#শ্রেয়সী
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
আমার হাজার পূর্ণতার ভীড়ে আপনি এক অপূর্ণতা। একটা কথা খুব মানতাম,’পূর্ণতার ভীড়ে অপূর্ণতা থাকতে হয়। না হয় পূর্ণতার খাতার মূল্য বুঝবো না ঠিক।’ কিন্তু আজ দেখুন না আমার শতশত পূর্ণতায় আমি মূল্য খুঁজে পাই না। যে পূর্ণতা আমার মূল্য বোঝে না। সে পূর্ণতার মূল্য অন্তত আমার কাম্য নয়। শুনেছিলাম জীবনের পূর্ণতার মাঝে এক সময় অপূর্ণতার খাতটা চুকে যায়। তবে আমার পূর্ণতার মাঝেও আমি অপূর্ণতার তলাশে। প্রতি নিয়ত অপূর্ণতায় দগ্ধ হচ্ছি বারংবার। সৃষ্টিকর্তা এ কেমন পূর্ণতা দিলেন আমায়? যেখানে আমি অপূর্ণতায় পুড়ছি। হৃদয় দহন-এ পুড়ে ছা’র’খা’র এই আমি। তাকে ছাড়া থাকা বড্ড দায় হয়ে দাঁড়িয়ে আমার জন্য। কি ভাগ্য আমার। পুরোনো দিনের কথা মনে পরে খুব। রঙ্গিন দিনের বহিরঙ্গ মানুষ কতই না বলেতেন,’শ্রেয়সী তোর কপাল তো একদম সোনায় মোড়ানো।’ বড্ড তাচ্ছিল্য হয় নিজের উপর। সোনায় মোড়ানো কপালটা, সোনার অনলেই বুঝি দগ্ধ হয়েছে। কি ভুল ছিলো আমার? কি পাপ করেছি? যার দরুন এত বড় কঠিন শাস্তি পেতে হলো। ভালোই তো বেসেছিলাম। এই বুঝি আমার ভুল? এই বুঝি আমার পাপ? তবুও আজ বলছি ভালোবাসি তারে। ভয়ংকর রকমের ভালোবাসি তারে। হয়তো তার মতো করে নয়। তবে আমার মতো করে অনেকটা বেশি। অপূর্ণতাময় প্রিয়তম ভালোবাসি আমৃত্যু পর্যন্ত। জানা নেই আমার কোনো দিন আপনাকে জানানো হবে কি না আমিও আপনাকে ভালোবাসি। জানা নেই আমার।
ইতি,
অপূর্ণ শ্রেয়সী
এক দৃষ্টিতে চিঠির দিকে তাকিয়ে আছে আরাবী। চোখের পলক ফেলা যেনো বারণ। সে বেশ ভালো করে অজ্ঞাত তার প্রেয়সীর হাতে লেখা চিঠি এটা। আরাবী নোনাজল অবজ্ঞা করে পরের পাতা উল্টায়। যেখানে জ্বলজ্বল করছে পৃথিবীর সুন্দরতম মুহূর্তের সাক্ষী। ছবি! হাসোজ্জল মুখশ্রীতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আরাবী-শ্রেয়সী। ছবিটা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। তবে আরাবী বেশ বুঝতে পারছে এই ছবিটা তাদেরই। তবে এই ছবিটা কে তুলেছে তা আরাবীর অজানা। ছবির নীচে গুটি গুটি অক্ষরে রৌদ্রসী রোদ্দু লেখা। তার মানে কি ছবিটা রৌদ্রসী তুলে ছিলো? হয়তো! ছবিটা দেখে আরাবীর চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে সেদিনের কথা। সেদিন তাদের ভার্সিটিতে ছিলো রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব। এই অনুষ্ঠানে গানে প্রতিযোগিতা হয়। যেখানে আরাবী শ্রেয়সীও অংশগ্রহণ করে। শ্রেয়সীর ইচ্ছে ছিলো না আরাবীর সঙ্গী হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার৷ আরাবী জোর করে তার সাথে গানের সঙ্গী করে নেয় শ্রেয়সীকে।
_________________________
-“রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তুমি আমার সঙ্গে গান করবে এটা ফাইনাল।”
শ্রেয়সী বিদ্রূপ কন্ঠে বলে,
-“হাহ্! গান করবো আমি? তাও আপনার সাথে। আমি গান করতে পারি না।”
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে আরাবী,
-“একদম মিথ্যা বলবে না আমাকে।”
-“মিথ্যা বলে লাভ আছে আমার?”
