অন্তর দহন পর্ব ৬

0
496

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব_৬

__আমার ছেলেটা এমন ছিলো না চন্দ্র।ও পরিস্থিতিতেই এমন হয়ে গেছে মা। জীবনে দুঃখ ছাড়া ছেলেটা কিছুই পায়নি।ওর ভেতরের মনুষ্যত্ব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে রে চন্দ্র। ভুল বুঝে ওকে ছেড়ে চলে যাস না তুই। আজকে তোর আমাকে স্বার্থপরের মতো মনে হচ্ছে কিন্তু এমন একদিন আসবে যেদিন তুই বলবি বড় আম্মু তুমি ঠিক বলেছিলে। তোমার ছেলের মতো কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবেনা।

__তুমি ভুল ভাবছো বড় আম্মু। আমার জীবনে এমন দিন কোনো দিন আসবে না। কারণ আমি তোমার ছেলের সাথে থাকতে পারবোনা কখনো।সে মানুষ নয়।সে কখনো ভালোবাসতে পারে না কাউকে।

__এভাবে বলিস না চন্দ্র। আমি ওর মা। আমার ছেলেটা ভেঙে গেছে ভেতরে ভেতরে। উপরে শক্ত আবরণ পড়ে আছে শুধু। বিশ্বাস কর চন্দ্র ওর বুকেও ভালোবাসা আছে।ও কাউকে ভালোবেসে আগলে রাখতে পারে। তুই ঐ শুষ্ক মরুর বুকে বৃষ্টি চন্দ্র। আমি আমার ছেলের হয়ে তোর দুটি পায়ে পড়ি চন্দ্র।এক মা’কে তুই চোখে জল নিয়ে ফিরিয়ে দিস না।

__বড় আম্মু? আমি তোমার মেয়ের মতো । তোমাকে বড় আম্মু বলে ডাকি। এভাবে আমার পায়ে পড়ে আমাকে অপরাধী করো না তুমি। তুমি যা চাইবে আমি তাই করবো।বলো তুমি কি চাও?

__আমি চাই মরতে মরতে বেঁচে থাকা স্পন্দনের বুকটা তুই পাথর থেকে ঝর্ণা ধারা করে দে।ওকে আগলে রেখে দে সারা জীবনের জন্য। কথা দে চন্দ্র আমার কথা তুই রাখবি?

__রাখবো বড় আম্মু। তোমাকে ফেরানোর সাধ্য আমার নেই।আগে বলো তোমার ছেলে এমন হলো কেনো?সবাই ওকে খারাপ ছেলের চোখে দেখে কেনো?

__সেটা আমি জানি না চন্দ্র।তবে বাপ ছেলের মধ্যে কিছু একটা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে গত দুই বছর ধরে।এই দুই বছর আগেও আমার ছেলে বাবা মায়ের বাধ্য সন্তান ছিলো চন্দ্র।কখনো রাত করে বাড়িতে আসতো না।কাজ পাগল ছেলে আমার। সারাদিন নিজের ব্যাবসা আর কাজ নিয়ে পড়ে থাকতো।একটু একটু করে তোর বড় আব্বুর সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। সাজানো গোছানো আমার ছেলেটা দিনদিনই কেমন এলোমেলো হতে থাকে।নেশায় ডুবে নিজেকে শেষ করতে থাকে।তোর বড় আব্বু এই নিয়ে সব সময় আমাকে কথা শোনাতে থাকে। কয়েক দিন আগে আম্মা ডেকেছিলো ও বাড়িতে তোর বড় আব্বু কে। সেদিন উনি বললেন,মির্জা তোর ছেলে স্পন্দনের বিয়ে দিতে হবে চন্দ্রের সাথে।কেনো কি এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবি না।তোর বড় আব্বুর এই বিয়েতে মত না থাকলে ও আম্মার কথা ফেলতে পারেনি।তোর বাবার ও মত ছিল না এই বিয়েতে।সেও আম্মার কথা রাখতেই রাজি হয়েছে। আম্মা সেদিন আমার হাতটা ধরে বলেছিলেন,বড় বৌমা তোমার ছেলের সাথে চন্দ্রের বিয়ে হলে তোমার চোখের জল আর কখনো পড়বে না। আমি তোমাকে কথা দিলাম আমার চন্দ্র দিভাই তাকে আগের মতো সাজানো গোছানো জীবন দিবে। তুমি এই নিয়ে কখনো মন খারাপ করবে না আর।

