#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩.
‘ছেলেটা কে আপু, বলো না?’
‘উফফ, আমি কী করে জানব ছেলেটা কে?’
মাহিয়া বেলকনিতে গিয়ে আরো একবার উঁকি দিয়ে বলল,
‘ছেলেটা এখনো ঐ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিছু তো একটা ব্যাপার অবশ্যই আছে। এমনি এমনি একটা বিদেশি ছেলে আমাদের বাসার সামনে কেন দাঁড়িয়ে থাকবে? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে।’
মোহনা বিপদে পড়ল যেন। সে উপায়ান্তর না পেয়ে জলদি সেই ছেলেকে মেসেজ দিল। ছেলেটাকে মেসেজে বলল সেখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু ঐ ভদ্রলোক মোহনা কে উল্টো বলল, বেলকনিতে এসে তার সাথে দেখা করার জন্য। মোহনা সঙ্গে সঙ্গে তাকে রাগের ইমুজি পাঠিয়ে রাগি রাগি ভাবে বলল, সে যেন এক্ষুণি এখান থেকে চলে যায়, নয়তো কাল কোনোভাবেই সে তার দেখা পাবে না। ছেলেটা মুচকি হাসির ইমুজি পাঠিয়ে মোহনাকে রিপ্লাই এ বলল, সে এখনই চলে যাচ্ছে। আর বলল, তার ছোট বোনও তার মতোই কিউট। মোহনা রেগে গেলেও সেই মেসেজের আর কোনো রিপ্লাই দিল না।
মাহিয়া সেই সময়ে বেলকনি থেকে ছুটে এসে বলল,
‘এই আপু, ছেলেটা চলে যাচ্ছে। আর জানো, যাওয়ার আগে আমাকে হাত নাড়িয়ে বাই বলেছে।’
মোহনা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
‘এখন তাহলে খুশিতে মরে যা। দেশটা তাহলে একটু দূষণ মুক্ত হবে। তোর এই পকরপকরে দেশে শব্দ দূষণ খুব বাড়ছে। মরে টরে গেলে অন্তত এই শব্দ দূষণ টা তো কমবে।’
মোহনার কথাকে পাত্তা না দিয়ে মাহিয়া দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘এত সহজেই মরে গেলে তোমার কী হবে? তোমাকে তখন কে জ্বালাবে? তোমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে তবেই আমি মরব, এর আগে না।’
মোহনা জবাব না দিয়ে ফোন টিপতে লাগল। মাহিয়া মোহনার পাশে গিয়ে বসে খুব গম্ভীর সুরে বলল,
‘তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছো আপু?’
মোহনা মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে মাহিয়ার দিকে তাকাল। বলল,
‘আমি আবার কী লুকাবো?’
‘সত্যি করে বলো, কিছু লুকাচ্ছো না।’
‘আরে না বাবা, সত্যিই কিছু লুকাচ্ছি না।’
মাহিয়া শান্ত হয়ে বসল। মোহনা মনে মনে ভাবল, এই মেয়েকে সবকিছু বলা যাবে না। যা ঠোঁটকাটা মেয়ে, পেটের ভেতর কিচ্ছু থাকে না। আপাতত তাই ওর কাছ থেকে সবকিছু লুকিয়ে যাওয়ায় শ্রেয়।
