#প্রিয়_তুই
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৩
তিতাস মার খেয়ে আর দাঁড়াল না। গমগম শব্দ তুলে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তখন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি কুটিল হেসে মনে মনে বলল,
-‘ তোমাদের দু’জনকে আমি এক হতে দিবো না তিতাস। কখনো না, কোনোদিনও না।”
একথা বলে সে ঘুরতেই নার্সের সঙ্গে ধাক্কা খেলো। তার হাতে থাকা ফোনটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। বোধহয় ফোনের গ্লাস ফেটে গেছে। বেশ কয়েকজন রোগী উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। হয়তো এর পরের ঘটনাও দেখতে আগ্রহী উনারা।
তবে নার্স মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছেন। উনি ভয়ে আছে, যদি তার নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এমনিতেই সেকেন্ড ওয়ার্নিংয়ে আছেন তিনি। এবার কেউ অভিযোগ জানালে বিনাবাক্যে হসপিটাল ত্যাগ করতে হবে।
যেটা উনি মোটেও চাচ্ছেন না। এতদিন অহংকার করে রোগী এবং তাদের বাসার লোকদের সঙ্গে মন্দ আচরণ করেছেন। অকারণে রোগীর প্রতি রাগ দেখিয়েছেন, যা ইচ্ছে বলেছেন। পরে রোগীদের বাসার লোকরা হসপিটাল কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। ফলস্বরূপ উনাকে ওয়ার্নিং দিয়েছেন।
এখন যদি এই ভদ্রলোক অভিযোগ করে তাহলে শেষ রক্ষা আর হবে না। পরিশেষে তাকে পথে বসতে হবে। ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। তখন অগন্তুক বিরক্ত নিয়ে কিছু বলতে গেলে পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,
-‘আরে আয়মান তুমি এখানে?”
অগন্তুক অর্থাৎ আয়মান কৌতুহল বশত পেছনে ফিরে দেখে ভোর দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মিষ্টি হাসি। হালকা মিষ্টি রঙের থ্রি পিচে তাকে আরো মিষ্টি দেখাচ্ছে। আয়মান মুখভর্তি হাসি নিয়ে ফোনটা তুলে ভোরের মুখোমুখি দাঁড়াল। তখন ভোরের কল আসাতে তাকে দাঁড়াতে বলে সাইডে গিয়ে কথা বলতে লাগল। আর আয়মান ওর দিকে তাকিয়েই মিটিমিটি হাসল।
সে ভোরকে ছায়ার মতো ফলো করে, দেখে। তবুও তার তৃপ্তি আসে না। মনের খোরাক মিটে না। বরং ক্ষণে ক্ষণে তার সঙ্গ পেতে মনে আকাঙ্খা জন্মে, নিষিদ্ধ ভাবনা মস্তিষ্কে কিলবিল করে। এই মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে। যেটা তাকে সর্বদা টানে, আকর্ষন করে।বিমোহিত হয়ে করে তোলে
প্রতি মুহূর্তে। সে তার সুপ্ত অনুভূতির কথা ভোরকে জানাতে গিয়েও ফিরে এসেছে, পিছিয়ে গেছে। মনের কোণে লুকিয়ে রাখা গাঢ় অনুভূতি প্রকাশে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। শুধু একটা ভয়ে, যদি ভোর ভুল বুঝে অথবা তার সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে।
এসব ভেবে আয়মান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।তখন কল কেটে ভোর ব্যস্ততা দেখিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তাকে কিছু বলারও সময় দিলো না। আয়মানও আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল। এখানে তার কোনো কাজ নেই শুধু ভোরের জন্য এসেছিল।
ভোর হন্তদন্ত হয়ে বাসায় ফিরে দেখে ওর বড় ভাইয়ের ছেলে ভোম্বল হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। যদিও তার ভালো নাম আছে, সাফায়াত সাফি। তবে ভোর তাকে ভোম্বল বলেই ডাকে। খুব আদরের সে। ভোম্বল বাঁ হাত পুড়িয়ে চিৎকার করে কাদঁছে,
ভোর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজও করে দিলো। তারপর পাঁচ বছরের ভোম্বল কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর রা হলো দুই ভাই আর সে। বাবা-মাসহ সাতজন
সদস্যের পরিবার তার। তবে বর্তমানে সে একা ফ্ল্যাটে থাকে।
কারণ পিয়াসের মৃত্যুর পরে আত্মীয়-স্বজনরা এসে উপদেশ দিয়ে যেতেন। কেউ বা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চায়তেন সে অপয়া, অলক্ষী। তার সংসার ভাগ্য খুবই খারাপ, নয়তো বিয়ের দিনেই বিধবা হতো না। মূলত এসব থেকে মুক্তি পেতে তার একা থাকা। তবে মাঝেমধ্যে এখানে আসে, সবার সঙ্গে সময় কাটিয়ে যায়। এতে বাসার বাকি সদস্যরা আত্মীয়দের
আনাগোনা থেকে রেহাই পায়।
ভোর ভোম্বলকে রুমে শুইয়ে দিয়ে ওর বাবার কাছে বসল। ওর বাবা হাসিব চৌধুরী মৃদু হাসলেন। মেয়ের মাথার স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন,
-”মা, তোমার নামে বিচার এসেছে।”
-”তিতাস দিয়েছে?”
-” হুম, ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালো।”
-”জানি বাবা।”
-” তাকে একটা সুযোগ দিলে হয় না, মা?”
