#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো_২
#পর্বঃ৯
#Jhorna_Islam
কোয়াশার চাদরে মোড়ানো পৌষের ভোর।শীতের আড়মোড়া ভেঙে কাজে যাচ্ছে গায়ের মানুষ।পাখির কুজন শুনতে শুনতে আমি আর দায়ান হাটছি মেঠো পথে।শীত সকালের চেনা দৃশ্য খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি নামাচ্ছে গাছি।শীত মানেইতো খেজুর গাছের মিষ্ট রসের ফলন।
শীতকাল মানেই ভোর নানা ধরনের মুখরোচক খাবারের সমাহার,,,,,
এখন সময় ভোর ৬টার একটু উপরে হবে।অথচ বাইরে কোয়াশার কারণে মনে হচ্ছে এখনো মাঝ রাত ই আছে। সোহা ঘুম থেকে সেই ভোর পাঁচটায় উঠে ফ্রেশ হয়ে গিয়ে দায়ানের দরজা তে ন’ক করে।
দায়ান তখনো ঘুমে বিভোর। সোহা বার কয়েক ন’ক করার পর দায়ান আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে। তারপর কিছু সময় একই ভাবে বিছানায় বসে থাকে।
সোহা আবার দরজায় ন’ক করে।
এবার দায়ান হা’ই তুলতে তুলতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তারপর সামনে তাকিয়ে দেখে সোহা।
একদম পরিপাটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কি হয়েছে সোহা এতো সকাল সকাল? আরামের ঘুমটা ভেঙে দিলা কেনো?
আরে রাখেন আপনার আরামের ঘুম। আরাম করে ঘুমামোর জন্য সারাজীবন পরে আছে বুঝলেন? এমন সকাল আর পাবেন না।
কালকে কি বলেছিলাম ভুলে গেছেন?
কি বলেছিলে?
জানতাম আপনি ভুলে যাবেন।আপনাকে না বললাম যে আজ আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো তারাতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে?
ওহ ভুলে গেছি।
খুব ভালো করেছেন।এখন আমি মনে করিয়ে দিলাম।এখন গিয়ে রেডি হয়ে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি বাইরে আপনার জন্য। তারাতাড়ি আসবেন বেশি টাইম নিবেন না। দশ মিনিট দিলাম।
ওকে।
তারপর দায়ান তৈরি হয়ে আসলে সোহা দায়ানকে নিয়ে বেরিয়ে পরে। বাড়ির কেউ এখনো উঠে নি।সকলেই ঘুম।আরো পরে উঠবে।
রাস্তার পাশে খেজুর গাছ থেকে খেজুরের র’সি নামাচ্ছে গা’ছিরা। কয়েকজন নামাচ্ছে তবে কয়েকজন হয়তো আরো পরে এসে নামাবে।
গ্রাম অঞ্চলের দিকে শীত টা শহুরে থেকে বেশিই পরে।চারদিক কুয়াশা তে ঘেরা। তিন চার হাত দূরের দৃশ্যই কিরকম ঝাপসা। কুয়াশাকে ধোয়ার কু’ন্ড’লী মনে হচ্ছে।
আপনার কি বেশি শীত করছে? হাটতে হাটতেই জানতে চায় সোহা।
নাহ্ করছে তবে তেমন না। শীতের দিন শীত করবে এটাই স্বাভাবিক।
ওয়েট কিছুক্ষনের মধ্যেই আপনারা শীতটা কমিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।
কি করবে?
— “চু’রি।”
— হোয়াট! বলেই চিললিয়ে উঠে দায়ান।
— এই আস্তে এমন চেচামেচি করছেন কেনো? আপনি দেখি চু’রি করার আগেই আমায় গণ ধোলাই খাওয়াবেন।কি সাং’ঘাতিক।। আপনার জন্য চু’রি করবো আর আপনিই কিনা আমায় ধরিয়ে দিবেন?
— চু’রি করবে মানে টা কি? কি বলছো মেয়ে এসব? এসব করার জন্য আমায় সকালে তুমি ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছো? এমন জানলে আমি কখনো আসতামই না।আমার তোমার সাথে দেখা যায় আসাটাই ভুল হয়ে গেছে। আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি তুমি যা ইচ্ছে করো।বলেই ঘুরে দাঁড়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য।
সোহা তারাতাড়ি গিয়ে দায়ানের সামনে হাত দিয়ে আঁটকে দারায়।আরে এমন করছেন কেনো বলুন তো? আমি কি সোনা-রুপা চু’রি করার কথা বলছি নাকি?
