অমানিশার চাঁদ পর্ব ২

0
1934

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ (লেখিকা)

[ ২ ]

-” বিয়ে হয়ে গেলেও এ মেয়েকে আমি কিছুতেই ঘরে তুলবো না।

একটি কথায় যেনো বিয়ে বাড়ির সবার মাথাতেই বাজ পড়লো। যে বিয়ে দিয়ে দুই বংশের মধ্যে যুগ যুগের শ|ত্রুতা শেষ করতে চেয়েছিলো, সেই বিয়ের মাধ্যমেই আবারো নতুন করে শ|ত্রুতার সূচনা হবে না তো? ইব্রাহিম সিকদার নতমুখে এগিয়ে এলেন। ইতোমধ্যে বিয়ে বাড়িতে গুন গুন আওয়াজ শুরু হয়ে গেছে। ইব্রাহিম সিকদার নতমুখে থেকেই বললেন-

-” দেখুন বেয়াই বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু শুধু ঝামেলা করে লাভ কি?

সৈয়দ তুরাগ ভীষণভাবে রেগে গেলেন। তেতে উঠে গলা উঁচিয়ে বললেন-

-“কেন এমনভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করলেন? আপনি বড় মেয়ে বিয়ে দেয়ার কথা বলে এখন কেন মেজো মেয়েকে গছিয়ে দিলেন?

ইব্রাহিম সিকদার যেনো দিশেহারা হয়ে গেলো। কোন উপায় না পেয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন-

-” বড় মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পুরো বিয়ে বাড়ি এই কথায় নিরব হয়ে গেলো। সৈয়দ তুরাগ শুধু অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলেন। হতভম্ব কন্ঠে বললেন-

-” এ কি অবস্থা আপনার মেয়েদের? এদের শিক্ষার এই দশা। শিক্ষিত বলে আপনার মেয়েকে ঘরে তুলতে চেয়েছি। এই শিক্ষাতেই আপনার মেয়ে বিয়ের দিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে! আর তার বদৌলতে আপনি মেজো মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন? আপনার বড় মেয়ে যখন বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে, আপনার মেজো মেয়ে যে আমার ছেলের সংসার ছেড়ে পালাবেনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? বলি আপনার মেয়েরা শিক্ষিত তাই অনেক ভেবে চিন্তে পুরোনো শ|ত্রুতা শেষ করতে এই বিয়ে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনি তো পুরোনো ঘা তে মলম না লাগিয়ে তা আরো দ|গদগে করে দিলেন।

ইব্রাহিম সিকদার বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। এখন ভালোয় ভালোয় মেয়ে বিদায় দিতে পারলেই বাঁচে যেনো। তাতে বরপক্ষের দু চারটে কথা শুনলে দোষ কি। যখন অপরাধ তার বড় মেয়ে করেছে, কথা তো শুনতেই হবে। এই মেয়েকে আর কখনোই এ বাড়িতে আসতে দেবেনা। মনে মনে সেই প্রতিজ্ঞা করলো ইব্রাহিম সিকদার।

-” আহা বাবা ছাড়ুন তো। হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান হয়? বড় মেয়ে এমন করেছে তাই বলে সব মেয়েরাই কি এমন করবে? আর শ|ত্রুতা কিসের। সব শ|ত্রুতার সমাপ্তি আজ থেকে। ভুলে যান ওসব। কাজ ছিলো বিয়ে করা, কনে বদল হলেও সমস্যা নেই।

সবার মধ্যে থেকে একটা ভরাট পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এলো। উপস্থিত সবাই চাতক পাখির মতো তার দিকে তাকালো। বিয়ের বর এই কথা বলেছে! বরের কথা কারো কাছে ভারী অদ্ভুত ঠেকলো। তবুও কেউ কেউ পুরোদমে সমালোচনা শুরু করলো আবারো। কেউ কেউ স্বান্তনার বাণী শোনাচ্ছে। কেউ কেউ সিকদার বাড়ির বড় মেয়ের সমালোচনায় ব্যস্ত। সৈয়দ তুরাগ ছেলের কথায় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললেন-

-” কিন্তু!

তুরাগ কে চুপ করিয়ে দিয়ে তার ছেলে বলল-

-” বাবা আমি চাইনা আর কোন কথা হোক। এত ঝামেলা করলে আমাদের উভয় বংশের মানহানি হবে। যত শীঘ্রই বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে চলুন। আমাদের সব কাজ তো হয়েই গেছে‌। আপনি খামোখা চিন্তা করছেন! আপনি যা চেয়েছেন আমি তো তা করেছি।

ছেলের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তুরাগ‌। তার ছেলে ঠিক থাকলেই সব ঠিক। আর তাদের যা চাই তা তারা পেয়ে গেছে। এখন ঝোপ বুঝে কো প মা রার অপেক্ষা। হতাশার মাঝেও তুরাগের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাঁসি খেলে গেলো। সে হাঁসি বড্ড রহস্যময়। আড়াল থেকে তা একজনের চোখ এড়ালো না। ইব্রাহিম সিকদারের বুক থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো। আর যাই হোক মেয়ের জামাই তার লাখে একজন। নাহলে কনে বদলেও রা|গারাগী করলো না। সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরিয়া আদায় করলেন মনে মনে। ফুরাত শক্ত হয়ে বসে আছে শুধু। এরা আরো কত নাটক করতে পারে তা সে দেখে ছাড়বে। শ|ত্রুতা মেটানোর এত শখ। আড়ালে কারো কপালে চিন্তার ভাঁজ। সে একমনে ভাবছে বরের বলা কথাগুলো – [ কাজ ছিলো বিয়ে করা কনে বদল হলেও সমস্যা নেই।। আমাদের সব কাজ তো হয়েই গেছে।। আপনি যা চেয়েছেন তা তো আমি করেছি। ] কি বুঝিয়েছে এই কথা দ্বারা। আগন্তুক কথাগুলোর হিসেব মিলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মানে বিয়েতে ছেলের দিকে মতামত নেয়নি সৈয়দ সাহেব!

