ইজ ইট আ ডিজঅর্ডার ?,পর্ব:- ০২

0
2649

(এক্সিডেন্টের রাতে)

(…..) ছেলেকে একনজর দেখতেও পাচ্ছেন না হোসাইন সাহেব। ট্রাকের ড্রাইভার দ্রুত নেমে আসে। এই পরিস্থিতিতে সে কী করবে বুঝে পায় না। কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে।

মাঝরাতের দিকে তাসনিয়ার ফোনে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। একবার, দু’বার রিং হয়, তৃতীয়বারের সময় কল রিসিভ হলো। নাম্বারটা অপরিচিত, আর এতরাতে? তাসনিয়ার মনে কু ডাকে। বাবা ছেলের অপেক্ষা করতে করতে তিনি হলরুমের সোফাতেই বসে ছিলেন। কখন ঘুমিয়ে গেলেন খেয়ালই হয়নি। কল রিসিভ করে ফোন কানে লাগালেন তিনি। ওপাশ থেকে একজন নারীকণ্ঠ শুনা গেল,
“হ্যালো, আমি ঢাকা সেন্ট্রাল হসপিটাল থেকে বলছি। আপনি কি হোসাইন সাহেবের স্ত্রী বলছেন?”
ঘুম ঘুম চোখে কলটা রিসিভ হলেও তাসনিয়ার সব ঘুম নিমিষেই উড়ে গেল। হাসপাতাল থেকে এতরাতে কেন ফোন দিবে? তাসনিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“জি, আমিই। কী হয়েছে? এত রাতে আপনি কে…?” মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠটি বেশ শান্ত সুরে বলল,
“দেখুন, আপনি একটু শান্ত হোন। আপনাকে ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে আসতে হবে।” আর কিছু বললেন না তিনি। তাসনিয়া ওপাশে আরও কিছু শোনার অপেক্ষা করেন। কিন্তু শুধু টুট টুট শব্দ ভেসে আসলো!

*****

দরজায় ধরাধম করাঘাত পড়লো। এই সময়ে এভাবে কে ডাকাডাকি করছে? টলতে টলতে দরজা খুলল ফাইয়ায। চোখ কচলে বিরক্তির সাথে সামনে তাকাতেই দেখতে পায়, তার মা দাঁড়িয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাসনিয়া ভেজা গলায় বললেন,
“ফাইয়ায, তোর বাবা… ফাইয়ায… হাসপাতালে যেতে হবে। আয় দ্রুত।”
ফাইয়ায কিছুই বুঝলো না। তখনও সে বিরক্তির সাথে দরজার সাথে ঠায় দাঁড়িয়ে। পিছন থেকে আভা দ্রুত পায়ে এসে বলল,
“ভাই, হাসপাতাল থেকে ফোন আসছিল। কী যেন হয়েছে আব্বুদের! মায়ের অবস্থা ভালো না। দ্রুত আসো না?”

হাসপাতাল পৌঁছুতে তাদের সকাল পেরিয়ে যায়। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল! ফাইয়ায সেম নাম্বারে কল করে সবকিছু জেনে নেয়। ঠিকানা দিয়ে নার্স বলল,
“আপনার মায়ের অবস্থা বুঝতে পেরে আমি কিছুই বলিনি। আপনার বাবা আর ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়। বাচ্চাটা স্পট ডেড। আর আপনার বাবা বেঁচে থাকলেও হাসপাতালে আনার সময়ই তিনি মারা যান। সরি ফর অল অফ ইউ। আপনারা যত দ্রুত আসবেন, ততই ভালো!”
ফাইয়ায কিছু না বলেই ফোন রেখে দেয়। তাসনিয়া, আভা হাজারবার জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলল না।

হাসপাতাল পৌঁছে খোঁজ করতেই তারা লাশ বের করে দেয়। স্বামী, ছেলের এই অবস্থা দেখে তাসনিয়া সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাকে ইমারজ্যান্সিতে ভর্তি করানো হয়। ফাইয়াযের ভেতরে কোনপ্রকার ভাবান্তর দেখা যায় না। সে চুপচাপ সব কাজ একা হাতেই গুছিয়ে নিচ্ছে। আভা নিজেকে সামলাবে নাকি ভাই নিয়াযকে? আর না মাকে?
ডাক্তারের কথায় যত দ্রুত সম্ভব লাশ দাফন করা হয়। এক্সিডেন্টের কেস পুলিশের হাতে গেলেও ফাইয়ায সেটার ইতি ঘটায়। ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হয়। যদি সে মারতেই এসে থাকে, তবে হাসপাতালে কেন ফোন দিতো?

*****

দ্বিতীয়দিন,
রাতের বেলা। দেয়াল ঘড়ি টিকটিক করে জানান দিচ্ছে, রাত ১০টা বেজে ৫৬ মিনিট।
সবকিছু ছেড়ে তারা তিন ভাইবোন আলাদা হয়ে রইলো। বাবার মৃত্যুর কথা কেউ জানতেও পারেনি। আর না কেউ তাদের দেখতে এসেছে। দরজা জানালা সব বন্ধ করে ফাইয়ায দু’জনকে নিয়ে একা থাকলো। মায়ের কোনো খোঁজ নেই, খবর নেই!
আভা কিছুই বুঝতে পারছে না। ভাইকে কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না। বাবা আর ইমাদের মৃত্যুর শোক কাটাবে, নাকি… জানে না সে।

নিয়ায ঘুমুচ্ছিল। ঘরে একা সে। ঘুমের মাঝে সে স্পষ্ট অনুভব করলো, তার গায়ে কেউ হাত বুলাচ্ছে। নিয়ায হাত দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে। আবারও একই রকম! এবার একটু ভিন্ন, হাতটি নিয়াযের পা স্পর্শ করছে। সুড়সুড়ি দিচ্ছে তাকে। ঘুমের মাঝেই নিয়ায খিলখিল করে হেসে উঠে। মুখে বলল,
“ইমাদ, সর এখান থেকে। সুড়সুড়ি দিস না।” নিয়াযের কথায় কিছুই হলো না। বরং সে তার পায়ের পাতায় স্পর্শটি আরও ভালো করে অনুভব করছে। একপর্যায়ে নিয়ায বলতে লাগলো,
“ইমাদ, প্লিজ। প্লিজ সুড়সুড়ি দিস না। আম্মু… আম্মু…” হুট করেই জেগে যায় নিয়ায। তার মস্তিস্কে স্পষ্ট হয়, ইমাদ আব্বুর সাথে গাড়িতে মারা গেছে। ইমাদ এখানে কীভাবে আসবে? উঠে বসতেই নিয়ায দেখতে পায়, ইমাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথা নেই। গলার অংশটুকু ছেঁড়া। এ দৃশ্য দেখামাত্র নিয়াযের আত্মা শুকিয়ে আসে। তার কপাল ঘামছে। আভাকে ডাক দিতে চায়, অথচ তার গলায় সুর নেই। ভোকাল কর্ড যেন কাজ করতে অক্ষম!

তখনই নিয়ায শুনতে পায়, ইমাদ আগের মতো হেসে বলছে,
“আরেকটু দি ভাইয়া? আরেক… টু?”
ইমাদ চার ভাইবোনের মাঝে সবার ছোটো। ছোটো থেকেই সে ভাঙা গলায় কথা বলে। তার শব্দ উচ্চারণও ভাঙা শুনা যায়। নিয়ায স্পষ্ট তার ভাইয়ের গলা শুনতে পেল। অবিকল তার মতোই কথা বলছে! ইমাদের দেহ থেকে চোখ সরিয়ে খাটে তাকাতেই দেখল, ইমাদের কাটা মাথাটা সেখানে পড়ে আছে। চোখ দু’টো বন্ধ। রক্তে বিছানার একপাশ ভরে গেছে। কোনরকম দ্রুত পায়ে খাট থেকে আসে নিয়ায। এক দৌড়ে বোনের কাছে ছুটে যায়। আভা আজকেও তার মায়ের রুমে শুয়ে ছিল। নিয়াযকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“আজকে আবার কী হয়েছে?”
নিয়ায কাঁপতে কাঁপতে জোরে বলল,
“ইমাদ, ইমাদকে দেখেছি!”
“মানে?”
“আমি… আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ইমাদ এসে আমার পায়ে কাতুকুতু দিচ্ছিল। ওর মাথা নাই আপু। ওর মাথা ছিঁড়ে খাটে পড়েছিল। অনেক রক্ত, রক্ত… চাদর… রক্ত…”
বলতেই বলতেই নিয়ায ধপ করে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে। আভা তড়িঘড়ি করে তাকে টেনে বিছানায় তোলে। ঘেমে কী অবস্থা ছেলেটার! চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে, ওড়না দিয়ে ঘাম মুছে বলল,
“শান্ত হো। প্যানিক হওয়ার কিছু নেই! দুঃস্বপ্ন ছিল শুধু!”
নিয়ায কাতর কণ্ঠে বলল,
“না আপু, ছিল ও। আমি নিজের চোখে দেখেছি!”
আভা তাকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিছুই হলো না। অগত্যা তাকে নিয়াযের সাথে তার রুমে যেতে হলো। গিয়ে কিছুই দেখা গেল না। নিয়াযও হতবাক! তবে কি এটা স্বপ্নই ছিল? কিন্তু সে তো…
আভা চোখ দিয়ে ইশারা করলো তাকে। অর্থাৎ, কি? বলেছি না স্বপ্ন দেখেছ?”
নিয়ায উত্তর দিলো না। চুপচাপ বোনের সাথে ঘুমাতে গেল!

চলবে…

‘ইজ ইট আ ডিজঅর্ডার’
পর্ব:- ০২
কলমে- সায়ীদা নুহা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here