#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ১১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
ভারী বর্ষণ হচ্ছে। শীত আসার পূর্বে বোধয় এটাই শেষ বর্ষণ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে নীরা। এই বৃষ্টি মনে করিয়ে দিচ্ছে তাকে কক্সবাজারের কথা। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে অভিকের বকা খাওয়া, আবার আকাশের বিকট শব্দে অভিককেই জড়িয়ে ধরা। এগুলো এখন স্মৃতি হয়ে নীরার মনে গেঁথে আছে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠে, নীরার হাতে চুড়ি পরিয়ে দেওয়ার কথা। পায়ে ব্যথা পেয়েছিল বলে অভিক কিভাবে তার যত্ন নিল। এগুলো বারবার নীরার চোখের সামনে আসছে। আবার ফাহিমের হাত থেকে অভিক তাকে বাঁচিয়েছে। অভিককে সেদিন ওভাবে বলাটা উচিৎ হয়নি নীরার। ভালোভাবে বোঝালে হয়তো ওর অ্যাকসিডেন্টটা হতো না। অভিক তাকে ওর সামনে যেতে না করেছে। কিন্তু নীরাকে তো উপকারের প্রতিদান দিতে হবে। তাই অভিক যতই না বলুক। নীরা যাবেই।
বৃষ্টি দেখা শেষ হলে নীরা তার রুমে চলে আসে। আজ দুইদিন হলো নীরা অফিসে যায়নি। হাসপাতালেও যায়নি। ফাহাদকে কল দিয়ে অভিকের খোঁজ নিয়েছে। ফাহাদ নীরার নাম্বারে সেদিন রাতে কল দেওয়ায় ফাহাদের নাম্বারটা সেভ করে রেখেছিল নীরা। আজ নীরা নিজের হাতে রান্না করে অভিকের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। টিফিন বক্সে করে অভিকের জন্য খাবার ভরে হাসপাতালের দিকে রওনা হয় সে। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ বেশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে। নীরা একটা সিএনজি তে উঠে বসে। উদ্দেশ্য হসপিটাল।
.
অভিক ঘুমুচ্ছে। এখনো মাথায় ব্যান্ডেজ আছে ওর। আরো কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হবে তাকে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ, বেশী নাড়াচাড়া না করতে। কোথাও যাওয়ার থাকলে নার্সের সাহায্য নিতে হয়। অভিক এসময়ে নীরাকে কাছে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু ও নিজেই নীরাকে তার সামনে আসতে বারন করেছে। তাই বোধয় নীরা কষ্ট পেয়ে আর আসেইনি। ফাহাদ আর শুভ্র সবসময় অভিকের কাছাকাছি থাকছে। কাছের বলতে তো ওরাই আছে এখন।
.
নীরা হসপিটালে এসে দেখে অভিক ঘুমুচ্ছে। নীরা একটা টেবিলে টিফিন বক্সটা রাখে। অভিকের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। নীরা কখনোই ভাবেনি অভিককে এই অবস্থায় দেখবে।
নীরা অভিকের দিকে চেয়ে আছে এক মনে। এমন সময় অভিকের কেবিনে অফিসের ম্যানেজার ঢুকে পরে। নীরা তাড়াতাড়ি করে চোখ সরিয়ে নেয়। ম্যানেজার নীরাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘কি ব্যাপার! তুমি এখন অফিসে যাওনা যে? অভিক স্যারের অ্যাকসিডেন্ট এর পর থেকেই দেখছি অফিসে আসো না। কি সমস্যা তোমার?’
