তুমি আমার অভিমান পর্ব ১৮

0
1104

#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ১৮ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

আজ ফাহাদ আর প্রীতির বিয়ে। প্রীতি চাইছে কনে বিদায়টা তাদের বাড়ি থেকে হোক। তাই সকাল সকাল মা বাবার সাথে সে তাদের বাসায় চলে গেল। তাদের আত্নীয় স্বজনও তাদের সাথে ছিল। অভিক নীরাকে প্রীতির সাথে পাঠিয়ে দিল।

ছেলের বাসায় প্রচুর কাজ চলছে। অভিক আর শুভ্র মিলে হাতে হাতে কিছু কাজ করে দিল। ফাহাদকে আবার গোসল করানোর জন্য একটা ঘর বানিয়ে দিল পর্দা দিয়ে। সেখানে ফাহাদের মা আর খালারা মিলে তাকে কাচা হলুদ, স্বর্ণ আর রূপার পানি দিয়ে গোসল করাচ্ছে। ক্যামেরাম্যান কয়েকটা ছবি তুলে নিল। অভিক এসব দেখে শুভ্রকে বলছে,

‘ভাই, আমার বিয়েতে তো এসব করিনি। তাহলে আমার বিয়েটা কি শুদ্ধ হবে না?’

শুভ্র হেসে বলে,

‘না ভাই। তুইও ফাহাদের সাথে গোসল করে নে। তাহলে দেখবি তোর বিয়েটাও শুদ্ধ হয়ে গেছে।’

অভিক শুভ্রকে পিটে থাপা দেয়। শুভ্র বলে,

‘এটা না করলেও কিছু হবে না। এগুলো জাস্ট সমাজের নিয়ম। তাছাড়া ইসলামিক নিয়মে তুই বিয়ে করেছিস। সেখানে সমাজের নিয়ম না মানলেও চলবে। আর তোর বিয়েটা যেভাবে হলো!’

অভিক শুভ্রকে তাড়া দিয়ে বলে,

‘থাক বাদ দে। চল ফ্রেশ হয়ে নেই। ফাহাদকে রেড়ি করাতে হবে।’

ওরা চলে গেল ফ্রেশ হতে। আজ অভিক বেশ চিন্তিত। কারণ সে আজই চলে যাবে সিঙ্গাপুরে। নীরার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তাই তার পক্ষে জার্নি করাটাও পসিবল না। আবার একা রেখে যেতেও ভয় করছে। সব মিলিয়ে একটা ভয় ঢুকে যায় অভিকের মনে। অভিক এসব ভাবতে ভাবতে ওয়াশরুমে চলে গেল শাওয়ার নিতে।

.
প্রীতিদের বাসায় প্রীতির পাশে বসে আছে নীরা। প্রীতি ফাহাদের সাথে কথা বলছে ভিডিও কলে। প্রীতিকে সাজানো হচ্ছে। পার্লারের লোক এসে তাকে সাজাচ্ছে। ফাহাদ রেড়ি হচ্ছে। আধাঘন্টা পর-ই প্রীতিদের বাসায় পৌঁছাবে তারা। নীরা অভিকের কথা ভাবছে। আসার পর একবারও কল দেয়নি অভিক। খুব ব্যস্ত কি? নীরার খুব মন খারাপ হলো।

নীরা ওখান থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। নীরা নিজেই অভিককে কল দিল। কিন্তু অভিক ফোন রিসিভ করছে না। অন্তত তিনবার কল দিয়েছে সে অভিককে। নীরার আরও খারাপ লেগে উঠল। সে মন খারাপ করে প্রীতির পাশে বসে রইল। প্রীতি নীরার মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল,

‘কি হয়েছে আপু? মন খারাপ কেন?’

নীরা মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,

‘আরে কি বলো। আমি ঠিকাছি। বাহ্ তোমাকে কি সুন্দর লাগছে বলতো।’

প্রীতি বুঝতে পারছে নীরা তাকে কিছু বলতে চাইছে না। প্রীতিও আর তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেনি নীরাকে।

অভিকরা রেড়ি হয়ে প্রীতিদের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। প্রীতির কাজিনরা সবাই ফাহাদকে বরন করছে। এদিকে অভিকের চোখ নীরাকে খুঁজে চলেছে। নীরা কে কোথাও দেখছে না অভিক।

প্রীতিকে একা রেখে নীরা বরকে দেখতে আসে। তখন দেখে বরযাত্রী সবাই এসে বসে আছে স্টেজে। অভিক আর শুভ্র এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। অভিক তখন নীরাকে লক্ষ্য করে। নীরা আজ একটা ব্ল্যাক শাড়ি পরেছে। অভিক নীরার দিক থেকে চোখই সরাতে পারছেনা। অভিক বুকে হাত দিয়ে শুভ্রকে বলে,

‘উফফ!! মারডালা ইয়ার! আমার বউডা এতো সুন্দর ক্যান?’

