শ্রেয়সী পর্ব ২৩

0
218

#শ্রেয়সী
#পর্ব_২৩
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা

শাড়ী, গয়না গায়ে জড়িয়ে পাত্র পক্ষে সম্মুখে চুপ করে বসে আছি। নিজেকে কেমন মূর্তি ন্যায় বোধ হচ্ছে। এমনটাও হওয়ার ছিলো? আরাবী ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করা দ্বায় সেখানে অন্যের নামে আংটি পরাটা আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক। চোখের জল ফেলাও নিষিদ্ধ প্রায়।

দাদাভাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মা এসে শাড়ী, গয়না দিয়ে ভাবি কে বলে রেডি করে দিতে। ভাবি ‘কেনো’ জিজ্ঞেস করতে ই মা উত্তর দেয়,
-“ওর সাথে ওয়ালিদের এ্যাঙ্গেজমেন্ট সন্ধ্যায় রেডি করিয়ে দেও। আর ওকে বলে দেও যেনো মেহমানের সামনে কোনো অসভ্যতামী না করে। অন্তত আমাদের মান-সম্মানের কথা ভেবে চুপ থাকতে বলো।”

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিতেই সে আমাকে থামিয়ে বলে,
-“তোমার মুখ থেকে কোনো সাফাই শুনতে চাই না। আসা করিনি এটা।”

মায়ের চোখে স্পষ্ট ঘৃণা। নিজে কে সত্যি অপরাধী বলে বোধ হচ্ছে। কিন্তু আমারই বা কি করার ছিলো? একটা রাস্তার কুকুরও যদি আশেপাশে ঘুরে তার প্রতিও মায়া জন্মায় আর এ তো আস্ত এক মানব যে আমাকে ভালোবাসে সীমাহীন। তার প্রতি ভালোবাসা জন্মানোটা কি অস্বাভাবিক কিছু? হয়তো হ্যাঁ আবার হয়তো না। মায়ের কথা মতো ভাবি আমাকে শাড়ী পরিয়ে হালকা সাজিয়ে দেয়। অতঃপর পুতুলের মতো সাজিয়ে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়।
ড্রয়িংরুমে বাবা, দাদাভাই, ওয়ালিদ আর তার পরিবারের লোক বসে আছে৷ দাদাভাই গম্ভীর হয়ে বসা, বাবার মুখে মৃদু হাসি। জোরপূর্বক হাসি ওষ্ঠে বজায় রেখেছে। আর কারো দিকেই তাকানোর চেষ্টা করলাম না। ভাবি আমাকে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দেয় আমার ঠিক সম্মুখে বসে আছে ওয়ালিদের মা-বাবা। আমি মাথা নিচু করে চুপ করে বসে আছি। মা সবার দিকে তাকিয়ে হেসে আমাকে বলে,
-“সবাই কে সালাম দেও শ্রেয়সী।”

মায়ের কথা মতো নিচে তাকিয়েই মৃদুস্বরে সালাম দেই। ওয়ালিদের মা নানা প্রশ্ন করছে আমি শুধু মাথা নাড়াচ্ছি আর বাকি উত্তর মা দিচ্ছে। ওয়ালিদের মা উঠে এসে আমার পাশে বসে গলায় একটা চেইন পরিয়ে দিয়ে বলে,
-“শ্রেয়সী কে আমি ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতাম ওয়ালিদের বউ হিসবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা করছিলাম বড় হলেই বিয়ের প্রস্তাব দিব। আর দেখুন কত তাড়াতাড়ি আল্লাহ আমার মনের ইচ্ছা পূরণ করলেন।”

ওয়ালিদের বাবা আমার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-“তা নওয়াস এখন থেকে তো আমরা বেয়াই হয়ে গেলাম। তা বিয়ের ডেটটা কি আজই ঠিক করবে নাকি আরও কিছুদিন পর?”

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের তারিখ ঠিক করা হোক।”

-“কিন্তু শ্রেয়সী মায়ের সামনে এইচএসসি পরীক্ষা তার কি হবে?”

