সূর্যশিশির
১২.
চলন্ত গাড়ি সহসা থেমে যাওয়াতে বাইকটিও থেমে গেল। অরুনিকা নিঃশ্বাস আটকে থম মেরে বসে রইলো। গাড়ি থেকে বের হওয়ার দুঃসাহস তার নেই। তার চোখের পলক পড়ছে দ্রুত, ঠোঁটে লজ্জামিশ্রিত হাসি।
ড্রাইভার অশোক কর্মকার ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘কোনো দরকার ছিল মামনি?’
অরুনিকা দ্রুত নিজের মুখের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তন করে বললো, ‘না, না কাকা।’
অশোক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। দরকার না থাকলে গাড়ি থামাতে বললো কেন?
অরুনিকা বিব্রতবোধ করে। সে দ্রুত মাথায় হাত রেখে অসুস্থতার ভান করে বললো, ‘হুট করে মাথাটা কেমন করছিল। ‘
অশোক পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাড়ি ফিরতে আর একটু পথ বাকি। এখানে থাকার চেয়ে, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেয়াটা ভালো হবে।’
অরুনিকা পানির বোতল নিয়ে এক ঢোক পানি খেল।
অশোক যদি কোনোভাবে পিছনে থাকা বাইকওয়ালার উপস্থিতি আঁচ করতে পারেন সোজা অরুনিকার বাবাকে গিয়ে বলবেন। অরুনিকা এই ঝুঁকি নেয়ার সাহস পাচ্ছে না৷ আরো কিছুক্ষণ এখানে থাকলে মানুষটি অশোকের নজরে চলে আসবে। তার থেকে চলে যাওয়া উত্তম। সে বাধ্য হয়ে বললো, ‘জি কাকা। বাসায় চলুন।’
অশোক গাড়ি স্টার্ট দিতেই অরুনিকা পিছনে ফিরে তাকায়। সে আছে!
গাড়ি চলতে শুরু করলে বাইকটিও চলতে শুরু করে। অরুনিকার অন্তঃকরণে বসন্তের কোকিল ডেকে ওঠে। শুধু তার নয়, মানুষটিরও তাকে ভালো লেগেছে! নয়তো কি তার পিছু নিত?
কিন্তু মাঝের এতগুলো দিন কোথায় ছিল? প্রশ্নটি মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই অরুনিকার কপালে ভাঁজ পড়ে। যদি ভালোই লেগে থাকে, এতদিন কেন এলো না? ভাবতে ভাবতে সে উদাস হয়ে গেল।
গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামলো। অরুনিকা গাড়ি থেকে নেমে পিছনে ফিরে দেখে, চারপাশে সুনসান নীরবতা। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই, মানুষ নেই। তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। আবার হারিয়ে গেল না তো!
সে আকুল হয়ে দুই কদম এগিয়ে গেল। দেখা পেল কাঙ্খিত বাইকটির। রাস্তার পাশের এক সরু গলিতে বাইকটি রাখা।
অরুনিকার ঠোঁটে আবারও হাসি ফুটে ওঠে। তার বারান্দা থেকে গলিটি স্পষ্ট দেখা যায়। সে দ্রুত ছুটে গেল রুমে। ব্যাগ বিছানায় রেখে তড়িঘড়ি করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আযান। দিনরাত্রির মিলন মুহূর্তে অরুনিকা ও তার মনের মানুষটির দ্বিতীয়বারের মতো চোখাচোখি হয়।
মানুষটি এক হাত নাড়িয়ে অরুনিকাকে কিছু একটা বলতেই অরুনিকা লজ্জা পেয়ে রুমে চলে এলো। মানুষটি, মানুষটি বলতে আর ভালো লাগছে না৷ এবার নাম জানা প্রয়োজন। অরুনিকার ভীষণ মন চাইছে গিয়ে বলতে, ‘এইযে মনচোরা যুবক, আপনার নাম কী?’
অরুনিকা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে রূপাকে কল করতে উদ্যত হতেই আজিজুরের কণ্ঠ ভেসে এলো। তিনি অরুনিকাকে ডাকছেন।
অরুনিকা অবাক হয়। এই অসময়ে পাপা বাসায়!
সে ফোন রেখে আজিজুরের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
আজিজুর নিজ রুমের ইজিচেয়ারে বসে আছেন। তার ক্ষুদ্ধ চেহারা। অরুনিকা আসার সময় ড্রয়িং রুমে তার মা সেলিনাকে মুখভার করে বসে থাকতে দেখেছে। কী হলো? পরিবেশ এতো থমথমে কেন?
