#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২০
নির্মল ফ্যানের বাতাসে ঘরে শীতল আবহাওয়া বিরাজ করছে। জানালা আর বারান্দার দরজা খোলা থাকায় ষোলকলা যেন পূর্ণ হয়েছে। এতো শীতল আবহাওয়া তেও ঈশার কোন অনুভুতি হচ্ছে না। ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করেই যাচ্ছে সে। উদ্দেশ্য ইভান কে কিভাবে মানাবে। ইভান এখনো ঈশার উপরে রেগে আছে। না দেখা করছে না ফোন ধরছে। গত দুইদিন যাবত ইভানের কোন খবর নেই। ঈশা ফোন করলেও ফোনটা ধরছে না। এতটা রাগ! ঈশার কথাটাও শুনল না। কিন্তু ঈশা যে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সেটা সে এখন বুঝতে পারছে। ইভান কে আগেই সবটা তার জানানো উচিৎ ছিল। ইভান কোন না কোন একটা সমাধান খুজে বের করতো। ইফতির বুদ্ধি শুনে নিজে নিজে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক হয়নি। এই বিষয়ে কোনভাবে বাসায় জেনে গেলে কতটা খারাপ হবে সেটা ভেবেই ঈশা এখন ভয় পাচ্ছে। তার পরিস্থিতিটা কেউ বুঝতে চাইবে না। আর বুঝবেই বা কেন? তারা যদি বিয়ের কথা বাসায় বলতো তাহলে তো কারও আপত্তি ছিল না। এখনি বিয়ে দিয়ে দিত। ঈশার কথার উপর ভিত্তি করেই তো বিয়েটা পেছানো হয়েছে। এখন বিষয়টা সত্যিই অনেক জটিল হয়ে গেছে। ইভান এটা ভেবেই এতো রিয়াক্ট করছে। ভুলটা যখন করেই ফেলেছে সেটা তো আর ঠিক করতে পারবে না। তাই এখন সেটা নিয়ে না ভেবে ইভান কে নিয়ে ভাবাটা বেশী জরুরি। ভাবতে ভাবতে নিজের পড়ার টেবিলের উপরে বসে পড়লো ঈশা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় মুখ নিয়ে বারান্দার দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল। ইভানের বারান্দায় চোখ পড়তেই উকি ঝুকি মেরে বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ালো। সদ্য জলে ওঠা ঘরের লাইটটা অতি আকাংক্ষিত মানুষটার আগমন জানান দিতেই মন আনন্দে ভরে গেলো। কিছু না ভেবে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিলো। জানালা লাগিয়ে ফ্যান লাইট সব বন্ধ করে দিয়ে দ্রুত পায়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে ডাইনিং এ মাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
–আম্মু আমাকে ইফতির কাছে একটু যেতে হবে। সামনে পরিক্ষা একটু হেল্প লাগবে।
মেয়ের কথা শুনে ঈশার মা একটু ভাবলেন। এতো রাতে বাইরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল ওটা তো মেয়ের হবু শশুর বাড়ি। খারাপ কিছু তো না। ভেবেই মাথা নেড়ে বললেন
–একা যাবি?
–না আম্মু ইফতি নিচে অপেক্ষা করছে।
ঈশার মা হেসে অনুমতি দিলো। বাইরে বের হয়ে দরজা লাগিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। অনেক বড় দুইটা মিথ্যা বলেছে এখনি। ইফতি নিচে নেই। আর সে ইফতির কাছে যাচ্ছে না। তার কাছে যে কোন উপায় নেই। ইভান কে মানাতে হলে তার কাছে যেতে হবে। আর সে তো কোন ভাবেই ঈশার সামনে আসছে না। তাহলে এখন ঈশাকেই কিছু একটা করতে হবে। ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলো বাড়ির সামনে। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে কলিং বেল চাপল। ইমতিয়াজ রহমান এসে দরজা খুলে দিলেন। ঈশাকে দেখে খানিকটা ভ্রু কুচকে তাকালেন। মুহূর্তেই আবার মুখো ভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন
–আরে মামনি কি খবর? ভিতরে আসো।
ঈশা অপ্রস্তুত ভাবে সালাম দিলো। ইমতিয়াজ রহমান সালামের জবাব দিয়ে সরে দাঁড়ালেন তাকে ভিতরে যেতে দিতে। ঈশা মাথা নিচু কর ঢুকল। একটু আমতা আমতা করে বলল
–আঙ্কেল ইফতি বাসায় আছে? ওকে অনেকক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি। ধরছে না।
ইমতিয়াজ রহমান এবার ঈশার আসার কারণটা বুঝতে পেরে হেসে বললেন
–ঘরে আছে মামনি। তুমি যাও।
