#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি
পর্ব_৭
সন্ধ্যা বেলায় ক্লান্ত হয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ঘরের দিকে এলো স্পন্দন। ভেতরে গিয়ে দেখে চন্দ্র নেই কোথাও।ওয়াশরুম, বেলকনিতে না পেয়ে আবার নিচে এলো। মা’কে দেখে বললো,
__চন্দ্র কোথায় মা?
__ভাই বোনদের সাথে আছে হয়তো। সারাদিন তো ওদের সাথেই ছিলো।
__জ্বর কমেছে?
__সেটা দিয়ে তোমার কি স্পন্দন?মেয়টা কেমন আছে সারাদিন খোঁজ নিয়ে দেখেছো? প্রয়োজন মনে করো নাই নিশ্চয়ই?
__সে কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই।তাও আপনার কাছে।
স্পন্দন বড় বড় পা ফেলে উপরে যেতেই সৈয়দ মির্জা স্পন্দনের মা’কে বললেন,
__ আশরাফ ফোন করেছিলো।কাল ওরা আসবে।আর চন্দ্র স্পন্দনকে ও বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু তোমার ছেলে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমার মান সম্মানের কথা একটাবার তোমার ছেলে ভাবে না। এমন একটা ছেলের মা তুমি। তোমার ও লজ্জা হওয়া উচিত ছেলের এমন ব্যবহারের জন্য।
__চুপ কর মির্জা।সারা জীবন ধরে শুধু একজনের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাপাতে তোর অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে।
__আম্মা? আপনি জানেন না কিছু।তাই এভাবে বলছেন।
__আমি জানিনা করে করে যেটুকু জানি তাতে যথেষ্ট তোকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি তো মা। নিজের হাতে নিজের ছেলের বিচার করতে হবে বলেই আমি পিছিয়ে যাই সব সময়। না হলে তোর অপরাধের শাস্তি তোর প্রাপ্য মির্জা।
__আম্মা?
__গলা নামিয়ে কথা বল মির্জা। আমি এই সৈয়দ বাড়ির মান সম্মান রক্ষার জন্য এখনো মুখ বন্ধ করে রেখেছি। এমন কোনো কাজ করিস না যাতে আমি বাধ্য হই যেটা এতো বছর লুকিয়ে রেখেছি সেটা বলতে।
সৈয়দ মির্জা মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে গেলেন।স্পন্দনের মা এখনো দাঁড়িয়ে আছেন।উনার দিকে তাকিয়ে উনার শ্বাশুড়ি বললেন,
__বড় বৌমা তুমি এই সৈয়দ বাড়ির বড় বউ।এতো দিন ধরে পরে পরে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছো। এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে শেখো। ভুলে যেওনা তোমার শ্বাশুড়ি আম্মা এখনো বেঁচে আছে।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যখন এই বিয়ের আমি বুঝে শুনেই নিয়েছি।এই নিয়ে তোমার মনের মধ্যে যেনো কোনো প্রকার কিন্তু না থাকে বড় বৌমা।
__জ্বী আম্মা।
__যাও রাতের খাবার যেনো সবাই এক টেবিলে বসে খায় সেই ব্যবস্থা করো গিয়ে।
স্পন্দনের দাদিমা নিজের রুমে চলে গেলেন।স্পন্দনের মা ও নিজের কাজে চলে গেলেন।স্পন্দন ছাদে গিয়ে দেখে সবাই গোল হয়ে বসে গল্প আড্ডায় মেতে আছে। চন্দ্র উল্টো দিকে বসে আছে বলে খেয়াল করেনি যে স্পন্দন এসেছে পেছনে।স্পন্দন বলে উঠলো,
__এখানে বসে আছিস কেনো চন্দ্র?
চন্দ্র ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
__চোখে কি কম দেখেন? দেখছেন না সবার সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছি।
__ওহ্।তা তোর কোথায় থাকার কথা ছিলো চন্দ্র?
মিতু বলে উঠলো,
__ভাইয়া চন্দ্র আসতে চায়নি। আমি জোর করে এনেছি ওকে। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। দেখলাম জ্বর নেই তাই নিয়ে এসেছি।
__অনেক বড় হয়ে গেছিস মিতু? কিন্তু এই বিচ্চুর হয়ে সাফাই গাইতে গিয়ে যে মিথ্যা বলতে হয় সেটা ভুলে গেছিস। তুই এটা ভুলে গেছিস যে মিথ্যা কথাটা তুই স্পন্দনকে বলছিস।যাক ভালো।তা রেহান দিপ্ত রাতুল তোদের কোনো কাজ নেই?
