শ্যামাঙ্গণা-১

0
1430

শ্যামাঙ্গণা-১
———–

চৈত্রের খরতাপে অতিষ্ট জনজীবন। চারদিকে শুধু খা খা রোদ্দুর। কোথাও বাতাসের নামমাত্র অস্তিত্ব নেই। মাথার উপর সূর্যটা তীব্র তাপ ছড়াচ্ছে সেই সঙ্গে ফুরফুরে মেজাজটাও চুলার প্রেসার কুকারের মতোই ক্ষণে ক্ষণে ফুঁসে উঠছে। শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। একটু পানি খাওয়ারও ফুরসৎ নেই ঝুমুরের। এখন সে ব্যস্ত,মহা ব্যস্ত। তার ব্যস্ততার অন্যতম কারণ হলো সিড়ি ঝাড়ু দেওয়া।

ঝুমুরের বাবা মোতালেব সাহেব সৌখিন মানুষ। পুরনো জিনিস সংগ্রহ করার ভীষন রকমের শখ আছে তার। প্রায়ই তাকে পুরনো জিনিস নিয়ে আসতে দেখা যায়। আজও এনেছেন। একটু আগেই লোক এসে একটা পুরনো সময়ের বিপুল কারুকার্য খচিত লম্বা ঘড়ি তুলে দিয়ে গেছে তিন তলায়। সেই ঘড়ি তোলার সময় তার গায়ে যত ঝুল ছিল সব সিড়িতে পড়েছে। আর এখন সেসবই ঝুমুরকে পরিষ্কার করতে হচ্ছে।

ঝুমুরের মেজাজ একটু পরপর চিড়বিড় করে উঠছে। দাতে দাত চেপে ঝাড়ু দিচ্ছে সে। বাবার সঙ্গে তার এখন কঠিন যুদ্ধ ঘোষণা করতে ইচ্ছা করছে। তিন দিন মুখ দেখাদেখি,কথা বলাবলি সব বন্ধ। মুখও দেখবে না ওই লোকটার। কি পেয়েছে কি ? কয়দিন পরপর এটা ওটা বাড়িতে আনবে আর সেসব ঝুমুর দেখা শুনা করবে তাইতো ? না এখন আর এসব চলবে না। এখন থেকে সে ওগুলোর দিকে ফিরেও তাকাবেনা।

ঝাড়ু দিতে দিতেই চিন্তায় পড়ে গেল ঝুমুর। ঠিক তো করে নিলো মোতালেব সাহেবের সঙ্গে কথা বলবে না কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব ?সে তো রোজ একবার করে হালমনির(দাদু) কাছে যায়। আর হালমনির কাছে যাওয়া মানেই মোতালেব সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়া। ঝুমুর তার বাবাকে ভালো করে চিনে। তার রাগ হয়েছে ধরতে পারলেই ভদ্রলোক তার রাগ ভাঙ্গানোর একটা সুযোগও ছাড়বেন না।

বাবার সঙ্গে তাহলে যুদ্ধটা করা হবে না ভেবে ঝুমুর রাগে ফোঁস করে উঠলো। গজগজ করতে করতেই সে ঝাড়ু দিচ্ছে সিড়ি। সে যখন ক্রোধের দুনিয়ায় নন্দিনী হয়ে নিজের সমস্ত ক্রোধ বেচারা ঝাড়ুর উপর ঝাড়তে ব্যস্ত তখনই কানে এলো অপরিচিত কণ্ঠস্বর। ঝুমুর পরিষ্কার শুনতে পেলো কোনো এক ছেলে তাকে বলছে ‘ দেখি খালা একটু সরে দাঁড়ান, আমি উঠবো। ‘

—-

ছেলেটার কথা শুনে নির্বাক ঝুমুর। তার শব্দেরা তাদের অবস্থান হারিয়েছে। চোখ দুটোতে বিস্ময়ের ছড়াছড়ি। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সে একবার নিজেকে দেখে নিল। পরখ করলো তাকে কোন দিক থেকে খালা মনে হয়। কোথায় তার বেশভূষা তো বলছে না তাকে খালা মনে হয়। সে এবার সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো।