__দাদিমাকে আমি এতো ভালোবাসতাম আর সেই কিনা আমাকে এমন একটা জীবন দিলো নিজের হাতে।দাদিমা এটা কেনো করলো বড় আম্মু?

__আমি জানিনা মা।তবে আম্মা হয়তো কিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।উনি আমাদের সবার বড়।তার জ্ঞান বুদ্ধি অনেক বেশি। ভালো মন্দের হিসাব নিকাশ ও সেই ভালো জানেন।তাই হয়তো এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন।স্পন্দন দাদিকে কথা দিয়েছিলো তার বলা প্রতিটি কথা সে রাখবে।তাই ও এই বিয়ে অমত থাকলেও করেছে।

চন্দ্র কিছু ভাবতে লাগলো।এর মধ্যেই স্পন্দন হন্তদন্ত হয়ে এলো।ওর মা’কে বললো,

__চন্দ্রকে খেতে দিয়েছো মা?আর মেডিসিন?

__না দেওয়া হয়নি বাবা। এই তো দিবো।চল চন্দ্র।

চন্দ্র স্পন্দনের দিকে না তাকিয়েই বড় আম্মুর পেছনে পেছনে চলে গেলো।নিচে এসে দেখে সবাই বাড়ি ঘর পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। চন্দ্র সিঁথি কে বললো,

__এসব কি হচ্ছে রে সিঁথি?

__আরে চন্দ্র আপু সরি ভাবী। তোমাদের বিয়ের বৌভাত কাল।তার আয়োজন চলছে।

চন্দ্র সিঁথির মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

__আমি তোর আপু গাঁধী।ঐ গোমড়া মুখোর বউ বলে মোটেও ডাকবি না আমাকে।

__সিঁথি? এখানে দাঁড়িয়ে বকবক না করে কাজে যা।ওর এখনো নাস্তা খাওয়া হয়নি।

স্পন্দনের কথা শুনেই সিঁথি ভয়ে ভয়ে বললো,

__আচ্ছা ভাইয়া।আপু তুমি খেয়ে নাও যাও।

__আরে সিঁথি?

চন্দ্রকে আর কিছু বলতে না দিয়ে স্পন্দন ওকে ডাইনিংএ বসিয়ে দিয়ে ওর মা’কে ডেকে বললো,

__ওর জন্য খাবারে শুধু স্যুপ আর সিদ্ধ ডিম দিবা মা।আর এক গ্লাস দুধ।

দুধের কথা শুনে চন্দ্র নাক সিঁটকিয়ে বললো,

__বড় আম্মু?দুধ দিবা না। আমি খাবো না।

__দুধটা আগে শেষ করবি চন্দ্র।

অসহায় চোখে বড় আম্মুর দিকে তাকিয়ে চন্দ্র।উনি বললেন,

__জোর করে খাওয়াস না স্পন্দন।ও যখন খেতে চাইছে না তখন,,,,

__ওকে একদম মাথায় উঠাবে না মা।ও এই বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য এসেছে। আমি তুমি আমাদের কারো ব্যবহার বা কাজ ওকে কষ্ট না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখবে মা। আর ওর শরীর দূর্বল।পর্যাপ্ত খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নেওয়া দরকার।এদিকটাও খেয়াল রাখবে। খাওয়ার পর এই মেডিসিন গুলো দিয়ে দিও মা।আর ওদের সাথে মিশে যেনো লাফালাফি না করে সেদিকে খেয়াল রাখবা। আমার কাজ আছে।আসতে দেরি হয়ে যাবে।

__ও দুইদিনের জন্য এ বাড়িতে আসেনি স্পন্দন। সারাজীবনের জন্য এসেছে।

__আমি ওকে আমার মতো ছেলের সাথে সারাজীবন রেখে জীবন নিয়ে আফসোস করতে দিবো না মা।

__তুই আম্মাকে কথা দিয়েছিলি স্পন্দন।

__আমার কথা আমি রেখেছি।ওকে বিয়ে করেছি আর ওর ভালো থাকা না থাকা নিয়ে চিন্তাও করছি।এর বাইরে দাদিমা কে দেওয়া আমার আর কোনো কথা নেই মা।