অরুনিকা আজিজুরের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘পাপা ডাকছিলে?’
আজিজুরের দৃষ্টি বাইরে নিবদ্ধ। তিনি মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বললেন, ‘তোমার ফোন নিয়ে আসো।’
অরুনিকা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে চুপচাপ ফোন আনতে গেল। ড্রয়িং রুম পেরোনোর সময় সেলিনাকে চাপা সুরে প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে মা? পাপা রেগে আছে কেন?’
সেলিনা টু শব্দটিও করলেন না। দেরি হচ্ছে তাই অরুনিকা আর কথা বাড়ালো না। সে ফোন নিয়ে আজিজুরের রুমে এলো। ব্যথিত কণ্ঠে বললো, ‘আমি কি কোনো ভুল করেছি পাপা?’
আজিজুর অরুনিকার হাত থেকে ফোনটি নিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়৷ আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল অরুনিকা। সেলিনা শব্দ শুনে ছুটে আসেন। আজিজুরের উপর চেঁচিয়ে উঠেন, ‘বাড়ি এলে তোমার এটা-ওটা ভাঙতেই হয়?’
অরুনিকার ‘আমার ফোন’ বলে অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে। আজিজুর সেলিনাকে অগ্রাহ্য করে অরুনিকার দিকে তাকালেন। চোখে রাগ অথচ শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘রুমে যাও। পড়াশোনায় মন দাও।’
অরুনিকার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে সে। কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন বললো, ‘কেন এমন করলে? আমি কী করেছি? এভাবে আঘাত কেন দিলে পাপা?’
আজিজুর তিরস্কার করে বললেন, ‘সামান্য ফোন ভাঙাতে এতোটা আঘাত লেগে গেল! আর তুমি যে আমার সম্মান নিয়ে নোংরা আবাসিক হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকো তখন আমার সম্মানে আঘাত লাগে না? মনের আঘাত বড় নাকি সম্মানের?’
অরুনিকা এই কথায় চমকে গেল, থেমে গেল কান্না। আজই শপথ নিলো আর যাবে না আর আজই কি না পাপা সব জেনে গেল! সে আড়চোখে সেলিনাকে দেখলো। সেলিনার চাহনি যেন বলছে, এবার আমার আর কিছু করার নেই।
আজিজুর বললেন, ‘ওই মেয়ের সাথে মেশার পর থেকেই তোমার অধঃপতন শুরু হয়েছে। বহুবার নিষেধ করার পরও মিশেছো। এখন এমন অবস্থাতে এসেছো যে মুখে বলার মতো না। আমার মেয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখন মানুষ সন্দেহ করে! এই দিনও আমাকে দেখতে হলো!’
লজ্জায় অরুনিকার পা দুটি শক্তি হারাচ্ছে। কে তার চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করলো যে আজিজুর এতোটা রেগে আছেন! মাথাটা কেমন ভার লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্যাপারটা সত্যিই খুব ঘোলাটে হয়ে গেল। প্রথমেই রূপার বারণ শোনা উচিত ছিল।
আজিজুর আচমকা সেলিনাকে ধমকে বললেন, ‘মেয়েকে বলো সামনে থেকে যেতে।’
অরুনিকা ভয়ে কেঁপে ওঠে। সে রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। সেলিনা কোনো এক গোপন অভিমান থেকে বললেন, ‘চাইলেই আদর করে বুঝাতে পারতে। একটাকে তো রাগের জন্যই হারিয়েছো।’
আজিজুর সেলিনার কথাকে এবারও উপেক্ষা করলেন। বললেন, ‘কাল সকালে নতুন দারোয়ান আসবে। কোচিং-এ যখন যাবে সাথে তুমিও যাবে। আমি যেন আর না শুনি, তোমার মেয়ে আবার ওই মেয়ের সাথে দেখা করেছে বা ওই মেয়ে এখানে এসেছে।’
সেলিনা কিছু বললেন না। চুপচাপ শুধু শুনে গেলেন।
_
বারেক মিয়া ঘুম থেকে উঠতেই সুমনা এসে তার পায়ের কাছে বসলেন। ভারী শান্ত দেখাচ্ছে তাকে। মাথায় তেল দিয়ে সুন্দর করে বেণী করেছে। বারেক প্রশ্ন করলেন, ‘কিছু বলবা নাকি?’