রাতের খাবার শেষ করে রুমে এল মাহিয়া। মোহনার খাবার তখনও শেষ হয়নি। মাহিয়া এসে মোহনার ফোনটা নিয়ে বারান্দায় যায়। লক স্ক্রিন খুলতেই দেখে কারোর একটা মেসেজ। সচরাচর সে বোনের মেসেজ চেক করে না। ফোন নিয়ে কেবল গেইম খেলে। আজ হঠাৎ মেসেজ টা দেখে তার মন আঁকুপাঁকু করল মেসেজ প্রদানের মালিকটাকে দেখার জন্য। সে মেসেঞ্জার ওপেন করে। চ্যাট লিস্টের প্রথমেই একজন ব্যক্তির মেসেজ। যার আইডির নাম ছিল “ডানিয়েল লরিন”। এমন নাম দেখে কিছুটা বিস্মিত হলো সে। সে লোকটার মেসেজ সিন করল। মেসেজে লেখা ছিল, “কী করছো?” বাংলা মেসেজ। কিন্তু ছেলেটার নাম দেখে মোটেও এই দেশি ছেলে মনে হচ্ছে না। মাহিয়া তার প্রোফাইলে ঢুকল। বেশি কষ্ট করতে হলো না তাকে, প্রোফাইলের ছবি দেখেই সে চিনে ফেলল ছেলেটা কে। আঁতকে উঠল যেন। তার থেকেও অনেক বেশি কষ্ট পেল। তার বোন তাকে এত বড়ো মিথ্যে বলেছে, এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারল না। ফোনটা গিয়ে আবার সে জায়গায় রেখে আসল। মনে মনে পণ করল, মোহনার সাথে আর কথা বলবে না সে, কখনোই না।
মোহনা খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে এসে দেখল মাহিয়া শুয়ে পড়েছে। মোহনা অবাক হলো। এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার মেয়ে তো মাহিয়া না। কিছু আবার হলো নাকি?
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে মোহনাও মাহিয়ার পাশে গিয়ে শু’লো। পেছন থেকে একটু উঁকি দিয়ে দেখল, মাহিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা। চোখের পাতা বন্ধ। কোনো সাড়া শব্দ নেই। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মোহনা ফোন নিয়ে ফেইসবুকে ঢুকল। কিছুক্ষণ স্ক্রল করে এটা ওটা দেখে ফোনটা রেখে দেওয়ার সময়ই আরেকটা মেসেজ এল। মোহনা চেক করে দেখল, লরিনের আইডি থেকে। সে মেসেঞ্জারে গিয়ে দেখল, লরিন এর আগেও মেসেজ দিয়েছে। সে অবাক হলো এটা দেখে যে সেই মেসেজটা আগে থেকেই সিন করা। আরো অবাক হলো সেই মেসেজটা দেখে কারণ সেটা আবার বাংলা ফন্টে লেখা ছিল। ছেলেটা বাংলায় মেসেজ দিল কী করে? ওর তো বাংলা পাড়ার কথা না। মোহনা তখন রিপ্লাই এ লিখল,
‘How do you write in Bengali?’
সাথে সাথে উত্তর এল,
‘By the help of Google.’
মোহনা সিন করেও আর উত্তর দিল না। ছেলেটা আবার বাংলায় মেসেজ দিল,
‘শুয়ে পড়েছ?’
মোহনা ভ্রু কুঁচকাল। সে কিছু লেখার আগেই তার বোন পাশ থেকে খিটখিটিয়ে উঠে বলল,
‘লাইট অফ করছ না কেন?’
মোহনার তার দিকে চেয়ে বলল,
‘তুই এখনো ঘুমাসনি?’
‘না, জেগে জেগে তোমার প্রেম দেখছিলাম।’
‘কী?’
মোহনা চেঁচিয়ে উঠল। মাহিয়া তখন শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
‘এখন চেঁচাচ্ছো কেন? আমি কি মিথ্যে বলছি নাকি? তুমি ঐ বিদেশির সাথে প্রেম করছ না? আমায় তুমি মিথ্যে বললে কেন?’
