তুমি আমার অভিমান পর্ব ১৬

0
1210

#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ১৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

অভিক আজ পুরো রেগে আছে। গুপ্তচর তাকে কোনো খবরই দিতে পারেনি। এদিকে পুলিশও তদন্ত করে কোনো ক্লু পায়নি। তাহলে কে খুন করলো ম্যানেজারকে? তাও আবার এত জঘন্যভাবে! আবার সেই ছবি অভিকের কাছেই বা কে দিল? অভিক অফিসে বসে আছে। আজ নীরা আসেনি। নীরাকে একাও রেখে আসেনি, সার্ভেন্ট দুটো, প্রীতি আর ফাহাদকে নীরার কাছে রেখে এসেছে অভিক।

অভিক নিজের অফিসের পিওনকে ডেকে বলে,

‘তোমাকে কে এই খামটা দিল? জানো কিছু? সে কেমন দেখতে ছিল?’

অভিকের অফিসের পিওন বলে,

‘একটা বাচ্চা এসে দিয়ে গেল। আর বললো, কেউ একজন আপনাকে দিতে বলেছে।’

অভিক পিওনকে যেতে বলে। গভীর চিন্তায় মগ্ন আছে অভিক। কে এই নতুন শত্রু। কি চায় সে?
অভিক নিজের কাজে মন দিল। সামনেই ওর একটা ডিল আছে। ওকে দেশের বাইরেও যাওয়া লাগতে পারে।

.
ফাহাদ আর প্রীতি নীরার সাথে অভিকের রুমে বসে গল্প করছে। গল্প করতে করতে ফাহাদ তাদের রিলেশন এর গল্প নীরাকে শোনায়। কি কি কাণ্ড হয়েছিল, প্রীতি কিসে ভয় পায় এসব বলছে আর হাসছে। নীরাও হাসছে ফাহাদের কথা শুনে। এদিকে প্রীতি রেগে ফায়ার হয়ে গেছে। ধুমধাম ফাহাদের পিঠে কিল দিচ্ছে প্রীতি। ফাহাদ কিল খাচ্ছে আর হাসছে। নীরার ওদের খুনসুটি দেখে বেশ লাগলো। হঠাৎ প্রীতি নীরাকে জিজ্ঞেস করলো।

‘আপু তোমার আর অভিক ভাইয়ার গল্প বলো এবার। কিভাবে তোমাদের প্রেম হলো।’

নীরা চুপ হয়ে যায়। ওদের প্রেম? ওরা কি কখনো রিলেশন করেছিল?

‘আমাদের তো রিলেশন ছিলনা তোমাদের মতো। অভিক স্যারের অফিসে চাকরি করতাম। আমি ওনার পিএ ছিলাম। জানিনা উনি আমার মধ্যে কি দেখেছিলেন। ওনার বার্থডে এর দিন জানতে পারি উনি আমায় ভালোবাসেন। তারপর…।’

নীরার মনে পড়ে যায় কি হয়েছিল সেদিন রাতে৷ নীরা আর বলতে পারলো না। ফাহাদ নীরার অবস্থা বুঝতে পেরে বলে উঠে,

‘আরে প্রীতি শোনো, আমি বলছি। অভিক তো খুব রাগী আর বদমেজাজি। আর অভিকের এই স্বভাবটা নীরার ভালো লাগেনি। তাই রিজেক্ট করে দিয়েছিল। আর বেচারা অভিক তো ছ্যাঁকা খেয়ে রাস্তায় জোরে ড্রাইভ করে অ্যাকসিডেন্ট করে বসে। তারপর শুরু হয় আর এক প্রেম কাহিনী। নীরা অভিকের অবস্থার কথা জানতে পেরে হাসপাতালে এসে সে কি কান্না সে কি কান্না! এর থেকে কি বুঝা যায় প্রীতি? যে নীরাও অভিককে পছন্দ করে। আর এরপর নীরার হঠাৎ অন্য ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আর অভিক তা জানতে পেরে আমাদের সাথে প্ল্যান করে নীরাকে কিডন্যাপ করায়। আর বলে তোমাকে কল দিয়ে কাজি অফিসে নিয়ে আসতে। যাতে সাক্ষী হতে পারো ওদের বিয়ের। আর তুমি তো তেড়ে এসে আমার কলার চেপে ধরেছিলে। হুহ্। ভেবেছিলে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেছি। বাকিটা তো তুমি জানোই।’