সুমনা দরজার বাইরে ছেলেমেয়েদের উপস্থিতি দেখলেন। তারপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তোমার মেয়ের জন্য প্রস্তাব আসছে। ভালো ঘর, ভালো ছেলে।’
‘ রূপার জন্য?’
সুমনা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললেন, ‘আরে না। রুমিরে পছন্দ করছে।’
বারেক অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ‘তোমার কথাতে তো মনে হচ্ছে, তুমি রাজি। কিন্তু রুমির বয়স কত খেয়াল আছে? মাত্র পনেরো। এসএসসি পাস করেনি এখনো।’
‘তুমি আছো তোমার বয়স নিয়ে। কয়দিন পরই তো ষোল হয়ে যাবে। আর ভালো ছেলে কি সবসময় পাওয়া যায়?’
সুমনার অতি আগ্রহ দেখে বারেক বেশ অবাক হলেন। রুমি-রিনিকে সুমনা চোখে হারায়। এতো দ্রুত বিয়ে দিতে চাচ্ছে! কোন পাত্র সুমনার মন জয় করে নিলো! বারেক প্রশ্ন করলেন, ‘পাত্র কে?’
সুমনা হাসলেন। আরেকটু কাছে এসে ঠোঁট টিপে বললেন, ‘তোমারও অনেক পছন্দের ছেলে। ওইযে সৈয়দ বাড়িতে থাকে, ফাইয়াজ। সোনার টুকরো ছেলে একটা। রুমির বর হবে কয়দিন পর। কী ভদ্র, কী নম্র! ভালো চাকরি করে। বেতনও অনেক । আমাদের মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে।’
বারেক ফাইয়াজের নাম শুনে আরো অবাক হলেন। যে কেউ নির্দ্বিধায় বলবে, ফাইয়াজ লাখে একটা ছেলে। আচার-আচরণ, চলাফেরা ইতিমধ্যে এলাকাবাসীর মন কেড়েছে। তার ব্যক্তিত্ব, গম্ভীরতা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, গুছানো কথাবার্তা যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। এ গলি, ও গলির কিছু মেয়ে ফাইয়াজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছুদিন আগে এক মেয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। ফাইয়াজ বিয়েতে রাজি না হওয়ায় মেয়েটি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এসব কথা এলাকার মানুষের মুখে মুখে শোনা। বাড়ির পাশে থেকেও সত্য নাকি বারেক জানে না।
তিনি বললেন, ‘ফাইয়াজ কি নিজে প্রস্তাব দিল?’
সুমনা একটু নিভলেন। বললেন, ‘না।’
থেমে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘বড় বোন প্রস্তাব নিয়ে আসছে। ফাইয়াজের অভিভাবক তো ওর বড় বোনই। বোন যা বলে তাই করে। ওসব তুমি ভেবো না।’
‘ফাইয়াজের মতো ছেলে নিজের অর্ধেক বয়সী মেয়েকে বিয়ে করবে বলে আমার মন বলে না৷ ভালো করে জেনে নাও। এরপর কথাবার্তা আগাও। এমন ছেলে জামাই হিসেবে পেতে আপত্তি কোনো বাবাই করবে না। কিন্তু মেয়েটাকে আরেকটু বড় হতে দেয়া উচিত। তোমার মেয়ে রাজি হবে নাকি সেটাও দেখো। এরপর আমি যা বলার বলবো। আর বড় মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে মেজোটাকে দেয়া কি ঠিক হবে?’
রূপার কথা আসায় সুমনা রেগে গেলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তেজ নিয়ে বললেন, ‘এই ছেলেরে আমার পছন্দ হইছে দরকার পড়লে রিনির সাথে বিয়ে দেব। তাও আমার ঘরের জামাই বানাবো। আর তোমার বড় মেয়েরে কে বিয়ে করবে? ও সংসার সামলাতে পারবে? হোটেল সামলানো আর সংসার সামলানো কি এক জিনিস? হোটেলের কাজই ওর জন্য ঠিক আছে। ওইটাই করতে দাও।’
বারেক বিড়বিড় করেন, ‘এতোই যখন পছন্দ হইছে নিজে বিয়ে করে নাও না।’
সুমনার ভ্রু দুটি বেঁকে গেল। বললো, ‘কী বললা?’