ঈশা এক মুহূর্ত দেরি না করে উপরে চলে গেলো। কারন আর একটা মিথ্যা বলেছে সে। ইভানের ঘরের সামনে দিয়ে সোজা ইফতির ঘরে চলে গেলো। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই ঈশাকে দেখে ইফতি ভুত দেখার মতো অবাক হল। ঈশা সোজা গিয়ে ইফতির পাশে বসে বলল
–আমার হাতে একদম সময় নেই। তোর সাথে আমি দেখা করতে আসিনি। তবে তোর নাম সব জায়গায় বলেছি। ম্যানেজ করে নিস।
বলেই উঠে দরজার দিকে পা বাড়াতেই ইফতি বলল
–তুফান মেল তোমার জন্য আমি কাল থাপ্পড় খেয়েছি। আবার তুমি! কোনদিন যেন তুমি আমাকে মার্ডার করে দিবে নির্ঘাত।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ঝাঝাল গলায় বলল
–বুদ্ধি দেয়ার সময় মাথায় ছিল না? তুই জানতিস তোর ভাই কেমন জল্লাদ। তাহলে আমার মতো একটা অবুঝের মাথায় এসব কেন ঢুকাস? যেমন বুদ্ধি তেমন প্রাপ্য।
–ওহো কচি খুকি! আমি বুদ্ধি দিলাম আর নিয়ে নিলি না। যখন আমার কাছে এসে ভ্যা ভ্যা করে কাদছিলি তখন মনে ছিল না? আমার উচিৎ ছিল তখন তোর গলাটা টিপে জবান বন্ধ করে দেয়া। তাহলেই আমাকে আর কাল থাপ্পড়টা খেতে হতোনা। ইশ!! এখনো ব্যথা অনুভব করছি।
ইফতির কথা শেষ হতেই ঈশা দ্রুত পায়ে বের হতে হতে বলল
–এসব খোশ গল্প করার সময় আমার নেই।
বলেই সোজা ইভানের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কি হল কে জানে? সাহস করে দরজায় নক করতেই ইফতি নিজের দরজা খুলে মাথা বের করে ফিস ফিস করে বলল
–অল দা বেস্ট মাই ডিয়ার ভাবি!
ঈশা রাগি চোখে তার দিকে তাকাতেই ইভানের দরজা খুলে গেলো। ঈশা সামনে ঘুরে তাকাতেই ইভান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখল। ঈশাকে দেখে মোটেও অবাক হল না। এমন ভাব যেন সে জানত ঈশা আসবে। চোখ ফিরিয়ে ইফতির দিকে তাকাল। ইফতি সাথে সাথেই মাথা ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। ইভান ঈশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে দরজা খোলা রেখেই ভিতরে চলে গেলো। বালিশটা পিঠের নিচে দিয়ে আধ শোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশা ভিতরে ঢুকে নিশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলো। ধির পায়ে ইভানের পাশে এসে বসলো। ঈশা কি বলবে কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মাথা নামিয়ে ছোট্ট করে ‘সরি’ বলতেই মনের জমানো সমস্ত কষ্ট বেরিয়ে এলো ছুটে। আটকাতে পারলো না নিজেকে। কেদেই ফেলল। ঈশার কান্না শুরু হতেই ইভান একটানে তাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয়। সে যেন এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিল। ঈশা ইভানের শরীরের স্পর্শে আসতেই কান্নার বেগ বাড়িয়ে দেয়। ইভান এক হাত চুলের ভাজে ঢুকিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলে
–আহা! কাদেনা। আর এরকম করবো না। সরি। সত্যি করবো না। প্রমিস।
ইভানের এমন আদুরে কথা শুনে ঈশা আরও অস্থির হয়ে উঠলো। এবার শব্দ করে কেদে উঠলো। ইভান আবারো আদুরে কণ্ঠে বলল
–এভাবে কাদেনা পাখি প্লিজ। আমি সত্যি সরি। আর কখনও বকবো না।
ঈশা ইভানের কণ্ঠের অসহায়ত্ব বুঝতে পারলো। নিজেকে সামলে নিলো। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ইভান ঈশার মাথাটা তুলে মুখের দিকে তাকাল। এখনো হিচকি উঠে সারা শরীর কেঁপে উঠছে। ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি এরকম করতে চাইনি। আসলে আমা……।
ইভান কথা শেষ করতে দিলো না। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল
–বলতে হবে না। আমি সব জানি।
ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান একটু সরে গিয়ে ঈশার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল
–তোর কি মনে হয় তুই এমন কোন কাজ আজ পর্যন্ত করতে পেরেছিস যেটা আমি জানিনা?
