#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ১২ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
অভিক নীরার খুব কাছে। ঠিক ততটা কাছে যতটা কাছে থাকলে একে অপরের হৃদ স্পন্দনের শব্দ শুনতে পায়। যতটা কাছে থাকলে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
সাতদিন পর অভিক হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় এসেছে। নীরা অভিককে বাসায় নিয়ে এসেছে। অভিকের মাথায় কিংবা হাতে পায়ে এখন ব্যান্ডেজ নেই। নীরা অভিকের হাত ধরে যখন তাকে তার বেডে শুইয়ে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই; অভিক নীরাকে সুযোগ পেয়ে বেডের সাথে চেপে ধরে। নীরা ভয় পেয়ে কাঁপতে শুরু করে। অভিক নীরার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে। নীরা করুন দৃষ্টিতে অভিকের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে চাইছে অভিক যেন এমন কিছু না করে, যাতে এক মুহুর্তের জন্য হলেও নীরা অভিককে ভুল বুঝে।
অভিক নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘নীরা, সোজাসাপটা উত্তর দাও। কেন সেদিন আমায় রিজেক্ট করে চলে গেছ?’
নীরা ঘনঘন চোখের পলক ফেলছে। অভিক নীরার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে।
‘নীরা? কি হলো? বলবে সত্যিটা কি?’
নীরা আমতা আমতা করে বলল,
‘আ..আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। মুখের সামনে থেকে সরুন স্যার।’
নীরা অভিকের সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই অভিককে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। নীরা বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। অভিক রেগে তার বেডে একটা থাবা দেয়।
অভিকের রুমে দ্রুত দুজন মানুষ ঢুকলো। অভিক আর নীরা আওয়াজ পেয়েই তাদের দিকে তাকায়। এরা নীরার আশ্রমের নীরার বুড়ো দাদু ও মাসি। এরা এসময়ে এখানে কি করছে অভিকের মাথায় ঢুকছে না। আর এদিকে নীরা এদের দেখে চমকে গেল।
নীরার মাসি তার দাদুকে দেখিয়ে বলল,
‘দেখলেন কাকা? আমি আপনাকে বলেছিলাম না কিছু একটা চলছে। দেখুন এই তার প্রমাণ ‘
নীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘মাসি তুমি এসব কি বলছ?’
নীরার মাসি রাগ দেখিয়ে বলে,
‘ছিঃ নীরা। তুই এমন করবি ভাবতেও পারিনি। এর জন্যই বুঝি সেদিন রাতে আশ্রমে ফিরিসনি? একটা ছেলের সাথে একঘরে থাকছিস তুই? এসব করে বেড়াস?’
অভিক রেগে বলে,
‘এই যে, কি বলছেন এসব? আমার সাথে নীরার কিছুই নেই। শি ইজ জাস্ট মাই পিএ।’
বুড়ো দাদু নীরার মাসিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তুমি এখনই এখান থেকে যাবে। অভিক আমাদের কত রকম সাহায্য করেছে। আর তুমি কিনা অভিককে, তাও আবার নীরার সাথে দেখে উল্টো পাল্টা কথা বলছ?’
নীরার মাসি বলে,
‘কাকা, টাকা দিয়ে কি ভেবেছে; আমাদের মেয়ের সাথে যা ইচ্ছা তাই করবে আর আমরা মেনে নিব?’
‘মাসি তুমি ভুল বুঝছো। ওনার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল, আমি শুধু ওনাকে দেখতে এসেছিলাম ব্যাস। আর কিচ্ছুনা।’
‘হ্যাঁ, দেখতে এসেছিস তাও আবার একা একটা ফাঁকা বাসায়। নীরা এই ছেলেটা শুধু তোকে ব্যবহার করবে। কোনো দিনও স্বীকৃতি দিবে না। আর ওর কথা কি বলছি, তুই তো তোর সতীত্ব আগেই হারিয়েছিস। এসব কি ও জানে? জানলে তো তোকে ধারে কাছেই আসতে দিবে না।’
নীরা কেঁপে উঠে। ওর মাসি এসব কি বলছে? অভিককে যদি সবটা জানিয়ে দেয়, তাহলে অভিক ওকে ভুল বুঝবে। ওর সাথে কথাই বলবে না।
অভিক ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
‘স্পষ্ট ভাষায় বলুন। কিসের সতীত্ব হারিয়েছে নীরা?’
