#এক_সায়াহ্নে_প্রেমছন্দ
লেখিকাঃ #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৮
“তিতিরপাখি,
কৃষ্ণচূড়ার রঙে তোমাকে রাঙানোর আকূল ইচ্ছে হয়তো আমার কোনোদিন পূর্ণ হবেনা। তোমার প্রিয় রঙেই তুমি আজ রেঙে গেলে কিন্তু বিমর্ষ হয়ে গেল সেই শুভ্রতা! আমার যে তোমাকে বিমর্ষ ভালো লাগে না! আমার অবাধ্য ভালোবাসা দিনে দিনে বাড়ছে পক্ষান্তরে আমি আমার কর্তব্য থেকে পিছু হটতেও অপরাগ। আজ এই আগুন্তকের শেষ চিঠিই নাহয় ধরে নাও! হয়তো মেজর রাহানের মতো আমিও তোমাকে রিক্ত করে যাব। আমার রিক্ততা তোমাকে কোনো রঙে রাঙাবে না কারণ সবটাই একপাক্ষিক। কিন্তু রাহান স্যারের রিক্ততা তোমার প্রিয় রঙকেও তোমার কাছে অভিশা*পের তূল্য। চেয়েছিলাম সেই অভিশা*প ঘুঁচিয়ে শুভ্র প্রেমময় রঙের সাথে কৃষ্ণচূড়ার রঙের মিশ্রণ করাব।
যদি তুমি বিরক্ত হও ক্ষমাপার্থী। তোমাকে একটা দুঃসংবাদ দিতেই চিঠিটা। আশাকরি বুঝতে পেরেছ। এই দেখো, এইসবের মধ্যেও নিজের আবেগ সংবরণে ব্যার্থ আমি। আবেগ নাহয় সব চিঠির পাতায় থাক। কর্তব্যের কাছে আবেগ বেমানান। আর আমি নিজের কর্তব্যে হটকারিতা করতে পারি না। অতীত ভুলে সামনে এগোও। অতীতে কিচ্ছু নেই! তোমার অতীত আজ সম্পূর্ণ শূণ্য। নিজের নতুন ঠিকানায় শুভ কামনা। যদি অদৃষ্টে থাকে তবে তোমার ভবিষ্যৎ হবো। রাঙাব তোমায় কৃষ্ণচূড়ার রঙে।
ইতি
মেজর M.I”
গুরুত্বপূর্ণ চিঠি মনে করে চিঠিটা গ্রহণ করেছিল তিতির। যেহেতু প্রেরকের ঠিকানার স্থানে সেনানিবাসের ঠিকানা! চিঠিটা দুই থেকে তিন বার পড়ে শেষোক্ত উল্লেখে বুঝল, সে সত্যি আজ তার প্রিয় শুভ্র রঙে বিমর্ষ! এতোদিন কিয়ৎ সন্দেহ হতো আজ তা রূঢ় বাস্তবতা। অক্ষিকোণে জমে উঠা জলের কনাদের প্রশ্রয় দিলো না। অবাধ্য জলধারাকে কঠিন শা*সনে স্বস্থানেই আটকে দিল। কিন্তু আগুন্তকও যে মেজর তা জেনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এমনকি আগুন্তক তার পছন্দ সম্পর্কে অবগত তা বুঝে তাচ্ছিল্য হেসে নিজের ললাটকে ধি*ক্কার জানাল। তার জীবনে কেউ আসলে বা আসার চেষ্টা করলে নিয়তি তার সুনিপুণ নিষ্ঠুর পরিকল্পনায় তা রুদ্ধ করার প্রচেষ্টারত হয়। চিঠিটা ভাজ করে ফিজিওলজি বইয়ের ভিতর রাখল। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ক্যাম্পাসের পুকুর পাড় থেকে উঠে দাঁড়ায়। পুকুর পাড়ে বসেই চিঠিটা পড়ছিল। পুকুর পাড়ের কাছে কয়েকজন আছে তবে তারা ইন্টার্ন ডাক্তার। বলতে গেলে একটু নির্জনতার জন্যই আসা। এখন একাডেমিক ভবনে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তে বসে।
মৃদুলা, ইতি, রিক্তা, হাসিব ও সাইফও সেখানে। ওরা তিতিরকে কিছুক্ষণ খুঁজে তারপর না পেয়ে লাইব্রেরিতে এসে বসেছে। রিক্তা দেখল তিতির মাত্রই একটা কর্ণারের টেবিলে গিয়ে বসল। অতঃপর বই খুলে এক ধ্যানে চেয়ে আছে। রিক্তা বাকিদের আস্তে ডেকে দেখিয়ে বলে,
“তিতিরের কী হলো? সকালেই তো কী সুন্দর হাসি-খুশি ছিল।”
ইতিও লক্ষ্য করে বলল,
“ওর বাসায় কিছু হলো নাকি? এই মাইয়াটা এতো কম কথা বলে কেন বুঝিনা। চলতো।”
ওরা পাঁচজন তিতিরের কাছে যায়। তিতিরের টেবিলে দুইজন জুনিয়র বসে ছিল। তাদেরকে ইশারায় উঠে যেতে বলে। জুনিয়রা উঠে গেলে ইতি, হাসিবরা তিতিরের সামনে ও পাশে বসে। রিক্তা সুধায়,
“কী হইছে তোর? মাঝে কয়েকদিন বাড়ি গেছিলাম তার মধ্যে তুই শ্বশুরবাড়ি ছাড়লি। এখন মেডিকেল কলেজ মাইগ্রেশন করবি। কি চাচ্ছিস? এখন আবার মুড অফ। কী হয়েছে বাবু?”
