অন্ধকারে কেউ অহনার শাড়ির আঁচল ঠিক করে দিল। অহনা কিছু বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ কেউ বলে ওঠে, শাড়ির আঁচল যদি সামলাতে না পারো তাহলে শাড়ি পড়ো কেন? ভালো ভাবে শাড়ি পড়া শিখে নাও।
কথাটি বলেই আগন্তুক চলে যায়। অহনা কিছু বুঝতে পারছিল না। অহনা আজ তার মায়ের সাথে নিজের খালার বড় ছেলের বিয়ে খেতে এসেছে। সেখানেই এই ঘটনা ঘটে গেল। অহনা শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারছিল না, শাড়ির আঁচল বারংবার পড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কেউ তাকে টেনে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে আসল। তারপর শাড়ির আচলে সেপ্টিপিন দিয়ে দিল।
অহনা এর আগে কখনো শাড়ি পড়েনি৷ তাই হয়তো এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবল না অহনা। নিজের মতো বিয়েবাড়িতে ঘোরাঘুরি করছে। হঠাৎ করে তার সাথে ধাক্কা লাগে মুক্তর। মুক্ত হলো বরের ছোট ভাই, মানে খালার ছোট ছেলে। মুক্ত অহনাকে দেখে হেসে বলে, আজ এত সুন্দর করে সেজেছ কেন?
বেশি সাজিনি ঐ একটু তো সাজতেই হবে বিয়েবাড়ি বলে কথা।
তাদের মধ্যে আর কোন কথা হয় না। মুক্ত ফোন টিপতে টিপতে অন্যদিকে চলে যায়। অহনা তার মাকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে তাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না৷ হঠাৎ তার নজর যায় দূরে দাঁড়িয়ে নিজের বোনের সাথে গল্প করছে অহনার মা অহিমা বেগম।
অহনা অহিমা বেগমের কাছে গিয়ে বলে, আম্মু আমি কোন গাড়িতে করে যাব?
অহিমা বেগম বিরক্ত হয়ে বলেন, যেকোন একটা গাড়িতে করে গেলেই হয়। এখন থেকে এত টেনশন করছিস কেন। এখনো অনেক সময় বাকি। এখনো বরই তৈরি হয়নি বিয়ের জন্য আর তুই কিনা কোন গাড়িতে যাবি সেটার চিন্তায় আছিস। একেই বলে, যার বিয়ে তার হুশ নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই।
মুক্তর মা মহিমা বেগম বলেন, মেয়েটাকে এভাবে বলছিস কেন? শোন অহনা তোর যেই গাড়িতে বসতে ইচ্ছা করবে তুই সেই গাড়িতে বসবি। কেউ তোকে আটকাবে না। আর যদি কেউ কিছু বলে তাহলে আমাকে এসে বলবি কেমন?
অহনা মহিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমার খালা না হয়ে আমার মা হলে না কেন বলো তো? তুমি আমার মা হলে কত ভালো হতো। আমাকে কত ভালোবাসো তুমি। আম্মু তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না।
অহিমা বেগম মুখে ভেংচি দিয়ে বলেন, হু, দশ মাস দশ দিন পেটে ধরলাম আমি আর এখন মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি হয়ে গেল। আচ্ছা আমিও দেখব, তোর এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট আসুক। তারপর যদি তুই ঢাকার ভার্সিটিতে চান্স পাস তাহলে তোকে তোর খালার বাড়িতে আমি রেখে যাব। তখন যদি আমাকে ফোন করে কেঁদেকেটে বলিস, আম্মু আমাকে টাঙ্গাইলে নিয়ে যাও। আমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না, তোমার হাতের রান্না খাব। তখন বোঝাবো মজা।
একবার এখানে আসলে আর জীবনেও তোমার কাছে ফিরে যাবোনা দেখে নিও।
বলেই অহনা একটা দৌড়ে চলে যায়। মহিমা বেগম মা-মেয়ের এমন ঝগড়া দেখে না হেসে পারেন না। অহিমা বেগম মুখ ফুলিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে অহনা দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে মুক্তর সাথে ধাক্কা খায়। মুক্ত অহনাকে ধরে ফেলে। মুক্তর সাথে ধাক্কা খেয়ে অহনা বেশ নার্ভাস হয়ে যায়। এটা অবশ্য নতুন কিছু না, বরাবরই মুক্তর কাছে এলে নার্ভাস হয়ে যায় সে। হবে নাই বা কেন? ছোটবেলা থেকে এই গম্ভীর মানুষটার প্রশংসা শুনে বড় হয়েছে। মুক্ত অহনার থেকে মাত্র এক বছরের বড়। তাই সবসময় অহিমা বেগম মুক্তকে দিয়ে অহনাকে খোটা দিতেন। ক্লাস ৫ এ পিএসসি পরীক্ষায় মুক্ত গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল আর অহনা জিপিএ ৫। সেই নিয়ে যে কত কথা শুনতে হয়েছিল অহনাকে। শুধু পিএসসি কেন জেএসসি, এসএসসিতেও কথা শুনতে হয়েছে। এসএসসিতে তো ৪.৮০ পেয়েছিল অহনা। তাই তাকে আরো বেশি কথা শুনতে হয়েছিল তাকে।
