#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩.
দিনগুলো চলে গেল চোখের পলকেই। আর দু’দিন পর থেকে মোহনার ফাইনাল পরীক্ষা। এই কয়দিন সে খুব পড়েছে। ভার্সিটিতে খুব প্রয়োজন ছাড়া যায়নি। এশা আর রাফাতের সাথেও এখন খুব একটা কথা হয় না। তবে এই কয়দিন সে প্রায় রোজ বিকেলেই ছাদে যেত। আর ঠিক রোজ বিকেলেই লরিন বাড়ির ওপাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোহনাকে দেখত। মাঝে মধ্যে ইশারা দিয়ে মাহিয়ার সাথে কথা বলত। লরিন এর মাঝে অনেকবার চেয়েছিল, মোহনার বাবার কাছে তাদের বিয়ের কথা বলার জন্য। কিন্তু, মোহনা তাকে বারণ করে বলেছে, সামনে তার পরীক্ষা এখন বিয়ের কথা বললে বাবা তার উপর ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন দুশ্চিন্তায় তার পরীক্ষা খারাপ হবে। মোহনার কথা রাখার জন্য আপাতত লরিনও চুপ রয়েছে। ঐদিকে অরূপের তরফ থেকেও কোনো পজিটিভ রিপ্লাই আসেনি, এই নিয়ে মোহনাও এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। সে ভেবেই নিয়েছে, অরূপ হয়তো আর এই বিয়েতে রাজিই হবে না।
আজ বিকেলে হুট করেই এশা মোহনাকে কল করে। প্রথমে মোহনা কল রিসিভ করেনা। কিন্তু এশার লাগাতার কলে মোহনা পরে বাধ্য হয় কল রিসিভ করতে। আর কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করে। এমন ভাবে কাঁদছে যেন তাকে কেউ মেরে ফেলছে। তার অমন কান্নার স্বর শোনে মোহনাও হতভম্ব হয়ে পড়ে। ভয়ও পেয়ে যায় খুব। অস্থির গলায় বলতে থাকে,
‘কী হয়েছে, এশা? এভাবে কাঁদছিস কেন?’
এশার কান্না থামছে না। মোহনা আরো বেশি বিচলিত হয়ে উঠছে। প্রায় দুই সপ্তাহ পর এশা তাকে আজ কল করেছে। হঠাৎ এমন কী হলো যে মেয়েটা কল দিয়ে এভাবে কাঁদছে। মোহনা বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। উদ্বিগ্ন সুরে আবারও বলে,
‘কিরে, বলনা কী হয়েছে?’
এশা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,
‘তুই আমাকে কবে ক্ষমা করবি? আমি যে আর এভাবে থাকতে পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, দোস্ত। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দে।’
মোহনা কপালে ভাঁজ পড়ে। এর জন্য এশা এভাবে মরা কান্না কাঁদছিল? মোহনার রাগ হলো। সে ক্ষেপে গিয়ে বলল,
‘এর জন্য তুই এভাবে কাঁদছিলি? আর আমার এইদিকে বুকে মোচড় দিয়েছে ভয়ে। এর জন্য তুই এমন মরার মতো কাঁদছিলি কেন, আশ্চর্য?’
‘তুই আমার সাথে আর কত রাগ করে থাকবি? কতদিন তোকে দেখি না। লরিনের কাছ থেকে খবর নিই। ও তো তোকে প্রায়ই ছাদে দেখে, পরে আমাকে কল করে সব বলে। কিন্তু তাও তোর সাথে কথা বলতে না পারার আক্ষেপ টা তো আমার থেকেই যায়। আমি মানছি আমি ভুল করেছি, অনেক বড়ো ভুল করেছি। কিন্তু তুই আর আমাকে এভাবে শাস্তি দিস না প্লিজ। আমার এখন খুব কষ্ট হয়। তুই ছাড়া আমাকে কে বোঝে বল? কত কথা জমে আছে, কিন্তু বলার মানুষ নেই। একটু দয়া কর দোস্ত, প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দে।’
মোহনা যেন বাকরুদ্ধ। মন বলছে এক কথা আর মস্তিষ্ক বলছে আরেক কথা। এখন তো আর রাগ নয়, অভিমান হচ্ছে। কিন্তু, মেয়েটার এত আকুতি মিনুতির কাছে সে তো এই অভিমানটাকেও ধরে রাখতে পারছে না। কী করবে এখন? ক্ষমা করে দিবে এশাকে?
মোহনার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এশা আবারও কাঁদতে আরম্ভ করল। মোহনা এবার বিরক্ত গলায় বলল,
‘থামবি। তখন থেকে তোর ব্যা ব্যা শুনতে শুনতে এখন আমার মাথা ব্যথা করছে।’
এশা নাক টেনে জবাবে বলল,
‘তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দে।’
হ্যাঁ, ক্ষমা করা যায়। ক্ষমা মহৎ গুণ, ক্ষমা করলে কেউ ছোট হয় না। তবে মাঝেমধ্যে অভিমানের পাল্লা এত ভারি হয় যে ক্ষমা করতে গেলেও কয়েকবার ভাবা লাগে।
এশা ফ্যাচফ্যাচ করে বলল,
‘ক্ষমা করবি না, মোহনা?’
