোগাযোগ রাখবি না আমার সঙ্গে?’
‘আরে পা’গ’লি কাঁদে না। আমি কি তোর সঙ্গে কথা না বলে থেকেছি কখনোই? আমাদের রোজ যোগাযোগ হবে। আমি তোর প্রতিদিনের গল্প শুনবো দিন শেষে!’
আশফি যাওয়ার আগে মিষ্টিকে ডেকে বললো, ‘রাতে কি বলেছি মনে আছে তো?’
‘ হ্যাঁ আশফি বুবুজান মনে আছে। তুমি চিন্তা করো না।’
আশফি আর নীতি চলে গেলো। আর তুলিকা ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। এখন মনে হচ্ছে ঘরটা কতটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ওঁরা আসাতে যেনো পরিপূর্ণ ছিলো। একটা সুন্দর ফ্যামিলি মনে হচ্ছিলো। ওঁদের যতক্ষণ অব্দি দেখা গেলো তুলিকা তাকিয়েই রইলো।
#চলবে