‘ইজ ইট আ ডিজঅর্ডার’
পর্ব:- ৩(অন্তিম)
কলমে:- সায়ীদা নুহা।
—
চার.
ঘুমের মাঝে ফাইয়ায হেসে উঠে। সে তো এটাই চাইছিল! হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক এভাবেই! এভাবেই সে নিয়াযকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু আভা? সে আভাকে কেন কোনপ্রকার ভয় দেখাতে চায় না? আভাকে কেন সে কখনও আঘাত করতে চায়নি?
রুমের দরজায় করাঘাত পড়লো। বাহির থেকে তাসনিয়া ছেলেকে ডাকছেন। ফাইয়াযের মুখের থেকে বুঝি কেউ তার হাসিটা জোর করে কেড়ে নিয়েছে। ধড়াক করে উঠে বসে সে। রক্তচক্ষু সমেত দরজার দিকে তাকালো। এখনই এই মহিলার আসতে হলো? এখনই ডাকতে হলো?
ভেতরে রাগ চেপে উঠে দাঁড়ায় ফাইয়ায। দরজা খুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তাসনিয়া বরাবরের মতো সামান্য এক বিষয়ে রাগ দেখিয়ে বললেন,
“এখনও ঘুমানোর কথা? তোর বাবা খোঁজ করছে না তোর? আর কতদিন বলেছি, এরকম চোখ গরম দেখাবি না আমায়? জীবনে কিছুই করতে পারলি না, অন্তত স্বভাব ঠিক কর!”
ফাইয়ায আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইলো। তাসনিয়া বিরক্তির সাথে বললেন,
“সকাল সকাল চিল্লাচিল্লি শুরু করতে হয়!” বলেই তিনি চলে গেলেন। ডাইনিং থেকে বাকি সবার কণ্ঠ ভেসে আসছে। হাসাহাসি করছে তারা। বাবা, ইমাদ, আভা, নিয়ায সবার গলাই শুনা যাচ্ছে। কিন্তু এটা দেখতে যতটা ভালো দেখাচ্ছে, ফাইয়াযের কাছে সেটা ততই বিরক্তিকর! এসব চিৎকার, চেঁচামেচি তার মোটেও পছন্দ না। তার সামনে কেউ সামান্য জোরে কথা বললে ইচ্ছে করে, তার গলার রগটা সে চেপে ধরুক। টেনে ছিঁড়ে ফেলুক! যেন সেই মানুষটি কখনও দ্বিতীয়বার কথা না বলতে পারে!
তাসনিয়া চলে গেলেই ফাইয়ায দরজা লাগিয়ে তার রুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। আয়নায় ভেসে ওঠা প্রতিবিম্বকে বলল,
“এবার এই মহিলাকে নিয়ে আমি ভাবব। আমার স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে! এবার তাকে নিয়ে খেলার পালা!”
বলেই ফাইয়ায ভেতরে ভেতরে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার আনন্দ উপভোগ করে। প্রথম থেকে নিয়াযকে ভয় পাওয়া অবধি পুরো বিষয়টা মনে করে সুখ পায় সে। তৎক্ষণাৎ আয়নায় স্পষ্ট তার জ্বলজ্বলে চোখ দু’টো ভেসে উঠলো। তাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। রাজ্যের আনন্দ তার মনে!’
পাঁচ.
“দিস ইজ জাস্ট আ কাইন্ড অফ বাইপোলার ডিজঅর্ডার। এর আরও ভয়াবহ কিছু লক্ষণ আছে। আপনারা পড়তে থাকুন, জানতে শুরু করবেন!”
সাইকিয়াট্রিস প্রফেসর হোসাইনের গল্প শুনে ক্লাসের সবার ভেতরেই চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। সবার ভেতরেই কৌতূহল, প্রশ্নের ঢালি তৈরি হচ্ছে। চোখের চশমাটা পরিষ্কার করে প্রফেসর ক্লাসের সবার দিকে একনজর তাকিয়ে রইলেন। মুহূর্ত পর বললেন,
“কী জিজ্ঞেস করবেন আপনারা? করতে পারেন।”
ক্লাসের সবথেকে চতুর মেয়ে মিরা সাথে সাথে হাত তুলে বলল,
“স্যার, কেন ইউ প্লিজ ক্লিয়ার দিস, ইজ ইট জাস্ট আ স্টোরি অর এলস?”
স্যার মুচকি হাসলেন। বললেন,
“বাইপোলার ডিজঅর্ডার একটি মানসিক রোগ। যার পরিণতি ভয়াবহ হয়। এই রোগের অধিকারীরা নিজের মতো ভাবতে পছন্দ করে। তারা এত পরিমাণের ডিপ্রেশনে ভুগে যে, কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে। সে অনুপাতে কাজ করে তারা। আর অবশ্যই সেটা কোনো ভালো কাজ হয় না। তারা খারাপের থেকেও খারাপ কাজ শেষে ভিতরে সুখ অনুভব করে। কাউকে শারীরিক আঘাত দিলো, ব্যক্তিটি বাঁচার জন্য মিনতি করছে তার কাছে, তাকে অনুরোধ করছে কাজগুলো না করতে; এতেই সে সুখ পায়। আরও জঘন্য কাজ করতে পছন্দ করে।”
ক্লাসের মেধাবী ছাত্র রওনক বলল,
“স্যার, কীরকম ডিপ্রেশনে ভুগলে মানুষ এতটা জঘন্য হয়ে উঠে?”