-“মেয়ে মানুষের একটাই সমস্যা। কথার উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করে।”
-“এতই যখন সমস্যা তাহলে মেয়ে মানুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন কি?”
-“আছে আছে অনেক প্রয়োজন আছে। বলতে পারো বিশাল এক প্রয়োজন।”
-“কি প্রয়োজন শুনি?”
-“গান করতে হবে আমার সাথে।”
-“আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে?”
-“তোমার মাথায় আছে?”
-“যেটা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিন।”
শার্টের কলার ঠিক করতে করতে উত্তর দেয় আরাবী,
-“আল্লাহ রহমতে আমি একদম সুস্থ আছি। এবার তোমারটা বলো।”
-“তাহলে কি আপনার কানে সমস্যা আছে?”
-“উল্টাপাল্টা কথা বলে সময় নষ্ট করে আমার রাগিও না। মেইন কথায় আসো।”
-“বলুন আগে।”
-“না নেই। আমার কোনো সমস্যা ছিলো না। আর না আছে।”
-“তাহলে বুঝতে চাইছেন না কেনো? আমি আপনার সাথে গান করবো না! একদমই না।”
-“গান তো তোমাকে গাইতেই হবে। তাও আমার সাথে।”
-“না মানে না ব্যাস আর কোনো কথা হবে না।”
-“তুমি কি চাও পুরো ভার্সিটির সামনে আমার ওষ্ঠ দ্বারা তোমার ওষ্ঠ স্পর্শীত হোক?”
ললাটে সূক্ষ্ণ চিন্তার ভাজ পরে শ্রেয়সীর। আরাবীর কথাটা বুঝে উঠতে খানিকক্ষণ সময় ব্যায় হয় তার। অতঃপর বুঝে উঠার সাথে সাথে বড় বড় চোখে দৃষ্টি পাত করে সম্মুখে আরাবীর মুখশ্রী পানে। আরাবীর ওষ্ঠে বক্র হাসি ফুটে উঠেছে। শ্রেয়সী কে চুপ থাকতে দেখে আরাবী আবার বলে,
-“গান করবে? নাকি আমি যা বলেছি তা করবো? তুমি কিন্তু জানো আমি যেটা বলি সেটা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।”
শ্রেয়সী দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি দেয়। পূর্বের ন্যায় আরাবীর ওষ্ঠে বক্র হাসি ফুটে উঠেছে। বক্র হাসি ওষ্ঠে ঝুলিয়ে শ্রেয়সীর একদম কাছে চলে আসে আরাবী। দুজনের মধ্যখানির দূরত্ব এক ইঞ্চি পরিমাণ। আরাবী এতটা কাছে চলে আসবে তা শ্রেয়সী ভাবনাতীত। আরাবী কে এতটা কাছে দেখে শ্রেয়সীর শ্বাস-প্রশ্বাস খানিকটা দ্রুত গতিতে চলা শুরু করে। যেনো কোনো শ্বাসকষ্টের রোগি। আরাবী বেশ অনেকক্ষণ পরখন করে শ্রেয়সীর মুখশ্রী। অতঃপর দুপা পিছিয়ে বলে,
-“একদম রূপা সাজবে। ঠিক যেমন কল্পনাময়ী, রহস্যময়ী হৃদমোহিনী। যে দৃষ্টি সম্মুখে পদচারণ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরালে ঝ’ড়ে ন্যায় তা’ন্ড’ব শুরু হয়। অক্ষি জোড়ায় যেনো প্রশান্তিময় নিদ্রাহীনতা ঘটে। আসবে তো আমার কল্পনার রহস্যময়ী হৃদমোহিনী সাজে?”
শ্রেয়সী ওষ্ঠে লাজুক হাসি ফুটে ওঠে৷ মৃদু মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক সম্মতি প্রদায় করে। আরাবী ওষ্ঠদ্বয়ে বিস্তর এক হাসি নিয়ে বলে,
-“গুড সুইটহার্ট।”
কথাটা বলে দ্রুত প্রস্থান করে আরাবী। শ্রেয়সীর ওষ্ঠে তখনও লাজুক হাসি।
অনুষ্ঠানে দিন…….
