তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি লেখক-এ রহমান পর্ব ২১

0
836

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২১

নিকষ কালো অন্ধকার ঘরটি নিরবতায় ঘেরা। থেমে থেমে এয়ারকন্ডিশনের শনশন আওয়াজ কানে আসছে। সিলিং ফ্যানটা হালকা দুলে বাতাস দিচ্ছে। সব মিলে পুরো ঘরে যেন শীতের আমেজ। কিন্তু এতো শীতল হাওয়াতেও ঈশার শরীর দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে। কপালে ঠোটের উপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ইভানের শরীরের সংস্পর্শে ঠাণ্ডা আবহাওয়া হার মেনে দমে গেলো মুহূর্তেই। ইভান ঈশাকে কোলে বসিয়ে দুই হাতে ধরে তার মুখের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। ঈশার দৃষ্টি নিচে আবদ্ধ। সে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতা নেই। ইভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখে পড়ছে। ঈশা ঢোক গিলে নিজের গলা ভেজানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ইভানের নেশালো দৃষ্টি তার তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দিলো। আচমকাই ইভান তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো। ঈশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইভান তাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে নেমে দিলো। ঈশা ইভানের দিকে ঘুরে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ইভান তাকে উলটা দিকে ঘুরে গ্রিলের সাথে চেপে দিলো। তার পিঠের সাথে নিজের বুক ঠেকিয়ে দিলো। ঘরে এতো ঠাণ্ডার মাঝেও সে ঘেমে যাচ্ছিলো আর এখানে তো বলতে গেলে বাতাস নাই। ইভানের এমন স্পর্শে পুরো শরীর নিস্তেজ হওয়ার উপক্রম। চোখ নামিয়ে নিতেই ইভান পিছন থেকেই দুই আঙ্গুলে মুখ তুলে আরেক হাতে আকাশের দিকে তাকানোর জন্য ইশারা করলো। ঈশা চোখ তুলে দেখতেই থালার মতো জ্বলজ্বল করা পূর্ণিমার চাঁদটা চোখে পড়লো। মনের চাপা আনন্দটা আচমকাই বেড়ে গেলো। দুই হাতে গ্রিল চেপে ধরল। এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো। চোখ ধাঁধান সৌন্দর্য! আশে পাশে তারা গুলো মিটি মিটি করে জলছে আর নিভছে। কিছু সময়ের জন্য দুনিয়া ভুলে গেলো ঈশা। মুগ্ধ চোখে অপরুপ সেই দৃশ্য দেখতেই ব্যস্ত সে। সম্ভিত ফিরে পেলো আবারো ইভানের স্পর্শ পেতেই। ইভানের এক হাত ঈশার গ্রিলে আঁকড়ে ধরা হাত শক্ত করে চেপে ধরা। আর এক হাত তার কোমরে। মুখটা কানের কাছে এনে ফিস ফিস করে বলল

“মেঘহীন কোন এক পূর্ণিমা রাতে আকাশে এক ফালি চাঁদ থাকবে। উন্মাদ করা সেই চাঁদ মৃদু আলোয় চারিদিকে ভরিয়ে দিবে। বাতাসের শিষ কানে বাজবে। জোনাকি পোকারা চাঁদের সাথে পাল্লা দিয়ে আলো ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। নিস্তব্ধ চার পাশে ঝি ঝি পোকা মাদকময় এক সুর তুলবে। এরকম এক রাতে তোমার হাত ধরে শেষ হবে অপেক্ষার প্রহর। পাশে দাড়িয়ে তুমি আমাকে পূর্ণ করবে। এই মধু জোছনায় ঘটবে রাত্রির সাথে চাঁদের মিলন। নিঃসঙ্গতা’র যন্ত্রণায় বুকে চেপে রাখা কষ্টের আত্ম-চিৎকার, অন্ধকার পৃথিবীর নীরব স্তব্ধ-সুনসান শূন্যতা ভুলে সেদিন আমি তোমার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিবো। আমাদেরও মিলন হোক রাত্রি আর চাঁদের সাথে। মনের সাথে মন মিলে যাক। নিরব অনুভুতির আদান প্রদানেই নিশব্দে জানিয়ে দেই আমি তোমার। শুধুই তোমার।”

ইভানের কথা গুলো কানের পর্দা ভেদ করতেই ঈশার মস্তিষ্ক শুন্য হয়ে গেলো। চিন্তাধারা এলোমেলো হয়ে গেল। অনুভুতি শুন্য ঈশা কিছু বুঝতে ব্যর্থ হয়ে ইভানের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। ইভান নিজের হাসি প্রশস্ত করে ঈশার চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল
–কিছু মনে পড়ে?

ঈশা কোন কথা বলতে পারলো না। চোখ ছল ছল করে উঠলো। ইভান একটু বিরক্ত হয়েই বলল
–সব মেয়েরাই এমন ইমোশনাল নাকি শুধু তুই?