তিতির শূণ্য দৃষ্টিতে তাকায়। অতঃপর ঠোঁটকোলে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে,
“আমার আর পিছুটান রইল না। অপেক্ষার প্রহর অবশেষে ক্ষান্ত হলো।”
“স্পষ্ট করে বল। দিন দিন প্রচুর হেয়ালি করছিস।”
সাইফের প্রত্যুত্তরের জবাবে এবার তিতির স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
“বিধবা বুঝিস? বিধবা আমি। আমার দুই বছরের অপেক্ষা শেষ। আমি আর কখোনোই এই শহরে ফিরতে চাই না।”
তিতিরের বক্তব্যে উপস্থিত সকলের মাঝে নিরবতা বিরাজ করল। তা দেখে তিতির বলল,
“তোদের কী হলো? স্পষ্ট করে বলতে বললি বললাম। এখন চুপ কেন?”
মৃদুলা বলে,
“তোর কষ্ট হচ্ছে না?”
“নাহ্। কষ্ট সব পেছোনে ফেলে ওই বাড়ি ছেড়েছি। দুই বছরে উনার না ফেরাতেই আমার মনে ক্ষীণ সংকেত দিচ্ছিল। একটা মানুষের মৃত্যুর খবরে খারাপ লাগছে কিন্তু সবাই যেমন আশা করে মানে আশেপাশের মানুষজন যে আমি কাঁদতে কাঁদতে সেন্স হারাব। কয়দিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে নিজেকে মৃতপ্রায় করে ফেলব! তাদের সেই আশা পূরণ করতে পারলাম না।”
ইতি তিতিরকে নরম সুরে বলে,
“ঠিক আছে। পড় এখন। অতীত ভুলে সামনে আগা।”
“হুম।”
_______
আজ হিয়ার মেয়ের আট দিন বয়স হলো। এতোদিন নাম রাখেনি। আজ নাম রাখবে। নাম রাখা হলো ‘হৃদিতা তাহিয়াত হায়াত’। ভাবছে নামের আকিকা পরে দিবে। দুই-আড়াই বছর পর দিলেও তো হবে। আজ যেহেতু শুক্রবার তাই তিতির ভাবলো রাহানদের বাড়িতে গিয়ে সেদিন পার্সেলের জিনিসপত্র ফেরত দিয়ে আসবে। এগুলো প্রতিনিয়ত নিজের অতীতকে স্মরণ করাবে। তাই মা, হিয়া ও হায়াতকে নিয়ে বেরিয়ে পরল। সাথে চিঠিটা নেয়নি কারণ চিঠিটার পুরোটা জুড়ে কারও হৃদয়ের অনুরুক্তি। যা দেখলে রোকেয়া বেগম ও রাহানের ভাই-বোন অন্যকিছু ভাবতে পারে। তারা চাইলেই হেড অফিসে এখন খবর নিয়ে জানতে পারবে।
তিতির ও তার মা-ভাবিকে দেখে রোকেয়া বেগম খুশি হলেন কিন্তু রাহানের বোন মোটেও খুশি হয়নি। তিতির সেই বিষয়টা দেখেও না দেখার মতো করে থাকল। কুশলাদি জিজ্ঞেসা শেষে রোকেয়া বেগম হায়াতকে কোলে নিয়ে নাজমা বেগমের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। তিতির ও হিয়া চুপচাপ বসে আছেন। রোকেয়া বেগম তিতিরকে বলেন,
“প্রায় বিশ-বাইশ দিন পর আসলে। তোমার পড়ালেখার কী অবস্থা? হিয়াকে কি কোথাও ভর্তি করবে?”
