অমানিশার চাঁদ পর্ব ১

0
2505

সবার বড় বোনের বিয়েতে আনন্দ করে, কিন্তু আমি দু হাতে শাড়ি আঁকড়ে ধরে পালাচ্ছি। পেছনে হয়তো এতক্ষনে লোক লেগে গেছে। লোক লাগবেই বা না কেন ইব্রাহিম সিকদারের দুই মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে যে। বড় আপু তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে সিকদার বাড়ির মান সম্মান ডুবিয়ে দিয়ে। এখন সেই মান সম্মান আমাকে দিয়ে রক্ষা করবেন বাবা। তাই বাধ্য হয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। বড় আপু তো চলে গেলো আমায় কোন অথৈ সাগরে ফেলে গেছে। বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়াচ্ছি। এই রাতের আঁধারে আমার পিছে মশাল হাতে ছুটে আসছে গুটি কয়েক মানুষ। খালি পায়ে হঠাৎ কাঁটা ফুটে ওঠে। আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি আমি। আজ বোধহয় আমাকে ব|লি হতে হবে সিকদার বাড়ির মানসম্মান রক্ষার জন্য। দু চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই চারিদিকে মশাল হাতে মানুষজন ঘিরে ধরে। আমার বোধহয় এ জনমে আর পড়াশোনা করা হবে না। তাদের মধ্যে থেকে দুজন মহিলা এগিয়ে এসে আমাকে দাঁড় করায়। ধরে ধরে পেছন দিক থেকে আমাকে বাড়িতে নেয়া হয়। নিজের কক্ষে বসে কেঁপে যাচ্ছি সেই কখন থেকে। বাবা গম্ভির মুখে এসে আমার কক্ষে প্রবেশ করে। তার গম্ভীর মুখ দেখেই আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। মা মেয়ের শোকে বেহুঁশ হয়ে আছে সেই কখন থেকে। বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আচমকা হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়ে। আমি চমকে একটু পিছিয়ে যাই। বাবা আমার দুই হাত তার হাতের মুঠোয় নেয়। আমি ছলছল চোখে বাবার মুখের দিকে তাকালাম। বাবা আমার চোখে চোখ রেখে বলে-

-” মা রে তোর বোন ফাবিহা আমার মান সম্মান এই ডুবিয়ে পালিয়েছে। এই সিকদার বাড়ির সম্মান এখন তোর হাতে। দেখ মা সৈয়দ তুরাগ মশাইয়ের ছেলে খুব ভালো। তাদের বাড়িতে তুই রাজ রানি হয়ে থাকবি। তার এই সমুদয় সম্পত্তির ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী তার ছেলেই। তুই খুব সুখে থাকবি ফুরাত।

আমার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। কক্ষাট করে বললাম-

-” আমার সুখের কথাও আপনি ভাবেন সিকদার মশাই?

বাবা চমকে তাকালেন। তবুও হাল ছাড়লেন না। উপায় না পেয়ে বললেন-

-” তুই যদি বিয়েটা না করিস আমার আ|ত্মহ|ত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। যদি এই বাড়ির মান সম্মান ই না থাকে। আমি থেকে কি করবো?

আমি আঁতকে উঠলাম বাবার কথায়। আমি ফেঁসে গেছি এবার। আর কোন পথ নেই বিয়ে করে নিজেকে ব|লি দেয়া ছাড়া। বাবার হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। কিছুক্ষন ভেবে বললাম –

-” বেশ যখন আপনাদের এই জমিদার বাড়ির সম্মান বড় তাহলে দিলাম নিজেকে ব|লি। যান তবে আমি তৈরি হয়ে আসছি। মা কে পাঠিয়ে দেবেন। আর তীরা আর তুর কেও পাঠিয়ে দিন বিয়ের সকল সাজসামগ্রী নিয়ে। আপনি এখন আসতে পারেন ইব্রাহিম সিকদার।

খুব কক্ষাট করেই শেষের দুটো শব্দ উচ্চারণ করলাম। বাবা হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি তার নাম নেবো আমি বাবা আহত চোখে আমার দিকে তাকালো। আপনি আর তার নাম ধরে বলায় হয়তো অবাক হয়েছে। আমাদের বাবা মেয়ের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। থাকুক তাকিয়ে তাতে আমার কি। সে তো একবারো মেয়েদের কথা ভাবলোনা। আমিও ভাববোনা তার কথা। ধীর পায়ে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। কান্না পাচ্ছে না এখন আর। কিই বা করার আপন বড় বোন বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে, নিজের বাবাও আমায় বুঝলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালাম। মা হন্তদন্ত হয়ে আমার কক্ষে প্রবেশ করলো। আমি একনজর তার দিকে তাকালাম। মা এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল-

-” ফুরাত মা আমার তুই কেন রাজি হয়েছিস? তোকে আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবো না। তুই তোর বাবাকে কেন বিয়ের কথা বললি? জবাব দে ফুরাত?