যদিও মুক্ত কখনো অহনার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে নি বা রাগ দেখায় নি তবুও মানুষটাকে অকারণে ভয় পেয়েই থাকে অহনা। তবে ছোটবেলায় তাদের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছিল বটে।
সেইসময় তাদের নানু একদিন মজার ছলে বলেছিল, মুক্ত আর অহনাকে একসাথে কত ভালো মানায়। ওদের বিয়ে দিলে খুব ভালো হবে।
তখন অহনা প্রতিবাদ করে বলেছিল, তোমার ওমন ভ্যাবলা টাইপ নাতিকে আমি বিয়ে করব না। আমি কেন আমার থেকে অনেক কম সুন্দরী মেয়েও ওকে বিয়ে করবে না।
তখন মুক্ত বলেছিল, দেখে নিও আমার বউ হবে সবথেকে বেশি সুন্দরী।
অহনার আজও সেই কথা মনে আছে। তবে সে জানে না মুক্ত এখনো এটা মনে রেখেছে কিনা। তবে না মনে রাখলেই সেটা তার জন্য ভালো।
অহনা মুক্তকে পাশ কা’টিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন মুক্ত নিজের ফোনের গ্যালারীতে একটি ছবি বের করে অহনাকে ডাক দেয়। অহনা মুক্তর দিকে তাকালেই মুক্ত একটা মেয়ের ছবি অহনাকে দেখিয়ে বলে, মেয়েটা কেমন সুন্দরী না? এ হলো আমার গার্লফ্রেন্ড। তোমাকে বলেছিলাম না আমার বউ হবে সবথেকে সুন্দরী।
তোমার এখনো মনে আছে সেই কথা মুক্ত ভাইয়া।
মনে থাকবে না কেন? মুক্ত কোন কথা এত সহজে ভোলে না বুঝেছ?
কথাটা বলেই নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে চলে যায়।
এদিকে অহনা ভাবছে অন্য কথা। আসল কথা হলো সেও একজনকে পছন্দ করে। আদিল নামের একটি ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে অহনা। ছেলেটা অহনার সাথেই কলেজে পড়েছে। অনেক চেষ্টা করেও ছেলেটাকে প্রপোজ করতে পারে নি অহনা। তবে কৌশলে তার ফেসবুক আইডি জোগাড় করে নিয়েছে। অহনা অনেক সাধনার পরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে খুব শীঘ্রই আদিলকে ডেকে এনে তাকে প্রপোজ করবে। এরমধ্যে আদিলকে ফেসবুকে একটিভ দেখে তার সাথে ম্যাসেজে কথা বলতে শুরু করে অহনা।
কথা বলতে বলতে সময় কোনদিক দিয়ে চলে যায় সেটা বুঝতেই পারে না অহনা। এদিকে সবাই গাড়িতে উঠে পড়ে। অহনা কোন গাড়িতে উঠে পড়েছে ভেবে অহিমা বেগমও আর তার চিন্তা না করে নিজেও গাড়িতে উঠে পড়ের। সবাই মিলে মেয়ের বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে চলে যায়।
অহনা একা পড়ে থাকে। যখন সে ব্যাপারটা খেয়াল করে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অহনা এবার একপ্রকার কাদো কাদো মুখ করে থাকে। তখনই হঠাৎ মুক্ত পেছন থেকে বাইক নিয়ে আসে।
মুক্তকে দেখে অহনা বলে, তুমি যাওনি?
আমার মাইক্রোতে উঠলে বমি পায় তাই আমি বাইকে করে যাব। তোমার ভাগ্য ভালো আমি এখনো যাইনি। নাহলে আজ আর তোমার বিয়ে খাওয়া হতো না। অনেকক্ষণ দেখছি কার সাথে যেন ম্যাসেজে কথা বলছ। এখন আর বেশি না ভেবে উঠে পড়ো আমার বাইকে। আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।
অহনা খুশি হয়ে উঠে পড়ে বাইকে। মুক্ত বাইক চালাতে শুরু করে। এরপর তাদের মাঝে কোন কথা হয় না। অহনা মুক্তকে ধরতে দ্বিধাবোধ করছিল। তাই মুক্তকে না ধরেই বসেছিল। হঠাৎ করেই রাস্তার পিচে ওঠার কারণে অহনা বাইক থেকে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে খুব ব্যাথা পায় সে। মুক্ত দ্রুত বাইক থামিয়ে বলে, তুমি ঠিক আছো তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছি। উঠছি আমি।
একা একা ওঠার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় অহনা। তখন মুক্তই তাকে টেনে তোলে।মুক্ত অহনাকে বলে, তুমি আমাকে ধরো বসো নি কেন? জানোনা বাইকে কিভাবে বসতে হয়? আগে কি বাইকে উঠো নি নাকি।
না সেটা না আসলে
আচ্ছা ঠিক আছে বুঝেছি। আমি একটা রিক্সা ডেকে দিচ্ছি। আমাকে ধরতে যদি তোমার সংকোচ হয় তাহলে রিক্সায় করে চলে যাও।
মুক্ত একটি রিক্সা ডেকে অহনাকে তুলে দেয়। তারপর নিজে বাইকে করে পিছনে যেতে থাকে।
#চলবে
#পরিপূর্ণতা
#১ম_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী