#জল_ফোয়ারা |৫|
#লেখনীতেঃ Liza Bhuiyan
৮.
সৌহার্দ্যর কাছে তার প্রাক্তনের শেষ চিঠি আসে তখন শ্রাবণ মাসের দশ তারিখ, ঝুম বৃষ্টি আর খ’রা, তার ফাঁকেই রোজ একটি করে ঠিকানাহীন চিঠি আসতো। রোজ আসা চিঠিগুলো এরপর সাপ্তাহিক হয়ে গেলো।তার একদিন আর নির্দিষ্ট সময় আসলো না হুট করে। ভাদ্র মাসের দশ তারিখ পেরোনোর পরও যখন কোন চিঠির আগমন হলো না তখন সৌহার্দ্য বেশ চি’ন্তিত হলো। সেটাই কবে তার কাছে শে’ষ চিঠি?
দীর্ঘ একমাস গুনে গুনে পেরুলো কিন্তু তার পুরোনো দিনের স্মৃতির আলাপন হলো না। সৌহার্দ্যর বরাবরই ধৈর্য কম, এক মাস কিভাবে পার করেছে তার হয়তো নিজেরই জানা নেই। কিন্তু এভাবে আর দিন গুজার করা গেলো না, অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘাপটি মে’রে বসে রইলো। মাথা থেকে তাদের নামানো গেলো না। তার পর ফিরে এলো পুরোনো অভ্যেস, রাত চারটে হুট করে নিয়ে নিলো কঠিন সিদ্ধান্ত। ফে’লে আসা শহরে আবার ফিরে যাবে। মস্তিষ্ক খুব একটা শায় দিলো না কিন্তু মনের সাথে জোরা’জুরিতে ঠিকলো না! ঠিক চারটা আটাশে সকল জামাকাপড় গুছিয়ে অফিসে ইমেইল পাঠিয়ে দিলো ছুটির, এপ্রুভ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময় নেই। এখন শুধু অপেক্ষা ফজরের আজানের!
সকালের আকাশে আবছা আলো ফু’টতেই গাড়ি বের করলো, মাকে চিন্তিত না করানোর জন্য মিথ্যে বললো। অফিসের কাজে আর্জেন্ট যেতে হবে বলে অদিতাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো হালিশহরের উদ্দ্যেশে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন! জীবনের বিশেষ সময়গুলো সেখানে কে’টেছে ওর, শহর ছেড়ে দেয়ার ছলে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সব ছুটে গিয়েছলো তার। মাঝপথে যখন ওর মেয়েকে নাস্তা করাচ্ছিলো তখন নিজের সিদ্ধান্তকে নিতান্তই বাচ্চামো মনে হলো, এভাবে হুট করে বেরিয়ে তো পড়লো কিন্তু কোথায় গিয়ে উঠবে? এতো বছর কারো সাথেই তো যোগাযোগ নেই। বাসায় ফিরে চাওয়ার চেতনা মাথায় চে’পে বসলো, মনে মনে ভাবলো
“এখনো সময় আছে, সৌহার্দ্য বাসায় ফিরে চল। মাঝপথে এভাবে এমন ক’ঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া অবান্তর”
কিন্তু কি ভেবে যেনো পিছু হটলো না। হয়তো প্রবল ইচ্ছে কিংবা বয়সের ছাপ। সৌহার্দ্য মুঠোফোন বের করে অতি পরিচিত নাম্বারে কল করলো, ও পাশ থেকে তার অবাক হওয়া কন্ঠ বুঝতে পারলো। সে খুব একটা কিছু বলে নি যদিও কিন্তু কোথাও একটা ইতস্তত বোধ করলো। সৌহার্দ্য সেসব মাথা থেকে বের করে দিয়ে অদিতাকে খাওয়ানোয় মনোযোগ দিলো। থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে, এর চেয়ে বেশি আর কি চাই? অতীব খুশিতে খাওয়ার রুচি চলে গেলো!
চেনা শহরে ঢুকে আরেক বিপদে পড়লো সৌহার্দ্য, চেনা শহরে সব কিছু অচেনা হয়ে গেলো। আটবছরে আমুল পরিবর্তন, ঠিকমতো রাস্তা খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। বহুকষ্টে কাঙ্ক্ষিত স্থান খুঁজে পেলো, চেয়ারম্যান বাড়ির কথা জানতে চাইতেই সবাই এক পলকেই চিনে গেলো। ওরা যখন বাড়ি বিক্রি করেছিলো তখন চেয়ারম্যান কিনেছিলেন সেটা, এই ছোট্ট ইনফরমেশন কি করে মাথায় এলো ওর জানা নেই তবে মনে হলো ওর মন চাইছে ও নিজ গন্তব্যে পৌঁছাক, নিজ নীড়ে পৌঁছাক!
রাত নয়টার কাছাকাছি সময়ে সৌহার্দ্য গন্তব্যে পৌঁছালো,সবকিছু বদলালেও এই অংশটা যেনো আগের মতোই রয়ে গেছে। দেয়ালের রং অনেকটা ময়লা হয়ে গেলেও চিনতে অসুবিধে হয়নি। অনেক সংশয়ের পর দরজায় কড়া নাড়লো। অদিতা তখন ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্তিতে, ওকে এক হাতে কোলে নিয়ে আরেক হাতে থাকা ছোট্ট স্যুটকেইস শক্ত করে ধরলো। কিছুক্ষণ বাদেই পরিচিত মুখ ভেসে আসলো, কিছুটা খুশি হয়েই বলে উঠলেন
“আরে সৌহার্দ্য যে, এতো রাতে কই থেকে আসলা তুমি? আমি আমার ভু’ত টুত দেখতাছি না তো!”
সৌহার্দ্য হাল্কা হেসে চাচির পিছু ধরলো, ঠিক কি বলবে খুঁজে না পাওয়ায় চুপ করে রইলো। চাচি সবাইকে ডেকে এনে হুলু’স্থুর কা’ণ্ড বাধিয়ে ফেললো, এতোদিন পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে বলে সমাদর শুরু করলেন। সৌহার্দ্য নিশ্চুপে অদিতাকে একটি রুমে শুইয়ে দিতেই চাচি ভাত বেড়ে দিলেন।খাওয়া দাওয়া শেষে বসার ঘরে এসে বসলেন আর তাতেই চাচি নানান কথা জুড়ে দিলেন। চাচাও তার সাথে তাল মিলিয়ে কিছু কথা বললেন। কথা প্রসঙ্গে চাচি বেশ আফসোস নিয়ে বললেন
“অদিতার বয়স কত্তো কম, এইর মাঝে মাইয়াডা মা’রে হারা’ইলো। যদিও তোমরা অর খেয়াল রাখো, মায়ের অভাব কি মি’টবো? ওর মায়ের তো দরকার”
সৌহার্দ্য এই টপিকে কথা এড়িয়ে যেতে চাইলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো
“চাচি রোহিণীকে যে দেখছি না? ওকি বাসায় নেই?”
মুহুর্তেই যেনো চাচির চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো, অঢেল বি’রক্তি নিয়ে বললো
“থাকবে হয়তো নিজের ঘরে, সারাদিন তো হেনেই পইড়া থাকে। ওনার কি আর দুনিয়া দারির খোঁজ আছে? আমি ম’র’লেও হয়তো মহারানী টের পাবে না। ছেলে দুইটা তো বাইরে থাকে, মাইয়াডারে নিজের কাছে রাইখাও আশেপাশে পাইনা।”
সৌহার্দ্য বুঝতে পারলো চাচি রোহিণীর উপর কিছু একটা নিয়ে বি’রক্ত কিন্তু সবটুকু বলছে না। কথার পর্ব আরো এক ঘন্টা পর শেষ হলো, সবাই যার যার ঘরে গেলেও সৌহার্দ্য রোহিণীর রুমের দিকে গেলো। দরজায় নক করতেই তা সটানভাবে খুলে গেলো যেনো ভেতরের মানুষ ওর অপেক্ষায়ই ছিলো। সৌহার্দ্য ঘরের ভিতর না ঢুকে দরজায় দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করলো
“কেমন আছিস? কতোদিন পর দেখা হলো, আমি নিজেও ভাবতে পারিনি হুট করে এখানে আসা হবে কিন্তু মনে হলো সবার একটু খোঁজ খবর নেই। অনেকদিন তো হলো!”
রোহিণী আচমকা অনমনীয় গলায় বললো
“তুমি এখানে কেনো এসেছো ভাইয়া?”
সৌহার্দ্য হচকিয়ে গেলো, ঘাড়ে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে বললো
“আমি এসেছি বলে কি খুশি হস নি?”