বারেক চট করে গামছাটা গলায় ঝুলিয়ে ‘কিছু না’ বলে বেরিয়ে গেলেন। সুমনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী যেন বললো!
_
কিছুদিন হলো অনলাইনে অর্ডার নেয়া শুরু করেছে রূপা। হোটেলে ডেকোরেশনের কাজ চলছে বিধায় রান্নাবান্না বন্ধ। কিন্তু তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্ডার ছিল। এক কাস্টমারের জন্মদিন আজ। সে দশ জনের কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার করেছে।
তাই সন্ধ্যা হতেই রূপা রান্না শুরু করে। রাত নয়টায় পৌঁছে দিতে হবে। সে দ্রুত কাজ করছে। ফাঁকে ফাঁকে অরুনিকাকে মেসেজ করে। একবারও রিপ্লাই পেল না। রিপ্লাই না পেয়ে কিছুটা অবাক হলেও তেমন পাত্তা দিলো না। এমন সময় সাধারণত অরুনিকা পড়াশোনা করে। রূপা ভাবলো, রাতে ফ্রি হয়ে কল করবো। ততক্ষণে অরুনিকাও কল করতে পারে।
সে নিজের কাজে মনোনিবেশ করে।
কিছুক্ষণ পর ফাইয়াজের কণ্ঠ শুনতে পেল। সে আগ্রহবশত চামচ হাতে নিয়ে হেঁশেল থেকে উঁকি দিয়ে দেখে ফাইয়াজ হোটেলের চারপাশ দেখতে দেখতে সুজনকে কিছু বলছে। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকানো। সবেমাত্র কর্মস্থল থেকে ফিরেছে। ইদানীং দেরি করে ফিরে। কে জানে কেন! রূপা সরে যাওয়ার পূর্বেই ফাইয়াজ দেখে ফেললো। এখন ডেকে জ্ঞান দিবে!
ফাইয়াজ সঙ্গে সঙ্গে ডাক দিলো , ‘এই মেয়ে শুনো।’
রূপা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো, ‘জি স্যার।’
ফাইয়াজ এগিয়ে এলো, ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে। তার বক্তব্য শুরু হওয়ার আগে রূপা দ্রুত বললো, ‘স্যার আপনার যা বলার পরে শুনবো। এখন যাই? রান্না পুড়ে যাবে।’
‘কীসের পরে কথা? তুমি নাকি পড়াশোনা আর করবে না? পড়াশোনা কি ছাড়ার জিনিস? জীবনের মানে জানো? তুমি যদি নিজের…’
‘প্লিজ স্যার পরে শুনবো।’
ফাইয়াজকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেল রূপা। ফাইয়াজ থতমত খেয়ে যায়। সে রূপাকে দিতে চাওয়া উপদেশগুলো আপাততের জন্য হজম করে আবার ক্যাশ কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো।
হোটেল নতুন করে ডেকোরেশন করায় একদম নতুন লাগছে। সে সুজনকে প্রশ্ন করলো, ‘দোকান তো মনে হচ্ছে বন্ধ। রান্না হচ্ছে কেন?’
সুজন কান চুলকাতে চুলকাতে বললো, ‘কাচ্চি বিরিয়ানি রান্ধে। নেটে অর্ডার নিছে।’
ফাইয়াজ হাতঘড়ি দেখে পকেট থেকে পাঁচশ টাকার নোট বের করে বললো, , ‘রান্না হলে আমার বাসায় এক বক্স পাঠাতে বলবি।’
‘অর্ডারের হিসাবমতো রান্ধে স্যার। আরো দুইজনের তো হইবো না।’
রূপা স্যার ডাকায় সুজনও তাকে স্যার ডাকে। ফাইয়াজ টাকাটা সুজনের সামনে রেখে বললো, ‘আমিও অর্ডার করলাম। রাত দুটো বাজলেও সমস্যা নেই।’
কথা শেষ করেই ফাইয়াজ বাইক নিয়ে চলে যায়।
সুজন রূপাকে টাকা দিয়ে ফাইয়াজের অর্ডারের কথা বলে। রূপা টাকাটা নিয়ে ভাবনায় ডুবে গেল। প্রতিদিন ফাইয়াজ কিছু না কিছু তাদের দোকান থেকে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে যে রান্নাগুলো সে করে। হয়তো অন্যান্য রেস্টুরেন্ট থেকে স্বাস্থ্যকর বলেই! তাই বলে মাসে মাসে বাইরের খাবারের পিছনে এতো টাকা ব্যয় করবে!