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গোসল করে রেডি হতে শুরু করে শ্রেয়সী৷ রৌদ্রসী শ্রেয়সীর পাশে বসে সব কিছু পরখ করছে। শ্রেয়সী কে আজ একটু বেশি খুশি লাগছে। কারণ হয়তো রৌদ্রসী আন্দাজ করতে পারছে। পুরো ঘরে দুটো মানুষ থাকা সত্ত্বেও হাঁটার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দই হচ্ছে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসছে আর হালকা সাজগোজ করছে শ্রেয়সী। রৌদ্রসী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর পানে। নীরবতার ফোরন কে’টে রৌদ্রসী বলে,
-“কি ব্যাপার বলতো শ্রেয়ু? আজ এত সাজগোজ করছিস?”
-“কলেজে অনুষ্ঠান ভুলে গেছিস? আর একটু পর তো তুইও তৈরি হবি।”
-“সে না হয় বুঝলাম কিন্তু তুই এত লজ্জা পাচ্ছিস কেনো? আর এত যত্ন করে সাজছিস কেনো?”
শ্রেয়সী খানিক ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খেয়ে যায়।নিজেকে যথা সম্ভব সামলে বলে,
-“কই যত্ন? এমনি আজ প্রোগ্রাম আছে আমার তাই। তুই এত কথা বলছিস কেনো? যা গিয়ে নিজে রেডি হ।”
রৌদ্রসী ওষ্ঠে দুষ্ট হাসি নিয়ে নিজের কন্ধ দিয়ে শ্রেয়সীর কন্ধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,
-“প্রোগ্রামের জন্য? নাকি প্রোগ্রাম করা মানুষটার জন্য? হ্যাঁ! হ্যাঁ?”
কপট রাগ দেখিয়ে শ্রেয়সী বলে,
-“তুই না একটু বেশিই বুঝিস যা গিয়ে নিজের কাজ কর। আমাকে বিরক্ত করবি না।”
-“বুঝি বুঝি সবই বুঝি। তাই তো তোর মনের সুপ্ত সিক্ত অনুভূতি পড়ে ফেললাম।”
শ্রেয়সী হাতে থাকা চিরুনি দিয়ে রৌদ্রসী কে ঢিল মারে। নিজেকে বাঁচাতে রুম থেকে বেরিয়ে যায় রৌদ্রসী। শ্রেয়সী আপন মনে লাজুক হেসে মৃদু কন্ঠে বলে,
-“রহস্যময়ী রমনী নয় হৃদমোহিনী হয়ে হৃদয় হরণী হবো আপনার হৃদয়ের। কি? প্রস্তুত তো আপনি প্রাণেশ্বর?”
রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে শ্রেয়সী রৌদ্রসী। শ্রেয়সী পুরো রাস্তা কোনো কথা বলেনি। রৌদ্রসীর দম ফেটে যাওয়ার উপক্রম। কোনো উপায় না পেয়ে শ্রেয়সী কে প্রশ্নটা করেই ফেলে,
-“আচ্ছা শ্রেয়ু একটা কথা বল। ভাইয়ার সাথে গান করতে তোর কোনো আপত্তি ছিলো না। তাহলে এত ন্যাকামো করলি কেনো?”
-“এমনি।”
-“একদম লুকাবি না। সত্যি করে বলতো কেনো মানা করেছিলি?”
-“ভালোবাসার মানুষ কে নিজের প্রতি অধিকার খাটাতে দেখতে আলাদা এক প্রাশান্তি হয় অন্তরালে। তা আমি উপভোগ করতে চাই ক্ষনে ক্ষনে।”
শ্রেয়সীর সমগ্র মুখশ্রীতে লাজুকতার ছাপ। শ্রেয়সীকে উৎসুক দেখে রৌদ্রসী আর কোনো কথা বাড়ায় না চুপচাপ নীরবতা পালন করে।
কলেজ গ্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে আরাবী। প্রায় অনেক্ক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছে। অথচ শ্রেয়সী কোনো দেখা নেই। প্রায় অনেক খানি সময় পর শ্রেয়সী রৌদ্রসী দুজন কে গ্যাট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে আরাবী। আরাবী সেদিকে যেতে উদ্যত হয়েও থমকে যায়। তার দৃষ্টিতে শীতলতা বিরাজমান করছে। কল্পনার হৃদমোহিনী থেকেও ভয়ংকর লাগছে শ্রেয়সী কে। হৃদয় হরণী কি আজ হৃদয় হরণ করতে এসেছে? নাকি একেবারে তাকে নিঃশেষ করতে এসেছে?