রোহিণী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো
“আমার খুশি হওয়াতে না হওয়াতে কিছু আসে যায়না ভাইয়া, তবে এইটুকু বলতে পারি তোমার এখানে আসাতে কিছু মানুষ অবশ্যই খুশি হবে না। তুমি যেমন সবকিছু ফে’লে গেছো তার কিছুই আগের মতো নেই, সবকিছু বদলে গিয়েছে। চাইলেই সেই দিনগুলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, কেউ আগের মতো নেই।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
“তোকে কে বললো আমি সব ফিরিয়ে আনতে চাই? আমি নিজেও জানি হারানো জিনিস ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় কিন্তু তবুও আমি আমার ভু’ল শুধরাইতে চাই কিংবা সোজাসুজি বলা যায় ক্ষমা চাইতে এসেছি। তাতে খুব একটা কিছু হবে না কিন্তু নিজের মানসিক প্রশান্তির জন্য একটু প্রয়াস বলতে পারিস?”
রোহিণী আর কিছু বললো না শুধু তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যর দিকে, এবার বোধহয় তিরিশে পা দিয়ে বয়স।খুব খুঁজলে হয়তো দু একটা পাঁকা চুল পাওয়া যাবে, বয়সের ছাপ খুব একটা না পড়লেও পরিপক্ব সুপুরুষ লাগছে সৌহার্দ্যকে। এই সুক্ষ্ণ পরিবর্তন গুলো কি সে ধরতে পারবে?
রোহিণী প্রত্যুত্তর না পেয়ে সৌহার্দ্য আর কথা বাড়ালো না, ছোট্ট করে বিদায় জানিয়ে অদিতার কাছে চলে গেলো।
রোহিণী হাল্কা করে দরজা মিলিয়ে রাখলো,তারপর চোখ বন্ধ করে ফেললো, বিড়বিড় করে বললো
“তোমার ওই এক সিদ্ধান্ত অনেকগুলো জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। তুমি যদি জানতে তবে এখানে কখনো ফিরে আসতে না। কিছু কিছু ভু’ল শুধরানো যায়না ভাইয়া, তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো ফিরে আসতে…”
৯.
পশ্চিমা আকাশে কিছু সারি সারি মেঘ জমেছে, যদিও এই ভাদ্র ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টি হা’না দেয় তবুও মেঘের আড়ালে থাকা নীল আকাশ নুরের বেশ ভালো লাগে। এ দিনগুলোতে ঘুরতে ভালো লাগে, হাসতে ভালো লাগে কিংবা শখের প্রিয় কবিতা! তা লিখতেও অ’সম্ভব ভালো লাগে। লিখার ফাঁকে ফাঁকে রোজকার মতোই গেটের দিকে তাকাচ্ছে, কাউকে আসতে না দেখে একটু মন খারাপ হলো, পরক্ষণেই আনমনে আবার কবিতা লিখা শুরু করলো।
অনেকক্ষণ বাদে মনে হলো কেউ একজন হয়তো ওর দিকে তাকিয়ে, নুর মাথা তুলে তাকাতেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলো। মিষ্টি করে হেসে সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললো
“এই এলে তুমি? সেই কতক্ষণ ধরে অপেক্ষায় ছিলাম।মাকে লুকিয়ে এসেছি এখানে, কতো বা’হানা দিতে হলো জানো? তারউপর ভাইয়াকে তো চিনোই জানতে পারলে… শুনো আমি তোমার পছন্দের চা কিন্তু অর্ডার দিয়ে ফেলেছি, এক্সট্রা লিকার দিয়ে। ওইযে ওখানে যে চা ওয়ালা মামা বসে আছে?বলেছি তোমাকে আসলেই চা দিতে। যাইহোক পড়াশুনোর কি খবর? কালকে তো আবার এক্সাম তোমাদের! আর আমার সেই একগাদা এসাইনমেন্ট,উফ’ফ মাঝেমাঝে ভাবি পড়াশুনায় ছেড়ে দিবো”
নুরের কথা গুলো শুনেও সামনে থাকা ছেলেটির মাঝে নড়চড় দেখা গেলো না, সে বেশ কৌতুহল নিয়ে নুরকে দেখছে। চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজলো কিন্তু পেলো না, সবকিছু অস্বাভা’বিকভাবে স্বাভাবিক লাগছে।
ছেলেটা নুরের স্বাভাবিক আচরণে খুব অবাক হয়,এতো অপেক্ষার পরও না রা’গ আর না ক্ষো’ভ শুধু একরাশ ভালোবাসা আর স্পৃহা!
ও কি সত্যিই সবকিছু ঠিকঠাক দেখছে নাকি নিতান্তই চোখের ধোঁ’কা?সে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো সটান হয়ে, নড়চড়ে যদি সত্যিই মরি’চিকার মতো সব মিথ্যে হয়ে যায়?!
#চলবে…