নীরা কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। পরপর চোখের পলক ফেলছে ও। তখন ফাহাদ এসে ম্যানেজার এর সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘কিছু হয়েছে? বাইরে থেকে আপনার গলার আওয়াজ শুনলাম।’
ম্যানেজার বলল,
‘নীরা অফিসে যায় না। তাই তাকে জিজ্ঞেস করছি সে কেন অফিসে যায়না। অফিসে অনেক কাজ।’
ফাহাদ মলিন হেসে বলে,
‘অফিসটা অভিকের। যেখানে অভিকই নীরাকে ছুটি দিয়েছে, সেখানে আপনি বলার কে? আর অভিক যখন জানতে পারবে, আপনি বিনা কারণে নীরার উপর চেঁচামেচি করেছেন। তাহলে কি হবে জানেন তো? অফিস সামলান গিয়ে।’
‘অহ আমি জানতাম না নীরা ছুটিতে আছে।’
ম্যানেজার ওখান থেকে চলে যায়। ফাহাদ নীরাকে দেখে খুশি হয়ে বলে,
‘আমিতো ভেবেছিলাম তুমি আর আসবেই না। যাইহোক! খাবার নিয়ে আসছ নাকি? দেখো, শুধু অভিককে খাওয়ালেই হবে না। আমরাও ভাগ পাই কিন্তু।’
ফাহাদের কথায় নীরা হেসে উঠে। ফাহাদও নীরাকে হাসতে দেখে হেসে দেয়। এদিকে অভিকের ঘুম ভেঙে গেছে। চোখ খুলে পাশে তাকাতেই দেখে নীরা আর ফাহাদ হেসে হেসে কথা বলছে। অভিক শুয়ে থেকে ফাহাদকে বলল,
‘ফাহাদ, কি নিয়ে এতো হাসছিস?’
অভিকের কথা শুনে নীরা আর ফাহাদ অভিকের দিকে তাকায়। নীরা মাথা নিচু করে থাকে। ফাহাদ অভিকের পাশে বসে বলে,
‘তোকে বলবো কেন? ওটা আমাদের সিক্রেট কথা।’
ফাহাদের কথা শুনেই অভিক চোখ রাঙায়। ফাহাদ হাসতে থাকে। তারপর বলে,
‘নীরা রান্না করে নিয়ে এসেছে। তাই বলছিলাম যে শুধু তোকে খাওয়ালেই হবে নাকি। আমাদেরও তো খাওয়ার অধিকার আছে।’
অভিক নীরার দিকে এক নজর তাকায়। ফাহাদ তাড়া দিয়ে ওখানে থেকে চলে যায় দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে। অভিক অভিমানী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন এসেছ? নিষেধ করেছিলাম না আমার সামনে তোমাকে না আসতে।’
নীরা নিজেকে প্রস্তুত করে কথা বলার জন্য। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নীরা বলে,
‘আমি আপনার কাছে কিছু কারণে ঋণী। তার প্রতিদান আমাকে দিতে হবে। তাই এসেছি। আজ থেকে আপনাকে দেখার দায়িত্ব আমার।’
‘আমি বলিনি তো আমায় দেখতে বা আমার সেবা করতে।’
‘আপনি না বললেও আমাকে প্রতিদান হিসেবে করতে হবে।’
অভিক নীরার কথার আর কোনো জবাব দেয় না। অভিক তো মনে মনে এটাই চেয়েছিল। আনন্দটা মনে মনেই থাক। নীরার সামনে দেখানো যাবে না। অভিক বলে,
‘আমি ওয়াশরুমে যাবো।’
নীরা অভিকের কথা শুনেই অভিকের কাছে এসে বলে,
‘আসুন। আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’
নীরা অভিকের হাত ধরে নিজের ঘাড়ের ওপর রাখে। তারপর অভিককে ধরে আস্তে আস্তে বেড থেকে নিচে নামায়। কোনোমতে অভিককে ওয়াশরুমে নিয়ে যায় নীরা।
ওয়াশরুম থেকে অভিককে আবার বেডে নিয়ে এসে বসায় নীরা। তারপর একটা প্লেট নিয়ে খাবার বাড়ে অভিকের জন্য। ফাহাদ আর শুভ্রর জন্য কিছুটা খাবার রেখে বাকিটা অভিককে বেড়ে দেয়। একটা চামুচ নিয়ে অভিককে খাওয়াতে গেলেই অভিক রাগ দেখিয়ে বলে,
‘চামুচ দিয়ে আমি তোমার হাত থেকে খাবো না।’
নীরা হতাশ হয়ে বলে,
‘আপনি তো নিজেও হাত দিয়ে খেতে পারবেন না। তাহলে কিভাবে খাওয়াবো আপনাকে?’