তিতির হালকা হেসে জবাব দেয়,
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো চলছে। হিয়াকে ময়মনসিংহ গিয়ে এডমিশনের সময় ভর্তি করব। এডমিশনের তো বেশি সময় বাকি নেই। ওকে বলেছি, হায়াত ঘুমালে আগের বইগুলো পড়তে। কিন্তু মেয়েটা দিনকে দিন অলসে পরিণত হচ্ছে।”
রোকেয়া বেগমের মস্তিস্কে তিতিরের ময়মনসিংহ যাওয়ার কথাটায় প্যাঁচ লাগল। অতঃপর তিনি সুধালেন,
“তোমরা ময়মনসিংহ যাচ্ছ? বলোনি তো।”
“এইতো মা, আজ বলতে আসলাম।”
রোকেয়া বেগম জিজ্ঞেসা করেন,
“তোমাদের বাড়িটা? ওটা কি করবে?”
নাজমা বেগম জবাব দেন,
“বিক্রির কাজ চলছে। বর্তমান মূল্যের থেকে একটু কমে হলেও বিক্রি করে দিচ্ছি। যে কিনছে সেই অন্যান্য খরচ বহন করে কিনছে।”
“ওহ ভালো কথা।”
রোকেয়া বেগমের দিকে তিতির বারবার আড় নজরে তাকাচ্ছে। কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। এক মায়ের কাছে ছেলের মৃত্যুর খবর কতটা বেদনাতুর তা অন্যকেউ বোঝা দায়। তাও বলতে তো হবে। তিতির ব্যাগ থেকে গয়নার বক্সটা আর চেকটা বের করে টেবিলের উপর রাখল। রেখে একটু বড়ো করে শ্বাস নিলো। রোকেয়া বেগম সেদিকে ভ্রুঁ কুঁচকে চেয়ে আছেন। তিতির বলে,
“আমি এসব নিতে পারব না। আমি জানি বাবা আমাকে ভালোবেসে এসব দিয়েছেন সাথে আপনাদের ছেলেও। কিন্তু এসব সাথে রাখলে আমি অতীতেই নিষ্পেষিত হবো। তাছাড়া সমাজে তো রীত আছে, বিধবা নারী গয়না পড়তে পারে না!”
রোকেয়া বেগম আচমকা রেগে গিয়ে তিতিরের গালে সপাটে চ*ড় দিয়ে বসলেন। উপস্থিত নাজমা বেগম ও হিয়া এই কান্ডে হতবাক হয়ে গেলেন। হায়াতও হয়তো ভয় পেয়েছে। কেঁদে উঠেছে বাচ্চাটা। রোকেয়া বেগম শক্ত কন্ঠে উচ্চস্বরে বলে ওঠলেন,
“ভবিষ্যতে এমন কথা বলবে না। তুমি এই বাড়ি ছেড়েছ বলে যে আমার ছেলে মা*রা গেছে তা ভাবো কী করে? তুমি সম্পর্ক রাখতে চাওনা আমরি বাঁধা দেইনি। যুবতী-কুমারী মেয়ে ভেবে তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেছি।”
রোকেয়া বেগমের জোড়ালো কণ্ঠে রাহানের বোন বসার ঘরে আসে। তিতিরদের দেখেই সে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। মায়ের কথা শুনে বলে,
“কী হয়েছে মা? কী করেছে এই মেয়ে?”
রোকেয়া বেগম কেঁদে ওঠলেন। বললেন,
“দেখ না। তিতির বলতেছে আমার ছেলে নাকি বেঁচে নাই। ওর সাহস হয় কী করে? তোর বাবাও শেষ নিঃশ্বাম ত্যাগের সময় বলেছিল, হয়তো রাহান বেঁচে নাই। তখনি আমি অসুস্থ মানুষটার সাথে রাগ করেছিলাম। আজ তিতিরও বলছে।”
রাহানের বোন ক্ষীপ্র স্বরে বলল,
“চলে গিয়েছিলে তো ফিরেছ কেনো? আমার ভাইকে মৃত প্রমাণ করতে উঠে পরে লেগেছ কেনো? নাকি সম্পত্তির লোভে? ভাই মা*রা গেলে তো তার সম্পত্তি তুমিও পাবে। তাই জন্য এসেছ তাই না? তোমার মতো সুবিধাভোগী মেয়েদের খুব ভালো করে চেনা আছে।”
তিতির মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে। সবাই তারই দোষ কেনো ধরে? লোভ সে কেনো করতে যাবে? বরং আজ কিছু সম্পদ ফিরিয়ে দিতে এসেছে সে। তিতির জড়ানো কণ্ঠে বলল,
“সেনানিবাস থেকে চিঠি এসেছিল। সেখান থেকে জেনেছি। আপনারা খবর নিন তাহলেই হয়। তাছাড়া আজ আমি এসব(হাত দিয়ে টেবিলে দেখিয়ে) ফিরিয়ে দিতে এসেছি। আমার এসব লাগবে না। আমার বাবা যা রেখে গেছে তা দিয়েই আমাদের হয়ে যাবে। এতোদিন আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সারাজীবন কৃতঙ্গ থাকব। ভালো থাকবেন।”
কথাগুলো বলে তিতির আর অপেক্ষা করে না। মা, ভাবীকে উঠতে বলে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,