__কিন্তু স্পন্দন?

__আমার যা বলার তা বলে দিয়েছি মা।এই নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নয়।

__দেখেছো বড় আম্মু?আর এই ছেলের জন্য তুমি আমাকে অনুরোধ করে চলেছো সাথে থেকে যাওয়ার জন্য।

স্পন্দনের মা কিছু না বলে চন্দ্রকে মেডিসিন দিয়ে চলে গেলেন। চন্দ্র হা করে সেদিকে তাকিয়ে বললো,

__যাহ্ বাবা ।এই বড় আম্মুর আবার কি হলো? আমার তো বহুত শান্তি লাগতাছে। আমাকে নিজের ইচ্ছায় এ বাড়ি থেকে বর করে দেবে। উফ্ এর থেকে শান্তির আর কি হতে পারে?

__দিভাই?

__জ্বী দাদিমা।

__কোথায় যাওয়ার কথা বলছো তুমি?এর মধ্যেই তোমাদের কি হানিমুনে যাওয়ার প্লান তৈরি হয়ে গেছে নাকি?তাও আমাকে ছেড়ে?

__আরে ওসব কিছু নয় দাদিমা। আমি বলছি তোমার বড় নাতি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার উপায় খুঁজে চলেছে। সেই আনন্দে আমি,,,,

__কি বললে তুমি?

__না মানে কিছু না দাদিমা।মিতু আপু ডাকছে আমাকে। আমি যাই।

দাদিমা সব বুঝেও কথা বাড়ালেন না। চন্দ্র ছেলে মানুষ।ওর সাথে এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো মনে করে ভেতরে চলে গেলেন।

__চন্দ্র আপু তুমি এখানে কেনো?

__কেনো?কোন সংবিধানে লেখা আছে চন্দ্র এ বাড়ির এখানে সেখানে ঘুরতে পারবে না?

__স্পন্দনের ব্যক্তিগত সংবিধানে চন্দ্র।

__মিতু আপু তুমি ও এদের দলে?আমাকে কেউ ভালোবাসে না আর।

__হ্যাঁ ভাই চন্দ্র স্পন্দনের বউকে ভালোবাসা দেই আর সেই বেডায় এসে আমাদের মতো মাসুম মাসুম বাচ্চাদের গর্দান নিয়ে নিক।আমরা বাপু এর মধ্যে নেই।

__এই তোরা আমার সাথে এমন করছিস কেনো? ঠিক করে বল তো ঐ গোমড়া মুখো তোদের কি বলে ভয় দেখিয়ে গিয়েছে?

__শোন চন্দ্র সামনের সপ্তাহে আমার বিয়ে।তাই এখন মরতে চাই না। তুই ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক চন্দ্র।এটাই আমার ভাইয়ের তার প্রাণপ্রিয় বউয়ের জন্য আদেশ।

__আমি কি ভাবছি বল তো মিতু?

__তুই আবার কি ভাবছিস রেহান ভাই?

__না মানে যদিও তোদের মতো ছোট ছোট পোলাপাইনের সামনে আমার এগুলো বলা উচিত নয়। তবুও পেটে চেপে রাখতে পারছিনা রে।

__ভনিতা না করে বলবা রেহান ভাই।

__আরে চন্দ্র বলছিলাম কি প্রথম দিন তো হেব্বি ঝার খেলাম ভাইয়ার কাছে। কিন্তু আজকে আবার আমাদের ই দায়িত্ব দিয়ে গেছে তোর খেয়াল রাখতে। ঘটনা কিরে চন্দ্র?

__মিতু আপু দেখো রেহান ভাই কি সব বলছে।

__দেখ রেহান ভাই ওরা হয়তো নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে।আর তুই মাঝখান থেকে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে ঢুকতে চাচ্ছিস ? লজ্জা করে না তোর ভাইয়া?অন্তুকে বলে দেই এসব?

__আরে আপু এই অন্তুটা আবার কে?

__কি রেহান ভাই বলবো?

__তোর পায়ে পড়ি বোন। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।এই সমাজে একবার ওর কথা তুলে সারা জীবনের জন্য আমার মুখ বন্ধ করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে ফেললি রে বইন।

সবাই হু হা করে হাসাহাসি করতে লাগলো।আর মিতু বেশ ঘটা করে অন্তু আর রেহানের প্রেমের গল্প সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে মজা নিতে লাগলো।

#চলবে,,,,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন। গল্প পড়ে লাইক কমেন্ট করে পাশে থাকবেন। সবাইকে ভালোবাসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here