প্রিয় তুই পর্ব ১২

0
571

#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_১২

-”আমরা দু’জন ছোট্র একটা বাসা বানাব। বাসার নাম দিবো সুখরাজ্য। তারপর আপনি আর আমি একটু একটু করে সুখ কুড়িয়ে সেখানে জমা রাখব। দু’জনে মিলে খুনসুটি, ঝগড়া,
মায়া, আর বিশ্বাস দিয়ে সুখরাজ্যটা শক্তকরে আবৃত করব।
তারপর আমাদের একটা ছেলে হবে। ঠিক আমার ভাইয়ার মতো।তখন তাকে নিয়ে আমরা সুখরাজ্যে সুখ বিলাশ করব, ঠিক আছে? এর আগে বা পরে আপনাকে ছাড়ছি না, ছাড়ব না। এটাই আমার ওয়াদা, বুঝলেন?”

-”লোভ দেখাচ্ছিস?”
-”না, স্বপ্ন বুনাতে শিখাচ্ছি।”
-”একটা সত্যি কথা বলবি? যদি বলিস তাহলে আর কখনো একথার পুনরাবৃত্তি করব না।”
-”প্রমিস?”
-”পাক্কা প্রমিস।”
-”হুম, আগে খাওয়া শেষ করুন।”
-”আগে কথাটা শোন।’

ভোর বাঁধা দিলেও একগুঁয়ে তিতাস শুনল না। সম্পূর্ণ খাবার টুকু খাইয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো । তারপর প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে, বিনাসংকোচে ভোরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।
ওর মুখভঙ্গি অত্যান্ত স্বাভাবিক। তবে ভোর নড়েচড়ে বসল, মুখে সংকোচের ছাপ স্পষ্ট। ওদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামলেও নিলো। তারপর আলতো করে তার চুল টেনে দিতে থাকল। তিতাস কিঞ্চিৎ মাথা উঁচিয়ে দেখল দরজাটা বন্ধ কি না। সব ঠিকঠাক দেখে চোখজোড়া বুজে ফেলল। ওর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ভোর চুপ করে রইল। খানিক্ষন পরে,
তিতাস বলল,

-”আমি কি খুব খারাপ হাজবেন্ড?”
-”একথা কখন বললাম?”
-”কর্মে বুঝালে, মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না।”
-”তুই একটু বেশিই বুঝিস।”
-”আচ্ছা বলুন কি বলতে চেয়েছিলেন?”
-”ভেবে জবাব দিবি, ঠিক আছে?”
-“হুম।”
-”আমাকে নিয়ে লোক সমাজে চলতে তোর লজ্জা লাগছে না?”

একথা শুনে তিতাস মৃদু হাসল। উঠে বসে ভোরের আঙুলের ভাঁজে আঙুল রেখে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কিছু কথা গুছিয়েও নিলো। তারপর জবাব দিলো,

-”না, কারণ আপনি আমার জীবনসঙ্গী, খেলার পুতুল নয়। তাই অহেতুক এসব ভেবে বর্তমান সময়টুকু নষ্ট করবেন না।”

-”ভেবে বলছিস, পারবি আমার সঙ্গে বাকি পথ পাড়ি দিতে?”

-”পারব বলেই তো আপনাকে অর্ধাঙ্গিনী করেছি। আমি আর পাঁচটা স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর মতো আমাদের সম্পর্কটা গড়ে তুলতে চাই। আপনি বয়সে বড়, বিধবা, হ্যানত্যান এসবকিছু নিয়ে আমার কোনো ভাবনা আসে না, আসবেও না। দেখুন,
দিন শেষে আমারও কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে, শখ-আহ্লাদ আছে। বউকে নিয়ে বোনা কতশত রঙিন কিছু স্বপ্নও আছে। সেগুলো আপনাকে দিয়েই বাস্তবায়ন করতে চাই। বাকি পথ একসঙ্গে পাড়ি দিতে চাই,আপনার হৃদয় নিংড়ানো প্রেম হতে চাই। স্বামী রুপে আপনার ছত্রছায়া হতে চাই। আপনার মনে আমার জন্য নতুন করে জায়গা দখল করতে চাই। যেখানে
থাকবে শুধু আমার নাম। আর এই সবকিছুই আমার চাই-ই চাই। এগুলো পেতে একচুল পরিমানও ছাড় দিবো না আমি আপনাকে। আর না পাবেন অতিরিক্ত কোনো সময়। আমার সঙ্গে থেকে আমাকে বুঝে আমার মনমতোন প্রস্তুত হতে হবে আপনাকে।”