ছেলেটার বেশভূষা আপাদমস্তক সাধারণ। পড়নে আকাশী রঙের শার্ট এবং কালো জিন্স। শার্টের হাতাগুলো কনুই অব্দি গুটানো। এক হাতে সাদা এপ্রন আর কাধে ব্যাগ, পায়ে কেটস। ছেলেটার পায়ে কেটস দেখে ঝুমুরের এবার গলা উপচে কান্না এলো। তার দুই চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল।

আচমকা সামনে দাড়িয়ে থাকা শ্যামাঙ্গণাকে কাদতে দেখে ভরকে গেলো ফাহমান। ও আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ঝুমুরের দিকে তাকালো। ভীত গলায় বললো ‘ একি আপনি কাদছেন কেন ? কি হয়েছে ? ‘

ঝুমুর কাদতে কাদতে হেচকি তুললো। হেচকি তুলেই সে বললো ‘ আপনি কেটস নিয়ে সিড়িতে উঠেছেন কেন ? আপনি জানেন না জুতো নিয়ে সিড়িতে ওঠা নিষেধ ? ঐযে ওখানে তো পরিষ্কার করে লেখা আছে জুতো নিয়ে সিড়িতে উঠা যাবে না। ‘ কথাগুলো বলে হাতের ইশারায় নোটিশ বোর্ডটা দেখালো ঝুমুর।

ঝুমুরের কথায় ফাহমান সস্তির নিশ্বাস ফেললো। বড় করে দম নিয়ে বললো ‘ বুঝলাম আমার ভুল হয়ে গেছে। আসতে সময় নোটিশ খেয়াল করিনি। তাই বলে আপনি কাদবেন ? ‘

ফাহমানের কথায় ঝুমুর হেচকি তুলতে তুলতে বললো ‘ আমি কাদবো নাকি না সেটা আমাকে ভাবতে দিন। তার আগে এটা বলেন আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে খালা মনে হয় ? আমি কি দেখতে আন্টিদের বয়সী ? এখনও ফুপুই হলাম না আর আপনি খালা বানিয়ে দিলেন। ‘

ঝুমুরের কথা শুনে এবার ফাহমান অসস্তিতে পড়লো। আসলে সে ওই অর্থে খালা বলেনি। যেই অর্থে বলেছে সেটা জানলে এই কাদুনে মেয়ে আবারও কেঁদে দিবে। এমনিতেই তো কাদতে কাদতে চোখের জলে নাকের জলে করে ফেলেছে। তার থেকে আসল কারণটা না বলাই শ্রেয়। ফাহমান ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল ‘ আপনি ঝুঁকে ছিলেন তাই বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন, আই অ্যাম সরি। ‘

ঝুমুর আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল ফাহমানকে। তার ইচ্ছা করছে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। লোকটার জন্য তাকে এখন আবার পুরো সিড়ি ঝাড়ু দিতে হবে। কিন্তু তার আর কথা শুনানো হলো না। ততক্ষনে ওর মামা ফারুক এসে হাজির। বন্ধুকে সিড়িতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ফারুক বললো ‘ কিরে তুই এখানে কেন ? ‘

ফারুকের কথার জবাবে কি বলবে বুঝতে পারলো না ফাহমান। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে যা ঘটে গেছে তা বলাটা সমীচিন হবে না ভেবেই সে বললো ‘ খেয়াল করিনি বলে আসতে সময় উনি ঝাড়ু দিচ্ছিলেন আর উনার ঝাড়ু দেওয়া জায়গা আমি জুতো পায়ে পাড়িয়ে এসেছি। ‘

ফাহমানের কথায় ফারুক বললো ‘ আরে তুই ওকে উনি উনি করছিস কেন ? ও তোর অনেক ছোট। ফেলে দিলেও সাত বছরের ছোট তো হবেই। ‘

ফারুকের কথায় অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো ফাহমান। বন্ধুর এহেন দৃষ্টি দেখে ফারুক হেসে বললো ‘ ওভাবে তাকাস না। ও আমার ভাগ্নি। আমার আপু তাসনুবার বড় মেয়ে। ও শুধু দেখতেই অমন লম্বা। আসলে অত বড় নয়। সবে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ‘