অভিক নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তোমার হাত আছে কি জন্য? তোমার হাত দিয়ে খাইয়ে দাও।’
‘পাগলামী করবেন না। আমি পারবো না আমার হাত দিয়ে আপনাকে খাওয়াতে।’
‘এই তোমার প্রতিদান? লাগবে না তোমার এই প্রতিদানের। আমি নিজেই খেতে পারবো। দাও।’
অভিক নীরার হাত থেকে খাবার প্লেটটা নিয়ে নেয়। হাতে টান খাওয়ার ফলে হাতে ব্যথা পায় অভিক। নীরা এটা দেখে বলে,
‘ঠিকাছে আমি হাত দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছি আপনাকে।’
নীরা অভিকের হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে নিজের হাত দিয়ে অভিককে খাইয়ে দেয়। অভিকের খিব ভালো লাগছে। নীরার হাতের রান্না অসাধারণ। অভিকের ইচ্ছে করছে নীরার আঙুলগুলোও চেটেপুটে খেয়ে নিতে। ব্যাপারটা ভাবতেই অভিক আনমনে হেসে উঠলো।
অভিকের খাওয়া শেষ হলে শুভ্র আর ফাহাদ অভিকের কেবিনে আসে। নার্সও একজন আসে। নার্স অভিকের ঔষধগুলো খাইয়ে দিতে চাইলে নীরা নার্সকে বলে সে পারবে। নার্স নীরাকে সব কিছু বুঝিয়ে দেয়। এদিকে ফাহাদ আর শুভ্র মিটমিট করে হাসছে। অন্যদিকে অভিক মনে মনে হেসে কুল কিনারা পাচ্ছেনা। অভিককে ঔষধ খাইয়ে নীরা ফাহাদ আর শুভ্রকে বলে,
‘ভাইয়া, আপনাদের জন্য খাবার রেখে দিয়েছি। খেয়ে নিবেন। আমি একটু আসছি আশ্রম থেকে।’
এই বলে নীরা বেরিয়ে যায়। নীরা যাওয়ার পর অভিক শুভ্র আর ফাহাদ তিনজন একসাথে হেসে উঠে।
.
রাতের খাবার নিয়ে নীরা সন্ধ্যায় আবারও হসপিটালে আসে। অভিকের কেবিনে তখন ডাক্তার ছিল। নীরা বাইরে থেকে দেখছে ডাক্তার কি বলছেন। অভিককের ব্যান্ডেজ দুইদিন পর খোলা হবে। ডাক্তার অভিককে একটু দেখে চলে যান। নীরা ডাক্তার যাওয়ার পর অভিকের কাছে যায়।
অভিক নীরাকে দেখে, কিন্তু অভিকের চোখে প্রচুর ঘুম থাকায় নীরার সামনেই ঘুমিয়ে পড়ে। নীরা আস্তে করে অভিকের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে। ভালো করে অভিককে দেখে বুঝে সে ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত অবস্থায় অভিককে নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো লাগছে। নীরা অভিকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ এই অবস্থায় অভিককে দেখে বলবে যে, এই মানুষটা এতো রাগী? নীরা অভিকের মাথার দিকে হাত বাড়িয়ে আবার হাত গুটিয়ে নেয়।
.