ভোর জবাব পেয়ে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল। না বলা কিছু গল্পগাঁথা তার চাহনিতে। তবে কী তার জীবনেও সুখ আসতে চলেছে? তিতাসই কি হবে ওর সুখের মাঝি? বাবা বলেছিল, তিতাস তার সব দুঃখ-কষ্ট মুছে দিবে। একমুঠো সুখ কুড়িয়ে বেঁধে দিবে তার শাড়ির আঁচলে। সেই সুখটুকু বিলাশ করতে করতেই কেটে যাবে তার বাকি জীবন। তিতাস, নির্মল এবং স্বচ্ছ সুখের ফেরিওয়ালা। এজন্য তার উচিত এই একগুঁয়ে, চঞ্চল, পাঁজি ছেলেটাকেই নিজের জীবনে ঠাঁই দেওয়া। আর যায় হোক, তিতাস তার জীবনে কখনোই ক্ষতির কারণ হবে না।বাবার বলা কথাগুলো স্মরণ করে ভোর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
তখন তিতাস বলল,

-” এত চাপা স্বভাবের হবেন না ভোর। কষ্টগুলোকে এভাবে হৃদয়বন্দি করে রাখবে না। এতে কষ্ট বাড়বে, বৈ কমবে না।
আর এখন তো আমি আছি, আমাকেও এ কষ্টের ভাগ নিতে
দিয়েন। তাছাড়া আজ আপনার বাবা মারা গেছেন, আপনি কাঁদছেন না কেন? কাদুঁন ভোর, মনপ্রাণ জুড়িয়ে ইচ্ছে মতো কাঁদুন। আমার বুকটা আপনার জন্য বরাদ্দ করা ভোর, এই বুকেই লুটিয়ে পড়ে কাদুঁন।আমি নাহয় চোখজোড়া বন্ধ করে রাখছি, কানে তুলো গুঁছে নিচ্ছি। আপনি না বলা অবধি এক চুলও নড়বো না আমি।তবুও আমার বুকে মুখ লুকিয়ে একটু হলেও কাঁদুন ভোর, একটু কাঁদুন।”

-”হসপিটালে যাবি না?”

-”হুম, কৌশলে ফিরে দিলেন তো। একদিন এই বুকটাই হবে আপনার একমাত্র আশ্রয়কেন্দ্র। একটু শান্তি খুঁজতে আপনি এই বুকে মাথা রাখবেন, কারণে অকারণে আমার বুকে মুখ লুকাবেন। সেদিন আসতে বেশি দেরি নেই, মিলিয়ে নিবেন।”

একথা বলে তিতাস উঠে রেডি হতে শুরু করল। হসপিটালে যাওয়ার সময় গেছে। সে রুম এলোমেলো করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুঁজতে লাগল। চোখের সামনে থাকা জিনিস’ও সময় নিয়ে খুঁজে হয়রান হয়ে তারপর পেলো। তার গোছানো রুম পছন্দ নয়। গুছিয়ে রাখলে কিছুই খুঁজে পায় না। এখন যেমন পাচ্ছে না। সে বিরক্ত নিয়ে পরণের টি-শার্ট খুলে বিন ব্যাগের উপর ছুঁড়ে মারল। ওয়ার্ডড্রোপ ঘেটে ঘুটে পছন্দনীয় শার্ট বের করে পরিধান করল। তারপর আড়চোখে ভোরকে একবার দেখল, সে উঠে বেলকনিতে চলে গেছে। গ্রিল ধরে
চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মূলত সে পোশাক পরিবর্তন করতে দেখে গেছে। তিতাস তখন মনের সুখে সিটি বাজাতে বাজাতে তোয়ালে পরে প্যান্টটাও পরে নিলো। তার আবার বরাবরই লজ্জা-টজ্জা একটু কম। এজন্য নির্লজ্জ খেতাবও আছে। কেন, সেসব ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না।
তিতাস এবার হাতঘড়ি পরতে পরতে ভোরকে ডাকল। ভোর নিঃশব্দ এসে দাঁড়াতেই সে বলল,

-”আপনাকে এমনি এমনি বিয়ে করি নি আমি? এখন সেই উদ্দেশ্য পূরণ করার সময় এসে গেছে।”
-”মানে?”
-”সিনিয়র বউ বিয়ে করেছি, পেশায় আবার মস্তবড় ডাক্তার। আল্লাহর রহমতে টাকা-পয়সাও কম নেই, তাই এখন থেকে আমার হাত খরচ দেওয়ার দায়িত্ব আপনার। এখন ঝটপট দুই হাজার টাকা দিন, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।”