-“বাবা, তিতাস ভালো তবে তাকে মেনে নেওয়া আমার জন্য কঠিন। গত ছয় মাসে আগে ওদের বাসায় পিয়াসের বউ হয়ে পা রেখেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমি বিধবা।
আমার সেই ক্ষতই এখনো রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত।”
মেয়ের এ কথার জবাব উনি আর কিছু বলতে পারলেন না। শুধু নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
এখন রাত দুইটা একুশ। প্রগাঢ় আঁধারিয়া তিমির। চারপাশে নিস্তব্ধ পরিবেশ। এখন সুখী ব্যক্তিদের নিদ্রালু হওয়ার সময়।
আর যারা রাতজাগা পাখি তারা হয়তো বিষাদ কুড়াতে ব্যস্ত।
নতুবা সেই বিষাদে সেই নিজেকে পুড়াতে মগ্ন। তিতাস আজ বাসাতেই আছে। টেবিলে বসে একমনে পড়ছে। বাবা থাকছে ওর মায়ের সঙ্গে। যদিও সে নার্সদের সজাগ থাকার আদেশ করেছে। যেন কোনো সুবিধা না হয়। তাছাড়া ওর পড়ার চাপ বেশি থাকায় মায়ের সঙ্গে থাকতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রুগ্ন মাকে দেখে সে পড়তে পারে না, মনযোগও আসে না। ফলে অনেক পড়া জমে গেছে। এজন্য ওর বাবা আজ পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাতে ওর পড়া কভার করতে সুবিধা হয়। তিতাস আঙুলের ভাঁজে কলম নাড়িয়ে বিরবির করে পড়ছে। তখন ওর ফোন ভাইব্রেট হতে লাগল। এবার সে পড়তে পড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফোনের স্কিণে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘ভোর।’ ততক্ষণে পূর্বের কল কেটে ফোন নতুন উদ্দ্যেমে ভাইব্রেট হচ্ছে। তখন থাপ্পড় খেয়েও তার অভিমান কিংবা রাগ কোনোটাই হয় নি। যদিও ভোরের উপর রাগ করতে পারে না সে। কারণ সর্বদাই ওর মনে হয় ভোর নিজের জায়গাতে সঠিক, নির্ভুল। কারণ সেও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, তার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া আছে, আত্ম-সন্মান বোধ আছে। সে কেন একই ভুল করবে!
যাকে বিয়ে করে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে শশুড়বাড়িতে এসেছিল, সেই মানুষটাই তাকে ঠকিয়ে ঘন্টা না পেরোতেই আত্মহত্যা করেছে। কাপুরষদের মতো সমাধান না খুঁজে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। ওকে বিধবার সাজ উপহার দিয়েছে। সঙ্গে অপয়া, অলক্ষী, স্বামী খোঁকোর তকমা লাগিয়েছে। কতশত নোঁংরা কথা শুনতে বাধ্যও করছে। অথচ ভোর এসবের প্রাপ্য নয়।
সে নির্দোষ, নিরপরাধ। তবে তিতাস এখনো বুঝতে পারে না পিয়াস কেন আত্মহত্যা করেছে? কারণ পিয়াস খুশি মনেই ভোরকে সহধর্মিণী হিসেবে মেনে বিয়ে করেছিল। এমনকি তিতাসকে এমনও বলেছিল,
-”ভাই, ভোরের চোখ দু’টো আমাকে খুব টানে। মনে হয়, তার চোখজোড়া আমায় কাবু করতে সক্ষম।”
বড় ভাইয়ের কথা শুনে সে হেসে মজা করে বলেছিল,
-”ভাই কোথাও কোনো চক্কর লাগিয়ে বিয়ে করো না। দেখা যাবে, বিয়ের পরদিনই তোমার পূর্বের বউ এসে হাজির হবে। তখন বাসায় হাঙামা না বেঁধে যায়। তাই বলছি, সময় আছে ভেবে চিন্তে বিয়ে করো।”
একথা শুনে পিয়াস উচ্চশব্দে হেসেছিল। এছাড়াও, তিতাস নিজেও অবগত, পিয়াস কখনো কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায় নি। কারণ তার সমস্ত ভালোবাসাটুকু বউয়ের জন্যই তোলা ছিল। তাহলে আত্মহত্যা কেন? এসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে
মরিয়া সে। তিতাসে ভাবনার ছেদ ভাঙ্গল ভাইব্রেটের ভোঁ ভোঁ শব্দে। সে দ্রুত কল রিসিভ করতেই ভোর বলল,
–”কোথায় তুই?”
-”বাসায়।”
-”পরীক্ষা কবে?”
-”আগামী সপ্তাহে।”
-”আগামীকাল বাসায় থাকবি?”
-“বোধহয় না, কেন?”
-”আমি যাব তোদের বাসায়।”
-”হঠাৎ?”
-”কাজ আছে।”
তিতাস কান থেকে ফোন সরিয়ে আঙুল দিয়ে কান খুঁচিয়ে আবার ফোন কানে রাখল। ভুলভাল শুনছে নাকি পুনরায় নিশ্চিত হলো। না, যা শুনছে সব ঠিক। সে কিছু বলতে গেলে কল কেটে গেল। তিতাস কলব্যাক করলে ভোরের ফোন বন্ধ দেখাল। এই মেয়েটার মাথায় কখন কি চলে বোধগম্য হয় না তার। তিতাস চেয়ারে হেলান দিয়ে আড়মোড়া ভেঙে পুনরায় পড়াতে মন দিলো। তবে মনোযোগী হতে পারল না। মাথাতে নানান চিন্তা এসে ভর করল। বিয়ের পর ভোর ভুলেও ওদের বাসার ধারে কাছেও আসে নি। তাহলে কাল আসবে কেন?
এ বাসাতেই বা কি কাজ তার? তিতাস খোলা বইটা বন্ধ করে
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। আজ আর পড়াশোনা হবে না। এরচাইতে ঘুমানোই উত্তম। সে আর কিছু না ভেবে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাল।
To be continue………!!