_
সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশে বারেক দোকানে এলেন। তখন রূপা বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।
বাজারের প্রতিটি হোটেলে খবর চলছে। আজ মাসের উনত্রিশ তারিখ মানে আরেকটি খু’ন হবে। পূর্বের তিনটি খু’ন মাসের উনত্রিশ তারিখই হয়েছে। খু’নের সাথে এই তারিখের কি সম্পর্ক কেউ জানে না। শুধু সবাই এইটুকু আন্দাজ করতে পেরেছে, অজ্ঞাত খু’নি উনত্রিশ তারিখই খুন করে। খুনি রীতিমতো দেশের মানুষ ও দেশের আইনের সাথে চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তে আছে। সে একটি নির্দিষ্ট তারিখে খু’ন করে তবুও কেউ তাকে ধরতে পারে না। তৃতীয় খু’নের সময় চারিদিকে টহল দিয়েও খু’নিকে ধরা সম্ভব হয়নি। খু’ন হওয়ার মিনিট কয়েক পর পুলিশ টের পায় কেউ খু’ন হয়েছে। ততক্ষণে খু’নি গা ঢাকা দিয়েছে।
বারেক রূপাকে বাঁধা দিয়ে বললেন, ‘আজ ঊনত্রিশ তারিখ, বের হোস না। দেশের অবস্থা তো জানিস।’
রূপা সাইকেলের তালা খুলতে খুলতে বললো, ‘
রাত এগারোটার আগে খু’নি বের হবে না আব্বা। আপনি এতো চিন্তা করবেন না। এখন সাতটা পঁয়ত্রিশ বাজে। আমি আটটা ত্রিশের মধ্যে চলে যাবো। আবার ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরে আসবো। সব মিলিয়ে বেশি হলে দশটা বাজবে।’
‘আমি যাচ্ছি। তোর যেতে হবে না। আমাকে ঠিকানা দে।’
রূপা বারেক মিয়ার দিকে তাকালো। অনলাইনে যে অর্ডারগুলো আসে তার টাকা বারেক নেন না। তিনি রূপাকে বলেছেন, এই টাকা যেন সে রাখে। রূপাও এটা চেয়েছিল। সে অর্থ সঞ্চয় করতে চায়। নিজের জন্য কিছু করতে চায়। আজকের অর্ডারটির জন্য ভালো অংকের টাকা পাবে। এই টাকা তার স্বপ্ন পূরণের অংশ। সে কিছুতেই অর্ডার ক্যান্সেল করবে না। আবার পায়ে ঘা হওয়া বারেক মিয়াকেও এত দূরে সাইকেল নিয়ে যেতে দিতে পারে না৷
রূপা বললো, ‘পায়ের সমস্যা নিয়ে সাইকেল কীভাবে চালাবেন? বাসও তো চলে না। রিক্সা-সিএনজি দিয়ে গেলে আর লাভই থাকবে না।’
‘না থাকলো লাভ।’
‘লাভের জন্যই তো এতো কষ্ট! জেদ করবেন না আব্বা। আমাকে যেতে দিন। আমি যাবো আর আসবো। আর সড়ক দিয়েই তো যাবো। নিরিবিলি জায়গা দিয়ে তো যাচ্ছি না।’
বারেক কিছুতেই অনুমতি দেয়ার সাহস পাচ্ছেন না। তিনি বললেন, ‘সুজনকে নিয়ে যা তাহলে।’
‘এতজনের খাবার আবার সুজন! এটা সাইকেল আব্বা, ঠেলাগাড়ি না।’
রূপা সাইকেল নিয়ে বের হয়। বারেক পেছন থেকে বললেন, ‘অর্ডারে কত টাকা আসে বল আমি তোকে দিচ্ছি।’
‘শুধু তো টাকাটাই সব না। যদি না যাই একটা মেয়ের জন্মদিনের আনন্দ নষ্ট হবে। আপনি চিন্তামুক্ত থাকেন। আমি যাব আর আসব।’
রূপা বারেকের কথা শুনলো না। দীর্ঘ পথের যাত্রার জন্য বেরিয়ে গেলো। বারেক বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ শুনতে পান। মেয়েটার বিপদ না হয়!
চলবে…