শুভ্র এক থাপ্পড় দেয় অভিকের পিটে। আর বলে,

‘যা যা। তোর বউয়ের কাছে যা। শালা বউ পাগলা।’

অভিক নীরার দিকে এগিয়ে আসছে। এমন সময় কোত্থেকে একটা মেয়ে এসে অভিককে জড়িয়ে ধরে। অভিক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। নীরা শুধু দাঁড়িয়ে দেখছে। এদিকে শুভ্র মেয়েটিকে দেখেই ঢোক গিলে। অসময়ে তাকে কে এখানে ডেকেছে? ফাহাদ?

মেয়েটি অভিককে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় বলে,

‘আই মিস ইউ আ লট অভিক।’

নীরার চোখ ছলছল করছে পানিতে। ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আটকে রেখেছে। অভিক নীরার দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা কষ্ট পাচ্ছে অভিক বুঝতে পারছে। নীরা ওখান থেকে দৌড়ে চলে যায়। প্রিয় মানুষ্টির সাথে অন্য কাউকেই আমরা মেনে নিতে পারিনা। সেখানে অভিক তো নীরার স্বামী।

নীরা দৌড়ে প্রীতির কাছে চলে এলো। চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো মুছে নিল, যাতে প্রীতি না দেখতে পায়। প্রীতে নীরাকে দেখে বলল,

‘আপু? ফাহাদকে দেখেছ? কেমন লাগছে ওকে?’

নীরা মুচকি হেসে জবাব দিল।

‘হুম খুব সুন্দর লাগছে।’

নীরা বারান্দায় চলে গেল। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। ওই মেয়েটা অভিককে কেন জড়িয়ে ধরলো? ওর সাথে কি অভিকের কিছু ছিল?

.
অভিক মেয়েটিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়।

‘হোয়াট রাবিশ জেনি। গায়ে পড়ার স্বভাব তোমার এখনো গেল না? হুটহাট করে জড়িয়ে ধরো।’

মেয়েটি ন্যাকামি করে বলে,

‘অভিক! আমাকে তুমি এভাবে বললে? আগে তো এমন করতে না।’

অভিক রেগে গিয়ে বলে,

‘আগের অভিক আর এখনকার অভিকের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। সামনে থেকে সর।’

অভিক জেনিকে সরিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। এদিকে জেনি শুভ্রকে জিজ্ঞেস করে,

‘অভিক এতো চেঞ্জ হলো কি করে শুভ্র?’

‘কাউকে কে যদি তুমি মন থেকে ভালোবাসো। তাহলে তার জন্য তুমি শতবার পরিবর্তন হতেও রাজি হবে। অভিক একজন কে মারাত্মক ভালোবাসে। আর সে অভিক ওয়াইফ।’

জেনি অবাক হয়ে বলে,

‘হোয়াট? অভিক বিয়ে করেছে? আমি জানতেও পারলাম না?’

‘সব কথা সবাইকে বলা যায় না জেনি। বিয়েতে এসেছ, এঞ্জয় কর। অন্যের পিছনে লাগতে যেও না।’

কথাটা বলেই শুভ্র ওখান থেকে চলে যায়। আর জেনি রাগে গজগজ করতে থাকে।

.
প্রীতির রুমে এসে অভিক নীরাকে দেখতে পায়না। এদিকে প্রীতিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওর কাজিন’সরা তাড়া দেয়। অভিক প্রীতিকে জিজ্ঞেস করে,

‘নীরা কোথায় প্রীতি?’

‘আপু তো বারান্দায় আছে ভাইয়া।’

প্রীতিকে ওরা রুম থেকে নিয়ে যায়। অভিক নীরাকে খুঁজতে বারান্দায় যায়। ওখানে গিয়ে দেখে নীরা আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে বারান্দার গ্রিল ধরে। অভিক নীরার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। নীরার কোনো খেয়াল নেই। অভিক নীরার সাড়া পাওয়ার জন্য বলে,

‘মন খারাপ?’

নীরা অভিকের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসে। অভিককে দেখেই সে চলে যেতে নেয়। অভিক নীরার হাত ধরে বলে,

‘খবরদার! আমি না বলা পর্যন্ত এক পাও বাড়াবে না তুমি।’

নীরা থেমে যায়। ওর ভালো লাগছে না।

‘নীরা এদিকে ফিরো প্লিজ।’

নীরা অভিকের দিকে ফিরে।

‘কিছু হয়েছে? কেন এমন করছ? তুমি মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালো লাগে বলো?’

‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আপনি আমার কল রিসিভ করেননি। আপনার আর আমাকে প্রয়োজন নেই।’

অভিক মুচকি হেসে বলে,

‘আ’ম সরি নীরা। আমি খেয়াল করিনি তুমি কল দিয়েছ। আসলে দৌড়াদৌড়ি করছি বুঝতেই পারছ। আর শোনো! কে বললো তোমায় আমি ভালোবাসি না?’

‘আপনি যদি আমায় ভালোই বাসেন। তাহলে অন্য কেউ আপনাকে জড়িয়ে ধরার সাহস পায় কিভাবে?’

