#শ্রেয়সী
#সূচনা_পর্ব(অনুভতির আত্মকথন)
#লেখনীতে_নাদিয়া_সিনহা
মেদিনীতে পূর্বাহ্নের শেষ প্রহর গুনছে। ব্যস্ততার জীবনে যে যার কাজ নিয়ে ছোটাছুটি করছে। কেউ কর্মস্থল থেকে নিজ বাসস্থানে ছুটছে তো কেউ আবার দুমুঠো খাবার যোগাতে ছুটছে ভর সন্ধ্যায়। পিচঢালা সরু রাস্তাটা আজ অনেকটা শুনশান। কিয়ৎক্ষন পূর্বেই যে বৃষ্টিরা তুমুল তান্ডব করে গেছে ধরণীর বুকে। অপরাহ্নের শেষ প্রহর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নেমে আসবে ব্যস্ত শহরে। পিচঢালা সরু রাস্তাটার এক পাশে কাঠগোলাপের স্নান শিশি টপ টপ শব্দে জানান দিচ্ছে বর্ষনের অস্তিত্বের। পিচঢালা পথটায় একা হাঁটছে আরাবী।
সেও ফিরছে নিজ নীড়ে। আজ অনেকটা আগেই ফিরছে। আজ একটা টিউশানি বন্ধ থাকায় বাসায় চলে যাচ্ছে। হঠাৎ দূর থেকে চির চেনা শ্রেয়সীকে চোখে পরলো। আরাবী যাকে দেখছে সে কি সত্যি শ্রেয়সী? নাকি অন্য কেউ? স্বপ্ন দেখছে না তো? হয়তো মনের ভুল। খানিক কাছে এগোতেই দেখতে পেলো। নাহ্! সত্যি শ্রেয়সী। যাকে হারিয়ে ফেলেছে আরাবী। আরাবী আজও শ্রেয়সীকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আজও! হোক সে অন্য কারো কিন্তু আরাবী যে শুধুই তার শ্রেয়সীকে ভালোবাসে। সে শুধুই তার শ্রেয়সীর আর কারও না। আজও! বক্ষস্থল থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আরাবীর।
দু’বছর হয়ে গেছে আরাবী শ্রেয়সীর বিচ্ছেদের। এখন তাদের একটাই সম্পর্কে প্রাক্তন! আরাবীর বুক ফেটে আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। শ্রেয়সীকে না পাওয়ার আর্তনাদ। পুরোনো কথা মনে করতে করতে অনেকটাই কাছে চলে এসেছে শ্রেয়সী। তার দৃষ্টি পিচঢালা সরু রাস্তায়। আরাবীর আর্তনাদ যেনো দিগুণ বেরে গেলো। এ কোন শ্রেয়সী কে দেখছে সে? এ যেনো ছ’ন্ন’ছা’ড়া, এলোমেলো, বি’ধ’স্ত শ্রেয়সী। যাকে আরাবী চিনে না। যার সম্পর্কে আরাবী অজ্ঞাত। আরাবীর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখের নীচটা কালচে দাগ। গোলাপী ওষ্ঠদ্বয় শুঁকিয়ে কালচে বর্ন ধরন করেছে। যে ললাটে সর্বদা টিপ থাকার কথা সেখানে আজ লম্বা সরু কালচে দাগ। যে ওষ্ঠে থাকার কথা তৃপ্তির হাসি সেখানে আজ অসংখ্য দাগের বি’ভৎ’স কা’টা ছেঁ’ড়া। যেনো কোনো হিংস্র জানোয়ার ছিঁ’ড়ে ছিঁ’ড়ে খেয়েছে। ইশ! আরাবী আর পারছে না এই বি’ধ্ব’স্ত বিষন্ন মলিন চেহারাটা দেখতে। আরাবী চোখের কোনে জল চিক চিক করছে। আর সহ্য করা সম্ভব না ওই মুখটা পরখ করা। আরাবী মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আরাবীর খুব ইচ্ছে হচ্ছে শ্রেয়সীর কাছে যাওয়ার কিছু সে নিরুপায়। শ্রেয়সীর কাছে যাওয়ার অধিকার যে আরাবীর নেই। শ্রেয়সীও এক বারের জন্যও আরাবীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেনি। যার দরুন আরাবী সাহস করে উঠতে পারছে না। আরাবীর মস্তিষ্ক শূন্য। শ্রেয়সীর এমন অবস্থায়। কি করবে? কি বলবে? বুঝে উঠতে পারছে না।
চলে গেছে শ্রেয়সী আবারও। আরাবীও চলে এসেছে অনেকটা পথ। কিন্ত হঠাৎ করে আরাবীর কি জেনো হলো সে দ্রুত হাঁটা দিলো উল্টো পথে। শ্রেয়সীর কাছে যাবে। যাই হয়ে যাক না কেনো।