সে তুমি যাই চু’রি করো না কেনো চু’রি মি’ন’স চু’রি।
সোহা মুখ ভেংচি কেটে মনে মনে বলে,,, আসছে আমার সাধু পুরুষ রেএএএএ। আর মুখে বলে চুপ থাকুন তো।এটাকে চু’রি বলে না।নিজের গাছ থেকে খেলে কি চু’রি হয়?
“নাহ্”
তো আসুন বলেই দায়ান কে নিয়ে একটা খেজুর গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। খেজুর গাছের মধ্যে র’সির হাঁড়ি ঝুলছে। এখনো চু’ই’য়ে চু’ই’য়ে ফোটায় ফোটায় র’সি হাঁড়ির মাঝে পরছে। এই দৃশ্য টা খুবই মুগ্ধকর।যে নিজের চোখে দেখতে পেরেছে সেই শুধু জানে।
রসির দৃশ্য টা দায়ানের মন কেড়েছে।এতোদিন বইয়ের পাতায় পরে এসেছে। সামনা সামনি এমন দৃশ্য কখনো উপভোগ করা হয় নি। দায়ান যখন খেজুর গাছের দিকে তাকিয়ে আছে সোহা তখন কোমরে ওড়না বেঁধে অর্ধেক গাছে উঠে গেছে।
আরে আরে কি করছো? দেখতে পারতেছো না সকালের কোয়াশায় গাছ কেমন ভিজে আছে? ঐখান থেকে পরলে তোমার কাঠির মতো শরীর আসতো থাকবে?
চুপ করে দেখতে থাকুন কি করি।পরবো না।তবে আপনি পরবেতো পরবেতো করতে থাকলে নিশ্চিত পরবো।
দায়ান আর কিছু বলে না সোহাকে। সোহা খুব সাবধানে গাছ থেকে বাঁধন খুলে র’সির হাঁড়ি টা নিয়ে নিচে নেমে আসে।
তারপর দায়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে নিন এটা দিয়েই খেতে হবে।এখানে গ্লাস পাবো বা।আর চিন্তা করবেন না এটা আমাদেরই গাছ।সো খেতে পারেন।
কেমন এটা খেতে? না মানে,,,আগে কখনো খাইনি তো তাই এই প্রথম বার দেখছিই খাবো কি।
আমি বলবো না নিজেই খেয়ে দেখেন।তারপর বুঝতে পারবেন কেমন।
দায়ান ও হাঁড়ি টা হাতে তুলে নেয়। জীবনে নতুন কিছু টেস্ট করা মন্দ না। তারপর ঢকঢক করে কয়েক ঢোক র’সি পান করে।
সোহা দায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে দায়ানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
“ওমমম ইট’স টু ইয়াম্মি।” আসলেই অনেক ভালো লাগছে খেতে। বলতে বলতে প্রায় অনেক টুকু খেয়ে নেয় দায়ান। তারপর সোহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে এটুকু তুমি খাও। আমি অনেক খেয়ে নিয়েছি।
ওহ্ তাও ভালো মনে আছে দেখা যায় আমার কথা।আমিতো ভাবছি আমার কথা ভুলে আপনি সব একাই খেয়ে নিবেন।বলে নিজেও বাকিটা শেষ করে। এই হাঁড়ি তে এতো বেশি র’সি ছিলোও না।
খাওয়া শেষ করে সোহা আবার হাঁটা দেয়।
এখন আবার কই যাও? বাড়ি যাবা না?
