#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৯
হসপিটালের করিডোরে থম থমে মুখে বসে আছেন নিয়াজ সাহেব। পাশেই স্ত্রী মুনিরা মুখে আচল চেপে কাঁদছে। তিনি একবার তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। অনেকটা সময় কেঁদেছেন তাই। তিনি পারছেন না তার স্ত্রীকে শান্তনা দিতে। কিই বা বলবে? অসহায়ের মতো শুধু বলল
–পানি খাবে?
মুনিরা তার দিকে অভিমানের দৃষ্টিতে তাকাল। তার কথার উত্তর না দিয়েই কঠিন গলায় বলে উঠলো
–তুমি পাষাণ। তোমার বোন তোমাকে ছেড়ে গিয়ে বেঁচে গেছে। তাই আজ অনেক সুখে আছে। তোমার কাছে থাকলে মরে যেত। তুমি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পার। ঠাণ্ডা মাথার খুনি।
বলেই উঠে গেলো। নিয়াজ সাহেব অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলেন স্ত্রীর যাওয়ার দিকে। মুনিরা যা বলে গেলো আসলেই কি তিনি সেরকম? এর উত্তর তার জানা নেই। কিন্তু এটা বুঝতে পারছেন যে তিনি অন্যায় করেছেন। চোখ ভরে এলো তার। মাথা নামিয়ে নিতেই ইভান সামনে এসে দাঁড়ালো। শান্ত সরে বলল
–মামা?
নিয়াজ সাহেব মাথা তুলে তাকালেন। চোখ দেখে ইভানের বুঝতে বাকি থাকলো না তিনি মেয়ের জন্য কতটা কষ্ট পাচ্ছেন। ইভান পাশে বসে বলল
–তোমার ডায়াবেটিক। কিছু না খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে।
ইভানের কথা শুনে তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ভিতরে তোলপাড় শুরু হলেও নিজেকে যথা সাধ্য শক্ত রেখে কাপা কাপা গলায় বললেন
–মিরা কেমন আছে?
ইভান একটু হেসে বলল
–ঠিক আছে। এখন ঘুমাচ্ছে। প্রেসার ফল করেছিলো। খাওয়া আর ঘুমের অনিয়ম সাথে স্ট্রেচ। উত্তেজিত হয়ে প্রেসার ফল করেছিলো তাই সেন্স লেস হয়ে গেছিলো।
নিয়াজ সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। সামনে দরজায় কাতর স্ত্রীর দিকে একবার তাকালেন। চোখের পানি অনবরত পড়ছেই। করুন ভাবে তাকিয়ে আছে আবদ্ধ ঘরে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। তখন বাবাকে কঠিন কথা বলার পরে বাবা মেয়ের মাঝে অনেক কঠিন বাক্য বিনিময় হয়। এক সময় উত্তেজিত হয়ে মিরা সেন্স হারিয়ে ফেলে। প্রেসার ফল করার কারনে শকড হয়ে যেতে পারে ভেবেই ইভান কোন রিস্ক নেয়নি। সরাসরি হসপিটালে ভর্তি করায়। অবস্থা এখন স্থিতিশীল হলেও প্রচুর রেস্ট দরকার। নাহলে খারাপ কিছু হতে পারে।
ঈশা খাবারের প্যাকেট নিয়ে সামনে দাঁড়ালো। শান্ত সরে বলল
–মামা এগুলা খেয়ে নিন।
নিয়াজ সাহেব চোখ তুলে তার দিকে তাকালেন। কিছুক্ষন ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন
–তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না। তুমি ইভানের কি হও?
ইভান হেসে ফেলল। কারন সে জানে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ঈশা অপ্রস্তুত। ঈশা ইভানের হাসি দেখে কঠিন চোখে তাকাল। দাড়িয়েই থাকলো। ইভান এবার বলল
–আশরাফ আঙ্কেল কে চিন?
–কোন আশরাফ? ইমতিয়াজের বন্ধু?
ইভান মাথা নাড়ল। নিয়াজ সাহেব আবারো জিজ্ঞেস করলেন
–আশরাফের কে হয়?
–মেয়ে।
নিয়াজ সাহেব এবার ঈশার হাত ধরে সামনের চেয়ারে বসালেন। ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে থাকলো। নিয়াজ সাহেব বেশ উতফুল্যতার সাথে বলল
–তুমি আশারফের মেয়ে? বাহ! কতো বছর আগে দেখেছি আশরাফ কে। আর আজ তার মেয়ে কতো বড়। জানো ইমতিয়াজ আশরাফ আর আমি এক সাথে আড্ডা দিতাম। খুব ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের।
শেষ করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন
–কতো বছর দেখা হয়না। আশারাফ কেমন আছে?
–আব্বু ভালো আছে।
–তুমি কি এখানেই পড়ো?
ঈশা মাথা নাড়ল। ঈশার এমন অবস্থা দেখে ইভান মজা পাচ্ছে। ঈশাকে আরেক্টু অপ্রস্তুত করে দিতেই ইভান দুষ্টুমির সুরে বলল
–জানো মামা ও ভবিষ্যতে বোনের বড় ছেলের বউ হবে।
নিয়াজ সাহেব ইভানের কথাটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালেন। ঈশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো। মনে মনে ইভান কে গালি দিতে শুরু করেছে। কোন জায়গাতেই তাকে এরকম পর্যায়ে ফেলতে পিছপা হয়না। নিয়াজ সাহেব এবার হেসে উঠলেন। ঈশার মাথায় হাত দিলেন। তার দিকে তাকিয়ে বললেন
–বাহ! খুব মানাবে তোমাদের। খুব ভালো।
ইভান হেসে ঈশার দিকে তাকাল। এমন সময় ইভানের মা আফসানা আর তার বাবা ইমতিয়াজ রহমান চলে এসেছেন। তাদেরকে দেখে ইভান আর ঈশা উঠে দাঁড়ালো। নিয়াজ সাহেব মাথা নিচু করে বসে আছে। মাথা তুলে একবার বোনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মনের কোথাও একটা বাধা কাজ করছে। নিজের আত্মসম্মান টা বেশ করেই বাধা দিচ্ছে তাকে। কিন্তু তার পরেও ভালবাসার কাছে তো আর কিছুই বড় হয়ে দাড়ায় না। আফসানা ভাইয়ের সাথে কথা না বলেই ভাবির কাছে চলে গেলেন। দরজায় দাড়িয়ে দেখলেন একবার মিরাকে। তারপর ভাবির ঘাড়ে হাত দিতেই তিনি চমকে ফিরে তাকালেন। আফসানা কে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এতদিন পর ভাবিকে এভাবে দেখে সেও নিজেকে সামলাতে পারলো না। দুজন দুজন কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। ঈশা এসে দুজন কেই থামিয়ে দিয়ে বললেন
–তোমরা আর কেদনা। প্লিজ! মিরা ঠিক আছে। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
মুনিরা ঈশার দিকে তাকাল। ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–তোমাকে কাল থেকেই দেখছি। কিন্তু ঠিক চিনতে পারলাম না।
আফসানা হেসে বলল
–ইভানের আব্বুর বন্ধুর মেয়ে। আমার বড় ছেলের হবু বউ।
মুনিরা ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বললেন
–বেশ ভালো মেয়ে। দেখতেও বেশ মিষ্টি।
ঈশা কোন কথা বলল না। নিয়াজ সাহেব বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় বসে আছে। মাথা তুলেও দেখছেন না। ঈশা ভিতরে একবার তাকিয়ে দেখল ইফতি নিস্পলক বসে আছে মিরার পাশে। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–মামনি ইফতি কিছুই খায়নি। ওকে কিছু খাওয়াতে চেষ্টা করি।
বলেই খাবার নিয়ে ভিতরে গেলো। ইফতির ঘাড়ে হাত রাখতেই সে চমকে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা বুঝতে পারছে ইফতির অসহায়ত্ব। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়েই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই বলল
–এরকম দেবদাসের মতো বসে আছিস কেন? তুই না ডক্টর? তুই তো জানিস কোন প্রবলেম নেই।
ইফতি বিরক্ত নিয়ে তাকাল। কঠিন মুখে বলল
–ডক্টর বলে কি আমার মন নেই? আমি কি মানুষ না? আমার ভালবাসার মানুষটা কতো অসুস্থ আর আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে?
ঈশা হেসে ফেলল। ইফতি ভ্রু কুচকে তাকাল। একটু জোরেই বলল
–তোর কি বাংলা ছবির ডায়ালগ মনে হল আমার মনের কথা গুলো? তুই এতো নিষ্ঠুর কেন রে?
ঈশা ভ্রু কুচকে খাবার তুলে ইফতির মুখে চেপে ধরে বলল
–এখন আজে বাজে কথা না বলে খেয়ে নে। তুই না খেয়ে থাকলে মিরা ঠিক হয়ে যাবে না।
ইফতি খাবার মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল
–আচ্ছা ঈশা তোর কি মনে হয় মিরা ঠিক হলে মামা আমাদের বিয়ে দেবে?
–অবশ্যই দিবে। কেন দিবে না?
দুজনি পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান পাশে এসে বসলো। ঈশা একটু সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–তুমি কিভাবে এতো সিওর হচ্ছ?
