প্রেমের জোয়ার ভাটা পর্ব ৫

0
503

#প্রেমের_জোয়ার_ভাটা
#পর্ব_পাঁচ
#অধির_রায়

মীরার বাবা সব দিক বিচার বিবেচনা করে বিয়েতে রাজি হয়ে যান৷ ইহান বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করলেও বাবার মুখের উপর জোর গলায় বলতে পারিনি৷ ধূমধামে বিয়ে হয়ে যায় মীরা আরুশের।

মীরা স্বামী সংসার নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে৷ সুখ মানুষের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী নয়৷ কিছুদিন যেতে না যেতেই মীরার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। মীরার ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ। বাসা থেকে সব কাজের লোক তাড়িয়ে দিয়েছেন আরুশের মা বাবা৷ বাসার সকল কাজ মীরাকেই করতে হয়৷ ক্লান্ত দেহে বিছানায় গা ফেলতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমায় মীরা। আরুশের মা মীরার কাচা ঘুম ভেঙে রাগী কন্ঠে বলল,

“নবাবজাদি সারাদিন বসে থাকলে বাসার কাজ কে করবে? তোর বাপের বাড়ির মানুষ এসে কাজ করে যাবে? গরিবের বাচ্চা হয়ে বড়লোক ছেলের মাথা খাওয়া৷ কালো জাদু করছিস আমার ছেলের উপর৷ তোকে আমার চেনা হয়ে গেছে৷”

আরুশের মা আয়াত চৌধুরী প্রথম দিন থেকেই মীরাকে সহ্য করতে পারেন না৷ তিনি কখনও চাননি মীরাকে তার ছেলের বউ বানাতে৷ তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলের বউ হবে বড়লোক ঘরের কোন মেয়ে৷ যার বাবারর থাকবে বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ী৷ কিন্তু মীরার বাবার কিছুই নেই৷ তবে বিশাল মনের অধিকারী মীরার বাবা৷ একজন আদর্শবান শিক্ষক৷ ছাত্র গড়ার কারিগর তিনি৷
সমাজে গরিব মানুষের কোন মূল্য নেই৷ টাকা মানুষের চোখ বেঁধে রেখেছে। টাকার অহংকারে মানুষকে নিচু থেকে নিচু করে রেখেছে৷ মাথাটা সব সময় উঁচু করে রাখে উচু রাখে টাকার জোরে। অহংকারে পা মাটিতেই পড়তে চাইনা৷ মীরা ঘুম ঘুম চোখে জবাব দিল,

“মা আমি তো সব কাজই করছি৷ এখন তেমন কোন কাজ নেই৷ কোন কাজ থাকলে দুপুরে রান্নার সময় করে নিব৷”

মীরার চুলের মুড়ি ধরে বলল,

“তুই বাসার সকল পর্দা পরিষ্কার করবি৷ ধোঁলা জমে গেছে৷ আমি ময়লা পর্দা দেখতে পারব না৷”

“মা পর্দা তো দুইদিন আগেও পরিষ্কার করেছি৷ এক সপ্তাহ পর পর পরিষ্কার করলে অনেক৷”

“প্রতিদিন তিনবেলা না খেয়ে তিন দিন পর পর খেতে পারিস না৷ খাবারের কথা মনে থাকে কাজের কথা মনে থাকে না৷”

মীরা কথা না বাড়িয়ে কাজ করতে চলে যায়৷ আরুশের মা তৃপ্তির হাসি দিয়ে সোফায় বসে পড়ল। মনে মনে বলল,

“মীরা তোকে এই বাড়িতে আমি টিকতে দিব না৷ তুই কোনদিন এই বাড়িতে থাকতে পারবি না৷ ছিঁড়া কাঁথায় শুয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন। আমি তোর হাত ভেঙে দিব৷”

আরুশ অফিস থেকে বাসায় এসে মীরাকে ঘুমের দেশে তলিয়ে থাকতে পায়৷ আজও তার ভিন্ন কিছু হয়নি৷ মীরার জন্য ভালোবেসে শাড়ী নিয়ে এসেছে৷ কিন্তু সে শাড়ী মীরাকে দেওয়া হলো না৷ মন খারাপ করে শাড়ী একপাশে রেখে মীরার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল।
__________