মা আমার দুই বাহু ধরে জোড়ে চাপ দিলো। ব্যাথা লাগছে তবে তা মনের ব্যাথার কাছে কিছুই না। মায়ের চোখের জল মুছে দিয়ে হালকা হাসলাম। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম-

-” দেখো মা বড় আপু না হয় মান সম্মান চিন্তা না করে পালিয়েছে। এখন আমি বিয়ে না করলে নাকি সিকদার বাড়ির মান সম্মান থাকবেনা। দেখি আমার বাবা কতটা সম্মান রক্ষা করতে পারে আমায় বিয়ে দিয়ে। তাছাড়া ফাতিহা কে দেখে রাখবে। বাবা ওর সাথে যেনো আমাদের দু বোনের মতো অন্যায় না করে। এখন আমাকে তৈরি করে দাও মা।

তাহেরা সিকদার অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের দিকে তাকায়। তার ছোট মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে। দু হাতের আঁজলা ভরে মেয়ের মুখটা তুলে কপালে চুমু দেয়। এর মধ্যে তুর, তীরা আর ফাতিহা ঘরে প্রবেশ করে। তাদের হাতে বিয়ের পোশাক আর গয়নাগাটি। ফুরাত একবার সেগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

ফাবিহা, ফুরাত, ফাতিহা তিন বোন ওরা। ফাতিহা কেবল ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে-

-” মা বড় আপু কোথাও? ফুরাত আপুকে কেন ওরা বউ সাজাচ্ছে? বিয়ে তো ফাবিহা আপুর। ও মা বলো না।

তাহেরার গলা দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না। বয়স ই বা কতো সবে ১৭। সবে এসএসসি পাশ করেছে কমাস হলো। ইব্রাহিম সিকদার খুবই শক্ত মানুষ। কলেজে পড়তে গেলে মেয়ে বেয়ারা হয়ে যাবে তাই আর পড়ায়নি তিনি। ফাবিহা কেও এসএসসি পাশ করার পর পড়ায়নি। ফাবিহা এই আটকা জীবন আর সহ্য করতে পারছিলো না। তাইতো রাতের আঁধারে মিলিয়ে গেলো। কিন্তু ফুরাত চেষ্টা করছিলো কলেজে ভর্তি হওয়ার। এই বিয়ের সাথে সাথে তার‌ কলেজে ভর্তি হওয়ার আশাটাও চাঁপা পড়ে গেলো। মেয়েকে বধুবেশে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন তাহেরা। সব মায়েরই শখ থাকে মেয়েকে বধুবেশে দেখার। কিন্তু এভাবে তিনি কখনো মেয়েকে বিয়ে দিতে চান নি। ফাতিহা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তার বোনের দিকে। শ্যামবরণে লাল রঙের শাড়িতে মন্দ লাগছে না। সারা গায়ে গয়না জ্বলজ্বল করছে। কত বড়ি হবে? ৫, ১০, ১৫ হবে হয়তো জানা নেই ফুরাতের। মেয়েকে পণ দিয়ে ভালো বাড়িতে বিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে তার বাবা। তুর ফুরাত কে দেখে বলে-

-” আফামনি।

ফুরাত অগ্নিচোখে তাকায় তুরের দিকে। তুর ভয়ে ঢোক গিলে। তীরা তুর কে খোঁচা মে’রে চোখ দিয়ে সাবধান করে। তুর ঢোক গিলে বলে-

-” না না ক্ষমা করেন। ম্যাডাম আপনারে অনেক সুন্দর লাগতাছে। এক্কেরে বিউটিপুল।

তীরা, আর ফাহিতা হেসে ওঠে তুরের কথায়। ফুরাত আফামনি ডাক টা শুনতে পারে না তাইতো বাড়ির কাজের লোকদের শিখিয়ে দিয়েছে তাকে ম্যাডাম ডাকতে। আর দুই একটা ইংরেজি ও শিখিয়েছে। তীরা সব আয়ত্ত করে নিয়েছে কিন্তু এই গাধা তুর ইংরেজির বারোটা না বাজিয়ে ছাড়েনা। ফুরাত আর তাহেরা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে তুরের দিকে। তুর অপরাধী চোখে ফুরাতের দিকে তাকিয়ে বলে-

-” আফ সরি ম্যাডাম এমনে তাকাইয়া আছেন কেন?

ফাহিতা হাসতে হাসতে বলে-

-” তুমি বিউটিফুল কে বিউটিপুল বলেছো গাঁধী। তাই তাকিয়ে আছে।

তুর দ্রুত জিভ কা|টে। এই ইংরেজি টা সে ভালোভাবে বলতেই পারেনা। সবসময় ভুল হবেই। ফুরাত এদের কান্ড দেখে হালকা হাসে। মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে যায় এদের ছেড়ে যাবে ভেবে। তখনি নিচ থেকে একজন কাজের লোক এসে বলে কন্যাকে ডাকছে। ফুরাত ভালোমতো ঘোমটা দিয়ে মায়ের হাত ধরে হাঁটা দেয়। তার সাথে তুর, তীরা আর ফাতিহাও নিচে নামতে থাকে। ফাবিহান সেই থেকে বিরক্ত হয়ে বসে আছে। বিয়ে টা তার কাছে একটা জঞ্জাল। কবুল বলে এই প্যারা থেকে বাঁচতে পারলেই হলো। ফাবিহানের ওপাশে এনে ফুরাত কে বসানো হয়। তাদের মধ্যে পাতলা কাপড়ের পর্দা। বউকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। কোনরকম তিন কবুল বলে সে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মেয়ের নাম শুনেই দাঁড়িয়ে যায় সৈয়দ তুরাগ। তার ছেলে এত ধৈর্যহারা কবুল বলেও দিয়েছে। সৈয়দ তুরাগ ক্ষেপে বলে ওঠে-

-” আমার ছেলের বিয়ে তো আপনার বড়কন্যা ফাবিহা নাওয়ার তোয়ার সাথে হওয়ার কথা ছিলো!

#চলবে

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ_লেখিকা
#সূচনাপর্ব

(আসসালামুয়ালাইকুম কেমন আছেন সবাই। নতুন গল্প আশা করি সবার ভালো লাগবে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here