নীরা অবাক হয়ে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিভাবে বিষয়টাকে ঘুরিয়ে নিল সে। নীরা ইশারায় ফাহাদকে ধন্যবাদ দেয়। এদিকে প্রীতি এসব শুনে বলে,

‘কি লম্বা কাহিনী রে বাবা। তবে অনেক সুন্দর ছিল তোমাদের স্টোরিটা।’

ফাহাদ নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘এই যে বোন আমার শোনো। সামনেই আমাদের বিয়ে। হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কিন্তু চলবে না। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। কাজ কিন্তু জোরছে করা লাগবে।’

প্রীতি রাগ করে বলে,

‘আপু অসুস্থ দেখছ না? তুমি আপুকে কাজ করাতে চাইছো।’

‘কাজের মধ্যে থাকলে শরীরও ভালো থাকে। আর সবার সাথে মিলে মিশে থাকলে হাসি খুশি থাকবে খুব।’

নীরা মাথা নেড়ে বলে,

‘ঠিকাছে ভাইয়া। আপনার বিয়ের দায়িত্ব আমি নিব।’

প্রীতি নীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,।

‘অনেক ধন্যবাদ আপু। আমার মিষ্টি আপু।’

নীরা হাসে। কি ভাগ্য তার। ভাই পেয়েছে, বোন পেয়েছে৷ ভালো একটা জীবনসঙ্গী পেয়েছে। আর কি চাওয়ার আছে এই জীবনে?

দুপুর হতেই ফ্রেশ হয়ে নীরা আর প্রীতি নামাজ পড়ে নেয়। ফাহাদ আসলেই একসাথে লাঞ্চ করে তারা। আরো কিছুক্ষণ থাকে ওরা। অভিক আসলে অভিক আর নীরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা চলে যায়। নীরাকে বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছে। অভিক নীরাকে এভাবেই দেখতে চায় সারাক্ষণ। নীরার জীবনের সকল অতীত, সকল দুঃখ মুছে দিয়ে তাকে ভালোবাসাময় একটা পরিপূর্ণ জীবন উপহার দিতে চায় অভিক।

রুমে এসে অভিক নীরাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘কেমন কাটলো আজ?’

নীরা অভিকের গা থেকে ব্লেজার খুলতে খুলতে বলে,

‘অনেক ভালো লেগেছে। প্রীতি অনেক মিশুক। আর ফাহাদ ভাইয়া তো আরও বেশি হাসায়৷ সত্যিই ওনারা আসাতে আমি খুব খুশি হয়েছি।’

অভিক একটা টি-শার্ট গায়ে দিতে দিতে বলে,

‘অহ আচ্ছা। তা আমার কথা কি একবারও মনে পড়েনি আপনার?’

নীরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি বলতে অভিকের কথা আজ অনেক মনে পড়ছিল তার। ভিষণ মিস করেছে সে অভিককে। কিন্তু এটা অভিককে বলা ঠিক হবে কি? লাই পেয়ে যাবে। নীরা অভিকের দিকে তাকিয়ে বলে।

‘না তো। আপনার কথা কেন মনে পড়বে আমার? আমার পাশে আজ এতো মানুষ থাকতে আপনাকে মনে করতে যাবো কোন দুঃক্ষে?’

‘তাই না? দাঁড়াও।’

অভিক তেড়ে আসে নীরার দিকে। নীরা হাসতে হাসতে দৌড় দিল। নীরাকে অভিক সেই দৌড় খাওয়াচ্ছে। নীরা একবার বিছানায় উঠে, একবার বারান্দায় যায় আবার রুমে আসে। অভিকের হঠাৎ মনে হয় নীরার শ্বাসকষ্টের কথা। সে আর নীরাকে দৌড়ায় না। যদি আবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় তখন? অভিক বিছানায় বসে নীরার ঔষধগুলো দেখছে। নীরাকে জিজ্ঞেস করলো।

‘ঔষুধ খেয়েছ?’

‘হ্যাঁ, খেয়েছি। আচ্ছা আপনি লাঞ্চ করেছেন?’