ফারুকের কথায় ফাহমান ঠোঁট গোল করে ‘ ও ‘ বললো। ফারুক আবারও বললো ‘ তুই চিন্তা করিস না। তুই তো জানতি না সিড়িতে জুতা পড়ে ওঠা নিষেধ। নেক্সট টাইম খুলে নিলেই হবে। আর ঝুম তুই কাদিস না। ও আমার বন্ধু ফাহমান। ওই যে তিন তলার মারিয়াম আন্টি আছে না ? ওনার ছেলে ও। আমার সঙ্গে মেডিকেলেই ইন্টার্নশিপ করছে। ‘

ফারুকের কথায় ঝুমুর এবার ধরতে পারলো রোজ তবে এই লোকটাই জুতো পায়ে নেমে সিড়ি ময়লা করে দিয়ে যায় আর সেসব তার পরিষ্কার করতে হয়। ইচ্ছে করলো লোকটাকে দুই চার ঘা লাগিয়ে দিতে। কিন্তু মামার বন্ধু বলে ছেড়ে দিল। আরেকবার এরকম করলে ছেড়ে দিবে না সেও। মুখে বললো ‘ আমি জানি উনি মারিয়াম আন্টির ছেলে,কয়েকবার দেখেছি ‘

ফারুক ওর কথা শুনে ওর কপালে টোকা দিয়ে বলল ‘ বুঝলাম। তো বুড়ি সকালে তো ঝাড়ু দিয়েছিস। তাহলে এখন আবার দিচ্ছিস যে ? ‘

‘ বাবা আবারও একটা পুরনো জিনিস ঘরে এনে তুলেছে। এবারের টা পুরনো লম্বা ঘড়ি। ফ্ল্যাটে তুলতে সময় ঘড়ির গায়ে যত ঝুল ছিলো সব পড়েছে সিড়িতে। এখন এগুলো আমাকে পরিষ্কার করতে হচ্ছে। আমি বলে দিচ্ছি মামা এবার আমি বাবার সঙ্গে কথাই বলবো না। হালমনিও বিরক্ত তার এই কাজে। ‘ ঝুমুর কাদো কাদো গলায় বললো।

‘ তাহলে নিঝুমকে দিয়ে ঝাড়ু দেওয়ালেই পারিস। ওরও একটু কাজ করা উচিত। তিন তলার সব কাজ আন্টি করেন আর দোতলার কাজগুলো তো তুই করিস। ওর তো কিছুই করতে হয় না। ‘

‘ থাক আমি করছি তো। ওর করতে হবে না। ও ফর্সা মানুষ, কাজ করলে শরীরে ছাপ পড়ে যাবে। আমার শরীরে পড়লেও সেসব দেখা যাবে না। ‘ ঝুমুর জল চিকচিকে চোখে বললো।

‘ হ্যাঁ যতসব ফাউ কথা। নিজে কাজ করবে আবার নিজেই কাদবে। তুই তাহলে ঝাড়ু দে আর কাদতে থাক। আমি ফাহমানকে নিয়ে উঠছি। ‘

ফারুকের কথায় ঝুমুর একবার আড়চোখে ফাহমানকে দেখলো। সে এখনও এক দৃষ্টিতে তাকেই দেখছে। ঝুমুর দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো আর অসস্তিতে পড়লো। লোকটা এভাবে দেখছে কেন ওকে ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই ঝুমুর আবারও কাজে লেগে পড়লো আর ফারুক, ফাহমান সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।

—-

বাসায় ঢুকেই ঝুমুর মনোয়ারা বেগমকে খাবার ঘরে টেবিল সাজাতে দেখল। অন্যদিকে রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। মনে হয় আঞ্জুম আরা রান্না করছেন। খাবার ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে ফ্যান ছেড়ে বসলো ঝুমুর। মনোয়ারা বেগম তরকারিতে চামুচ দিতে দিতে বললেন ‘ পা নামিয়ে বস ঝুম। ভদ্রতা বলে কিছু আছে। ‘

সঙ্গে সঙ্গে পা নামিয়ে নিবিড় ভঙ্গিতে বসলো ঝুমুর। মনোয়ারা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো ‘ আপনাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন আপি ? ‘ নাতনির কথার জবাবে মনোয়ারা বেগম বললেন ‘ তাড়াতাড়ি গিয়ে গোসল সেরে আয়। আজ তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া শেষ করতে হবে। বিকালে লাবিবা আসছে। ‘

