#পারলে_ঠেকাও
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃদিশা_মনি
মধুজা বলে,
‘আব্বু, আমার সিদ্ধান্ত হলো আমি তোমার বিয়ে দিতে চাই।’
এই কথাটা শুনে ডাইনিং টেবিলে সবার চোখ বড়বড় হয়ে যায়। মিলন হাসান রাগী দৃষ্টিতে নিজের মেয়ের দিকে তাকায়। কোন কঠিন কথা শোনাতে উদ্যত হন তখনই মধুজা বলে,
‘আমি জানি আব্বু, তুমি আমাকে আর আম্মুকে কত ভালোবাসো। তাই তো এতগুলো দিন একা কা’টিয়েছ। আমার কথা ভেবে অন্য কাউকে নিজের জীবনে আনো নি। কিন্তু এখন যখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে তখন তুমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছ। তোমার খেয়াল রাখার মতো কেউই নেই। তাই আমি চাই, এই শেষ বয়সে তোমার পাশে কেউ থাকুক বন্ধু হয়ে।’
অক্ষর মুগ্ধতার সাথে মধুজার দিকে তাকায়। মধুজাকে আজ নতুনভাবে আবিষ্কার করল সে। নিজের বাবার জন্য যে কেউ এভাবে ভাবতে পারে সেটা মধুজাকে না দেখে বোঝা যায়না।
মিলন হাসান বেশ রেগেই বলেন,
‘তোকে আমার কথা এত ভাবতে হবে না। আমি একাই ঠিক আছি। এতগুলো বছর যখন একা কা’টাতে পেরেছি তখন বাকি দিনগুলোও একাই থাকব।’
‘আব্বু, আমি কিন্তু তোমার কথা শুনে বিয়ে করেছি। তোমাকেও আমার কথা শুনতে হবে।’
‘আমি তোমার আব্বু তুমি আমার আম্মু নও। তাই প্রথম আর শেষবারের মতো বলছি এই নিয়ে যেন আর কোন কথা না ওঠে।’
মিলন হাসান উঠে নিজের রুমে চলে যান। বর্ণও নিজের মতো চলে যায়। শুধু অক্ষর আর মধুজাই সেখানে থেকে যায়। মধুজার চোখে জল। সে তো নিজের বাবার কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তার বাবা কিছু বুঝতে চাইছে না।
অক্ষর মধুজার পাশে এসে তার মাথায় হাত রাখে। মধুজা কাদো কাদো গলায় বলে,
‘আমি কি কোন ভুল কথা বলেছি পাগলা ডাক্তার?’
‘না হানি। তুমি কোন ভুল কথা বলোনি। সত্যিই তো একটা মানুষ এভাবে একা থাকতে পারে না। শেষ বয়সে তার একজন ভরসায় প্রয়োজন।’
‘তাহলে আব্বু কেন এরকম রিয়্যাক্ট করল?’
‘উনি হয়তো বুঝতে পারেন নি ব্যাপারটা। তুমি আর এই ব্যাপারটা নিয়ে মন খারাপ করে থেকো না।’
‘আমি আব্বুর বিয়ে দিয়েই দম নেবো, আর আব্বুকে রাজিও করাব। আমার ডিশিসন ফাইনাল।’
‘আচ্ছা এখন রুমে চলো। এখানে বসে থেকে তো কোন লাভ নেই। রুমে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবো কি করবে।’
১৯.
মধুজা আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কাউকে কিছু না জানিয়েই কোথাও চলে গেছে। অক্ষর তাকে খুজে খুজে পুরো হয়রান। গতকাল রাতে অক্ষর খেয়াল করেছিল মধুজা কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন। হয়তো নিজের বাবার কথা ভাবছে এটা ভেবে সে আর কিছু বলে নি। কিন্তু আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মধুজাকে নিজের পাশে দেখতে না পেয়ে অক্ষরের খটকা লাগে। মধুজা নিজের ফোনটাও বালিশের তলায় রেখে গেছে। সবমিলিয়ে খুব চিন্তায় আছে সবাই।
মিলন হাসান তো ভাবছেন তার মেয়ে অভিমান করে আবার কোথাও চলে গেল নাকি। এদিকে অক্ষরের হাসপাতালে যাওয়ার সময়ও প্রায় হয়ে এসেছে। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে আছে।
অক্ষর হাসপাতালের উদ্দ্যেশ্যে যাওয়ার সময়ই মধুজা বাড়িতে প্রবেশ করে। মধুজাকে দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। অক্ষর রক্তিম চোখে মধুজার দিকে তাকায়।
‘কোথায় ছিলে তুমি? মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে কি খুব ভালো লাগে? জানো সকাল থেকে তোমাকে খুজতে খুজতে আমি কতটা হয়রান হয়ে গেছি।’
‘আমি একটা জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। আপনাকে আর হয়রান হতে হবে না। বর্ণকে ডাকুন, আজই আমরা বাড়িতে ফিরে যাবো।’
মিলন হাসান অবাক হয়ে বলেন,
‘আজকে যাবি মানে কি? তোদের তো দুইদিন থাকার কথা।’
‘না আব্বু আমি আর এখানে থাকব না। একেবারে তখনই ফিরব যখন তুমি বিয়ে করতে রাজি হবে। তার আগে নয়।’
‘তুই কিন্তু এবার বেশিই জেদ করে ফেলছিস মধু। আমি বলেছি তো, এই বয়সে বিয়ে করে সমাজের লোক হাসাতে পারব না। তাছাড়া আমার মনে এখনো তোর মা রয়েছে।’
‘সমাজের লোকের কথা বাদ দাও তো আব্বু। সমাজের লোক ওমন কথা বলেই। তাছাড়া আমি তো কোন যুবতী মেয়েকে তোমায় বিয়ে করতে বলছি না৷ মাঝবয়েসী কাউকে বিয়ে করো। আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। আমি জানি তুমি আম্মুকে অনেক ভালোবাসো। আম্মুর যায়গা কাউকে দিতে হবে না। তোমাকে যাতে এই শে’ষ বয়সে নিঃসঙ্গ থাকতে না হয় সেই জন্যই তো আমি বলছি বিয়ের কথা।’
মিলন হাসান কোন কথা না বলে নিজের রুমে চলে যান। মধুজা বলে,
‘আমি তোমাকে রাজি করাবোই আব্বু। তুমি চিন্তা করো না। তুমি বাবা হিসেবে যেমন নিজের সব দায়িত্ব পালন করেছ, আমিও তেমনি তোমার জীবনটা গুছিয়ে দিয়ে তোমার সন্তানের দায়িত্ব পালন করব।’
অক্ষর নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। বর্ণকে ডেকে নিয়ে আসছি তুমি তৈরি হয়ে নাও।’
‘আচ্ছা। আপনি যান গিয়ে বর্ণকে ডেকে আনুন। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’
২০.
বাড়িতে পৌছে কম্পিউটার বের করে কিছু জরুরি কাজ করছে মধুজা। অক্ষর তাদেরকে পৌছে দিয়েই হাসপাতালে চলে গেছে। বর্ণ অক্ষরের কথামতো নিজের মা-বাবার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে। অনীল চৌধুরী ক্ষমা করে দিলেও মমতা চৌধুরী এবিষয়ে কিছু বলেন নি। শুধু বলেছেন,
‘তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি তোর জন্য খাবার আনছি।’
মায়েরা হয়তো এমনই হয়। তাদের সন্তানকে ক্ষমা করার প্রয়োজন হয় না। কারণ তারা সন্তানদের উপর কখনো রেগে থাকতেই পারেন না। সন্তান যেমনই হোক, মায়েরা তাদের কথা সবসময় চিন্তা করেন।
মধুজা এসব কথা ভেবে মৃদু হাসে৷ আজ তারও নিজের মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। মধুজার মা’য়ের সাথে কা’টানো কোন মুহুর্ত ঠিকভাবে মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে তার মা তাকে খুব আদর করত। মধুজা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কম্পিউটারে নিজের কাজে মন দেয়।
একটু পরেই তৈরি হয়ে নেয় বাইরে যাওয়ার জন্য। নিচে এসে দেখে মমতা চৌধুরী শোফায় বসে টিভিতে নিউজ দেখছেন। মধুজা মমতা চৌধুরীর কাছে এসে বলে,
‘আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।’
‘কেন?’
‘আসলে আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। জবের জন্য।’
‘ও আচ্ছা। বেস্ট অব লাক। তোমার জবটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আমি তোমার জন্য দোয়া করি। আল্লাহর নাম নিয়ে ইন্টারভিউ দিবে৷’
‘আচ্ছা।’
মধুজা মমতা চৌধুরীর ব্যবহার দেখে সত্যি মুগ্ধ না হয়ে পারে না। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের কাছে শাশুড়ির ব্যাপারে যেমন কথা শুনেছে মমতা চৌধুরী একদমই তার ব্যতিক্রম। এমন মানুষের জন্য মন থেকে শ্রদ্ধা চলে আসে। মধুজা মমতা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হেসে চলে যায়।
✨
রাতে বাড়ি ফেরার সময় অক্ষর লক্ষ্য করে কেউ তার পিছু করছে। ব্যাপারটা নিয়ে অক্ষরের বেশ খটকা লাগে। সে গ্যারেজে গাড়ি রেখে এসে বাড়ির দিকে হাটা ধরতেই নিজের পেছনে একটি ছায়া লক্ষ্য করে। কিন্তু পিছনে ফিরে কাউকেই দেখতে পায়না। তবে তার বারবার মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিচ্ছে।
অক্ষর একপ্রকার তাড়াহুড়োর মধ্যেই নিজের রুমে চলে আসে। রুমে এসে দেখে মধুজা খুশি মনে ফোন টিপছে। মধুজার এত খুশি দেখে অক্ষর বলে,
‘কি হয়েছে? এত খুশি কেন তুমি?’
‘আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে তাই। জানেন এখন আমি একজন জার্নালিস্ট। তাও আবার প্রথম আলো সংবাদপত্রের জার্নালিস্ট। ভাবতে পারছেন?’
‘ওহ, কংগ্রাচুলেশনস।’
‘থ্যাংকস।’
‘বলো কি গিফট চাই তোমার।’
‘গিফট নাহয় পরে চেয়ে নেব।’
‘আমার তো এখনই গিফট দিতে ইচ্ছা করছে। গিফটা বরং এখনই দিয়ে দেই।’
বলেই মধুজার ঠোটে ভালোবাসার পরশ লাগিয়ে দেয় অক্ষর। মধুজা বিড়বিড় করে বলে,
‘পাগলা ডাক্তার চুমু না খেয়ে বাচতে পারে না। চুমু যেন ওনার কাছে অক্সিজেন।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