__না মানে আপাতত নেই ভাইয়া।
__আচ্ছা তাই বুঝি বোন গুলোকে নিয়ে এখানে বসে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে।যা নিচে যা।দাদিমা ডেকেছেন তোদের।
ওরা তিনজন এক ছুটে নিচে নেমে গেলো। চন্দ্র অসহায় মুখে বোনদের দিকে তাকিয়ে আছে।তারাও এক পা দু’পা করে হাওয়া হয়ে গেছে। এবার শুধু স্পন্দন আর ও।স্পন্দন চন্দ্রকে বললো,
__তো মহারাণীকে কি আলাদা করে আমন্ত্রণ করতে হবে?নিচে যাওয়ার জন্য?
__দেখুন আপনি কিন্তু এটা ঠিক করলেন না।
__হ্যাঁ তো?কি করবি তুই?
__আমি মানে,,,
__হ্যাঁ তুই।বল কি করবি?
চন্দ্র উঠেই এক দৌড়ে ছাদ থেকে নামতে গিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে নিতে গেলে স্পন্দন গিয়ে ধরলো।বললো,
__নিজের পায়ে এখনো ঠিক মতো হাঁটতে শিখিস নি চন্দ্র। তুই আবার এই স্পন্দনকে ভয় দেখাতে যাস? সাহসের তারিফ করতে হবে রে চন্দ্র।
চন্দ্র চোখ খিঁচে বন্ধ করে আছে।ভয়ে ঠোঁট গুলো মৃদু কাঁপছে।স্পন্দন সেদিকে তাকিয়ে থমকে গেলো।ওর হার্টবিট মিস্ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।শরীর দিয়ে ঠান্ডা শীতল কিছু নেমে যাচ্ছে বলে মনে হলো। চন্দ্র চোখ পিটপিট করে তাকালো।স্পন্দনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নড়েচড়ে উঠলো।স্পন্দনের ঘোর কেটে গেলো। দ্রুত চন্দ্রকে ছেড়ে দিয়ে নিচে নেমে গেলো। চন্দ্র এখনো হাবার মতো সেদিকে তাকিয়ে আছে।কিছুই বুঝতে পারলো না ও।স্পন্দন নেশা করার জন্য বেলকনিতে গিয়ে একের পর এক খেতে লাগলো।না চন্দ্রের ঐ মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারছেনা। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। নিজের মস্তিষ্কের উপর প্রেসার দিয়েও হৃদির মুখটা মাথায় আনতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে বোতল গ্লাস সব ফেলে দিলো ফ্লোরে।ঝনঝন করে শব্দে সব টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।স্পন্দন মাথার চুল গুলো পেছনে টেনে ধরে অসহায়ের মতো আর্তনাদ করতে করতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। চন্দ্র দৌড়ে এলো ওর আর্তনাদ শুনে।স্পন্দনকে ধরতে গেলেই ধাক্কা দিলো চন্দ্রকে।বললো,
__স্পর্শ করবি না চন্দ্র। আমাকে তুই স্পর্শ করবি না।যা বেরিয়ে যা এই ঘর থেকে। আমার জীবন থেকে। আমি তোর মুখ ও দেখতে চাইনা।চলে যা তুই চন্দ্র। বেরিয়ে যা।
চন্দ্র ভয়ে সেঁধিয়ে গেছে।স্পন্দনের এমন রূপে আরো ভয় পেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।স্পন্দন তেড়ে এসে।দু হাত দিয়ে চন্দ্রের মুখটা আগলে ধরে এলোমেলো করে বললো,
__কাঁদবি না চন্দ্র।তোর চোখে কান্না মানায় না চন্দ্র। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হবে তোকে। এভাবে আমার মতো মানুষের সাথে থেকে তোর জীবনটা নরক বানাতে দেবো না আমি চন্দ্র। কিছুতেই না। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়িয়ে আমার মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ করতে শেখ চন্দ্র। এভাবে চোখের জলে নিজেকে হেরে যাওয়া অবলা নারী করে রাখিস না।তোকে শক্ত হতে হবে।