-“পরিক্ষা বিয়ের পরও দেওয়া যাবে। তা নিয়ে ভাবার কি আছে?”

ওয়ালিদ আমার দিকেই তাকিয়ে। তার চাহনি অদ্ভুত ঠেকছে আমার কাছে। সে আমার দিকে তাকিয়েই ওষ্ঠে হাসির রেখা ফুটিয়ে বাবা কে বলে,
-“আঙ্কেল আমার তাড়া নেই কোনো। বিয়ের ডেটটা আমরা পরিক্ষার পরই ঠিক করব। বিয়ের পর নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে শ্রেয়সীর কষ্টও হবে। পরিক্ষার প্রস্ততি তেমন নিতেও পারবে না। তাই না শ্রেয়সী?”

ওয়ালিদের পানে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেই। ঘৃণা লাগছে এই ছেলেটার দিকে তাকাতেই। তার সাথে আমি সারাজীবন কাটাব কি করে? অসম্ভব! আমি চুপ করে আছি বলে ওয়ালিদ বাবা কে বলে,
-“আঙ্কেল চুপ করে থাকা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ। তাই বলছি শ্রেয়সী পরিক্ষার পর বিয়ের ডেট ফাইনাল করি। কেমন?”

বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দেয়,
-“বিয়ে তুমি করবে তাই তুমি যা ভালো মনে করো তাই হবে।”

ওয়ালিদ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে,
-“অসংখ্য ধন্যবাদ আঙ্কেল।”

কথাবার্তা শেষ হতেই আংটিবদলের জন্য তাড়া দেয় মা। আমাকে নিয়ে ওয়ালিদের পাশে দাঁড় করায়। নিজেকে কেমন পাপেট মনে হচ্ছে। যেভাবে চালাচ্ছে সেভাবেই চলছি। ওয়ালিদ আমার বাম হাতের অনামিকা আঙ্কেল আংটি পরিয়ে দেয়। আমার দিকে মা আংটি এগিয়ে দিয়ে বলে ওয়ালিদের হাতে পারিয়ে দিতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আংটিটা হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মনে মনে পণ করে ফেলি কেয়ামত হলেও আংটি আমি ওয়ালিদের হাতে পরাব না। যা ভাবা তাই কাজ। আমি অজ্ঞান হওয়ার অভিনয় করে ভাবির গায়ে ঢলে পরি৷ ভাবির কোলে তাওফ ছিলো বলে আমাকে কোনো মতে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয়। হাত থেকে আংটিটাও ফেলে দেই। আমাকে এই অবস্থায় দেখে দাদাভাই এগিয়ে এসে আমাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে ডাকছে। আমার সাড়াশব্দ না পেয়ে ওয়ালিদ দাদাভাই কে বলে,
-“আমি শ্রেয়সী কে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।”

ওয়ালিদ হাত বাড়াতেই দাদাভাই ওয়ালিদের হাত ধরে বলে,
-“বিয়ে দিচ্ছি, দিয়ে দেইনি। আমার বোন কে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখাবে না। দূরে থাকো।”

ওয়ালিদ বোধহয় অপমান বোধ করেছে। তার আর কোনো কথা শোনা গেলো না। দাদাভাই আমাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে। ভাবিকে খেয়াল রাখতে বলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ঘর থেকে যাওয়ার আগে আমার মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয় দাদাভাই। দাদাভাইয়ের স্পর্শে কেমন কান্না চলে এসেছে। আমাকে যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে সে আজ গায়ে হাত তুললো। মানতে পারছি না এটা কিছুতেই।
ভাবিও অনেক্ক্ষণ বসে থেকে তাওফ কে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আমি সতর্কতার সাথে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে নেই ঘরে কেউ আছে কি না। না! ঘরে কেউ নেই। বিছানা থেকে দ্রুত উঠে ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে আরাবী কে কল দেই। রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে কল। দুবার রিং হয়ে কল কেটে যায়। তিনবারের বেলায় কল রিসিভ হতেই আরাবী উদ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-“ঠিক আছো প্রেয়সী? কোথায় তুমি?”