শ্রেয়সীর অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে আরাবী। তবে দূর থেকেই থমকে যায়। কি দেখছে সে। শ্রেয়সী কান্না করছে। আরাবী যাওয়ার পথটায় মুখ করে হাঁটু মুরে বসে কাঁদছে। খুব কাঁদছে! শ্রেয়সীর অশ্রুতেই প্রকাশ পাচ্ছে সে কতটা যন্ত্রণা সহ্য করছে। কান্নার সাথে বুক ফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। আকাশের পানে তাকিয়ে আর্তনাদ করছে শ্রেয়সী। হাত দুটো মাথায় চেপে ধরেছে খুব শক্ত করে। চুল গুলোও দু’হাতের মুঠোয় বন্ধী। চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। চোখ দিয়ে অঝরে অশ্রু ঝরছে। চাপা কান্না শ্রেয়সী মুখশ্রীতে। যেনো অভিযোগ করছে সৃষ্টি কর্তার কাছে। শ্রেয়সীর এই আর্তনাদ আর সহ্য হচ্ছে না আরাবীর। আরাবী সিধান্ত নিলো সে যাবে তার শ্রেয়সীর কাছে। যা হবার হোক। তাও যাবেই। আরাবী এক কদম এগোনোর পর থমকে যায়। শ্রেয়সী তার চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়। রাস্তার পাশেই একটি পুকুর আর সেখানে বসার জন্য ছোট একটি ব্যাঞ্চের ব্যবস্থা করা। শ্রেয়সীর চোখের জল বাঁধ মানছে না। আস্তে আস্তে গুটি গুটি পায়ে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে গিয়ে ব্যাঞ্চে বসে পরে। আরাবী তখনও দূরে দাঁড়িয়ে। আড়াল থেকে লক্ষ্য করছে সবটা। শ্রেয়সী তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করে। ডায়েরিটা চিনতে আরাবীর একটুও ভুল হলো না। এই ডায়েরিতে শ্রেয়সী আরাবীকে নিয়ে সুপ্ত অনুভূতি লিপিবদ্ধ করে রাখতো। আজও হয়তো তাই করছে। শ্রেয়সী ডায়েরি লিখছে আর চোখ থেকে অনবরত জল গড়াচ্ছে। শ্রেয়সী ডায়েরির শেষ পাতায় লিখছে। হয়তো তার শেষ অনুভূতি। হয়তো আর লিখা হবে না আরাবী-শ্রেয়সী প্রনয় অপূর্নতায় ঘেরা কাহিনি। হয়তো এখানেই শেষ শ্রেয়সী আরাবীর অনুভূতি সহস্রাধিক কথন।
ডায়েরিটা লেখা শেষ। শ্রেয়সী ডায়েরি বন্ধ করে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। আবারও সেই বুকফাঁটা আর্তনাদে ভেঙ্গে পরেছে শ্রেয়সী। আরাবী ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এখনও। শ্রেয়সী কাঁদছ কান্নায় তার সর্বাঙ্গ শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। শূন্য মস্তিষ্ক বরফের ন্যায় দূরে দাঁড়িয়ে আরাবী। ডায়েরি বুকে জড়িয়ে কতক্ষণ কেঁদেছে শ্রেয়সী তা আরাবীর জানা নেই। আরাবী আবারও সিদ্ধান্ত নিলো সে যাবে শ্রেয়সীর কাছে। দাঁড়াবে শ্রেয়সীর সম্মুখে। জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করবে, “কেনো এত কষ্ট তোমার?”
তবে সম্মুখে এককদম এগোতেই থমকে যায় আরাবী।
শ্রেয়সী বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখের জল হাতে তালু দিয়ে বার বার মুচ্ছে। এ যেনো এক অতল সাগরের জল। ফুরাবার নয়। যতই মুছে যাক, শুষে নেয়। গড়াবে অনবরত।
অঝরে চোখের জল গড়াচ্ছে শ্রেয়সীর। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়সী। আচমকা এক ভয়ানক কান্ড ঘটায়। তার এহেন কান্ডে আরাবী বরফের ন্যায় ঠায় জমে যায়। শ্রেয়সী এমন কাজ করবে তা আরাবীর ভাবনাতীত। শ্রেয়সী ডায়েরিটা পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আরাবী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। শ্রেয়সী আর এক মূহুর্তও দাঁড়ায় না সে স্থানে। চলে যায় নিজ গন্তব্যে।
আরাবী দৌড়ে পুকুরে পারে যায়। কিছু না ভেবেই লাফিয়ে পড়ে পুকুরে। পুকুরটা বিশাল আকৃতির। গভীরতাও বেশ। তার উপর অন্ধকার নেমে এসেছে। যার দরুন আরাবী ডাইরিটা খুঁজেতে বেশ বেগ পোহাতে হয়।
_______________________
রাত ১২ টা
আরাবী এখনও পুকুর পাড়ে বসে আছে। জামা কাপড় সম্পূর্ন ভেজা। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। কেনো গেলো না শ্রেয়সীর কাছে? দূরে কেনো দাঁড়িয়ে ছিলো? কেনো আটকায়নি শ্রেয়সীকে? কেনো? আরাবীরই বা কি দোষ প্রিয় মানুষটাকে ওভাবে দেখে ঠিক বোঝে উঠতে পারেনি। ঠিক কি করা উচিত।