অভিক ঘুম থেকে জেগে দেখে নীরা ওর বেডের কাছে এসে ঘুমিয়ে আছে। অভিক আস্তে করে উঠে বসে যাতে নীরা সজাগ না হয়ে যায়। নীরার এক হাত ধরতেই অভিক চমকে উঠে। নীরার হাত আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। সাথে সাথেই অভিক নীরার কপালে হাত দেয়। অভিক দিশেহারা হয়ে যায়। নীরার খুব জ্বর। অভিক কি করবে ভাবতে ভাবতেই ফাহাদকে একটা কল দেয় অভিক।
‘ফাহাদ, নীরা.. নীরার খুব জ্বর। দ্রুত ডাক্তারকে নিয়ে আমার কেবিনে আয়। হাত ব্যথা করছে মোবাইল ধরে রাখতে পারছিনা।’
ফাহাদ ডাক্তার নিয়ে দ্রুত অভিকের কেবিনে আসে। ডাক্তার ঘুমের মধ্যে নীরাকে চেকাপ করে কিছু ঔষধ লিখে দেন। আর বলেন নীরাকে হসপিটালেই যেন রাখে। ফাহাদ একটা রোগীর বেড এনে অভিকের পাশাপাশি রাখে। তারপর নীরাকে ধরে বেডে শুইয়ে দেয়। নীরা জ্বরের ঘোরে সেন্সলেস হয়ে গেছে।
.
কপালে ভেজা কিছু অনুভব করতেই নীরা চোখ মেলে তাকায়। চোখের সামনে অভিককে দেখে নীরা চমকে যায়। নীরা বোঝার চেষ্টা করছে সে কোথায়। নীরা দেখে সে একটা রোগীর বেডে শুয়ে আছে আর অভিক তার কপালে জল পট্টি দিয়ে দিচ্ছে। নীরা অভিকের হাত ধরে নেয় জলদি।
‘কি করছেন আপনি এসব!’
নীরা ধড়ফড়িয়ে উঠে যায়। নীরা দেখে সে অভিকের পাশাপাশি বেডে শুয়ে আছে।
‘নীরা তোমার খুব জ্বর। দেখি, জল পট্টি দিতে দাও আমাকে।’
‘আমার জ্বর হলে আমি নিজেই আমার যত্ন নিতে পারবো। তারমানে এই না যে আপনার হাতে ব্যথা নিয়ে আপনি আমাকে জল পট্টি দিয়ে দিবেন। আমি আশ্রমে যাবো। সরুন।’
নীরা অভিকের কোনো কথাই শুনছে না। আর একটু হলেই নীরার দম বন্ধ হয়ে যাবে এখানে। নীরা অভিকের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। অভিক নীরাকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলে। নীরাকে খেতে বললে সে না করে দেয়। অভিক জোর করেই নীরার মুখে খাবার গুঁজে দেয়। তারপর নীরার ঔষধগুলো একটা একটা করে খাইয়ে দেয়। নীরা বলে,
‘কেন করছেন এমন? আপনার হাতে তো ব্যথা।’
‘আমি তখনই ভালো থাকবো যতক্ষণ না তুমি ভালো হবে।’
‘আশ্রমে যেতে হবে আমায়। আমি কি এখানে থাকবো নাকি। আপনাকে তো খাওয়াতে হবে। আপনার ঔষধও তো রয়েছে।’
‘আমার খাওয়া হয়ে গেছে। ঔষধও নার্স এসে খাইয়ে দিয়েছে। তুমি ঘুমাও।’
নীরা অভিকের কথা শুনে শুয়ে পড়ে। অভিক ভিষণ রাগী। রাগের বসে কি না কি করে ফেলবে! এই ভয়ে নীরা চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। অভিক নীরাকে দেখে দেখেই রাত কাটিয়ে দেয়। নীরার দিকে তাকিয়ে থাকাই অভিকের মানসিক শান্তি। প্রিয় মানুষটির জন্য জীবনও দিতে রাজি, হাত ব্যথা তো সামান্য জিনিস।
চলবে…