শ্যামাঙ্গণা-২৫
————-
[অন্তিম পাতা]
অভিমানে ঝুমুরের সারা রাত্তিরে আর ঘুম হলো না। সেই রাতটা ও না ঘুমিয়েই পার করলো। পরের দিন সকালে ওর রাগে,দুঃখে আরও কান্না পেলো যখন ফাহমান তাকে একবারের জন্যও ডেকে তুললো না। উল্টো নিজের মতো খেয়ে দেয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। দুঃখের বহর সহ্য করতে না পেরে ঝুমুর বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোলো।
এর মাঝে মিস মারিয়াম আর হৈমন্তী যতবার ডেকে গেছে ততবারই শরীর ভালো লাগছে না এই অজুহাতে সে বিছানায় পড়েছিল। তবে তার এই অজুহাত বেশী কাজ করেনি কারণ মিস মারিয়াম জোর করে হলেও ওকে নিজ হাতে খাওয়ালেন, ওষুধ দিলেন, যেসব জায়গায় এলার্জি আছে তাতে ক্রিম দিয়ে দিলেন এবং সবশেষে বেকিং সোডা মেশানো পানি দিয়ে গোসল করতে পাঠালেন। ঝুমুর স্রেফ শাশুড়ির মান রাখতে মাঝে উঠে সব কাজ মিটিয়ে আবার শুয়ে ঘুম দিলো।
ঝুমুরের যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ্যা। ফাহমান এখনও ফিরেনি। এত ঘন্টা ঘুমনোর ফলে শরীর ম্যাজম্যাজ করছিলো তাই ঝুমুর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। দেখলো সন্ধ্যা ছয়টা। ও দ্রুত উঠে বাথরুমে গেলো। চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। চুল পরিপাটি করে রুম থেকে বের হলো। শাশুড়ি মায়ের খোঁজে বসার ঘরে ঢুকতেই দেখলো আঞ্জুম আরা সোফায় বসে আছেন। উনার সামনে সাজানো চা, চানাচুর এবং বিস্কিট।
আঞ্জুম আরা এবং মিস মারিয়ামের মুখভঙ্গি দেখে ঝুমুর টের পেলো বেশ খানিকক্ষণ আগেই এসেছেন আঞ্জুম আরা। ভদ্রতা রক্ষার্থে ঝুমুর সালাম দিয়ে বললো ‘ কেমন আছেন মামী ? ‘
ঝুমুরের কথায় কাষ্ঠ হাসলেন আঞ্জুম আরা। চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন ঝুমুরকে। ঝুমুর আঞ্জুম আরার দিকে নির্দ্বিধায় এগিয়ে গেলো এবং সন্তপর্নে তার পাশে বসলো।
মিস মারিয়াম আঞ্জুম আরার এই বাসায় আসার কারণ জানেন তাই আঞ্জুম আরা এবং ঝুমুরকে খানিকটা সময়ের জন্য একলা ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঝুমুর মিস মারিয়ামের প্রস্থানে খানিকটা অবাক হলো। তবে বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেলো না কারণ ইতিমধ্যে আঞ্জুম আরা মলিন হেসে বললেন ‘ তোর শরীরটা এখন কেমন রে ঝুম ? ‘
ঝুমুর আঞ্জুম আরার সম্বোধনে অবাক হলো। আঞ্জুম আরা কখনও ওকে ঝুমুর ব্যতীত অন্য কোনো নামে ডাকেননি অথচ আজ ঝুম ডেকেছেন। তবে ও ওর হতবুদ্ধি ভাব কাটিয়ে উঠে বললো ‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো মামী। আপনি কেমন আছেন ? ‘