প্রফেসর একমুহূর্ত চুপ থেকে বললেন,
“ধরুন, এমন কোনো বিষয়, যেটা আপনি ছোটো থেকে মস্তিষ্কে ক্যাচ করে আসছেন। যেমন ধরতে পারেন, ছোটো থেকেই বাবা মায়ের মাঝে খারাপ ব্যাবহার দেখে আসা, তাদের থেকে খারাপ আচরণের সাক্ষী হওয়া, পারিবারিক অশান্তি কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে না পারা, আপনার সামনেই আপনাকে হেয় করে অন্য কাউকে গুরুত্ব দেওয়া… ইত্যাদি। সে সাথে এটা আপনার মনে একেবারের জন্য কালো দাগ ফেললে…”
প্রফেসর একটু থেমে আবার বললেন,
“২৫ বছর বয়স থেকে এই রোগের লক্ষণ দেখা শুরু হয়। এই বয়সে এসে তারা একা থাকতে, একাকীত্ব অনুভব করতে বেশি পছন্দ করে। যেটা ফাইয়াযের ভেতরে এত পরিমাণের ছিল যে, সে ২৮ বছর বয়স থেকেই মারাত্মক রকমের চিন্তাভাবনা করতে শুরু করে। তবে হ্যাঁ, কোনো না কোনভাবে, তার ভেতর আভার প্রতি দুর্বলতা ছিল। সে তার ছোটোবোনকে কষ্ট দিতে চাইত না। এটা একটা প্লাস পয়েন্ট! নোট ইট, রুগী তার সর্বাধিক কাছের মানুষদের নিয়ে ভাবত, বাদবাকি সব ভেস্তে যাক!”
মিরা বলল,
“স্যার, প্লিজ… ফাইয়ায কে ছিল? আমরা সবাই তার ব্যাপারে জানতে উৎসুক!”
প্রফেসর হাসলেন। হাতঘড়িতে সময় দেখলেন একবার। ক্লাসের টাইম শেষের পথে। মুখে ‘চুক’ করে একটা শব্দ করলেন তিনি। মিরার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
“আমার নাম জানেন আপনি?”
“অবশ্যই স্যার। সাইকিয়াট্রিস হোসাইন। এই নামেই তো আপনাকে এখানে সবাই চিনে।”
“না। ফুল নেইম। হোসাইন নাম তো আমার উপাধি। যেটা আমার বাবাও এখানে ক্যারি করতেন। যার ফলস্বরূপ আমাকে আজও এখানে হোসাইন নামে বেশিরভাগ মানুষ চিনে।”
মিরা একপলক ভাবলো। পরক্ষণেই তার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। ঠোঁট নাড়িয়ে ধীরে বলল,
“সাইকিয়াট্রিস ডক্টর নিয়ায হোসাইন!!!”
প্রফেসর হাসলেন। প্রোজেক্টরের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। মিরা তখনও হা করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রফেসর নিয়ায পেনড্রাইভ বের করে ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করলেন। কিছুক্ষণ বাদেই প্রোজেক্টরের স্ক্রিনে বড়ো করে ফাইয়াযের ছবি ভেসে উঠলো। কী সুন্দর চেহারার অধিকারী ছেলেটা, কী মিষ্টি হাসি দিয়ে আছে! একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে সে যেন তৃপ্তির হাসি দিচ্ছে। মিরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
প্রফেসর বললেন,
“এই ছবিটা তখনের। যখন ফাইয়ায ভাই আভা আপার সাথে কথায় পারেনি। আপা তাকে কথার জালে ফেলে হারিয়ে দেয়। কোনো একটা বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছিল তাদের মাঝে। ফাইয়ায ভাই একমাত্র আভা আপার সাথেই সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। আমার মা একটা কথা প্রায় বলতেন, আভা আপা ভাইয়ার এত আদরের যে, কেউ যদি ভাইয়াকে বলে, তোর বোনের জন্য তুই জান দিতে পারবি? ভাইয়া হেসেই বলে দিতো, আভা এতে খুশি হলে আমি তাই করব!”
ক্লাসে পিনপতন নীরবতা। প্রফেসর নিয়ায মাউসে ক্লিক করে আরেকটি ছবি বের করলেন। সাথে সাথে ক্লাসের সবাই আঁতকে উঠে। ছবিতে ফাইয়াযের মৃতদেহ ভেসে উঠেছে। সুইসাইড করে সে। হাতের কবজি কেটেও দিব্যি হাসছে!
প্রফেসর নিয়ায স্ক্রিনে তাকালেন না। তার বুকের ভেতরের পাথরটা আরেকটু নাড়া দিয়ে উঠলো। মনে পড়ে ফাইয়ায ভাইয়ের ডায়েরির কথা। যেখানে তার একাকিত্বের কথাগুলো স্পষ্ট লেখা ছিল। সে কী ভাবত, সবকিছু! তিনি বললেন,
“বাইপলি ডিজঅর্ডার। মানুষ খারাপ কাজ করে দিব্যি সুখ পায়, আনন্দ অনুভব করে!”
ক্লাস টাইম অভার হয়ে যাচ্ছে। সবকিছু গুছিয়ে প্রফেসর নিয়ায বের হবেন এমন সময়ে ক্লাসের সবার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন,
“আপনারা গল্প পড়তে, শুনতে পছন্দ করেন। তবে যে কোনো ধরনের গল্পই হোক না কেন, মনে রাখবেন… গল্প কিন্তু জীবন থেকেই উঠে আসে! আর কারও ডিপ্রেশনকে হেলা করবেন না! ইট কেন কিল আ ম্যান সফটলি!”
সমাপ্ত!