ছাই রাঙ্গা শাড়ি পরিহিত রমনী দাঁড়িয়ে আছে আরাবী সম্মুখে। তার দৃষ্টি সরাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এক সাইডে সিঁথি করে চুল গুলো পেছন দিকে খোঁপা করা। কোনো নববধূ থেকে কম লাগছে না শ্রেয়সী কে। আরাবী কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্রেয়সী বলে,
-“ভিতরে যাওয়া যাক? অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। একটু পর বোধহয় প্রোগ্রাম শুরু হবে?”
আরাবীর কোনো হেলদোল নেই। রৌদ্রসী হতাশ ভঙ্গিতে বলে,
-“চোখের সামনে এমন এক ভয়ংকর রমনী কে দেখলে যেকোনো পুরুষ জ্ঞানহীন হয়ে যাবে। তাই না ভাইয়া?”
আচমকা রৌদ্রসীর উচ্চস্বরে কথা বলায় ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসে আরাবী। আশেপাশে দৃষ্টিপাত করে দৃষ্টি স্থাপন করে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভয়ংকর রমনীর মুখশ্রী পানে।
-“ভিতরে চলো।”
শ্রেয়সী কে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে আরাবী। তাদের দেখা মাত্র আরাবী বন্ধু মহল জোরে করতালি দেয়া শুরু করে। আশেপাশে অনেকে শিশ বাজিয়ে চিৎকার করছে। শ্রেয়সী সভবসূলভ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে হাঁটছে। শ্রেয়সী আর আরাবীর পোশাকেও বেশ মিল খাচ্ছে। ছাই রঙ্গা শাড়ির সাথে মিলিয়ে ছাই রঙ্গা পাঞ্জাবি পরেছে আরাবী। যার দরুন দুজন কে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। সকলের মাঝে অনন্য লাগছে। এরই মধ্যে প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যায়। গানের পারফরম্যান্স শুরু হওয়ার এক পর্যায় আরাবী শ্রেয়সীর নাম ডাকা হয়৷
দু’জন মুখশ্রী সম্মুখে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি প্রশান্তময় অক্ষিদ্বয় দৃষ্টিপাত করছে একে অন্যতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তুমি রবে নীরবে’ গানটায় পারফর্ম করে দুজন কিন্তু। গানের এক পর্যায় এসে আরাবী থমকে যায়। হৃদমোহিনীর সম্মুখে তার হৃৎস্পন্দন থেমে যায়। আশেপাশে সবাই চিৎকার করছে। তবুও আরাবী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। নির্বিঘ্ন তাকিয়ে আছে শ্রেয়সীর মুখশ্রীতে।
শ্রেয়সীর চক্ষুদ্বয় টলমলে। কারণটা আজও আজানা আরাবীর। সেদিন আরাবী থেমে যাওয়ায় তাদের প্রতিযোগিতা থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়। তবে দর্শকের তাদের জুটি বেশ পছন্দ হয়। যার দরুন তাদের স্টেজে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সেই ফাকেই রৌদ্রসী ওদের ছবি তুলে নেয়৷
দীর্ঘশ্বাস টানে আরাবী। সেদিনে কথা মনে পরলে আজও তার সম্মুখে ভেসে উঠে এক কিশোরী রমনীর টলমলে দৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে সহস্র বার নিজের সর্বনাশ দেখেছে আরাবী। ডায়েরি পরবর্তী পাতা উল্টায় আরাবী। সেখান থেকে শুরু হয়েছে শ্রেয়সীর জীবনের সুন্দরতম এবং বিষাদময় জীবনের পুরো অধ্যায়৷
~চলবে….