-“আমার……”

কেউ এসে হূট করেই ফোনটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। আমি চমকে পেছনে তাকাতেই দেখি দাদাভাই দাঁড়িয়ে। দাদাভাই কে দেখে আমার আত্মা কেঁপে উঠে। চোখ পাকিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে আমার পানে দৃষ্টি আবদ্ধ করে বলে,
-“বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ফোন আমার কাছে থাকবে।”

ফোনটা নিয়ে চলে যায় দাদাভাই। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে৷ বলার মতো কিংবা ভাবনার মতো কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন সব সিদ্ধান্ত কেবল দাদাভাই এবং বাবাই নিবেন। তাদের কথার কোনো নড়চড় হবে না। তা বেশ জানি আমি।

রাতে ভাবিকে দিয়ে বাবা আমাকে ডেকে পাঠায় আমি বেশ জড়তা-সংকোচ নিয়েই বাবার ঘরে প্রবেশ করি। কারণ কোনো মেয়ে তার বাবার কাছে ভালোবাসার কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করবে। তাহলে আমি কি করে বলি ‘বাবা ভালোবাসি কাউকে।’ সত্যি কি মূল্য আছে এসবের? নেই জানি।
বাবা সিঙ্গেল সোফায় বসে চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবছে। বাবার তর্জণী আঙ্কেল কিয়ৎ পর পর সমস্ত ললাটে বিচরণ করছেন। আমি মাথা নিচু করে বাবার সম্মুখে দাঁড়াই। বাবা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমার ভালোবাসায় বোধ হয় খাত ছিলো তাই তোমার অন্য কারো ভালোবাসার আশ্রয় প্রয়োজন হলো। তাই না?”

চুপ করে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছি শুধু। বাবা কিয়ৎ থেমে আবার বলেন,
-“জানো কী? একটা বাবার জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয় কী? যখন তার মেয়ের নামে অভিযোগ আসে তা। আর কি অভিযোগ জানো?
বাবা খানিক শব্দ করে হেসে বলে,
-“তার মেয়ে তার অগোচরে কোনো ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায়। এবং সেই ছেলের বাবা ফোন করে যা নয় তাই বলে মেয়েটার বাবা কে অপমান করে। তার মেয়ের চরিত্রের দিকে আঙ্গুল তুলে। বংশ নিয়ে কটুকথা বলে। তখন একজন বাবার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়।
আমারও হয়ে ছিলো যখন তোমার প্রেমিকের বাবা আমাকে ফোন দিয়ে অপমান করেছিলো। আমি বড় জোর গলায় কি বলেছি জানো? আমার মেয়ে কখনও এসব করতেই পারে না। নিশ্চয়ই আপনারা আমার মেয়ে কে ফাঁসাচ্ছেন। কিন্তু না আমি ভূল ছিলাম৷ শোনা কথা ভূল হয় কিন্তু চোখের দেখা ভূল হয় না। আমাকে আজ তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যার্থ বাবা প্রমান করলে শ্রেয়সী।”

বাবার প্রতিটা কথা আমার হৃদয়ে ছু’রি’কা’ঘা’তে ন্যায় বিঁধছে। চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে। বক্ষস্থলে কেমন চাপা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। গলায় শব্দ গুলো জমাট বেঁধে আছে। শ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। বাবাকে কি বলব? বলার মতো কি সত্যি কিছু আছে? আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“বাবা সব সময় তোমার সব আবদার পূরণ করেছে। কখনও না বলেনি। যখন যা চেয়েছো হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছি। আজ আমি বাবা হয়ে তোমার কাছে কিছু চাইছি। আমাকে অন্তত ফিরিয়ে দিও না শ্রেয়সী।”

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আছি কেবল। বেশ অনেক্ক্ষণ হয়ে যাচ্ছে বাবা কিছু বলছে না তাই আমি নিজের মনকে শক্ত করে আস্বস্ত হয়ে প্রশ্ন করি বাবাকে,
-“কি চাও বাবা?”

-“আমি চাই তুমি ওয়ালিদ কে বিয়েটা করো।”

~চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here