মাসি বলে,
‘নীরা তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। স্কুল থেকে আশ্রমে আসার সময় একটা বখাটে ছেলে ওর সাথে…।’
নীরার বুড়ো দাদু নীরার মাসিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘চুপ কর তুমি। চলো এখান থেকে।’
অভিক নীরার মাসির সাথে রাগ দেখিয়ে বলে,
‘কি হয়েছে বলুন।’
‘তুমি বুঝতে পারছ না কি বলছি? নীরাকে ওই ছেলেটা ধর্ষণ করেছে।’
এ কথা শুনেই অভিকের মনে তীরের মতো আঘাত লাগলো। নীরা শুধু চোখের পানিই ঝরাচ্ছে। নীরার মাসি ওকে এখান থেকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। আর যাওয়ার সময় বলে যাচ্ছে নীরাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিবে। অভিক নীরাকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলো না। সে এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। কি বলল নীরার মাসি এটা! নীরাকে ধর্ষণ করা হয়েছে? অভিক নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছেনা। নীরার কথাটা ভাবতেই দূর্বল হয়ে পরেছে অভিক।
.
নীরাকে আশ্রমে নিয়ে এসে নীরার মাসি তার রুমে দরজা আটকে রাখে। নীরা বার বার দরজা ধাক্কাচ্ছে। বলছে, সে কিছু করেনি। সবাই তাকে ভুল বুঝছে। কিন্তু নীরার মাসি তার কোনো কথাই শুনছে না। বলছে কালই ওর বিয়ের ব্যবস্থা করবে। একজনকে তিনি ঠিক করে রেখেছেন। নীরার যিনি মাসি তিনি হিন্দু। নীরা তাকে সম্মান করে বলে তাদের ভাষায় তাকে মাসি ডাকে। কিন্তু সেই মাসি যে তার সাথে এমন করবে নীরা ভাবেনি।
দরজার সামনে বসে কাঁদছে নীরা। ওর কাঁন্নার শব্দ হয়তো সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে, কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করছেনা। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। বিষাক্তের চেয়ে বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে তার জীবন। এমন জীবন তো নীরা চায়নি। নীরাকে কি কেউই বুঝবে না? ওর কি আদৌও দোষ আছে?
.
সকালের ঘটে যাওয়া সেই কাহিনীটা ফাহাদ আর শুভ্রকে বলছে অভিক। সবটা শুনে ফাহাদ আর শুভ্রর চোখ জল টলমল করছে। অভিক নিজেও শান্ত থাকতে পারছেনা। সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে শুধু৷ অভিকের বাসার ছাদে বসে আছে ওরা।
ফাহাদ অভিককে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আমরা পুরুষরা যেভাবে হাজারটা অন্যায় করেও বুক ফুলিয়ে হাটি। একটা মেয়ে কিন্তু সেটা পারেনা। আর নীরা তো অন্যায়ের স্বীকার হয়েছে। তখন ছোট ছিল। আত্মরক্ষাও করতে পারেনি। কিভাবে বেঁচে আছে এই সমাজে, একমাত্র সেই জানে। আসলে আমাদের সমাজে ধর্ষণকারীর চেয়ে ধর্ষিতাকে বেশী হেও চোখে দেখা হয়। যেন মনে হয় ওরা ইচ্ছে করেই ধর্ষণ হয়েছে। একটা মেয়ের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সত্যি খুব কষ্টকর। না তারা সমাজে বাঁচতে পারে না সমাজ তাদের নিয়ে কুটক্তি করা বন্ধ করে। আজকাল তো বাচ্চাদেরও ধর্ষণ করা হয়। মেয়েরা কোথায় নিরাপদ? আর ধর্ষিতা জেনে কেউ তাকে বিয়েও করতে চায়না।’