এখনই কিসের বাড়ি? বাড়ির কথা আজ ভুলে যান।জাস্ট এনজয় করুন। বাড়িতে যেতে আরো দেরি আছে।
তারপর সোহা মাঠের মধ্যে নেমে পরে। মাঠে দূর্বা ঘাস দিয়ে ভরপুর। সোহা মাঠে নেমেই জোতা খুলে খালি পায়ে হাঁটতে থাকে।
কি করছো ঠান্ডা লাগলে বুঝবা মেয়ে।
আপনি আপনার ডাক্তার গি’রি আপনার পকেটে ঢুকিয়ে রাখুনতো আজকের জন্য। প্রকৃতি উপভোগ করুন।এবার চুপচাপ জোতা খুলুন কোনো প্রশ্ন করবেন না।
কিন্তু,,,,,,,
কোনো কিন্তু না।
দায়ান অ’গ’ত্তা নিজের পায়ের জোতা খুলতে বাধ্য হয়।
এবার আমার সাথে শিশিরের উপর দিয়ে হাটুন আর ফিল করুন।দেখেন কি ভালো লাগবে!
দায়ান বলে উঠে আসলেই ভালো লাগছে। তারপর দুজন মিলে খালি পায়ে শিশিরের উপর অনেক সময় নিয়ে হাঁটাহাটি করে।এবার এখান থেকে যাওয়া যাক? সোহা বলে।
দায়ান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। দুজন জোতা পরে আবার হাটতে থাকে।
এতোসময় খালি পায়ে শিশিরের মধ্যে হাঁটার জন্য এখন অনেকটাই শীত লাগছে।সূর্য এখনো উঠেনি। সোহা কাঁপতে কাঁপতে বলে,, উফফ মাগো কি শীত।
হুম। চলো বাড়ি ফিরে যাই।
এই একদম না চুপ থাকেন আপনি।বলেই সোহা দৌড়ে একটা বাড়ির ভিতর ঢুকে যায়।
কি হয়ে গেলো দায়ান কিছু বুঝতে পারলো না।মিনিট কয়েক পরই আবার ফিরে আসে।
কি হলো এটা? দৌড়ে ঐ বাড়িতে ঢুকলে কেন?
অনেক শীত করছে তাই এখন শীত নি’বা’ড়ন করবো।
কিভাবে?
দেখতে থাকুন বলেই আশেপাশে তাকয়।পাশেই একটা খ’ড়ে’র পা’ড়া দেখতে পায়।আবার দৌড়ে গিয়ে ওখান থেকে কতোগুলো খ’ড় নিয়ে আসে।তারপর আবার আশেপাশে তাকিয়ে কতোগুলো শুকনো ডাল কুড়িয়ে নিয়ে আসে গাছের নিচ থেকে। তারপর বসে মে’চ নিয়ে খ’ড় দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
এবার আরেকটু পাশে এসে দাড়িয়ে আগুন পো’হা’ন কিছু সময় ঠান্ডা দেখবেন চলে যাবে। দায়ান কথা বাড়ায় না বিষয় গুলো সে উপভোগ করতে থাকে। কিছু সময় আগুন পোহানোর পর বলে উঠে,,, এবার আমরা কোথায় যাবো?
এবার আমরা মিষ্টি মুখ করতে যাবো আসেন আমার সাথে। তারপর একটা বাড়ির ভিতর ঢুকে যায় দায়ান কে নিয়ে।
বাড়িতে ঢুকেই দায়ান দেখতে পায় পাঁচ ছয় জন লোক বড় একটা হাঁড়ি না কি যেনো জ্বা’ল দিচ্ছে আর নাড়ছে।
সোহা এটা কি? কি করছে ওরা এসব?
আমরা যে খেজুরের র’সি খেলাম না?
হুম।
ঐটা এখানে ওরা জ্বাল দিচ্ছে।
কি করবে?