‘করেছি অফিসে।’

‘আমি আপনার জন্য রান্না করে দিব। একসাথেই যখন যাবো তখন আর বাইরের খাবার কেন খাবো। বাড়ি থেকেই রান্না করে নিয়ে যাবো। ওভেনে দিলেই তো গরম হয়ে যাবে।’

অভিক বলে,

‘আচ্ছা ঠিকাছে। আর শোনো। আজ একজনের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিব। যিনি আমার অনেক প্রিয় একজন মানুষ। রাতে তাদের বাড়িতে যাবো। রেড়ি থেকো কেমন?’

নীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।

.
সন্ধ্যা হয়ে আসতেই সব মসজিদে আজানের ধ্বনি কানে বাজছে। অভিক ঘুমে ছিল। নীরা অভিককে জাগিয়ে তোলে। অভিক হাতমুখ ধুয়ে অজু করে নেয়। বিকেলে যে ঘুমিয়ে ছিল এই মাত্র উঠলো। এখনো চোখে ঘুম লেগে আছে। অভিক পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে মসজিদে চলে যায় নামাজ পড়তে। নীরা বাসায় নামাজ পড়ে নেয়।

অভিক যখন বাসায় আসে। দেখে নীরা কোরআন শরিফ পড়ছে। অভিক নীরার পাশে বসে নীরার তেলোয়াত শুনতে থাকে। পড়া শেষে নীরা সেটা সঠিক স্থানে রেখে দেয়। অভিক নীরাকে বলে,

‘মাশআল্লাহ। খুব সুন্দর করে তেলোয়াত করো তো তুমি।’

নীরা মুচকি হাসে। অভিক নীরাকে বলে রেড়ি হতে তারা একটা বাসায় যাবে।
নীরা চট করে বোরকা পরে হিজাব বেধে নেয়। অভিক নীরাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

আধাঘন্টা পর একটা ছোট বাসায় আসে ওরা। অভিক নীরাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে। নীরা ভিতরে ঢুকে দেখে যে একটা বয়স্ক লোক বসে আছে বিছানায়। দুজন মধ্য বয়সী মহিলা আছেন ওনার সাথে। অভিককে দেখেই ওনারা খুশি হয়ে বসতে বলেন। অভিক নীরাকে বয়স্ক লোকটির কাছে নিয়ে গিয়ে বলল,

‘চাচা। আপনার অভিকের বউ।’

নীরা ওনাকে সালাম দেয়। উনি নীরার মাথায় হাত রেখে বলেন,

‘বেঁচে থাকো মা। আমার অভিকের বউ তো মাশআল্লাহ খুব সুন্দর। কই, ওদের নাশতা দাও।’

মহিলা দুজন নীরা আর অভিকের জন্য নাশতা নিয়ে আসে। অভিক বলে,

‘নীরা, আমার মা বাবা মারা যাওয়ার পর এই চাচাই আমাকে মানুষ করেছেন। আর এনারা হলেন তার পুত্রবধূ। চাচা না থাকলে হয়তো আমিও থাকতাম না। আমি কত করে বলেছি ওনাদের আমার বাসায় চলে আসতে। কিন্তু তারা রাজিই নয়। তারা এখানেই থাকবেন। ওনারা সবাই খুব ভালো জানো তো।’

নীরা ওনাদের সাথে আলাপ করে। কি মিষ্টি পরিবার চাচার। তার ছেলেরা আসলে নীরার সাথে পরিচিত হয়। ছোট ছোট বাচ্চারা নীরার কাছে আসে। নীরা ওদের সাথে অনেক দুষ্টুমি করে।

রাতে ওখানেই খাওয়া দাওয়া করে তারা। রাত দশটায় ওই বাসা থেকে বের হয়ে নিজেদের বাসায় চলে আসে অভিক আর নীরা। নীরা চেঞ্জ করে নেয়। অভিক ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। নীরা এসে পাশে বসে। আর বলে,

‘অনেক সুন্দর পরিবার চাচার। আমার খুব ভালো লেগেছে। ওনারা এখানে থাকলেই তো ভালো হতো। আমি একটা পরিবার পেতাম৷’

অভিক নীরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

‘চিন্তা করো না। একদিন আমাদেরও খুব সুন্দর একটা পরিবার হবে। শুয়ে পরো।’

নীরা অভিকের পাশে শুয়ে পড়ে। অভিক নীরাকে তার কাছে টেনে নেয়। নীরার মাথাটা নিজের বুকে রাখে। নীরা নিজে থেকেই অভিককে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর তারা ঘুমের দেশে চলে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here