ঝুমুরের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি দিলেন আঞ্জুম আরা। মলিন কণ্ঠে বললেন ‘ তোর সঙ্গে এত বছর করা অন্যায়ের শাস্তি আমাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। নিজের ছেলের চোখে সবচেয়ে নিচে নেমে গেছি আমি। তাফিম এখন আর আমার মুখও দেখতে চায় না। তোর মামা তোর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা জেনে গেছে। আম্মা ঘটনা সবকিছু বলেছেন উনাকে।
ভেবেছিলাম প্রত্যেকবারের মতো এবারও উনাকে মানিয়ে নিবো কিন্তু তোর বাড়ি ছেড়ে চলে আসাতে দোষ যে আমারই সেটা টের পেয়ে গেছেন উনি। উনি জানেন তুই এমনই এমনই ঘর ছেড়ে আসিস নী। সামনের সপ্তাহে বৃহস্পতিবার রাতে অফিস থেকে ফিরে শুক্রবার সকালে আমাকে চাঁদপুর দিয়ে আসবেন। আমার মতো মহিলার সঙ্গে উনার সংসার করার ইচ্ছে মরে গেছে। তাফিম, সামি ওরাও তাদের বাবার এই সিদ্ধান্তের বিরোধ করেনি। ‘
আঞ্জুম আরার কথা শুনে ঝুমুরের তেমন বিশেষ কোনো অনুভূতি হলো না কারণ এত বছরে এমন অনেক অত্যাচার সে সহ্য করেছে যার জন্য আজ সে অনুভূতি শূন্য। তবে আঞ্জুম আরার পরিণতি শুনে খারাপ লাগলো। সে ভাবেনি ঘটনা এত দূর গড়াবে। তবে যার যা নিয়তি তাই তো হবে। ও চাইলেও যে নিয়তির লেখন আটকাতে পারবে না। ওর সেই ক্ষমতা থাকলে ও নিঃসন্দেহে আঞ্জুম আরার নিয়তি বদলে দিত। কারণ দিনশেষে আঞ্জুম আরাই এত বছর ওকে আগলে রেখেছেন।
খানিকটা থেমে আঞ্জুম আরা আবারও বললেন ‘ আমি জানি আমি যা করেছি তার কোনো ক্ষমা হয়না তবে যদি পারিস তাহলে তোর এই মামীকে ক্ষমা করে দিস। তোর মামা আর ভাইদের চোখে আমি আর কখনো উপরে উঠতে পারবো না। কিন্তু আমার একটাই ইচ্ছা আমাকে তুই অন্তত ঘৃনা করিস না। তোর ঘৃণার আগুন আমাকে শান্তিতে মরতে দিবে না। ‘
আঞ্জুম আরার কথায় ঝুমুর এবার মুখ তুলে তাকালো। দেখলো যেই আলতা বরণ নারী এক সময় রূপ, সৌন্দর্য্যে অহংকারী ছিলেন আজ তার সেই চকচকে উজ্জ্বল সৌন্দর্য যেন হারিয়ে গেছে। চোখ দুটো যেন এক দিনের মধ্যেই কোটরে ঢুকে গেছে। অনিদ্রায় চোখের নিচে কালি পড়েছে। সময়ের স্বল্পতায় শরীরে এখনও কোনো প্রভাব দেখা দেয়নি তবে এক দিনেই যেন মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।
ঝুমুর জানতো অন্যের সঙ্গে অন্যায় করার শাস্তি দুনিয়ার জীবনেই পেতে হয়। কিন্তু সেটা যে এত শীঘ্রই হবে সেটা জানা ছিল না তার। অতীতের কথা ভেবে তিক্ত শ্বাস ফেললো ঝুমুর। পুরনো কথা সে মনে করতে চায়। মনের উপর পাষাণ ভার কমাতেই সে আঞ্জুম আরাকে ক্ষমা করে দিতে চায় তাই আঞ্জুম আরার করজোড়ে উঠে আসা হাত আগলে ধরলো।
‘ আমি আপনার উপর কখনোই অসন্তোষ ছিলাম না আর কোনোদিন আপনাকে ঘৃনা করেছি। আমার কাছে মায়ের আরেক রূপ আপনি। আমার পক্ষে আপনাকে ঘৃনা করা কিংবা আপনার উপর রাগ হওয়া সম্ভব না। তাই ক্ষমা করার প্রশ্ন উঠে না। ‘