ঈশা চোখ বন্ধ করতেই পানি গড়িয়ে পড়লো। ইভান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ইভান ঈশাকে ধরে আদুরে কণ্ঠে বলল
–কাদছিস কেন? জোনাকি মিসিং বলে? এখন জোনাকি কোথায় পাবো বল? ওরা তো আর আমার ইচ্ছা মতো আসবে না।

ইভানের কথা শুনে ঈশা হেসে ফেলল। কিছু একটা ভেবে মাথা তুলে বলল
–তুমি আমার ডাইরি পড়েছ কিন্তু কিভাবে? আমি তো ওটা…।

ঈশা কে কথা শেষ করতে দিলো না ইভান। তার আগেই তাকে চেপে ধরে একটু কাছে এসে বলল
–এই তোকে আমি পুরোটাই জানি। তোর মনের কথা গুলো আমার সব জানা।

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন একদিন বারান্দায় বসে পূর্ণিমা দেখতে দেখতে ঈশা তার ডাইরির পাতায় নিজের মনের এই ইচ্ছাটাকে লিপিবদ্ধ করেছিলো। ঠিক এভাবেই। এখন সেই ডাইরি বন্ধ অবস্থায় ড্রয়ারে আটকানো। সেখানে জমিয়ে রাখা এই ইচ্ছা গুলো কখনও বেরিয়ে আসবে সেটাই সে ভাবেনি। আর এভাবে কেউ সেটা পুরন করবে সেটা সত্যিই কল্পনাতেও আসেনি তার। ঠিক কতটা ভালবাসলে একটা মানুষকে এভাবে উপলব্ধি করানো সম্ভব সেটা ঈশা ধারনাও করতে পারছে না। ইভান ঈশার গালে হালকা স্পর্শ করে বলল
–কি ভাবছিস?

–তুমি পুরোটাই আমার কাছে রহস্য। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে আমি এই রহস্যে ঘেরা মানুষটার রহস্য ভেদ করতে চাইনা। দেখতে চাই আরও কতো কিছু আমার জানার বাইরে আছে।

ইভান হেসে ফেলল। ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সব দেখাবো জান।

ঈশা কিছু বলল না। মুচকি হাসল শুধু। ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–জোনাকির সাথে আরও একটা জিনিস মিসিং আছে।

ঈশা কৌতূহলী চোখে তাকাল। মনে করতে চেষ্টা করলো আর কি ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই মনে পড়ছে না। হতাশা ভরা একটা শ্বাস ছাড়তেই ইভান তার কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নিলো। নেশা ভরা কণ্ঠে বলল
— নিঃসঙ্গতা’র যন্ত্রণায় বুকে চেপে রাখা কষ্টের আত্ম-চিৎকার, অন্ধকার পৃথিবীর নীরব স্তব্ধ-সুনসান শূন্যতা ভুলে সেদিন আমি তোমার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিবো।

ঈশা ইভানের কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান হেসে তার একদম কাছে এসে বলল
–তুমি আমার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিবে।

ইভানের কথা মাথায় ঢুকতেই ঈশা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি নত করে নিলো। ইভান ঈশার মুখের কাছে আসতেই ইফতি দরজায় নক করলো। ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। বিরক্তিকর একটা শব্দ করলো। সরে দাঁড়ালো। ইফতি ঘরে ঢুকে দুজন কে দেখতে না পেয়ে ধির কণ্ঠে ডাকল
–ভাইয়া।

ইভান বারান্দার দরজায় দাঁড়ালো। ইফতি হেসে বলল
–অনেক দেরি হয়ে গেছে আমি ঈশাকে বাসায় দিয়ে আসি। নাহলে সবাই প্রশ্নের ঝড় তুলে দিবে।

ইভান কোন কথা বলল না। এই মুহূর্তে ইফতির উপরে তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। শাস্তি স্বরূপ সারারাত তাকে পানিতে চুবিয়ে রাখলেও কমই হবে। ইফতি ইভানের উত্তরের অপেক্ষা করছে। ইভান ঘাড় বেকিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা নিচে তাকিয়ে ঠোট চেপে হাসছে। সেই হাসিতে ইভানের রাগ আরও বেড়ে গেলো। উলটা ঘুরে সামনে তাকিয়ে ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–ওকে নিয়ে যা।

ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বের হয়ে গেলো ইফতির সাথে। ইফতি হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলো
–কি রে সব ঠিক আছে তো?

ঈশা আনমনে হাঁটছিল। ইফতির কথা শুনে ভ্রু কুচকে বলল
–কি?