আরাবী মাথার হাত দিয়ে চুলগুলো শক্ত করে ধরে পিছনে ঠেলে মুঠোয় পুরে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর রাগে গিজগিজ করতে করতে হাঁটা দিলো বাসার উদ্দেশ্যে।
আরাবীর জীবন থেকে শ্রেয়সী চলে যাওয়ার পর থেকে কখনও রাতে ঠিক মতো ঘুমায় না। সব সময় শ্রেয়সী ভাবনায় বিভোর রয়। আর আজ তো শ্রেয়সী স’চোখে ধরা দিয়ে গেলো। আজ সে ঘুমাবে কি করে। আজকের ছটফটানি আরও কায়েক গুন বেড়ে গেছে।
আরাবীর মাথায় হাজারও চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। শ্রেয়সী কি লিখেছিলো তার ডায়েরিতে? কেনই বা কান্না করছিলে? আর ডায়েরিটা কেনো ফেলে দিলো? সেটা তো শ্রেয়সীর প্রানের চেয়েও প্রিয় ছিলো। আরাবীর মস্তিষ্ক শূন্য থেকে শূন্যের কোটায় গিয়ে দাড়িয়েছে। মেয়েটা কি খুব বেশই কষ্টে আছে? বুঝে না আরাবী। আরাবী আর ভাবতে পারছে না। সে দ্রুত ঘুমের জন্য তিনটা ঔষধ খেয়ে নিলো। তার ঘুমের প্রয়োজন। তার কাছে তিনটে ঔষধই ছিলো। বেশি থাকলে হয়তো সব গুলোই খেয়ে নিত।
_________________________________
সকাল ১১ টা
অনেক কষ্টে আরাবী চোখ দু’টো খোলার চেষ্টা করছে। কাল রাতে ভিজে জামা কাপড় পড়ে থাকায় রাতে জ্বরও এসেছিলো। তবে তাতে আরাবী যায় আসে না।
আরাবী ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পরে। উদ্দেশ্য শ্রেয়সীর ডায়েরি……………..
________________________________
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আরাবী। আজ না পাচ্ছে কোনো গাড়ি না পাচ্ছে কোনো রিক্সা। প্রচন্ড বিরক্ত সে। মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে নানা চিন্তা। কোথাও ডায়েরিটা পানিতে নষ্ট হয়ে যায়নি তো? না না! এসব সে কি ভাবছে? নিজের মন কে অনেক কষ্টে বোঝায়,” ডায়েরিটা ঠিক আছে কিচ্ছু হয়নি।”
আরাবী আর দাঁড়ায় না। দ্রুত হাঁটছে। গন্তব্যে পৌছাঁতে হবে যত দ্রুত সম্ভব।
_________________________________
প্রায় ১ ঘন্টা সময় লেগেছে তার পুকুর পারে আসতে। যেখানে ৩০ মিনিটের রাস্তা।
আরাবী দৌড়ে পুকুর পারে চললো। তবে থমকে গেলো। তার পৃথিবীটাও উল্টে যাওয়ার উপক্রম।
আরাবী দূর থেকে দেখছে সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা পুকুরের ময়লা আবর্জনা গুলে পরিস্কার করছে। আরাবীর মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায়। কি করবে ভেবে পায় না। তবে কালকের মত আর দাঁড়ায় না কালকের মতো ভূল সে আর করবে না। সে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয়।
তবে বিপত্তি ঘটলো আরেক জায়গায় কেউ তাকে সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না। আরাবী তাদের কাছে অনুরোধ করছে যেনো তাকে যেতে দেয়া হয়।সে এক প্রকার তাদের হাতে পায়ে ধরার অবস্থা। তবে কেউ মানছে না। অতঃপর বাধ্য হয়ে তাদের হুমকি দেয়। যেটা সে কখনো দিতে চায়নি।
অতঃপর তাকে অনুমতি দেওয়া হয় ডায়েরিটা খোঁজার। পাগলের মতো খুঁজছে সে ডায়েরি। তার এহেন কান্ডে উপস্থিত সকলে হতভম্ব। একটা ডায়েরির জন্য কেউ এমন পাগলামি করবে তা ভাবনার বাইরে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আরাবী কে সাহায্যও করে।
২ ঘন্টা খোজাখুজির পর পেয়ে যায় সে কাঙ্ক্ষিত ডাইরি। আরাবীর খুশি আকাশ চুম্বি। সে ডাইরিটি নিয়ে দ্রুত বাড়ি ফিরে। তবে………….’
__________________
ডাইরিটা কি আরাবী পড়তে পারবে? নাকি অজানা থেকে যাবে শ্রেয়সীর অনুভূতি আত্নকাহিনী?
~চলবে…..
[সবার মন্তব্য চাই। প্রথম পর্ব কেমন হয়েছে? ভুল হলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন]
হ্যাপি রিডিং🥰