#হারানো_সুর- ৫ম পর্ব
©শাহরিয়ার
— হৃদয় কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর প্রেমাকে ডেকে চলছে। কিন্তু প্রেমার কোন হুস নেই।কি করবে এইমুহুর্তে হৃদয়ের মাথায় যেন কোন কিছুই কাজ করছে না। তাড়াতাড়ি রুমে নিয়ে এসে শুয়িয়ে দিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ডাক্তারকে ফোন করলো। নিচ থেকে মনি কে ডাক দিলো। মনি আসার আগ পর্যন্ত সমস্ত কিছু ভুলে নিজেই হাতের তালু পায়ের তালুতে ঘষে দিতে থাকলো। মনি রুমে আসার পর, হৃদয় ব্যালকনিতে যেয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো তাড়াতাড়ি শাড়িটা চেঞ্জ করে অন্য একটা জামা পরিয়ে দে। ডাক্তার চলে আসবে। আর শরীরটা ভালো করে টাওয়েল দিয়ে মুছিয়ে দিতে। মনি তাড়াতাড়ি নিজের কাজে লেগে গেলো। হৃদয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে চলেছে কেমন জানি টেনশন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। মনির জামা চেঞ্জ করানো হলে হৃদয় এসে মনিকে নিচে যেতে বলে আর ডাক্তার আসলে তাকে উপরে নিয়ে আসতে বলে। মনি চলে যেতেই হৃদয় প্রেমার পাশে বসে।
— কিছুক্ষণ পর মনি ডাক্তার রুমে আসলো, সাথে হৃদয়ের মাও আসলো। ডাক্তার দেখি আসস্থ করলো চিন্তার কোন কারণ নেই। একটা ইন্জেকশন দিয়ে দিলো, আর কয়েকটা ঔষধের নাম লেখে দিয়ে উনি চলে গেলেন। হৃদয় ইশারায় ডাক্তারের সাথে মা ও মনি দু’জনকেই চলে যেতে বললো।
— রাত একটা বেজে বিশ মিনিটের সময় প্রেমা চোখ মেলে তাকালো। ড্রীম লাইটের হালকা আলোয় চোখ মেলতেই চেয়ারে বসা হৃদয়ের দিকে চোখ গেলো। হৃদয় তখনো জেগে বসে আছে। প্রেমা কিছুটা চমকে গেলো হৃদয়কে এভাবে বসে থাকতে দেখে। হঠাৎ করেই মনে পড়লো সন্ধ্যায় কি হয়েছিলো,সেই বজ্রপাতের পর আর কিছুই মনে করতে পারছে না সে। গড়ির দিকে তাকাতেই কেমন জানি আন ইজি ফিল হচ্ছিলো প্রেমার এতো রাতে হৃদয় তারপাশে জেগে বসে আছে এটা কেমন জানি লাগছে। তাই সব কোন রকম চিন্তা না করে সোজা প্রশ্ন করলো প্রেমা।
প্রেমা:- আপনি জেগে বসে আছেন কেন?
হৃদয়:- কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে এসে তাহলে তোমার জ্ঞান ফিরলো। কেমন লাগছে এখন?
প্রেমা:- হুম ভালো, আমার কি হয়েছিলো? আর আমি কিভাবে এখানে আসলাম?
হৃদয়:- তেমন কিছু না, অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলে। ছাঁদে সেন্সলেস হয়েছিলে তাই আমাকেই কোলে তুলে নামাতে হয়েছে, ভাগিস তুমি পিচ্চি যদি মোটা নাদুস নুদুস হতে তাহলে খুব কষ্ট হয়ে যেতো।
— প্রেমা বেশ লজ্জা পেলো, উঠে বসলো ওয়াশ রুমে যাবে। শরীরে খুব একটা জোর পাচ্ছে না। সমস্ত শক্তি দিয়ে শীরের উপর থেকে কম্বলটা সরাতেই সম্পূর্ণ রূপে চমকে গেলো প্রেমা। নিজের শরীরে শাড়ির বদলে থ্রী জামা দেখে। মনে মনে নিজেই ভাবতে শুরু করলো তার মানে হৃদয় আমার সমস্ত শরীর দেখে ফেলেছে। লজ্জায় লাল হবার অবস্থা। হৃদয়ের দিকে যেন তাকাতেও এখন শরম লাগছে প্রেমার। প্রেমা উঠে বসার পরপরই ব্যাপারটা নোটিশ করেছে হৃদয়, তারপর প্রেমার দিকে তাকিয়ে বললো মনি এসে তোমার ড্রেস চেঞ্জ করে দিয়ে গেছে। ওসব আমি পারি না।
প্রেমা:- মনে মনে বেঁচে গেছি বাবা, আমার উঠতে কষ্ট হচ্ছে, বলে হৃদয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
— হৃদয় উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রেমার বাড়িয়ে দেয়া হাতটার উপর নিজের হাত রাখলো। প্রেমা হৃদয়ের হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। আস্তে আস্তে দু’জন এগিয়ে আসলো ওয়াশ রুমের দিকে। হৃদয় বললো এখন তুমি যাও। প্রেমা মাথা নিচু করে খুব ধীর পায়ে ভিতরে চলে গেলো।
— প্রেমা ফ্রেস হয়ে বের হয়ে দেখতে পেলো হৃদয় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। তাই তাকে ডাক না দিয়ে খুব আস্তে আস্তে সেদিকে হাঁটা শুরু করলো। হৃদয়ের পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই, হৃদয় প্রেমার দিকে তাকিয়ে কি হলো তুমি এখানে কেন আর আমাকে ডাক দিতে।
প্রেমা:- সমস্যা নেই কিন্তু আপনি এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখনো জেগে আছেন কেন? ঘুমাবেন না?