ভোর বিষ্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই ছেলে বলে কি? এই জন্য তাকে বিয়ে করেছে! তাকে হাতখরচও দিতে হবে? শেষ পর্যন্ত এই ছিল তার ললাটে? ভোরকে অনড় দেখে দেখে, সে নিজেই ভোরের পার্স থেকে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। দু’এক সেকেন্ডের মধ্যে পুনরায় ফিরে এসে ভোরের গালে শব্দ করে চুমু এঁকে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। ভোর সেখানেই স্থির হয়ে
গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই ঘটনা এত দ্রুত ঘটল না কিছু বলতে পারল, না বলতে দিলো। পরক্ষণেই তার ঠোঁটে ফুটল একচিলতে মিষ্টি হাসি। ছেলেটা এত চঞ্চল। সর্বদা দুষ্টু বুদ্ধি তার মাথায় ঘুরপাক খেতেই থাকে। নির্লজ্জ একটা। সে
লাজুক হেসে বসতে যাবে তখন তিতাস দরজার পাশে থেকে উঁকি দিয়ে বলল,
-”আর লাগবে?”
-”তুই এখনো যাস নি?”
-” না, দেখছিলাম আপনি কি করেন? ভেবেছিলাম রাগ টাগ
করবেন। ওমা, মেয়ে দেখি লজ্জা পাচ্ছে।”

ভোর এবার রেগে কুশন ছুঁড়ে মারার আগেই তিতাস সত্যি সত্যিই দৌড় দিলো৷ এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। ভোর ধীর পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। তিতাস শব্দ করে ড্রাইভার চাচাকে ডেকে গাড়িতে গিয়ে বসল। পরক্ষণেই জানালা দিয়ে মুখ বের করে হাত নাড়িয়ে টাটা দিলো। ভোর মুচকি হাসল। এই ছেলেটা আর কয়েকদিন পরে ডাক্তার হবে। তারও নাকি দায়িত্ব বহন করবে। অথচ এর বাচ্চামো স্বভাবই কাটল না। অথচ সে নাকি হবে পার্ফেক্ট জীবনসঙ্গী, এবং দায়িত্বশীল একজন ডাক্তার!
_________________

প্রায় সপ্তাহ তিনেক পরের ঘটনা,

রাত তখন সাড়ে তিনটে। চারদিকে সুনশান নিরাবতা।তিতাস
কেবল বাইরে থেকে আসল।পরীক্ষা চলছে বিধায় অকারণে
বাইরে যায় না সে। সর্বক্ষণ বই হাতেই বসে পড়ে। এত্ত পড়া, পড়ার ঠেলায় চোখে সর্ষে ফুল দেখে। ভোরও তাকে যতটুকু পারে সাহায্য করার চেষ্টা করে। তিতাস যখন পড়তে পড়তে ক্লাস হয়ে তখন সে ভোরের পেছনে লাগে। মেয়েটাকে প্রচন্ড জ্বালিয়ে, বিরক্ত করে, ধমক খেয়ে তারপর থামে। নতুবা ওর
ফাজলামি একের পর এক চলতেই থাকে। এটা খাবো, ওটা খাবো, পানি দেন, চুল টেনে দেন, কাঁধটা ম্যাসাজ করে দেন।
ভোর কখনো মুখ বুজে মেনে নেয় তো কখনো রেগে বাগানে গিয়ে বসে থাকে। কিন্তু আজ জুররি কাজের কথা বলে সে রাত সাড়ে এগারোটায় বাইরে বেরিয়েছিল। ফিরল কেবল। ওর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ভোর ঘুমিয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধ সরল অতি সাধারণ মায়াবী একখান মুখ তার। কি চমৎকার ভাবে গুছিয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎ’ই কেউ আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে ধরাতে, ভোরের ঘুমটা হালকা হয়ে গেল। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখে তিতাস তার গলায় মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। তার শরীরের সমস্ত ভার ভোরের উপর। ভোর হতভম্ব হয়ে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে সমানে ঠেলতে শুরু করল। কিন্তু তার কাজের কাজ কিছুই হলো না।বরং কিছু একটা খেয়াল করে অবাক হলো।তিতাসের শরীর মৃদুভাবে কম্পিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের গলাতে পানি জাতীয় কিছু অনুভব করছে। সে পুনরায় তিতাসকে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল। ফলস্বরূপ, ব্যর্থ হলো। ভোর তার শক্তি সঙ্গে না পেরে এবার মুখ বলল,

-”তিতাস! এই তিতাস, কি হয়েছে? বল আমাকে, কাঁদছিস কেন তুই?”

তিতাস জবাব দেওয়া তো দূর নড়ল না পর্যন্ত। তবে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ বেড়ে গেল। ভোরকে আরো শক্ত করে জড়িয়েও ধরল। তিতাসের শরীরে প্রচন্ড জ্বর, মেরুণ শার্টে কাঁদা মাটি।ভোর নিজেকে ছাড়াতে না পেরে এক হাত তিতাসের মাথায় আর অন্য হাত রাখল তার পিঠে। তারপর নরম সুরে বলল,

-” না বললে বুঝব কিভাবে? বল প্লিজ, আমি কাউকে বলব না। সত্যি বলছি, প্রমিস।”

-”আমি তার ক/লি/জা মেপে ইঞ্চি ইঞ্চি করে টু/ক/রো করে এসেছি। আগামীকাল গিয়ে কুকুরকে খাওয়াব। আমার সুখ রাজ্যে হাত বাড়ানোর শাস্তি সে পেয়েছে।”

To be continue………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here