আঞ্জুম আরা মলিন হেসে ঝুমুরের কাছে আরেক দফা ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন। আঞ্জুম আরা যেতেই ঝুমুর মিস মারিয়ামের সঙ্গে মিলে কিছু কাজ করলো। অবশ্য মিস মারিয়াম বলেছিলেন সাহায্যের দরকার নেই কিন্তু ঝুমুর জোর করে কাজ করলো। কাজ শেষে সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঝুমুর ঘরে এলো। ঘরে এসেই সঙ্গে সঙ্গে সে বারান্দায় চলে গেলো। অন্ধকার এই সন্ধ্যায় বারান্দার খোলা হাওয়ায় দাড়াতে তার ভালই লাগছে।
কিছুক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে থাকার পর ঝুমুরের কানে বাথরুমের কলের শব্দ এলো। ঝুমুর জানে ফাহমান এসেছে আর সে এখন গোসলে ঢুকেছে। ফাহমানের এই নিঃশব্দ চলাচল ও ঝুমুরকে কাল রাত থেকে বারবার এড়িয়ে চলার ব্যাপারটা ঝুমুরের মনে জমে থাকা অভিমানের পারদ আরও গাঢ় করলো। ঝুমুর অভিমানে এগিয়ে গিয়ে ফাহমানের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করলো না।
ঝুমুর তখন বারান্দায় দাড়িয়ে দখিনা হাওয়া উপভোগ করতে ব্যস্ত। চকিতে ওর নাকে এক ফুলেল সুবাস এসে ঠেকলো। ও সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুচকে ফেললো। মুখ নামিয়ে দেখলো কেউ একজন তার সামনে কয়েক গুচ্ছ সাদা গোলাপের তোড়া ধরে আছে। ঝুমুরের সাদা গোলাপ খুব পছন্দ। বিশেষত সব শুভ্র রঙ্গা ফুলই তার পছন্দের তালিকায় আছে।
‘ বাগানের রাজকুমারীর অভিমান ভাঙাতে শুভ্র গোলাপের শুভেচ্ছা ‘
ফাহমানের কথা শুনলো ঝুমুর তবে কথায় আছে মান যায় তো যায় কিন্তু নারীর দেমাগ না যায়। ঝুমুর তার ইগো বজায় রাখতে কাঠ কাঠ গলায় বলল ‘ অঙ্গণা ঝুমুরের মন এত দূর্বল না যে সামান্য কথায় অভিমান করবে। তার থেকে ফুলগুলো ওই শালীনকে দিয়ে দিলে খুশি হবে বেচারি। নিজের ক্রাশের কাছ থেকে ফুল পেতে কে না চায়। ‘
ফাহমান ঝুমুরের মেজাজের বহর টের পেলো। ম্যাডাম যে অসম্ভব রেগে আছে এবং হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে সে ভালই টের পাচ্ছে সেটা। তাই ঝুমুরকে আরেকটু জ্বালাতে ও বললো ‘ ঠিকাছে তাহলে আমি কাল নতুন ফুল কিনে শালীনকে দিবো। এই ফুল নিয়ে কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে সব শুকিয়ে যাবে। ‘
ফাহমানের এই কথাগুলো যেন ঝুমুরের রাগের আগুনে ঘৃতাহুতি দিলো। ঝুমুর জ্বলন্ত উনুনের মতো জ্বলে উঠে দাতে দাত চেপে বললো ‘ তাই ? কেন আপনার শালীন কি তার ক্রাশের হাত থেকে শুকিয়ে যাওয়া ফুল নিবে না ? আমি হলে তো আমার ক্রাশ যা দিত তাই নিয়ে নিতাম। ‘