আরো শক্তিশালী হয়ে স্পন্দনকে আঘাত করতে হবে। ক্ষতবিক্ষত করে দিতে হবে স্পন্দনের মধ্যের মানুষটাকে।
বলতে বলতেই চন্দ্রের কপালে কপাল ঠেকিয়ে দিয়ে স্পন্দন আরো কিছু বলতে লাগলো অস্ফুট স্বরে। চন্দ্র এতোটাই ভয় পেয়ে গেছে যে তা আর শোনা বা বোঝার বোধ নেই তখন।এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাড়ির সবাই ওদের ঘরে চলে এসেছে। এভাবে চেঁচামেচিতে সবাই থমকে আছে।কেউ সামনে এগিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছে না। একসময় স্পন্দন চন্দ্রের উপর সমস্ত ভর ছেড়ে দিলো। চন্দ্র ধরে রাখতে না পেরে সোফায় বসিয়ে দিয়ে রেহানকে ডাকলো।
__রেহান ভাইয়া উনাকে একটু ধরে বিছানায় শুইয়ে দেও না। আমি পারছিনা সামলাতে।
রেহান আর দিপ্ত এসে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো।স্পন্দনের বাবা আসেন নি।রুমেই আছেন।তখন আম্মার কথা শোনার পর থেকেই ভেতরে আছেন।বাইরে আসেনি।ওর মা কাঁদছে। এগিয়ে গিয়ে বললেন,
__এসব কিভাবে হলো চন্দ্র?একটু আগেও তো স্বাভাবিক ছিলো স্পন্দন।
__আমি জানি না বড় আম্মু।কি থেকে কি হয়ে গেলো আমি বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করো আমি কিছু জানি না।
__বড় বৌমা বাদ দেও এসব। একদিনের তৈরি ঘা নয় যে এক দুই দিন মলম পড়তেই সেরে যাবে।সময় দাও ওকে।সবার জন্য খাবার দেও।সবাই খেতে চলো। চন্দ্র দিভাই তুমি ও এসো। দাদুভাই ঘুমিয়ে গেছে।তাকে ডাকার প্রয়োজন নেই।
সবাই একে একে বেড়িয়ে গেলে চন্দ্র স্পন্দনের চোখ মুখ মুছে দিলো।জুতা খুলে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে বাইরে গেলো। খাওয়ার সময় চন্দ্র আর কিছুই বললো না। চুপচাপ বসে অল্প কিছু খেয়ে উঠে আসলো। চন্দ্রের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে হঠাৎ করেই কেনো এভাবে ক্ষেপে গেলো স্পন্দন। কারণ কি? মেহেদী লাগানোর কথা ছিলো রাতে।সেটা বেমালুম ভুলে চন্দ্র স্পন্দনের পাশে গিয়ে গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে পড়লো।সকালে ঘুম ভাঙার পর দেখে হাত ভর্তি মেহেদী দেওয়া। গায়ে আবার কাঁথা দেওয়া।উঠে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সামনের দিকে তাকিয়ে।কিছু একটা বির বির করছে। চন্দ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে শুনতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তার আগেই দরজায় নক পড়তেই স্পন্দন পেছনে তাকিয়ে চন্দ্রের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো।স্পন্দন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে চন্দ্র চোখ নামিয়ে দরজা খুলে দিল।দেখে বড় আম্মু দাঁড়িয়ে।হাতে কাপড় গয়না ও ফুল।
__এগুলো কার জন্য বড় আম্মু?
__আমার চন্দ্রের জন্য।যা ঝটপট গোসল করে রেডি হয়ে নিচে আয়। মেহমান একটু পরেই চলে আসবে।তার আগে কিছু খেয়ে নিতে হবে।না হলে সারাদিন আর সময় হবে না মা। আমি মিতু নিরা সিঁথি কে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
__আচ্ছা বড় আম্মু।
চন্দ্র ওয়াশরুমে যেতেই দাদিমা ডেকে পাঠালেন স্পন্দনকে।
#চলবে,,,,,,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট করবেন। ভালোবাসা সবাইকে।