খেজুরের গুড় তৈরি করবে।
ওয়াও! ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
হুম। দেখতে থাকুন।
তারপর একটা ছোট ছেলে দুইটা মোড়া এনে সোহা ও দায়ানকে দেয় বসার জন্য। সোহাকে গ্রামে সকলেই কম বেশি চিনে।লোকটা আখা তে খেজুরের র’সি নাড়তে নাড়তে সোহার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। সোহা ও বিনিময়ে হাসি দেয়।
খেজুরের গুড় তৈরি করতে যতোটা সময় লেগেছিলো পুরোটা সময় দায়ান একটা কথা ও বলেনি।চুপচাপ সব দেখেছো উপভোগ করেছে।সময় কতো হলো কারো সেই দিকে খেয়াল নেই। কয়েক ঘন্টা যে পার হয়ে গেছে এখানে বসে দায়ানের ধারণা ও নেই।
তারপর সোহা ও দায়ান কে গুড় এনে দেয় খাওয়ার জন্য। দায়ান মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।ভেজাল মুক্ত খাঁটি গুড় এর মজাইতো আলাদা।তার উপর কি সুন্দর একটা ঘ্রাণ আসছে। এর মধ্যে একটা মহিলা প্লেটে করে ভাপা পিঠা নিয়ে আসে।
আরে ভাবি এসব কখন করল? সোহা জানতে চায় মহিলাটার থেকে।
এখনই ননদিনী নতুন মানুষ নিয়ে আসছো।নতুন চালের খেজুরের গুড় দিয়ে পিঠা খাওয়াও।বলেই মহিলা ভিতরে চলে যায়।
সোহা দায়ানকে পিঠার প্লেট টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে নিন খান,,,আমি নিশ্চিত এতোক্ষন যা যা খেয়েছেন তার থেকে সবচাইতে বেস্ট হবে পিঠার টেস্ট। খেয়েই দেখুন।
দায়ান পিঠা নিয়ে খেতে থাকে। কোনো কথা বলেনি চুপচাপ তিনটি ভাপা পিঠা খেয়ে নিয়েছে। গ্রামের দিকে সাধারণত বড় বড় ভাপা পিঠা বানায়।শহরের ভাপা পিঠা গ্রামের ভাপা পিঠার কাছে নিতান্তই বাচ্চা।
সোহা বেশ খুশি হয়ে যায় দায়ানের পিঠা খাওয়া দেখে। আর জিজ্ঞেস করেনি কেমন লেগেছে। ভালো লেগেছে বলেই তো তৃপ্তির সাথে খেয়েছে লোকটা।
তারপর দুইজন ই আবার হাটা দেয়।
খেতের আইল ধরে হেঁটে চলেছে দু’জন। সত্যি অসাধারণ,, মাঠ খেত মাটির মিষ্টি গন্ধ হালকা বাতাস মিলেমিশে একাকার,৷,,
কিছু দূর যাওয়ার পরই বাতাসের তীব্র গতিতে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে নাকে বারি খাচ্ছে। দায়ানের খুবই ভালো লাগছে।দায়ান ঘ্রাণ টা পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
এই সোহা এই ঘ্রাণ টা কিসের বলোতো?
সোহা কিছু সময় চুপ থেকে পাশে তাকিয়ে হাসি মুখে বলে এটা? আপনার পাশে তাকান।
দায়ান তাকিয়ে দেখে ধান খেত।তবে ধান গুলোর স্বাভাবিক রং না।দায়ানের জানা মতে ধান হয় সোনালী রং এর, এগুলো কালো। এগুলো কেমন ধান সোহা কালো কালো।
এগুলা কালোজিরে ধান বুঝলেন? এখান থেকেই মিষ্টি সুবাস পাচ্ছেন।তারপর কয়েক টা ধান ছিরে হাতে নিয়ে বলে দেখেন কেমন পোলাও পোলাও গন্ধ আহ্। এগুলো থেকেই পোলার চাউল হয় বুঝলেন?
সোহা তোমায় ধন্যবাদ দেওয়ার ভাসাই আমার নেই।উফফ এখন মনে হচ্ছে গ্রামে না এসে এসব উপভোগ না করতে পারলে অনেক কিছু মিস করে যেতাম।
আজ মনটা আমার প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য ও গ্রামের দৃশ্য দেখে পরিতৃপ্তিতে ভরে গেছে। কি যে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই প্রকৃতি তে আমি ডুবে যাই।
তারপর দুইজন বাড়ির দিকে পা বাড়ায় আজকের জন্য অনেক ঘুরেছে। দায়ান ফুরফুরে মেজাজে হাসি মুখে হেঁটে চলেছে। সোহা দায়ানের আগে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে হাঁটছে।
“ধ’নো ধা’ন্যে পু’ষ্পে ভ’রা আমাদের এই বসুন্ধরা।
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।”
#চলবে,,,,,,,
বিঃদ্রঃ কেমন হলো জানাবেন সকলে।আজ সোহা আর দায়ানের সাথে সকলকেই গ্রামের শীতের সকাল উপভোগ করিয়ে আনালাম। রিচেক করা হয়নি।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।