ফাহমান এবারও ঝুমুরকে আরও রাগিয়ে দিতে বলল ‘ হয়তো আমার কাছ থেকে ও শুকনো ফুলই নিয়ে নিত কিন্তু ও স্পেশাল একটা মানুষ। শুকনো ফুল ধরিয়ে দিলে কেমন লাগে। আজ পর্যন্ত কতবার আমাকে তাজা ফুল দিয়ে প্রপোজ করলো অথচ আমি কিনা ওকে শুকিয়ে, মরে যাওয়া ফুল দিবো। ইমপসিবল… ‘
ফাহমান ভেবেছিল ঝুমুর ওর কথায় রেগে গিয়ে চেঁচামেচি করবে কিন্তু এর ধারণা এবারও ভুল কারণ ও রেগে তো গেলই না উল্টো পিছন ফিরে ফাহমানকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বললো ‘ আপনি এভাবে কথা বলবেন না প্লিজ। আপনার কি আমাকে আর ভালো লাগছে না ? বিয়ের দুই দিন হতে না হতেই কি আমি আপনার কাছে পুরনো হয়ে গেছি ? প্লিজ ওই মেয়ের কাছে যাবেন না। আপনি কি আমাকে আর ভালোবাসেন না ? আমাকে ভালো লাগছে না আপনার ? ‘
ঝুমুরের আকস্মিক কান্নাকাটিতে থম মেরে গেলো ফাহমান। ও কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। ঝুমুরকে রাগিয়ে দিবে ভেবেছিল কিন্তু এখন তো উল্টো ঝুমুরই কাদঁছে। ঝুমুরকে এভাবে কান্নাকাটি করতে দেখে ফাহমান প্রথমে চমকে গেলেও এবার ওর পেট ফেটে হাসি আসছে। ও হো হো করে হেসে দিল। হাসতে হাসতে ওর দম বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড় আর ওকে এভাবে হাসতে দেখে ঝুমুর চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছে।
‘ আপনি এভাবে হাসছেন কেন ? ‘
‘ সিরিয়াসলি অঙ্গণা, তুমি আমার কথায় এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে। আমি বললাম আর তুমি বিশ্বাস করলে ? আরে বাবা আমার মতো সাধারণ দেখতে ছেলেকে কে পছন্দ করবে ? আর আমি যার কথা বলছি উনি তো আমার সিনিয়র। অলরেডি দুটো ছেলে আছে। আরে বাবা তুমি এত বোকা কেন ?’ ফাহমান হাসতে হাসতে বললো।
‘ তারমানে আপনি আমাকে রাগিয়ে দিতে এসব বলছিলেন ? ‘ ঝুমুর সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো।
ফাহমান জোর করে হাসি আটকে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো। ফাহমানের ইশারা দেখে ঝুমুর যেন সস্তির নিশ্বাস ফেললো। ও ফাহমানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বললো ‘ আজ করেছেন করেছেন কিন্তু আর কখনো এমন করবেন না। আমি আপনাকে কারোর সাথে ভাগ করতে পারবো না। খবরদার যদি কোনো মেয়ের কথা মুখে তুলেছেন তো দেখবেন কি করি। ‘
ঝুমুরের হুমকি শুনে ফাহমান ভয় পাওয়ার ভান ধরে বললো ‘ ওমা ভয় পেয়ে গেলাম তো। আচ্ছা ঠিকাছে কোনো মেয়ের দিকে তাকাবো না। আই প্রমিজ। ‘ কথাগুলো বলে ফাহমান ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরলো। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো ওভাবেই নীরবতায় একে অপরকে জড়িয়ে। হঠাৎ ফাহমানের কিছু একটা মনে পড়লো। ফাহমান ঝুমুরকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে সরে গেলো। ঝুমুর দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওর কার্যকলাপ দেখছে।