এশার এমন সুরে মোহনা আর নিজেকে কঠোর রাখতে পারল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘তোর সাথে কথা বলতে না পারলে আমার নিজেরও শান্তি লাগে না। কষ্ট তো আমারও হয়। তবে যখনই ঐ কথাগুলো মনে পড়ে তখন তোর উপর থেকে রাগটা আর ফেলতে পারি না। মনে হয় আর কখনোই কথা না বলি। কিন্তু, একটু পরেই আবার তোর কথা মনে পড়ে। তোদের দেখি না কতদিন। খারাপ তো আমারও খুব লাগছে। কিন্তু, মনের অভিমানের কাছে সেই খারাপ লাগা আর টিকতে পারছে না। তবে আমিও আর পারছি না। অনেক হয়েছে এই মান অভিমান। রাগ পুষে রাখতে রাখতে মন ভার হয়ে উঠেছে। আর পারব না। ক্ষমা করে দিয়েছি তোকে। তবে এরপর যদি কোনোদিন এমন কিছু করেছিস তাহলে আর জীবনেও ক্ষমা পাবি না।’
এশা অস্থির হয়ে বলতে লাগল,
‘না না, আর জীবনেও আমি এই ভুল করব না। এই তওবা কাটালাম। এখন একটু কষ্ট করে দরজাটা এসে খোল।’
মোহনা অবাক হয়ে বলল,
‘দরছা খুলব মানে? তুই কি বাইরে?’
‘হ্যাঁ, তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি এসে দরজা খোল।’
মোহনা কল কেটে দরজার কাছে ছুটে গেল। দরজা খুলে দেখল সত্যি সত্যিই এশা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে। এতক্ষণ সে তাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কেঁদেছে? মোহনাকে দেখে এশা ঝাপটে জড়িয়ে ধরে, যেন কত বছর পর দেখা। মোহনাও আর সংশয় না করে এশাকে জড়িয়ে ধরে। ভেতর থেকে তখন মাহিয়াও দরজার সামনে আসে। দুই বান্ধবীর ভালোবাসা দেখে সে খুশিতে হাত তালি দিতে থাকে।
এশা আসার কিছুক্ষণ পর মোহনা রাফাতকেও কল করে আসতে বলে। কতদিন পর ওরা তিন বন্ধু এক হয়েছে, কতদিন পর আবার একটু মন খুলে হেসেছে ওরা। সেই আগের মতো, হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের পিঠে দুই চারটা চড় মেরে দেওয়ার প্রকোপটাও এখনো রয়েছে। যেন কয়েকদিনের জমানো কথা শতশত বছরের জমানো কথার সমান হয়েছে। আজ সেগুলো মন খুলে বলে তবেই মন হালকা হলো তাদের।
মোহনার হাতে কফি খেয়ে তবেই এশা আর রাফাত বাড়ি ফিরল। মোহনার আজ আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে আজ যেন আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। বন্ধুত্ব সুন্দর জিনিস। তবে যদি সেখানে স্বার্থ চলে আসে তবে সেই সুন্দর জিনিসটাই কুৎসিত হতে বেশি সময় লাগে না।
রাতে বাবার সাথে ফোনে কথা বলে মোহনা আবার গিয়ে পড়তে বসে। মা আর তার ছোটবোন শুয়ে পড়েছে । মোহনা একাই তখন তার রুমে পড়ছিল। তখন আচমকাই তার ফোনে ভো ভো শব্দ হয়। এমন নিস্তব্ধ পরিবেশে এই ভো ভো শব্দেই মোহনা যেন আঁতকে উঠে। সে তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, “লরিন”। এই ছেলেটা এমন হুটহাট করে কেন কল দেয় কে জানে। মোহনা কল রিসিভ করে। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, এত রাতে কল দিয়েছেন কেন?’
‘একটু বেলকনিতে আসবে?’
মোহনার ভ্রু কুঁচকে যায়। তার জানা মতে লরিন তো আজ তার বাড়িতে। এশা তো তাই বলল। তাহলে সে এখন হঠাৎ মোহনাকে বেলকনিতে যেতে বলছে কেন? মোহনা বলল,
‘কেন, বেলকনিতে গিয়ে কী হবে?’
‘আসলে, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।’
‘আপনি কি এখানে? আপনি না আপনার বাড়িতে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, ছিলাম। তবে কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছি। জানতো, হুট করেই না তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। মানে যেই সেই মনে পড়ে না, মনে হচ্ছিল এক্ষণ যদি তোমাকে একবার না দেখি তাহলে হয়তো মরে যাব। আশ্চর্য, আমি কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিলাম না, কেমন যেন করছিল। দাদা দাদু কোনোভাবেই এত রাতে আসার জন্য দিচ্ছিলেন না। তবে আমি তো আমার মনের সাথে পারছিলামই না। এত বুঝিয়েও লাভ হয়নি। মন বলেছে সে মোহনাকে দেখবে, মানে দেখবেই। কী আর করব বলো, মনের এত জোরালো আন্দোলন আমি কীভাবে ফেলব? তাই চলে এলাম। এখন একবার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তোমার মুখদর্শন করার সৌভাগ্য আমাকে পেতে দাও প্লিজ।’
মোহনা মাথা চাপড়ে হতাশ হয়ে পড়ল। না জানি ছেলেটা তার এই কঠিন প্রেমরোগে কবে মারা পড়ে। প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ এত পাগলামী করে? তাহলে তো প্রেম ভয়ানক জিনিস, আর যাই হোক এই প্রেমে পড়া যাবে না।
কিন্তু মোহনা যতই সতর্ক থাকুক না কেন, সে নিজেও জানে লরিন তার প্রেম ভাইরাস দিয়ে ঠিকই তাকে সংক্রমিত করবে। আর তার প্রসেস হয়তো এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে।
চলবে…