ইফতি একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–ভাইয়ার মেজাজ খারাপ মনে হল। তাই বলছিলাম।

ঈশা মুচকি হেসে বলল
–তোর ভাইয়ার মেজাজ কখন ঠিক থাকে আমি সেটা নিয়েই আসলে কনফিউজড।

ইফতি ঈশা দুজনি হাসল।

—————–
ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভিতরে ঢুকছিল ঈশা। আচমকাই কারও সাথে ধাক্কা খেলো। চোখ তুলে তাকাতেই মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে ‘সরি’ বলল। ঈশা একটু ভাবল। আসলে সরিটা তার বলা উচিৎ। কারন সে নিজেই খেয়াল করেনি। একটু হেসে বলল
–তোমার কোন দোষ নেই। আমি খেয়াল করিনি।

বলেই সামনে এগিয়ে যেতেই আবার পিছনে ঘুরে বলল
–কফি কার জন্য নিয়ে যাচ্ছ?

মেয়েটা কোমল কণ্ঠে বলল
–ইভান স্যারের জন্য।

ঈশা ঘড়ি দেখল। তার ক্লাস এখনো প্রায় আধা ঘণ্টা লেট। আর আজ ক্লাস দেরি করে থাকায় সে দেরি করে এসেছে। ইভান সকাল সকাল এসে গেছে। তার সাথে দেখা হয়নি এখনো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল
–কফিটা আমাকে দাও। আমি নিয়ে যাচ্ছি।

কফিটা নিয়ে ইভানের কেবিনের দিকে পা বাড়াল। কেবিনের সামনে এসে দরজা খুলে ঢুকেই দেখল ইভান ফোনে কথা বলছে। দরজা খোলার আওয়াজে সামনে তাকাতেই ঈশাকে দেখে ইভান অবাক হল। এই সময় ঈশার ক্লাস আছে। ফোনে কথা বলতে বলতেই হাতের কালো ঘড়িটা একবার দেখে নিলো। এখনো সময় আছে ক্লাস শুরু হতে। ঈশা টেবিলে কাপটা রাখল। সামনে পড়ে থাকা একটা ফাইল তুলে নিয়ে সেটাতে চোখ বুলাতে লাগলো। ইভান ফোন কানে ধরে ঈশাকেই দেখছে। ফোনে কতোটুকু মনোযোগ কে জানে। ঈশা ফাইলের মাঝে নিজের সব টুকু মনোযোগ দিয়েছে। ভ্রু কুচকে সেটাই দেখছে। কতক্ষন সময় কেটে গেছে সেটা খেয়াল নেই। এর মাঝেই কারও উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠলো। পিছনে ঘুরে তাকাতেই ইভানের কপালে কপাল ঠেকে গেলো। লজ্জায় কাতর হয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। একটু পেছাতেই ইভান কোমর ধরে টেবিলের উপরে বসিয়ে দিলো। দুই পাশে হাত রেখে নিজেও একটু ঝুকে গেলো। আবারো কপালে কপাল ঠেকাতেই ঈশা মাথা পিছিয়ে নিতেই ইভান তার মাথার পিছনে হাত দিয়ে আটকে দিলো। ঈশা কোন শব্দ উচ্চারণ করার আগেই ইভান তার ঠোঁটে ঠোট ডুবিয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঈশা তার হার্ট বিট মিস করলো। ভালবাসার প্রথম স্পর্শে ইভান পুরোপুরি হারিয়ে গেলেও ঈশা নিজের সংকোচের কারনে এই মুহূর্তটাকে অনুভব করতে পারছে না। শরীর জুড়ে এক শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার। দম আটকে আসছে লজ্জায়। হাত পা অসাড় হয়ে কাপন ধরেছে। ইভান ঠোট ছেড়ে কপালে কপাল ঠেকাল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। ঈশা চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ইভান যে তাকে ছেড়ে দিয়েছে সেটাও সে ঠিক অনুভব করতে পারছে না। ইভান ঈশার মাথার পিছন থেকে হাত সরিয়ে নিজে একটু সরে যেতেই ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আ…আমার ক্লাস আছে।

ইভান কোন কথা বলল না। পানির বোতলটা ঈশার দিকে এগিয়ে দিলো। ঈশা ইভানের হাত থেকে নিয়ে পানি খেতে লাগলো। যেন এরকম তিন চার বোতল পানি খেয়ে নিলেও তৃষ্ণা মিটবে না। অর্ধেক পানি শেষ করে বোতলটা পাশে রাখল। ইভান ঈশার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিতে দিতে শান্ত সরে বলল
–ক্লাস কখন শেষ হবে?

–১২ টায়।

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়েই বলল। ইভান ঈশার অসস্তি বুঝতে পেরে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলো। ঈশা ঠিক হয়ে দাঁড়ালো। ইভান কফির কাপটা হাতে নিয়ে সেটাতে চুমুক দিয়ে বলল
–ক্লাসে যা দেরি হয়ে যাবে।

ঈশা ফোনটা হাতে নিয়ে দরজা পর্যন্ত গেলো। দাড়িয়ে গেলো দরজা ধরে। ইভান কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে বলল
–সরি! আমি আসলে…।

ঈশা ঘুরে তাকাল। কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল
–এখনো কি বলা বাকি আমি শুধুই তোমার?

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here