আঁধার কেটে দিনের আলো৷ আরও একটু নতুন দিনের সূচনা করলেন সূর্যদেব। সকলের জীবন থেকে আঁধার কেটে নতুন আলো ফুটলেও মীরার জীবনে ঘন অন্ধকার নেমে আসে৷ অফিসের কাছে কিছু দিনের জন্য আরুশ ঢাকার বাহির যায়৷ সে সুযোগে মীরার উপর চলে অমানবিক অত্যাচার৷ না পারে কাউকে বলতে, না পারে সহ্য করতে৷ মনের মাঝে সাহস জুগিয়ে বলল,

“আপনারা কি চান? একটা দিনও আমায় শান্তি দেননা৷ কেন আমার সাথে এমন ব্যবহার করেন?”

আরুশের মা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“তুই এখনও বুঝতে পারিস না৷ আমরা তোর থেকে মুক্তি চাই৷ তুই আরুশকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবি৷ না হলে তোর জীবন নরক বানিয়ে ফেলব৷ এভাবে তুই একদিন মারা যাবি৷ সেদিন আরুশের অন্য জায়গায় বিয়ে দিব৷”

মীরা অসহায় দৃষ্টিতে নিজের শ্বাশুড়ির দিকে তাকায়৷ শ্বশুর বাড়িতে শ্বাশুড়ির অবস্থান মায়ের জায়গায়। মা হয়ে বউমাকে কাজ শেখায়৷ আর মীরার শ্বাশুড়ি মুক্তি চাইছে৷ মীরা শক্ত গলায় জবাব দিল,

“আপনাদের অনেক সহ্য করছি আর নয়৷ আমি কোনদিন আরুশকে ডিভোর্স দিব না৷ এরপর আমার উপর অত্যাচার করার চেষ্টা করলে আপনাদের স্থান হবে জেলে৷ আমাকে গ্রামের মেয়ে পেয়ে বোকা পাননি৷ আমি আগেই বুঝতে পেরেছি৷ আপনার মুখ থেকে জানার জন্যই বললাম৷”

আরুশের মা রাগী কন্ঠে বলল,

“আমার বাড়িতে থেকে আমাকে চোখ রাঙানো৷ তোর চোখ তুলে ফেলব৷ তুই এখনও আমায় চিনতে পারিস নি৷”

মীরা ভদ্রতার সহিত বলল,

“আমার সাথে ভালো ব্যবহার করলে মাথায় তুলে রাখব৷ এরপর আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে আপনার এমন হাল করব আপনি নিজের নাম ভুলে যাবেন৷”

মীরা রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছিল৷ আরুশের মা কিছু বলতে নিবে তার আগেই মীরা পিছনে ঘুরে বলল,

“আমি কাল থেকে ভার্সিটি যাব৷ আমাকে কে আটকায় আমি দেখব? আমার লেখাপড়ায় যে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে আমি তাকে দেখে নিব।”

মীরাকে এমন অগ্নিমূর্তি ধারণ করতে দেখে আরুশের মা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়৷ একজন সাদাসিধে মানুষ কিভাবে এতোগুলো কথা বলল৷ রাগে টি টেবিলে রাখা ফুলদানি ভেঙে ফেলেন৷
মীরা রুমে এসে একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস নিল৷ ফোন বের করে ইহানকে ফোন দিল৷ দুইবার ফোন বেজে কেটে গেল৷ তৃতীয়বার ইহান ফোন তুল৷ আপনার পাশ থেকে ইহান বলে উঠল,

“ভাইয়ার কথা ভুলে গেছি৷ ভাইয়াকে মনে পড়ে না৷ ফোন দিলে ফোনে পাওয়া যায়না৷”

মীরার নেত্রদ্বয়ে জল টলমল করছে৷ কথা হারিয়ে ফেলছে৷ কিভাবে বলবে তার আদরের বোন ভালো নেই? এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল৷ মলিন ভেজা গলায় বলল,