ঈশা চোখ খুলে ফেলল। কৌতূহলী চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান একটু হেসে বলল
–আমি সারাদিন এতো এতো ফাইল সাইন করি না পড়েই? কোনটা কিসের ফাইল সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। আর সেদিন তুই আমাকে ডিস্ট্র্যাক্ট করার জন্য আমার সাথে কথা বলছিলিস। তোর কি মনে হয় আমি না দেখেই সাইন করে দিয়েছি।
ঈশা অবাক চোখে তাকাল। ইভান ঈশার মুখে পড়ে থাকা এলোমেলো চুল গুলো কানের পিছনে সরে দিতে দিতে বলল
–ঈশা পাখি আমাকে বোকা বানানো এতো সহজ না। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম কিন্তু তারপরে ভাবলাম কিছু একটা কারন আছে। হয়তো তুই আমাকে এখন বলতে চাস না পরে বলবি তাই কিছু না ভেবেই সাইন করে দিয়েছি। কিন্তু মাঝখানে ইফতি আর মিরাকে নিয়ে যা কিছু হল তাই আর সেটাতে গুরুত্ত দেইনি। ভেবেছিলাম পরে তুই নিজে থেকেই এটা নিয়ে কথা বলবি। কিন্তু তুই যখন কিছুই বললি না তখন তোর আর ইফতির কল রেকর্ড থেকে সবটা জানতে পারলাম। আমি সত্যিই অপেক্ষা করে ছিলাম তুই আমাকে নিজে থেকেই সব কিছু বলবি কিন্তু আমাকে না বলে তুই মেঘলার সামনে সিন ক্রিয়েট করলি।
ঈশা কিছু বলল না। চুপ করে ইভানের কথা শুনছে। ইভান ঈশাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল
–আমার ওভাবে রিয়াক্ট করা উচিৎ হয়নি। এর জন্য আমি সরি। কিন্তু সেদিন তোর উপরে খুব রাগ হয়েছিলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। আমার রাগ করার যথেষ্ট কারন ছিল। মেঘলা যে তোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো তুই সেটা আমাকে বলতে পারতিস। কিন্তু বলিস নি। আর তুই পুরো ব্যাপারটা মেঘলার সামনে যেভাবে উপস্থাপন করেছিস তোর কি মনে হয় মেঘলা কোন স্টেপ নিবে না?
ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–ওর কথা গুলো শুনে সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিলো। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।
ইভান ঈশাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল
–মেঘলা এমন বাড়াবাড়ি করে সেটা তুই জানিস। তারপরেও এই বোকামিটা কিভাবে করলি জান? মেঘলা মেনটালি সিক। বেশ কয়েকবার সুইসাইড করতে চেষ্টা করেছিলো। ওর বাবা আমাকে সবটা বলেছে। ও যে জিনিসটা চায় সেটার জন্য ডেস্পারেট হয়ে উঠে। ওকে ট্রিটমেন্টের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান চলছে। এই জন্যই আমি ওর কোন আচরনের কোন রকম স্টেপ নিতাম না। কিন্তু তুই যে বোকামিটা করেছিস এর পরে যদি মেঘলা সুইসাইড করে তাহলেও আমি অবাক হবো না।
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। অপরাধির মতো বলল
–আমাকে আগে বলনি কেন?
ইভান একটু রাগ করলো। বলল
–কিভাবে বলবো? মেঘলা যে তোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো আমাকে সে যে কোনভাবে বিয়ে করবে সেটা তুই আমাকে বলেছিস? আমাকে বললে কি আমি মেঘলা কে হেল্প করতাম আমাকে বিয়ে করতে? তুই এটা আগে বললেই আমি সেভাবেই বিষয়টা হ্যান্ডেল করতাম।
ইভানের এমন কথা শুনে ঈশা কি বলবে বুঝতে পারলো না। মাঝে মাঝে ইভান এমন কথা বলে ঈশার কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু ঈশা এখন ভালো করেই বুঝতে পারছে ইভান কে না জানিয়ে এতো বড় ভুল করা উচিৎ হয়নি। এখন সত্যি সত্যি যদি মেঘলা কোন স্টেপ নেয় তাহলে বিষয়টা ভালো হবে না। ইভান ঈশার বিষয়টা বুঝতে পারলো। ঈশার গালে হাত রেখে বলল
–এতো ভাবিস না। আমি আছি তো। আমি থাকতেও তোর এতো ভয় কিসের?
ইভানের কথাটা শুনেই ঈশার মনের সমস্ত ভয় কেটে গেলো। সত্যিই এই মানুষটা জতদিন তার কাছে আছে ততদিন পর্যন্ত কোন চিন্তা নেই। ঈশা একটু হাসল। ইভান হেসে ঈশার গালে একটা চুমু দিলো। ঈশা কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান গালে আরও একটা চুমু দিয়ে বলল
–সরি সেদিন মারতে চাইনি জান। খুব রাগ হয়েছিলো।
ঈশা চোখ খুলে ফেলল। ইভানের ফোনে মেসেজ টোন বেজে স্ক্রিনটা অন হয়ে গেলো। ঈশা সেদিকে তাকাল। সময়টা খেয়াল হতেই আঁতকে উঠলো। ব্যস্ততার সাথে বলল
–অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাসায় যেতে হবে।
কথাটা শেষ করে উঠতেই ইভান তার কোমর জড়িয়ে নিজের অনেকটা কাছে টেনে আনল। নিজের মুখটা ঈশার মুখের কাছে এনে বলল
–এতো তাড়া কিসের ম্যাডাম! এসেছেন নিজের ইচ্ছায় যাবেন আমার ইচ্ছায়। এতো সহজে ছেড়ে দিবো ভেবেছেন?
চলবে………
(আপনারা শুধু ইভান কে কেন বকেন? ঈশার ভুলটা কেন চোখে পড়লো না। মেঘলার কথা ইফতির সাথে আলোচনা না করে ইভানের সাথে করতে পারতো। বেচারা ইভান!? আপনাদের বকা খেয়ে খুব মন খারাপ করেছে।)