ইভান হেসে বলল
–আব্বু আম্মু মামা মামি কথা বলছে। সব কিছু ঠিক থাকলে মিরা সুস্থ হলেই তাদের আংটি পরিয়ে রাখবে। আর বিয়ে পরে হবে।
কথাটা শুনেই ঈশা চিৎকার করে উঠতে জেয়েও মিরাকে দেখে থেমে গেলো। সে ঘুমাচ্ছে। ইভান ঈশা আর ইফতি কে বলল
–তোরা এখন এখান থেকে বের হয়ে যা। ওকে ঘুমাতে দে।
ইভানের কথা শুনে সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
————–
মিরাকে একবার চেকাপ করার জন্য ইভান তার রুমের দিকে পা বাড়াতেই মেঘলার ডাকে থেমে গেলো। মেঘলা এগিয়ে এসে বলল
–ইভান তুমি কি মিরাকে চেকাপ করতে যাচ্ছ?
–হ্যা।
মেঘলা একটু হেসে বলল
–আমি মাত্রই চেক করে এসেছি। সব একদম ঠিক আছে। ঘুমের ইঞ্জেকশন আবার দেয়া হয়েছে। ফুল রেস্ট দরকার। এবার ঘুম ভাংলেই আশা করা যায় ঠিক হয়ে যাবে।
ইভান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল
–থ্যাঙ্ক ইউ মেঘলা।
মেঘলা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমাকে খুব টায়ার্ড লাগছে ইভান। মনে হয়না কিছু খেয়েছ? কামান ইভান! এভাবে তুমিও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এতো উত্তেজিত হলে কিভাবে হবে বল? নিজের খেয়াল রাখতে হবে তো। নিজে না পারলে আমি তো আছি।
–তুমি একটু বেশিই কেয়ার করছ না মেঘলা আপু?
ঈশা কথাটা বলতে বলতে ইভানের পাশে এসে দাঁড়ালো। মেঘলা সরু চোখে তাকাল। মুচকি হেসে বলল
–বন্ধু বন্ধুর জন্য কেয়ার করবে সেটাই কি ঠিক না ঈশা? আর আমি এমন কোন বাড়াবাড়ি কিছুই করিনি যেটা দেখতে দৃষ্টি কটু দেখায়।
–বন্ধু শব্দটার একটা লিমিট থাকে। তুমি সেটা ক্রস করে যাচ্ছ। তুমি ইভান কে নিয়ে যতটা সচেতন সেটা কিন্তু আমার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার দায়িত্বটা তুমি নিতে চাইছ মেঘলা আপু।
ঈশার কথা শুনে মেঘলা এবার একটু ঝাঝাল গলায় বলল
–তুমি ঠিক কি বলতে চাইছ? আমার সাথে ইভানের একটা সম্পর্ক আছে। তোমার দায়িত্ব তুমি ঠিক মতো পালন করতে পারছ না বলেই আমি সেটার দায়িত্ব নিতে চাইছি।
বলেই একটা তাছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
–দায়িত্ব নিতে গেলে একটা সম্পর্ক থাকতে হয়। সেটা তোমার নেই। তাই তোমার মধ্যে একটু হলেও সংকোচ কাজ করে। সেই জন্যই হয়তো ইভানের খেয়াল রাখতে পারনা। তোমার মনের মাঝে কোথাও বাধা কাজ করে।
ঈশা এবার রেগে গেলো। ইভানের দিকে একবার তাকাল। ইভান খুব শান্ত ভাবে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ঠিক কি উত্তর দিবে সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছে। মেঘলা আবারো ঈশার হাত ধরে সামনে ধরে বলল
–তোমার আংটিটাও তো নেই ঈশা। তাহলে কিসের সম্পর্কের ভিত্তিতে তুমি এতো জোর দেখাও।
ইভান কথাটা শুনে চুপ করে থাকতে পারলো না। কিছু একটা বলতে যেতেই ঈশা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
–তুমি এতো ছোট বিষয় নিয়ে ভাবো মেঘলা আপু? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
মেঘলা ইভান দুজনি ঈশার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশার কথার মাঝে এমন কিছু তো একটা আছে যেটা এই মুহূর্তে শুধু ঈশাই বুঝতে পারছে। কিন্তু কি? ঈশা নিজের ব্যাগ হাতড়িয়ে একটা কাগজ বের করলো। সেটা মেঘলার হাতে দিয়ে বলল
–আমার মনে হয়না এর পরে আংটি নিয়ে আর কোন মাথা ব্যাথা থাকবে তোমার।
ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা কি বুঝতে চেষ্টা করছে। মেঘলা হাজার বিস্ময় নিয়ে কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছে। অস্পষ্ট সরে বলল
–এটা কিভাবে সম্ভব?
চলবে………