অভিক ফাহাদের কথা শুনে বলে,
‘সেদিন আমায় খারাপ লোক বলে রিজেক্ট করেছিল, আমি নীরার গলা পর্যন্তও টিপে ধরেছিলাম। পরে নীরা বলল, আমার সাথে নাকি ওর যায়না। মানে ও আমার যোগ্য না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমিই ওর যোগ্য না।’
শুভ্র বলে,
‘নীরার জায়গায় অন্য কেউ হলে তোর প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করে নিতো। কিন্তু ও সেটা করেনি। নীরার অতীতটা নীরা তোকে বলেনি সত্যি। কোনো মেয়েই কি ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলবে যে সে ধর্ষণ হয়েছে? কিন্তু ও তোর থেকে দূরেই থেকেছে। সত্যিটা জানলে তুই ওকে মেনে নিবিনা, হয়তো এটা জেনেই ও তোর থেকে দূরে সরে থাকে। আই থিংক, নীরা ইজ পার্ফেক্ট ফর ইউ। সবাই অতীত ভুলতে চায়। নীরাও সেটাই চায়। এখন তুই ভাব তুই কি করবি। আমাদের মনে হচ্ছে নীরাকে ছাড়া অন্য কেউই তোকে সুখি রাখতে পারবে না।’
অভিক ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। কিছুক্ষণ ভাবার পর ফাহাদকে বলছে।
‘ফাহাদ তোর গার্লফ্রেন্ড আছে না?’
ফাহাদ একটু চমকে উঠে! হঠাৎ এই কথা অভিক বলছে কেন? ফাহাদ জবাব দেয়।
‘আছে, কিন্তু হোয়াই?’
‘আমি কাল নীরাকে বিয়ে করছি। সাক্ষী হিসেবে দুজন মেয়ে লাগবে। আর তোরা তো আছিসই আমার ফ্রেন্ড।’
ফাহাদ আর শুভ্র একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবার অভিকের দিকে ফিরে বলে,
‘সত্যি?’
অভিক হেসে বলে,
‘আমি সেই প্রেমিক নই, যে প্রেমিকার অতীত জেনে তাকে ছেড়ে দিব। আমি সেই প্রেমিক নই, যে প্রেমিকার সাথে অন্যায় হয়েছে বলে আমি তাকে ছেড়ে দিব। আমি সেই প্রেমিক, যে প্রেমিকার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ হয়ে তার পাশে থাকবো। তাকে তার অতীত ভুলিয়ে রাখবো। আমার ভালোবাসা দিয়ে আমি ওকে ঠিক আগলে রাখবো।’
ফাহাদ খুশি হয়ে বলে,
‘দোস্ত সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দরকার পরলে আমার গার্লফ্রেন্ডকে বলবো ওর কিছু বান্ধবীকে নিয়ে আসতে। তুই শুধু বল কি করতে হবে।’
অভিক শুভ্র আর ফাহাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তাহলে প্ল্যান শোন।’
অভিক ওদের তার সব প্ল্যানের কথা বলে। নীরাকে একটা মধ্যবয়সী লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছে তার মাসি। এটা অভিকের কানে অনেক্ষণ আগেই এসেছে। অভিক সেটাও ওদের সাথে শেয়ার করে। সব কথা শেষ হলে ফাহাদ লাফিয়ে উঠে বলে,
‘জিও মামা, কাল মিশন শুরু হবে। আর আমরা এই মিশনে সাকসেস হবোই।’
অভিক মনে মনে বলে,
‘তুমি কিচ্ছু ভেবোনা নীরা। তুমি আমার, আমারই থাকবে। আমি থাকতে তোমায় আর কোনো বিপদকে ছুঁতে দিবো না আমি। কথা দিলাম।’
চলবে…