কনে বিদায় দেয়ার সময় হয়েছে। ইব্রাহিম সিকদার মেয়ের হাত তুলে দিলেন জামাইয়ের হাতে। ফুরাতের সর্বাঙ্গে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। কখনো কেউ স্পর্শ করায় এমন হয়নি। ইব্রাহিম সিকদার অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন-

-” বাবা তোমার হাতে আমার কলিজার টু|করো কে তুলে দিলাম। তুমি ওকে দেখে রেখো। আমার বংশের রত্নের অমর্যাদা করোনা। ওকে সুখে রেখো।

মেয়ের জামাই ও সুন্দর করে শ্বশুরের কথার জবাবে বলল-

-” জ্বী ইনশাআল্লাহ।

-” লোক দেখানো চোখের জল ফেলানো হচ্ছে। বলে কি আবার কলিজার টু|করো। বংশের রত্ন। নিজের বংশের রত্নের অমর্যাদা নিজেই করেছে। অন্য‌ লোকে আর কি করবে। ( মনে মনে কক্ষাট করে কথাগুলো বলল ফুরাত) তার চোখে আজ পানি নেই। বিদায় বেলায় নাকি মেয়েরা না চাইতেও চোখে জল এসে যায়। তার একটুও আসছেনা কেন? আর কাদের জন্যই বা কাঁদবে? যারা নিজেদের বংশ মর্যাদার জন্য তাঁকে ব|লি দিয়েছে? তাচ্ছিল্য করে হাসলো ফুরাত। অনেক কিছু দেখা বাকি তার। ফুরাতের দু চোখ তার মা কে খুঁজছে। কিন্তু তার মা যে ঘরে বসে একা একা কাঁদছে। তাঁর নয়নের মনিকে সে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এই আক্ষেপে সে মেয়ের সামনেও আসছেনা। ফুরাত রাগান্বিত হলো‌। মায়ের কাছেও পর হয়ে গেলো তাহলে। তাকে নিয়ে পালকি তে বসানো হলো। মা কে দেখার জন্য তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো বুজে এলো। তার কোন মূল্যই নেই এই সিকদার বাড়িতে।

_____

আঁকাবাঁকা রাস্তায় ধীরে ধীরে পালকি চলছে। রাত হয়ে গেছে আগেই। একটু পর হয়তো এশারের আযান পড়বে। পালকির ভেতর বসে বসে নিজের জীবনের হিসাব মেলাচ্ছে ফুরাত। সবশেষে কিছুই পেলো না সব শূন্য। মেট্রিকের পর বাবা আর পড়তেও দিলেন না। ( পুনশ্চঃ প্রথম পর্বে আমার কিছুটা ভুল হয়েছে। ওরা দু বোন এসএসসি নয়‌ মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে। এই উপন্যাস টা এখনকার সময়ের না। এটা পুরোনো সময়কার কাহিনী নিয়ে হবে। তখন এসএসসি ছিলো না। আমি দুঃখিত ভূল তথ্য দেয়ার জন্য) জীবনে প্রাপ্তির খাতাটা একেবারে শূন্যতায় ভরা। ফুরাত মনে মনে আবারো আক্ষেপ করে বলল- সিকদার বাড়িতে যেনো কোন মেয়ের জন্ম না হয়। ও বাড়িতে মেয়ের‌ চেয়ে দাসিদের স্বাধীনতা বেশি। ও বাড়ির সম্মান রক্ষায় মেয়েরা যুগ যুগ ধরে ব|লি হয়ে আসছে। তার বোনটা চলে গেছে ভালোই হয়েছে। চারদিক নিরব, নিকষ কালো, এই রাতে কিছু মানুষের পদধ্বনি ভুতুড়ে ট তাকিয়ে থাকতে দেখলো। ফুরাত বিব্রত হয়ে গুটিসুটি মেরে বসলো। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে বেনারসি ঠিকঠাক করে নিলো। বড় বোনের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। যতই হোক ফাবিহা ওকে নিজের চেয়েও ভালোবাসতো। না জানি কার সাথে গিয়েছে! ফুরাতের এসব ভাবনার মাঝেই পালকি থামে। কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দেয় তাকে নামানোর জন্য । হাতটা তার সদ্য বিবাহিত স্বামীর। সত্যিই স্বামী? সে কখনোই এ সম্পর্ক মানবে না। হাতের উপর হাত রাখতেই তখনকার মতো অচেনা অনুভূতি ঘিরে ধরলো। ফুরাত এসবে পাত্তা দিলো না। সে নেমে এলো পালকি থেকে। চারদিকে মানুষের কোলাহল শুনে কিছুটা বিব্রত হলো ফুরাত। তার মুখ ঘোমটার জন্য দেখা যাচ্ছে না। তাহলে মায়েদের ভাষ্যমতে এই সৈয়দ বাড়িই তার আপন নীড়। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ নজর ওয়ালা গম্ভীর লোকটা কে?

#চলবে

(আসসালামুয়ালাইকুম পাঠকমহল আমি দুঃখিত গত পর্বে ভুল তথ্য দেয়ার জন্যে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here