মোহনা অসহায়ের মতো মুখ করে চেয়ে আছে। কিন্তু মাহিয়ার তার সেই অসহায়ত্বের উপর মায়া হলো না। সে পুনরায় গর্জে উঠে বলল,
‘আমি তো তোমার কেউ না, তাই না? আমার কাছে তুমি কিচ্ছু শেয়ার করতে চাও না। অথচ আমি তোমায় সব বলি। আজ থেকে আমিও তোমায় আর কিছু বলবো না। যাও, তোমার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই।’
বলে আবার সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মোহনার মনে হলো, সত্যিই বাচ্চা মেয়েটা হয়তো কষ্ট পেয়েছে। তাকেও এখন সব কিছু বলতে হবে।
আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে মোহনা ছোট বোনকে মানিয়ে টানিয়ে তার কাছে সব কিছু শেয়ার করল। মাহিয়া সব শুনে খুশিতে হাত তালি দিয়ে বলল,
‘উফফ, কত ভালো। আমি তাহলে বিদেশি দুলাভাই পাবো।’
মোহনা রেগে গিয়ে বলল,
‘এইজন্যই তোকে কিছু বলি না। বুঝিস কম, লাফাস বেশি।’
মাহিয়া হাসি থামিয়ে বলল,
‘ছেলেটা হ্যান্ডসাম আছে, তোমার পছন্দ না হলে আমাকে একটা সুযোগ দিতে পারো।’
মোহনা উগ্র কন্ঠে বলল,
‘খালি সুযোগ না, ধরে বিয়ে দিয়ে দিব অসভ্য মেয়ে।’
__________________________
পরদিন সকাল সকালই মোহনা ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় এশাকেও তার রিক্সায় তুলে নেয়। ঘড়িতে তখন আটটা বাজে। সময় বাড়ার সাথে সাথে মোহনার টেনশনও বাড়ছে। এগারোটা বাজলেই তাকে ঐ ছেলের সাথে দেখা করতে হবে। আদৌ সে তাকে বোঝাতে পারবে কিনা সেটা নিয়েই সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। এশা তাকে শান্ত থাকতে বলল। বলল, সবাই মিলে ঠিক ম্যানেজ করে ফেলবে।
রিক্সা থেকে তারা নামতেই এক দল ছেলে মেয়ে এসে তাদের ঘেরা দিয়ে ধরল। তার মধ্যে থেকে একটা মেয়ে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘আল্লাহ, আমি তো এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না মোহনা। ঐ বিদেশি ছেলেটা তোর জন্য তার দেশে চলে এলো । তুই কত লাকি রে। একটা ছেলে তোর জন্য নিজের দেশ ছেড়ে এখানে চলে এসেছে, এটা কত বড়ো ব্যাপার তুই ভেবে দেখেছিস?’
মোহনা রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘মাত্র তোরা এই কয়জন এসেছিস, আমি তো ভাবলাম তোরা পুরো ডিপার্টমেন্ট এসে হাজির হবি। এত বড়ো একটা নিউজ, ইতিমধ্যে বোধ হয় সবার কানেই চলে গিয়েছে তাই না?’
তাদের মধ্যে থেকে একটা অশান্ত টাইপ ছেলে জবাবে বলল,
‘আমরা ছাড়া কেউই কিছু জানে না। এত চিন্তা করিস না। এখন তোর মজনুর খবর বল। ভাবছি সবাই মিলে এমন টাইট দিব যে বেটা বাপ বাপ বলে দেশ ছেড়ে পালাবে।’
‘দেখিস, উল্টো আবার সেই ছেলেই না তোদের টাইট দিয়ে বসে।’
এশার কথা শুনে ছেলেটার মেজাজ চটকে গেল। সে বলল,
‘চিন্তা করিস না মোহনা টিভি, ঐ বিদেশি কে কেনভিন্স করতে না পারলে তোর বদলে এশাকে তার কাছে রেখে আসব।’
এশা ভ্রু কুঁচকে কোনো উত্তর না দিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে ক্লাসের দিকে চলে গেল। মোহনা তখন বিরক্ত গলায় বলল,
‘আহ রাফাত, তুই শুধু শুধুই মেয়েটার পেছনে পড়ে থাকিস।’
‘মেয়েটা যদি আমায় বুঝতো, তাহলে কি আর আমি ওর পেছনে পড়ে থাকতাম বল?’
মোহনার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে রাফাতও সেখান থেকে চলে গেল। এ আর নতুন কিছু না। বন্ধুত্বের মধ্যে যখন ভালোবাসা এসে হানা দেয় তখন এমন মান অভিমানের পর্ব চলতেই থাকে।
চলবে…