‘জেলাস ফিল করছ বুঝি?’

নীরা রাগী চোখে অভিকের দিকে তাকায়। অভিক বলে,

‘আমি সত্যিই জানতাম না ও আমাকে জড়িয়ে ধরবে।’

‘আপনি সুযোগ দিয়েছেন বলেই সে আপনার কাছে আসার সাহস পেয়েছে।’

‘নীরা, লক্ষীটি। আমি আর কাউকে আমার কাছে ঘেঁষার সুযোগ দিব না। রাগ করোনা প্লিজ৷ চলো ওখানে বিয়ে পড়ানো হচ্ছে।’

অভিক নীরার কপালে একটা চুমু দেয়। নীরা অভিককে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।

‘আমি আপনার পাশে কাউকেই সহ্য করতে পারিনা। কারণ আমি আপনাকে হারাতে চাইনা। আপনার পাশে কাউকে দেখলে মনে হয় আপনাকে কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে। আমি একা হয়ে যাবো আপনি ছাড়া।’

‘আরে নীরা। বাচ্চাদের মতো কাঁদো শুধু। আমি আছিতো তোমার পাশে। কিচ্ছু হবেনা। চলো তো।’

.
ফাহাদ আর প্রীতির বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। নীরা আর অভিক পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে একজন ওদের দেখে জ্বলছে। শুভ্র এসে ফাহাদের কানে ফিসফিস করে বলে,

‘মামা, তোমরা তো বিয়ে টিয়ে করে ফেলছ। এখন আমার কি হবে? গার্লফ্রেন্ড একটা এনে দে না প্লিজ।’

ফাহাদ বলে,

‘আমার শালিরা আছে। পছন্দ হয় কিনা দেখ। বাকি সব দায়িত্ব আমার।’

‘ধুর! একেকটার ভঙ্গি একটাও ভালো না। নীরার মতো ফেলে বিয়ে করে নিতাম।’

সবাই একসাথে হেসে উঠে। এরপর সবাই একসাথে খেতে বসে। অভিকের মতো ফাহাদও প্রীতিকে খাইয়ে দেয়। খাওয়া শেষে ওরা সবাই বর কনেকে নিয়ে বের হয়ে যায়। গাড়িতে সবাই আনন্দ করতে করতে ফাহাদের বাসায় আসে।

সন্ধ্যায় সবাই মিলে আড্ডা দেয়। ওখানে অভিককে জোর করা হয় গান গাওয়ার জন্য। অভিকও রাজি হয়ে যায়। ও সবাইকে খুশি করার জন্য গান গায়।

.
রাতের দিকে অভিক যখন নিজেদের রুমে এসে ব্যাগ গুছাতে থাকে তখন নীরা চমকে যায়। নীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘আমরা কি কালকে চলে যাবো? আপনি ব্যাগ কেন গুছাচ্ছেন হঠাৎ?’

‘না নীরা। আমি আজ রাতেই সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি।’

‘কি বলছেন? আমাকে আগে কেন জানাননি?’

‘সরি টু সে। বাট তুমি কষ্ট পেও না। সব হুট করেই ঠিক হয়ে যায়। দু ঘন্টা পর আমার ফ্লাইট। তুমি এখানে থেকো। এখানে সবার সাথে থাকলে একা লাগবে না। আমি আসলে তোমাকে নিয়ে যাবো।’

নীরা বিছানায় বসে পড়ে। অভিক এসে নীরার সামনে হাটু গেড়ে বসে। নীরার দুটি হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়।

‘মন খারাপ করোনা নীরা প্লিজ। আর একটা কথা বলতে চাই।’

‘কি?’

‘আমি যাওয়ার আগে তোমার মুখ থেকে ওই তিনটে ম্যাজিকেল ওয়ার্ডস শুনতে চাই।’

‘আমি বুঝতে পারছিনা আপনার কথা। কোনো তিনটা শব্দ?’

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

নীরা ঢোক গিলে।

‘আজ আর চুপ থাকলে আমি মেনে নিব না। বলো বলছি।’

‘আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘হোক।’

‘আমার নিচে কাজ আছে।’

‘থাকুক। আমি আজ শুনেই ছাড়বো। বলো!’

অভিকের ধমক খেয়ে নীরা হালকা কেঁপে উঠে। সাথেই সাথেই চোখ বন্ধ করে বলে,

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি।’

অভিক যে কতটা খুশি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। অভিক নীরার গালে একটা চুমু দিয়ে উঠে পড়ে। নীরা অভিকের স্পর্শ অনুভব করে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে, অভিক রেড়ি হচ্ছে যাওয়ার জন্য। নীরা এদিকে ভাবছে কিভাবে সে বলে দিল অভিককে এই কথাটা। অভিক রেড়ি হয়ে নীরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। নিচে গিয়ে সবাইকে বলে সে বাসা থেকে বের হয়। যাওয়ার আগে নীরার দিকে এক নজর তাকায়। নীরার খুব কষ্ট হচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here