হৃদয়:- তুমি যেয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পরো আমি জেগে আছি। আমার অভ্যাস আছে জেগে থাকার।
প্রেমা:- এমনটা হবে না আপনি যেয়ে শুয়ে পরুণ।
হৃদয়:- আমি এ ঘরে থাকলে কি তোমার ঘুমাতে অসুবিদা হবে?
— হৃদয়ের এমন কথায় প্রেমা লজ্জা পেয়ে গেলো। আস্তে আস্তে বললো অর্ধেক রাততো আপনি পাশেই বসে ছিলেন। আর এ ঘর এ বাড়ি সবই আপনার।
হৃদয়:- না শুধু আমার হবে কেন? এ বাড়িতে তোমার ও পুরো অধিকার আছে যতটুকু আমার ঠিক ততটুকুই তোমার।
প্রেমা:- প্লীজ জেগে থাকবেন না। আপনার শরীর খারাপ করবে বিছানায় যেয়ে শুয়ে পরুণ। আমি নিচে বিছানা করে শুয়ে পরবো।
হৃদয়:- নিচে শুতে হবে কেন? তুমি বিছানায় শুয়ে পরো আমি না হয় সোফায় শুয়ে পরবো।
প্রেমা:- উফ হবে না। আপনি বিছানায় শুয়ে পরুণ।
হৃদয়:- আচ্ছা দু’জনই বিছানায় শুয়ে পরি, ভয় নাই। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।
— প্রেমা হৃদয়ের দিকে চেয়ে রইলো অনেকটা সময় তারপর মাথা নেড়ে বললো হুম ঠিক আছে। দু’জন বিছানায় যেয়ে শুয়ে পরলো, হৃদয় এক পাশে আর প্রেমা একপাশে। দু’জন দুইদিকে ঘুরে শুয়ে আছে কারো চোখেই ঘুম নেই, রাতের গভীরতা বেড়েই চলেছে। শেষ রাতের দিকে দু’জনই ঘুমিয়ে পরলো।
— সকাল নয়টার দিকে মিহি এসে দরজায় নক করে মামুনি মামুনি বলে ডাকছে, মিহির ডাকে দু’চোখ মেলে তাকালো প্রেমা। তখনো গভীর ঘুমে ঘুমাচ্ছে হৃদয়। প্রেমা আস্তে করে উঠে বিছানা থেকে নেমে যেয়ে দরজা খুলে দিতেই মিহি ঘরের ভিতর ঢুকলো। ঘরে ঢুকেই মিহি প্রেমাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রেমা মিহিকে কোলে তুলে নিয়ে কি হয়েছে আমার মামুনির। কখন উঠলে?
মিহি:- উঠেই তোমার কাছে চলে এসেছি।
প্রেমা:- আচ্ছা চলো মামুনি তোমাকে রেডি করে দেই তারপর দু’জন নাস্তা করবো।
— প্রেমা মিহিকে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলো। দু’জন ফ্রেস হয়ে এসে গল্প করছে আর মিহির মাথার চুল আচড়ে দিচ্ছে। এমন সময় ওদের কথায় হৃদয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। আধ খোলা চোখে হৃদয় চেয়ে রইলো প্রেমা আর মিহির দিকে। ওদের হাসি মাখা মুখ দেখে হৃদয়ের মনটা ভরে গেলো। হঠাৎ প্রেমার চোখ হৃদয়ের চোখে পরতেই লজ্জা পেয়ে গেলো প্রেমা। চোখ অন্যদিকে সরিয়ে এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন? ফ্রেস হয়ে নিন নাস্তা করবেন।
হৃদয়:- হুম উঠছি বলে বিছানা ছেড়ে উঠে পরলো।
সোজা ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লো। অল্প সময়ের ভিতর ফ্রেস হয়ে আসলো। ততক্ষণে মিহিকে রেডি করে ফেৃলেছে প্রেমা।
— হৃদয় এসে শার্ট প্যান্ট পরে নিলো।
প্রেমা:- কোথাই বের হবেন?