‘ বড় খালামণি ? কিন্তু কেন ? ‘ অবাক হয়ে সুধাল ঝুমুর।

‘ মানুষ একজনের বাড়িতে কেন আসে ? ‘ মনোয়ারা বেগম পাল্টা প্রশ্ন করলেন ।

আর কথা বাড়ালো না ঝুমুর। ক্লান্ত পায়ে উঠে তার ঘরের দিকে গেলো। সে বুঝে গেছে তার আপিকে পাত্র পক্ষের সন্ধান দিতেই আসছেন লাবিবা বেগম। লাবিবা বেগম হলেন ঝুমুরের মা তাসনুবার চাচাতো বোন। উনি এলেই দেখা যায় এক গাদা নাতি নাতনী নিয়ে আসেন। বাচ্চা কাচ্চা ঝুমুরের পছন্দ নয় তানা কিন্তু লাবিবা বেগমের নাতি নাতনী সবকটা প্রচন্ড ফাজিল। আসলেই ঝুমুরের ঘর বিছানা ময়লা করে দিয়ে যায়। তখন আর তার কান্নাকাটি করা ছাড়া উপায় থাকে না।

ঘরে ঢুকতেই ঝুমুর দেখলো মেঝেতে তার ইম্পর্ট্যান্ট নোটসের গুষ্টি উদ্ধার করা হয়ে গেছে ততক্ষনে। সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। দুঃখে ঝুমুরের আবারও কান্না এলো। সে কাদতে কাদতে কাগজগুলো তুলে ঘরের পেপার ডাস্টবিনে ফেললো। এখন তাকে আবারও নোটস করতে হবে। অনেক কষ্টে লিখেছিলো ওগুলো অথচ ওর বিচ্ছু ভাইটা সব ছিঁড়ে ফেললো। দোষ তো ওরই। আমির দেখলে ছিঁড়ে ফেলবে জানার পরও টেবিলের উপর রেখে গেছে। তাই এটা তো হওয়ারই ছিলো।

ছেলেটাকে যে একটা কঠিন ধমক দিবে সেটাও সে পারে না। সে ধমক দিবে কি তার আগেই আদরের ভাইকে ধমক দিতে হবে এই কষ্টে সে কেঁদে ফেলবে। তাই মনের দুঃখে কাগজগুলো ফেলে জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে গোসলে ঢুকলো। গোসল সেরে বারান্দায় জামা কাপড় মেলে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়ালো ঝুমুর। চুলগুলোতে চিরুনির আঁচড় লাগাতেই আঞ্জুম আরা ঘরের দরজায় কড়া নাড়লেন।

ঝুমুর বললো ‘ কিছু বলবেন মামী ? ‘ আঞ্জুম আরা এবার ঘরের দরজা খুলে এক পলক ভাগ্নিকে দেখলেন তারপর বললেন ‘ কলা পাতা রঙের জামাটা পড়লি না ? ওটাতে তোকে সুন্দর লাগে। ‘

‘ ভাবলাম ওটা আজ কাল পড়ি। আপনি কিছু বলবেন নাকি ? ‘ ঝুমুর চুল ঝেড়ে বলল।

‘ হ্যাঁ তাড়াতাড়ি খেতে আয়। মা বলেছে খাওয়া দাওয়ার পাট তাড়াতাড়ি শেষ করতে ‘ আঞ্জুম আরা বললেন।

‘ আচ্ছা আপনি যান। আমি আসছি। ‘

‘ তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু। মা তোর জন্য প্লেট নিয়ে বসে আছে। ‘ আঞ্জুম আরা কথাটা বলে বেরিয়ে গেলেন।

ঝুমুর আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিজের শ্যামলা অদলের দিকে তাকিয়ে হাসলো আনমনে। ভেজা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে মুক্তো দেওয়া সোনার কানের দুল দুটো তুলে নিলো। দুলগুলো আজও চিকচিক করছে অথচ এগুলো দশ বছর পুরোনো। ঝুমুরের মা তাসনুবার ছিল এগুলো। ঝুমুর মায়ের কানের দুলগুলো হাতে নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর আলতো হেসে দুলগুলো পড়ে ঘরের বাইরে এগিয়ে গেলো।

চলবে….
মিফতা তিমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here