“ভাইয়া আমি সারাদিন ফোন নিয়ে তো বসে থাকিনা৷ ক্লাসে যেতে হয়৷ তাছাড়া প্যাক্টিকেল ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। তোমাদের কথা খুব মনে পড়ে৷ খুব দেখতে ইচ্ছা করে৷ ভার্সিটিতে একটু ভালো লাগে৷ বাড়িতে আসলে একা একা ভালো লাগে না৷”

কথা বলার সময় চোখ থেকে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে৷ কতো সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলা শিখে গেছে৷ নিজের কষ্ট বুকে চাপা রেখে হাসিমুখে মিথ্যা বলে যাচ্ছে৷ যেন অপর দিকের মানুষটা কষ্ট না হয়৷ ইহান মলিন কন্ঠে জবাব দিল,

“মীরু তুই কান্না করছিস কেন? কি হয়েছে তোর? আরুশ কই? প্লিজ বোন আমার কান্না করিস না৷”

“ভাইয়া তোমাদের কথা খুব মনে পড়ে৷ আরুশ কাজের জন্য ঢাকার বাহিরে গেছেন৷ কালই চলে আসবেন৷ তোমার স্কুল কেমন এগিয়ে যাচ্ছে? মানুষের কল্যাণে তুমি নিজেকে বিলিয়ে দাও৷ আমাদের গ্রামকে একটা আদর্শ গ্রাম করে তুলবে৷”

বোন ভাইকে সব সময় ভালো কাজে উৎসাহীত করে৷ ভাই বোনের সব কথা মেনে চলার চেষ্টা করে। বোনের কষ্ট হলে সব থেকে বেশি কষ্ট ভাইয়ের হয়৷ ভাইবোন কিছু কথা ফোন রেখে দিল৷ অনেকদিন পর মীরার মন হালকা হলো৷ শাওয়ার নিয়ে পড়তে বসল৷ ঠিক করেছে সে সব কাজ করবে না৷
____________

আরুশ বাড়িতে এসে মাটির ফুলদানি ভেঙে ফেলল। ভাঙার শব্দে আয়াত চৌধুরী দৌড়ে ডাইনিং রুমে আসে। আরুশ মাত্র আকন্দপুর থেকে ফিরেছে৷ দুই বছর আগে মেয়েটাকে দেখেছে৷ মেয়েটাকে এতো বছর পর একটা নজর দেখার সুযোগ হলো না৷ মীরা কি করে পারল আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে আলাদা করতে? আরুশের মা এগিয়ে এসে আরুশের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে আরুশ রাগী গলায় বলল,

“মম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না৷ তোমার মতো মা যেন কারো ঘরে না হয়৷ তোমার মতো অহংকারী মাকে মায়ের পরিচয় দিতে লজ্জা করে৷ কি করে পারলে তুমি মীরা আর আমার মাঝে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি করতে৷ আমি তোমায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম৷”

আরুশের মা দৃঢ় গলায় বলল,

“আরুশ তুমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো৷ আমি তোমার ভালোর জন্যই এমন করেছিলাম৷ আমি কখনও তোমার খারাপ চাইনি।”

আরুশ অগ্নি দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। চোখ থেকে যেন আগুনের লাভা বের হবে৷ কর্কশ গলায় বলল,

“তুমি আমার মা বলে তোমাকে এখনও অনেক সম্মান করি৷ অন্য কেউ হলে আমি তাকে খু/ন করতাম৷ আমার ভালোর জন্য আমাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছো৷ আজ আমি একা৷ আমি এতোটাই খারাপ যে মেয়ের মুখে বাবা ডাক শুনতে পারিনা৷ আমার বন্ধু আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে পরিচয় দেয়৷ তার জন্য তুমি দায়ী৷”

আরুশ সোফায় লাথি দিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়৷ আরুশের মা সেখানেই বসে কান্না করতে থাকে৷

চলবে……

দুইদিন দিতে পারিনি। বই মেলায় ছিলাম গত দুইদিন৷ ভুলত্রুটিগুলো মার্জনীয় দৃষ্টিতে দেখবেন৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here