হৃদয়:- হ্যাঁ অনেক দিন হলো অফিসে যাই না আজ অফিসে যাবো।
— হৃদয়ের কথাতে প্রেমার মুখে হাসি ফুটলো। প্রেমা মিহির কপালে চুমু খেয়ে বললো মামুনি তুমি টেবিলে যাও তোমার বাবাকে নিয়ে আমি আসছি।
মিহি দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। হৃদয় ড্রেসিং এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে টাই ঠিক করে নিচ্ছে এমন সময় প্রেমা কোট নিয়ে এসে দাঁড়ালো পেছনে টাই পড়া হতেই। প্রেমা পেছন থেকে বলে উঠলো হাত সোজা করেন আমি পরিয়ে দিচ্ছি।
হৃদয়:- আমি পারবো আমার হাতে দাও।
প্রেমা:- আমি জানি আপনি পারবেন। কিন্তু তা ভালো হবে না এটাও জানি। তাই বেশী কথা না বলে হাত বাড়িয়ে দিন আমি পরিয়ে দিচ্ছি।
হৃদয়:- কিন্তু।
প্রেমা:- কোন কিন্তু নেই, এটা কিন্তু আমার অধিকার।
— প্রেমার এমন কথা শুনে হৃদয় হেসে দিয়ে বললো পিচ্চি মেয়ে কোথাকার। প্রেমা যা খুশি বলতে পারেন। কিন্তু অধিকার আছে যেহেতু সেহেতু আমি পরিয়েই দিবো। হৃদয় আর কথা না বলে হাত সোজা করে ধরতেই প্রেমা কোট পরিয়ে দিলো।
— এই প্রথম প্রেমা খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখলো, অসম্ভব সুন্দর লাগছে হৃদয়কে যেন চোখ সরানো কষ্ট কর। সুন্দর চেহারার সাথে সাদা শাট আর কালো কোটে একদম হিরোর মত লাগছে হৃদয়কে। প্রেমে পরা বারণেও যেন মন হারিয়ে প্রেমে পরতে চায়।
হৃদয়:- কি হলো সরবে না নাকি? নাস্তার টেবিলে নিশ্চই সবাই অপেক্ষা করছে।
–প্রেমা অনেকটা লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়ালো হৃদয় বলে উঠলো চলো দেরী হয়ে যাচ্ছে। দু’জন হেটে সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নামছে ছেলেকে এতোদিন পর গুছানো অবস্থায় দেখে বাবা মা দুজনই নিচ থেকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে তার নিচে নামার দিকে। প্রেমা বাবা মায়ের এমন করে তাকিয়ে থাকা দেখে কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেলো। নিচে নেমে টেবিলে বসতেই মনি সবাইকে নাস্তা দিলো।
বাবা:- হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে তুই কি অফিসে যাবি?
হৃদয়:- হ্যাঁ বাবা অনেক দিন হলো অফিসে যাইনা।
বাবা:- বেশ বেশ ভালোই হবে আমি কিছু দিন রেস্ট নিতে পারবো।
— হৃদয় কিছু না বলে কিছু শুধু হাসলো। নাস্তা খাওয়া শেষ হতেই হৃদয় বললো তুমি যাবে না বাবা?
বাবা:- না আজ তুই যাচ্ছিস আমি যেয়ে কি করবো? কোন দরকার হলে ফোন দিস।
— হৃদয় আর কথা না বলে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিয়ে রওনা হলো অফিসের পথে। প্রেমা অপলক চেয়ে রইলো হৃদয়ের চলে যাবার পথে। মা এসে প্রেমার হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে আমি জানতাম তুই পারবি ওকে আবার ওকে নতুন করে তৈরি করতে। বাবা হ্যাঁ আমিতো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
প্রেমা:- দোয়া করবেন আপনারা আমি যেন আপনাদের ছেলেকে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি। বলে মিহিকে কোলে তুলে নিয়ে উপরের দিকে হাঁটা শুরু করলো। বাবা মা চেয়ে রইলেন প্রেমার দিকে। প্রেমার মনের ভিতর আজ আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
#চলবে..