ফাহমান ঘরে ফিরে গিয়ে ওর স্টাডি টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটা নিয়ে এসেছে। বারান্দায় যে টিমটিমে হলুদ আলোর বাল্ব ছিল ফাহমান সেটাও জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঝুমুরকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজে হাঁটু মুড়ে বসলো ঝুমুরের সামনে। ঝুমুর এতক্ষণ নীরবে সবকিছু দেখছিল কিন্তু ফাহমানকে মেঝেতে ওর সামনে বসতে দেখে অধৈর্য্য হয়ে বললো ‘ কি ব্যাপার ? আপনি নিচে বসছেন কেন ? ‘
‘ ধৈর্য্য ধরো অঙ্গণা। একটু অপেক্ষা করলেই দেখতে পাবে। ‘ ঝুমুরের নরম ঠোঁটে নিজের রুক্ষ ঠোঁট জোড়া হালকা ছুঁয়ে দিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল ফাহমান।
ঝুমুর ভ্রু কুচকে ফাহমানকে দেখছে। ফাহমান ওর ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা চারকোনা ছাই রঙ্গা বক্স বের করেছে। বক্সের উপর ছোট আর্টিফিসিয়াল শিউলি ফুল ডিজাইন করা। দেখে মনে হচ্ছে কোনো গয়নার বাক্স। ফাহমান এবার বক্সটা খুললো এবং বক্সের ভিতর থেকে ছোট আংটির মতো কিছু একটা নামিয়ে আনলো। তারপর আংটিটা নিজের উরুর উপর ঝুমুরের রাখা বাম পায়ের দ্বিতীয় আঙ্গুলে পড়িয়ে দিল।
ঝুমুর হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর পায়ের আংটির দিকে। ওটা যে টো রিং বুঝাই যাচ্ছে। রিংটা রুপার কারুকার্য খচিত সাধারণ এক পায়ের আঙ্গুলের আংটি অথচ আংটির মধ্যে কত মায়া জড়ানো। ঝুমুর জানে ফাহমানের পক্ষে সোনার কোনো কিছু দেওয়া সম্ভব নয় তাই ও রুপার আংটিই বানিয়ে এনেছে। ঠিক কতটা ভালোবাসলে প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য সোনার গয়না আনতে না পেরে তার বিকল্প হিসেবে রুপা এনেছে।
‘ ওহ মাই গড। এটা আপনি কখন কিনলেন ? জিনিসটা এত সুন্দর কেন ? আমি না আজ থেকে রোজ এটা পড়ব। ‘
ঝুমুরের অবাক কণ্ঠে বলা কথা শুনে হাসলো ফাহমান। ও জানে ঝুমুর ওকে এতটা ভালোবাসে যতটা ভালোবাসলে সোনার বদলে রুপা পেয়েও অত খুশি হওয়া যায়। ফাহমান জানে ঝুমুরের নিজেরই অনেক সোনার গয়না আছে যার কাছে ওর রূপার তৈরি কিনে আনা পায়ের আংটি কিছুই না। তবুও ও ভালোবেসেই কিনে এনেছে আংটিটা যাতে এর উসিলায় হলেও ঝুমুরের মুখে হাসি দেখতে পারে।
ঝুমুরের জন্য এই আংটি বানাতে ফাহমানকে তার জমানো টাকা থেকে চার হাজার টাকা ভাঙাতে হয়েছে। ফাহমান খুব অল্প বয়স থেকেই টাকা জমাতো কারণ পড়াশোনায় তুখোড় হওয়ায় ক্লাস সিক্স থেকেই সে বৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনা করে এবং বাকি কিছু রয়ে গেলে সেগুলো জমিয়ে রাখত। আর আজ সেগুলোই কাজে লেগেছে ঝুমুরের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।
‘ কয়েকদিন আগেই বানাতে দিয়েছিলাম। আজ হসপিটাল থেকে ফেরার সময় নিয়ে এলাম। বিয়ে করেছি এখন বউকে কিছু তো দেওয়া মাস্ট। রোজ যাতে পড়তে পারো তাই এটা এনেছি। ‘
ঝুমুরের আনন্দ আর দেখে কে। ও খুশিতে কিছুক্ষণ আংটি খুটাখুটি করলো তারপর ক্ষণে ক্ষণে ফাহমানকে ধন্যবাদ দিলো এবং সব শেষে ফাহমানকে জড়িয়ে ধরে তার কোলে বসে রইলো। ফাহমানের বোতাম খোলা লোমশ বুকে আঁকিবুকি করতে করতে বলল ‘ আপনি একবার বলেছিলেন না আমার বাগানে এত ফুল আছে অথচ লাল গোলাপ নেই কেন ? ‘
ঝুমুরের কথা শুনে ফাহমান মাথা নেড়ে সায় দিল যে হ্যাঁ সে বলেছিল। ঝুমুর উত্তরে হাসলো এবং বললো ‘ আমার এই সতেরো বছরের বসন্তে কেউ কখনো ডাকেনি শ্যামাঙ্গণা বলে। এই দশ বছরের জীবনে অমনির পর কেউ অঙ্গণা বলে সম্বোধন করেনি। অথচ জীবনের সতেরোটা বছর পেরিয়ে এখন বিশেষ একজন আমাকে শ্যামাঙ্গণাও ডাকেন সঙ্গে অঙ্গণাও। সর্বোপরি আমার এত বছরের জীবনের প্রেমের লাল রং ছিল না তাই কখনও বাগানে লাল গোলাপ লাগানো হয়নি।
কিন্তু এখন আমার জীবনেও প্রেম আছে, আছে আমার ভালোবাসা তাই সুযোগ বুঝে দুম করে একদিন চমকে দিয়ে বাগানে লাল গোলাপ গাছ লাগাবো। তারপর ফুটে উঠা সেই লাল গোলাপ কানে গুঁজে টকটকে লাল শাড়ি পড়ে প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে শিউলি কুড়ানো বিকেলে ঠান্ডা লাগিয়ে কাপতে কাপতে বাড়ি ফিরব। বলুন রাজি ?’
ফাহমান ঝুমুরের কথা শুনে হাসলো। ঝুমুরের এগিয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে পূর্ণিমার গোল থালির মতো চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো ‘ রাজি শ্যামাঙ্গণা। আপনাকে নিয়ে দূর দূরান্তে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আমার বহু পুরনো। এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না। ‘
ঝুমুর যেন ফাহমানের হাসির অপেক্ষাতেই ছিল। ফাহমানের সেই সাধারন হাসির প্রেমে সে আবারও অসাধারণভাবে হারিয়ে যেতে যেতে ফাহমানের বুকে মাথা রেখে আদুরে গলায় বলল ‘ ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব। ‘
উত্তরে ফাহমান ঝুমুরকে আগলে ধরে বললো ‘ ভালোবাসি অঙ্গণা ‘
সমাপ্ত….
( বলেছিলাম একটা চমক দিবো যেটা দিয়ে দিলাম। যারা গল্প পড়েন কিন্তু মন্তব্য, রিয়েকশন দেন না তাদের বলছি আমার বাসায় বিশ ত্রিশজন মেহমান। আমার নিজের রুমেই আমার বসার জায়গা নেই তবুও আমি সারাদিনে টুকটুক করে লিখে গল্প দিচ্ছি। আপনাদের পড়তে পাঁচ মিনিট লাগলেও আমার সারাদিন লাগে লিখতে। কাজেই আজকের শেষ পর্বে সকলে মন্তব্য করবেন তাই আশা করি। সুযোগ থাকলে দিন দুয়েক এর মধ্যে আরেকটা চমক আসবে। )